শেখ হাসিনা নব্য হিটলার আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী দল -নাটোরে ২০ দলের বিশাল জনসভায় খালেদা জিয়া
নাটোরে ২০ দলের বিশাল জনসভায় খালেদা জিয়া : শেখ হাসিনা নব্য হিটলার আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী দল ; সময়মতো আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে ; বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস ছাড়া দেশ ধ্বংসের দিকে, সরকার জনগণ ও বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন...
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে নব্য হিটলার ও মুসোলিনি আখ্যা দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, সরকার একঘরে হয়ে পড়েছে। তারা এখন বলছে, বিএনপি নাকি আন্দোলন করতে পারে না। আমি বলব, পুলিশকে দিয়ে গুলি করে আন্দোলন দমানো যাবে না। একবার গুলি বন্ধ করুন, আন্দোলন কাকে বলে দেখিয়ে দেবো।
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির চক্রান্ত প্রতিরোধ, গুম, খুন, গুপ্ত হত্যা বন্ধ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে ২০ দলীয় জোট আয়োজিত নাটোরের জনসভায় তিনি এসব কথা বলেন।
খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জনগণ ও বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। এ সরকার অবৈধ, অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক। তারা দেশের মানুষকে চুষে খাচ্ছে। দেশের সবকিছু লুট করে আজ অর্থনীতি ধ্বংস করে ফেলেছে।
শেখ হাসিনাকে নব্য হিটলার বলে আখ্যা দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন সমাবেশে আগত জনতার উদ্দেশে বলেন, আপনারা এই শয়তান ও নব্য হিটলারদের বিদায়ের জন্য প্রস্তুতি নিন। আমিও আপনাদের সাথে মাঠে নামব। সময়মতো আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। অবিলম্বে গণতন্ত্র ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার দাবিও জানান খালেদা জিয়া। প্রায় এক ঘণ্টার বক্তব্যে সরকারের জুলুম-নিপীড়ন, খুন, গুম, দুর্নীতি, বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ, বাকস্বাধীনতা হরণ ও লুটপাটসহ নানা অভিযোগ তোলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যা দেন।
শহরের নবাব সিরাজউদ্দৌলা সরকারি কলেজ মাঠের এই সমাবেশে নাটোরের সাতটি উপজেলা, পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়া, রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জ থেকে বাস-ট্রাক, ‘ভটভটি’তে চড়ে আসা হাজার হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত হন। এতে করে জনসমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। নেতাকর্মীদের অনেকের হাতে ধানের শীষ প্রতীক, জিয়াউর রহমান, তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার বড় বড় প্রতিকৃতি ছিল। চার দিকে ছিল বর্ণিল সাজসজ্জা।
জনসভার পশ্চিম পাশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তাদের হাতে ছিল জামায়াত-শিবিরের শীর্ষ নেতাদের মুক্তি দাবি সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন। নাটোর জেলা আমির অধ্যাপক ইউনুছ আলীসহ জেলার শীর্ষ পাঁচ নেতার মুক্তি দাবি সংবলিত পোস্টার ছিল চোখে পড়ার মতো। নির্ধারিত সময়ের আগেই জেলা স্কুল মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেলেও সমাবেশের আশপাশে প্রায় দুই কিলোমিটারজুড়ে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মাঠের চার পাশে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তাব্যবস্থাও ছিল ব্যাপক।
বেলা সোয়া ১২টায় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে জনসভার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। বেলা সাড়ে ৩টায় প্রধান অতিথি বেগম খালেদা জিয়া মঞ্চে এসে পৌঁছলে নেতাকর্মীরা তুমুল করতালি ও স্লোগান দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান। এরপর জোট নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শেষে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিট থেকে ৫টা ২০ মিনিট পর্যন্ত বক্তব্য রাখেন খালেদা জিয়া।
জনসভায় যোগ দিতে খালেদা জিয়া শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গুলশানের বাসা থেকে সড়কপথে উত্তরা, আশুলিয়া, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ হয়ে নাটোরে পৌঁছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের যাত্রাপথে ছিল শতাধিক দৃষ্টিনন্দন তোরণ।
নাটোর জেলা সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর সভাপতিত্বে জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সাবেক মন্ত্রী আমিনুল হক, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান পটল, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম নীরব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, মহিলা দল সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, শ্রমিকদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম খান নাসিম, ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসান, মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের সভানেত্রী শামা ওবায়েদ, স্থানীয় নেতাদের মধ্যে জেলা সহসভাপতি সাবিনা ইয়াসমীন ছবি, সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক, সাবেক এমপি কাজী গোলাম মোর্শেদ, কাজী শাহ আলম, ফরহাদ আলী দেওয়ান শাহিন, সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত বড়াইগ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবুর স্ত্রী ও বনপাড়া পৌর যুগ্ম আহ্বায়ক মহুয়া নূর, জেলা ওলামা দলের সভাপতি অধ্যক্ষ রিয়াজুল হক, বড়াইগ্রাম পৌরমেয়র ইসহাক আলী, জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে রাজশাহী অঞ্চলের সহকারী পরিচালক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, রাজশাহী মহানগর আমির অধ্যাপক আবুল হাশেম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমির অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম, পাবনা জেলা আমির আব্দুর রহিম, বড়াইগ্রাম উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জেলা জামায়াতের নেতা প্রভাষক আব্দুল হাকিম, ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি আশরাফুল আলম ইমন, নাটোর জেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আলমগীর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আবু তালেব বক্তব্য রাখেন।
জোট নেতাদের মধ্য জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা: রিদওয়ান উল্লাহ শাহিদী, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল লতিফ নেজামী, খেলাফত মজলিসের অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) টি আই এম ফজলে রাব্বী চৌধুরী, জাগপার শফিউল আলম প্রধান, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনডিপির খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা, ইসলামিক পার্টির অ্যাডভোকেট আব্দুল মোবিন, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, পিপলস লীগের গরীবে নেওয়াজ, ন্যাপ ভাসানীর আজহারুল ইসলাম, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, ন্যাপের ব্যারিস্টার গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া, কল্যাণ পার্টির এম এম আমিনুর রহমান, ডেমোক্র্যাটিক লীগের সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, বিজেপির সালাহউদ্দিন মতিন প্রকাশ, লেবার পার্টির হামদুল্লাহ আল মেহেদী, নাটোর জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। জনসভা শেষে বিএনপি চেয়ারপারসন কিছুণ সার্কিট হাউজে অবস্থান করে সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান মরহুম সানাউল্লাহ নূর বাবুকে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করেছে। তার কোনো বিচারও হয়নি। এ সরকারের আমলে কেউ নিরাপদ নয়। এভাবে দেশ চলতে পারে না। চলতে দেয়া যায় না।
বিএনপি চেয়ারপারসন সরকারের কঠোর সমালোচনা করে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, এ সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়, এ জন্য জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব নেই। সব জেলা ও উপজেলায় এখন শুধু মানুষ খুন আর গুম হচ্ছে। এসবে জড়িত আওয়ামী লীগের লোক। অন্য দিকে বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে।
পত্রিকার রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ৫০টি কিলিং মিশন আছে। টাকার বিনিময়ে তারা মানুষ মারছে। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে কোনো বিদেশী বিনিয়োগ হচ্ছে না। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি নেই। বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই। শুধু তাই নয়, দেশের ব্যাংকগুলোতে চড়া সুদ গুনতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের।
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, আওয়ামী লীগ ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার নামে ঘরে ঘরে বেকার তৈরি করছে। এভাবে শেখ হাসিনার দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড চলতে দেয়া যায় না।
বিদ্যুতের বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের বিদ্যুৎব্যবস্থার বেহাল অবস্থা। চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস নেই। গ্রাম তো দূরের কথা ঢাকাতেও বিদ্যুৎ নেই। দেশ আজ কোন দিকে যাচ্ছে? ধ্বংসের দিকে এবং নিচের দিকে যাচ্ছে। গার্মেন্ট শিল্প শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় সারা বিশ্বে দ্বিতীয় নম্বরে স্থান পেয়েছিল। এই অবৈধ সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর তা এখন চতুর্থ নম্বরে এসে পৌঁছেছে।
বিরোধী দলের আন্দোলনের ওপর সরকারের নিপীড়নের কথা তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, মিছিল, সভা-সমাবেশ করা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু মিছিল-মিটিং করতে দেয়া হয় না। সরকার জনবিচ্ছিন্ন্ বলেই এসব করছে। আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে। মূলত মামলা-হামলা করে এ সরকার এখন ক্ষমতায় টিকে আছে।
বিএনপি নেত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের এসব অপকর্ম যেন কেউ প্রকাশ করতে না পারে সে জন্য সম্প্রচার নীতিমালা করে তা নিয়ন্ত্রণ করছে। আমার দেশ পত্রিকা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ করে রেখেছে। অনলাইন চালু ছিল। এখন তাও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিলো। সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া হলো। চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে রেখেছে। অন্য দিকে তাদের চ্যানেলগুলো ঠিক রেখেছে।
সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে আজ মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। গণতন্ত্র নির্বাসনে। গণতন্ত্র ফিরে না এলে দেশের কারো উন্নতি হবে না।
সরকারকে নব্য হিটলার আখ্যা দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকার গুম, খুন করে ফ্যাসিস্ট কায়দায় ক্ষমতা দখল করে আছে। কোনো ধর্মের লোক নিরাপদ নয়। সবাই নির্যাতিত। এই শয়তান ও নব্য হিটলারকে বিদায় করতে পারলে দেশে আবার সুশাসন ও শান্তি ফিরে আসবে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সে দিন কোনো নির্বাচন হয়নি। বিএনপির ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। কুকুর গিয়েছিল। এ সরকারকে কেউ ভোট দেয়নি। আমরা আন্দোলনে সফল হয়েছি। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, জনগণের দায়িত্ব হলো সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন করা।
আইনশৃঙ্খলা ও র্যাবের প্রসঙ্গ তুলে ধরে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, অন্যায় অপকর্ম করতে পুলিশ ও র্যাব বাহিনীকে উৎসাহ দিচ্ছে সরকার। নারায়ণগঞ্জে টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করেছে। খুনিদের লোক দেখানোর জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে। আর রাখা হয়েছে জামাই আদরে। তিনি অবিলম্বে র্যাববাহিনী বাতিলের দাবি জানান। একই সাথে র্যাবের কর্মকর্তা জিয়াকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি জানান তিনি।
খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারা জানে ক্ষমতা ছাড়লে কী হবে, শেখ হাসিনাই অতীতে গানপাউডার দিয়ে মানুষ হত্যা করেছেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। এ মানুষের প্রতি এ সরকারের কোনো দরদ নেই। তারা টাকা ছাড়া আর কিছুর সাথে প্রেম করে না।
খালেদা জিয়া বলেন, আমরা নির্বাচন চাই। কিন্তু ব্যালট ছিনতাই আর ভোটবাক্স দখল করার নির্বাচন নয়। অবিলম্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার দাবি জানান তিনি। আওয়ামী লীগ যদি এতই জনপ্রিয় হয় তাহলে নির্বাচন দিন। আমার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শখ নেই। আমরা মানুষের শান্তি, ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছি।
কিন্তু সরকার এসব কর্মসূচিতে হামলা করছে। পুলিশ দিয়ে গুলি করছে। পুলিশকে গুলি বন্ধ করে মানুষের বিপদে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসার কথা বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এ সরকারের লোকেরা বনভূমি দখল করছে। কিন্তু তারা জনগণের কথা শোনে না। কানে কম শুনে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে দুর্নীতি কমিশন বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, এ সরকার দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে ফেলেছে।
সরকার ক্ষমতা স্থায়ী করতে একের পর আইন করছে মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, এখন বিচারকদের জন্য অভিশংসন আইন করেছে। কিন্তু অবৈধ সরকারের কোনো আইন টিকবে না। সময় মতো সব হবে। তিনি বিচারকদের বলেন, আপনারা ন্যায়বিচার করুন। তা না হলে এক দিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
স্থানীয় জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, এই নির্বাচন কমিশন অথর্ব। তাদের দিয়ে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই আপনাদের এখনি প্রতিবাদ করতে হবে। এখনি প্রতিবাদের সময়।
খালেদা জিয়া বলেন, আমরা আর কোনো মা-বোনের চোখের পানি দেখতে চাই না। আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি। তারা আমাদের সাথে আছেন। আমাদের পায়ের তলায় শক্ত মাটি আছে। আপনারা (সরকার) গুলি বন্ধ করুন, দেখবেন আন্দোলন কাকে বলে।
খালেদা জিয়া বলেন, আমরা আন্দোলন করে এরশাদকে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগই তার সাথে আঁতাত করেছে।
গত বছরের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা প্রসঙ্গে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেদিন পরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে সরকার। রাতের অন্ধকারে বহু মানুষ হত্যা করেছে। এসবের বিচার হবে একদিন।
বক্তব্যের শেষ দিকে এসে খালেদা জিয়া বলেন, খুব নাচতে নাচতে শেখ হাসিনা আরব আমিরাত গেলেন। কিন্তু কী ফল হয়েছে। কোনো চুক্তি হয়নি। আমরা (২০ দল) ক্ষমতায় এলে শ্রমশক্তি রফতানির যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
২০ দলীয় জোট সরকার গঠন করতে পারলে ভবিষ্যতের দেশ পরিচালনার রূপরেখাও তুলে ধরেন খালেদা জিয়া।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, আমরা জাকাত, নামাজ প্রতিষ্ঠা ও ভালো কাজের মাধ্যমে দেশের মানুষের শান্তি আনতে চাই। অন্যায় দূর করে সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে চাই। কিন্তু যারা এসব চান না তারাই জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বশূন্য করার চক্রান্ত করছে। দলের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে মিথ্যা মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে কার্যকরের ষড়যন্ত্র করছে। সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমকে কারাবন্দী রেখে নির্যাতন করে শহীদ করেছে। কাদের মোল্লাকে হত্যা করা হয়েছে। গোলাম আযমের নামাজে জানাজায় লাখো মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে জীবিত গোলাম আযমের চেয়ে মৃত গোলাম আযম কত শক্তিশালী।
তিনি বলেন, আর যদি একজনের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হয় তাহলে আমাদের হরতাল চলছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত লাগাতার হরতাল চলবে। কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটানোর জন্য নেতাকর্মীদের উদাত্ত আহ্বান জানান তিনি।
স্থানীয় প্রতিনিধি জানান, জনসমাবেশে বিএনপির সব অঙ্গসংগঠনের কর্মী-সমর্থকেরা মাঠে আলাদা রঙের পোশাক পরে আলাদাভাবেই অবস্থান করেন। এর মধ্যে ছাত্রদল লাল গেঞ্জি, যুবদল সবুজ গেঞ্জি, স্বেচ্ছাসেবক দল হলুদ গেঞ্জি, ওলামা দল সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি ও টুপি, কৃষকদল মাথায় মাথাল, তাঁতীদল ঘাড়ে গামছা ও মৎস্যজীবী দল ধুতি গেঞ্জি পরে এবং মাছ ধরার সামগ্রী হাতে নিয়ে মাঠে অবস্থান করে। ২০ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান শরিকদল জামায়াতে ইসলামীর কর্মী-সমর্থকদের জন্য মাঠের পশ্চিম পাশে আলাদা জায়গা রেখে মাঠের অন্য সব অংশ বিএনপির সব অঙ্গসংগঠনের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। প্রতিটি ভাগে যার যার রঙের পোশাক পরে হাতে রঙিন বেলুন নিয়ে হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক অবস্থান নেন। খালেদা জিয়া বিকেল সাড়ে ৩টায় জনসভা মঞ্চে এলে এক সাথে পুরো মাঠের লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক এসব গ্যাস ভরা বেলুন আকাশে উড়িয়ে দিয়ে তাকে স্বাগত জানান।
বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের সব শীর্ষ নেতাকে স্বাগত জানাতে জেলাজুড়ে তিন শতাধিক তোরণ নির্মাণের পাশাপাশি জেলা বিএনপির অস্থায়ী কার্যালয় আলাইপুর থেকে জনসমাবেশস্থল নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজ মাঠ পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশে রঙিন বাতি, রঙিন কাপড়, জাতীয় ও দলীয় পতাকা ছাড়াও লাল সবুজসহ নানা রঙের পতাকা এবং ডিজিটাল ব্যানার ছবি আর তোরণে বর্ণিলভাবে সাজানো হয়। শহরের সব মানুষকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও ২০ দলীয় জোট নেতাদের বক্তব্য শোনাতে ঢাকার একটি অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান থেকে দুই শতাধিক মাইক এনে মাঠ ও শহরজুড়ে লাগানো হয়। তৈরি করা হয় ৬০ ফুট প্রস্থ ও ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে সুবিশাল মঞ্চ।
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির চক্রান্ত প্রতিরোধ, গুম, খুন, গুপ্ত হত্যা বন্ধ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে ২০ দলীয় জোট আয়োজিত নাটোরের জনসভায় তিনি এসব কথা বলেন।
খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জনগণ ও বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। এ সরকার অবৈধ, অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক। তারা দেশের মানুষকে চুষে খাচ্ছে। দেশের সবকিছু লুট করে আজ অর্থনীতি ধ্বংস করে ফেলেছে।
শেখ হাসিনাকে নব্য হিটলার বলে আখ্যা দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন সমাবেশে আগত জনতার উদ্দেশে বলেন, আপনারা এই শয়তান ও নব্য হিটলারদের বিদায়ের জন্য প্রস্তুতি নিন। আমিও আপনাদের সাথে মাঠে নামব। সময়মতো আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। অবিলম্বে গণতন্ত্র ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার দাবিও জানান খালেদা জিয়া। প্রায় এক ঘণ্টার বক্তব্যে সরকারের জুলুম-নিপীড়ন, খুন, গুম, দুর্নীতি, বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ, বাকস্বাধীনতা হরণ ও লুটপাটসহ নানা অভিযোগ তোলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে আখ্যা দেন।
শহরের নবাব সিরাজউদ্দৌলা সরকারি কলেজ মাঠের এই সমাবেশে নাটোরের সাতটি উপজেলা, পার্শ্ববর্তী জয়পুরহাট, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়া, রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জ থেকে বাস-ট্রাক, ‘ভটভটি’তে চড়ে আসা হাজার হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত হন। এতে করে জনসমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। নেতাকর্মীদের অনেকের হাতে ধানের শীষ প্রতীক, জিয়াউর রহমান, তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার বড় বড় প্রতিকৃতি ছিল। চার দিকে ছিল বর্ণিল সাজসজ্জা।
জনসভার পশ্চিম পাশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তাদের হাতে ছিল জামায়াত-শিবিরের শীর্ষ নেতাদের মুক্তি দাবি সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন। নাটোর জেলা আমির অধ্যাপক ইউনুছ আলীসহ জেলার শীর্ষ পাঁচ নেতার মুক্তি দাবি সংবলিত পোস্টার ছিল চোখে পড়ার মতো। নির্ধারিত সময়ের আগেই জেলা স্কুল মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেলেও সমাবেশের আশপাশে প্রায় দুই কিলোমিটারজুড়ে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মাঠের চার পাশে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তাব্যবস্থাও ছিল ব্যাপক।
বেলা সোয়া ১২টায় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে জনসভার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। বেলা সাড়ে ৩টায় প্রধান অতিথি বেগম খালেদা জিয়া মঞ্চে এসে পৌঁছলে নেতাকর্মীরা তুমুল করতালি ও স্লোগান দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান। এরপর জোট নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শেষে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিট থেকে ৫টা ২০ মিনিট পর্যন্ত বক্তব্য রাখেন খালেদা জিয়া।
জনসভায় যোগ দিতে খালেদা জিয়া শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গুলশানের বাসা থেকে সড়কপথে উত্তরা, আশুলিয়া, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ হয়ে নাটোরে পৌঁছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের যাত্রাপথে ছিল শতাধিক দৃষ্টিনন্দন তোরণ।
নাটোর জেলা সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর সভাপতিত্বে জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সাবেক মন্ত্রী আমিনুল হক, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান পটল, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম নীরব, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, মহিলা দল সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, শ্রমিকদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম খান নাসিম, ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসান, মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের সভানেত্রী শামা ওবায়েদ, স্থানীয় নেতাদের মধ্যে জেলা সহসভাপতি সাবিনা ইয়াসমীন ছবি, সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক, সাবেক এমপি কাজী গোলাম মোর্শেদ, কাজী শাহ আলম, ফরহাদ আলী দেওয়ান শাহিন, সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত বড়াইগ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবুর স্ত্রী ও বনপাড়া পৌর যুগ্ম আহ্বায়ক মহুয়া নূর, জেলা ওলামা দলের সভাপতি অধ্যক্ষ রিয়াজুল হক, বড়াইগ্রাম পৌরমেয়র ইসহাক আলী, জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে রাজশাহী অঞ্চলের সহকারী পরিচালক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, রাজশাহী মহানগর আমির অধ্যাপক আবুল হাশেম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমির অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম, পাবনা জেলা আমির আব্দুর রহিম, বড়াইগ্রাম উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জেলা জামায়াতের নেতা প্রভাষক আব্দুল হাকিম, ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি আশরাফুল আলম ইমন, নাটোর জেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আলমগীর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আবু তালেব বক্তব্য রাখেন।
জোট নেতাদের মধ্য জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ডা: রিদওয়ান উল্লাহ শাহিদী, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল লতিফ নেজামী, খেলাফত মজলিসের অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) টি আই এম ফজলে রাব্বী চৌধুরী, জাগপার শফিউল আলম প্রধান, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এনডিপির খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা, ইসলামিক পার্টির অ্যাডভোকেট আব্দুল মোবিন, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, পিপলস লীগের গরীবে নেওয়াজ, ন্যাপ ভাসানীর আজহারুল ইসলাম, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, ন্যাপের ব্যারিস্টার গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া, কল্যাণ পার্টির এম এম আমিনুর রহমান, ডেমোক্র্যাটিক লীগের সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, বিজেপির সালাহউদ্দিন মতিন প্রকাশ, লেবার পার্টির হামদুল্লাহ আল মেহেদী, নাটোর জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সমাবেশে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। জনসভা শেষে বিএনপি চেয়ারপারসন কিছুণ সার্কিট হাউজে অবস্থান করে সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান মরহুম সানাউল্লাহ নূর বাবুকে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করেছে। তার কোনো বিচারও হয়নি। এ সরকারের আমলে কেউ নিরাপদ নয়। এভাবে দেশ চলতে পারে না। চলতে দেয়া যায় না।
বিএনপি চেয়ারপারসন সরকারের কঠোর সমালোচনা করে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, এ সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়, এ জন্য জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব নেই। সব জেলা ও উপজেলায় এখন শুধু মানুষ খুন আর গুম হচ্ছে। এসবে জড়িত আওয়ামী লীগের লোক। অন্য দিকে বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে।
পত্রিকার রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ৫০টি কিলিং মিশন আছে। টাকার বিনিময়ে তারা মানুষ মারছে। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে কোনো বিদেশী বিনিয়োগ হচ্ছে না। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি নেই। বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই। শুধু তাই নয়, দেশের ব্যাংকগুলোতে চড়া সুদ গুনতে হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের।
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, আওয়ামী লীগ ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার নামে ঘরে ঘরে বেকার তৈরি করছে। এভাবে শেখ হাসিনার দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড চলতে দেয়া যায় না।
বিদ্যুতের বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের বিদ্যুৎব্যবস্থার বেহাল অবস্থা। চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস নেই। গ্রাম তো দূরের কথা ঢাকাতেও বিদ্যুৎ নেই। দেশ আজ কোন দিকে যাচ্ছে? ধ্বংসের দিকে এবং নিচের দিকে যাচ্ছে। গার্মেন্ট শিল্প শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় সারা বিশ্বে দ্বিতীয় নম্বরে স্থান পেয়েছিল। এই অবৈধ সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর তা এখন চতুর্থ নম্বরে এসে পৌঁছেছে।
বিরোধী দলের আন্দোলনের ওপর সরকারের নিপীড়নের কথা তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, মিছিল, সভা-সমাবেশ করা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু মিছিল-মিটিং করতে দেয়া হয় না। সরকার জনবিচ্ছিন্ন্ বলেই এসব করছে। আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে। মূলত মামলা-হামলা করে এ সরকার এখন ক্ষমতায় টিকে আছে।
বিএনপি নেত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের এসব অপকর্ম যেন কেউ প্রকাশ করতে না পারে সে জন্য সম্প্রচার নীতিমালা করে তা নিয়ন্ত্রণ করছে। আমার দেশ পত্রিকা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ করে রেখেছে। অনলাইন চালু ছিল। এখন তাও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিলো। সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়া হলো। চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে রেখেছে। অন্য দিকে তাদের চ্যানেলগুলো ঠিক রেখেছে।
সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে আজ মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। গণতন্ত্র নির্বাসনে। গণতন্ত্র ফিরে না এলে দেশের কারো উন্নতি হবে না।
সরকারকে নব্য হিটলার আখ্যা দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকার গুম, খুন করে ফ্যাসিস্ট কায়দায় ক্ষমতা দখল করে আছে। কোনো ধর্মের লোক নিরাপদ নয়। সবাই নির্যাতিত। এই শয়তান ও নব্য হিটলারকে বিদায় করতে পারলে দেশে আবার সুশাসন ও শান্তি ফিরে আসবে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সে দিন কোনো নির্বাচন হয়নি। বিএনপির ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। কুকুর গিয়েছিল। এ সরকারকে কেউ ভোট দেয়নি। আমরা আন্দোলনে সফল হয়েছি। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, জনগণের দায়িত্ব হলো সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন করা।
আইনশৃঙ্খলা ও র্যাবের প্রসঙ্গ তুলে ধরে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, অন্যায় অপকর্ম করতে পুলিশ ও র্যাব বাহিনীকে উৎসাহ দিচ্ছে সরকার। নারায়ণগঞ্জে টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করেছে। খুনিদের লোক দেখানোর জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে। আর রাখা হয়েছে জামাই আদরে। তিনি অবিলম্বে র্যাববাহিনী বাতিলের দাবি জানান। একই সাথে র্যাবের কর্মকর্তা জিয়াকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি জানান তিনি।
খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারা জানে ক্ষমতা ছাড়লে কী হবে, শেখ হাসিনাই অতীতে গানপাউডার দিয়ে মানুষ হত্যা করেছেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। এ মানুষের প্রতি এ সরকারের কোনো দরদ নেই। তারা টাকা ছাড়া আর কিছুর সাথে প্রেম করে না।
খালেদা জিয়া বলেন, আমরা নির্বাচন চাই। কিন্তু ব্যালট ছিনতাই আর ভোটবাক্স দখল করার নির্বাচন নয়। অবিলম্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার দাবি জানান তিনি। আওয়ামী লীগ যদি এতই জনপ্রিয় হয় তাহলে নির্বাচন দিন। আমার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শখ নেই। আমরা মানুষের শান্তি, ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছি।
কিন্তু সরকার এসব কর্মসূচিতে হামলা করছে। পুলিশ দিয়ে গুলি করছে। পুলিশকে গুলি বন্ধ করে মানুষের বিপদে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসার কথা বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এ সরকারের লোকেরা বনভূমি দখল করছে। কিন্তু তারা জনগণের কথা শোনে না। কানে কম শুনে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে দুর্নীতি কমিশন বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, এ সরকার দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে ফেলেছে।
সরকার ক্ষমতা স্থায়ী করতে একের পর আইন করছে মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, এখন বিচারকদের জন্য অভিশংসন আইন করেছে। কিন্তু অবৈধ সরকারের কোনো আইন টিকবে না। সময় মতো সব হবে। তিনি বিচারকদের বলেন, আপনারা ন্যায়বিচার করুন। তা না হলে এক দিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
স্থানীয় জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, এই নির্বাচন কমিশন অথর্ব। তাদের দিয়ে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই আপনাদের এখনি প্রতিবাদ করতে হবে। এখনি প্রতিবাদের সময়।
খালেদা জিয়া বলেন, আমরা আর কোনো মা-বোনের চোখের পানি দেখতে চাই না। আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি। তারা আমাদের সাথে আছেন। আমাদের পায়ের তলায় শক্ত মাটি আছে। আপনারা (সরকার) গুলি বন্ধ করুন, দেখবেন আন্দোলন কাকে বলে।
খালেদা জিয়া বলেন, আমরা আন্দোলন করে এরশাদকে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগই তার সাথে আঁতাত করেছে।
গত বছরের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা প্রসঙ্গে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেদিন পরিকল্পিতভাবে হামলা করেছে সরকার। রাতের অন্ধকারে বহু মানুষ হত্যা করেছে। এসবের বিচার হবে একদিন।
বক্তব্যের শেষ দিকে এসে খালেদা জিয়া বলেন, খুব নাচতে নাচতে শেখ হাসিনা আরব আমিরাত গেলেন। কিন্তু কী ফল হয়েছে। কোনো চুক্তি হয়নি। আমরা (২০ দল) ক্ষমতায় এলে শ্রমশক্তি রফতানির যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
২০ দলীয় জোট সরকার গঠন করতে পারলে ভবিষ্যতের দেশ পরিচালনার রূপরেখাও তুলে ধরেন খালেদা জিয়া।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, আমরা জাকাত, নামাজ প্রতিষ্ঠা ও ভালো কাজের মাধ্যমে দেশের মানুষের শান্তি আনতে চাই। অন্যায় দূর করে সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে চাই। কিন্তু যারা এসব চান না তারাই জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বশূন্য করার চক্রান্ত করছে। দলের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে মিথ্যা মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে কার্যকরের ষড়যন্ত্র করছে। সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমকে কারাবন্দী রেখে নির্যাতন করে শহীদ করেছে। কাদের মোল্লাকে হত্যা করা হয়েছে। গোলাম আযমের নামাজে জানাজায় লাখো মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে জীবিত গোলাম আযমের চেয়ে মৃত গোলাম আযম কত শক্তিশালী।
তিনি বলেন, আর যদি একজনের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হয় তাহলে আমাদের হরতাল চলছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত লাগাতার হরতাল চলবে। কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটানোর জন্য নেতাকর্মীদের উদাত্ত আহ্বান জানান তিনি।
স্থানীয় প্রতিনিধি জানান, জনসমাবেশে বিএনপির সব অঙ্গসংগঠনের কর্মী-সমর্থকেরা মাঠে আলাদা রঙের পোশাক পরে আলাদাভাবেই অবস্থান করেন। এর মধ্যে ছাত্রদল লাল গেঞ্জি, যুবদল সবুজ গেঞ্জি, স্বেচ্ছাসেবক দল হলুদ গেঞ্জি, ওলামা দল সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি ও টুপি, কৃষকদল মাথায় মাথাল, তাঁতীদল ঘাড়ে গামছা ও মৎস্যজীবী দল ধুতি গেঞ্জি পরে এবং মাছ ধরার সামগ্রী হাতে নিয়ে মাঠে অবস্থান করে। ২০ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান শরিকদল জামায়াতে ইসলামীর কর্মী-সমর্থকদের জন্য মাঠের পশ্চিম পাশে আলাদা জায়গা রেখে মাঠের অন্য সব অংশ বিএনপির সব অঙ্গসংগঠনের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। প্রতিটি ভাগে যার যার রঙের পোশাক পরে হাতে রঙিন বেলুন নিয়ে হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক অবস্থান নেন। খালেদা জিয়া বিকেল সাড়ে ৩টায় জনসভা মঞ্চে এলে এক সাথে পুরো মাঠের লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক এসব গ্যাস ভরা বেলুন আকাশে উড়িয়ে দিয়ে তাকে স্বাগত জানান।
বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের সব শীর্ষ নেতাকে স্বাগত জানাতে জেলাজুড়ে তিন শতাধিক তোরণ নির্মাণের পাশাপাশি জেলা বিএনপির অস্থায়ী কার্যালয় আলাইপুর থেকে জনসমাবেশস্থল নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজ মাঠ পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশে রঙিন বাতি, রঙিন কাপড়, জাতীয় ও দলীয় পতাকা ছাড়াও লাল সবুজসহ নানা রঙের পতাকা এবং ডিজিটাল ব্যানার ছবি আর তোরণে বর্ণিলভাবে সাজানো হয়। শহরের সব মানুষকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও ২০ দলীয় জোট নেতাদের বক্তব্য শোনাতে ঢাকার একটি অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান থেকে দুই শতাধিক মাইক এনে মাঠ ও শহরজুড়ে লাগানো হয়। তৈরি করা হয় ৬০ ফুট প্রস্থ ও ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে সুবিশাল মঞ্চ।
>>>শফিকুল ইসলাম ও শহীদুল হক সরকার,নাটোর
No comments