বিনিয়োগ বাড়লে প্রবৃদ্ধিও বাড়বে by ড. আর এম দেবনাথ

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটা স্বীকারোক্তি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বরাবর একজন উচ্চাভিলাষী ও আশাবাদী মানুষ বলে নিজেই স্বীকার করেন। এমন একজন অর্থমন্ত্রী কিছুদিন আগে বললেন, আমরা জিডিপি (গ্রস ডমেস্টিক প্রডাক্ট) প্রবৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে ৬-এর ঘরে আটকে গেছি। এ কথা জানা, বিগত পাঁচ বছর যাবৎ আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছয় শতাংশের ওপরে। কিছুদিন আগে সমাপ্ত ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) এক সম্মেলনে বক্তারা একে বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য অগ্রগতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর জিডিপি নিু প্রবৃদ্ধির হার এবং অব্যাহত বিশ্বমন্দার পরিপ্রেক্ষিতে, বলা বাহুল্য, ছয় শতাংশের কিছুটা উপরের প্রবৃদ্ধি প্রশংসারই বিষয়। কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা আরও বেশি। আমরা যত কম সময়ে সম্ভব মধ্য আয়ের দেশ হতে চাই। সাত শতাংশের ওপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরে বহুদিন আমরা হিসাব করছিলাম। আশা করা হচ্ছিল এই তো সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েই গেল বোধহয়। কিন্তু না, এটা হচ্ছে না। এ প্রেক্ষাপটেই অর্থমন্ত্রী আক্ষেপের সুরে বলেছেন, আমরা ছয়ের ঘরে আটকে গেছি। প্রশ্ন, এই ছয়ের ঘর থেকে বেরোনোর ব্যবস্থা কী? এর উত্তর একটাই- বিনিয়োগ, আর বিনিয়োগ। সরকারি বিনিয়োগ, আর অধিকতর বেসরকারি বিনিয়োগ। এখানেও মুশকিল একটাই- আশাপ্রদভাবে বিনিয়োগ হচ্ছে না।
সরকারি তথ্যেই দেখা যাচ্ছে, বিনিয়োগের কোনো নড়নচড়ন নেই। ২০০৯-১০ অর্থবছরে জিডিপির তুলনায় প্রকৃত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা ২৬ দশমিক ৮৪ শতাংশে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ এ সময়ে হ্রাস পায়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগের হার ছিল ১৯ দশমিক ৪০। ২০১২-১৩ সালে তা ১৮ দশমিক ৯৯ শতাংশে হ্রাস পায়। বলা বাহুল্য, ২০১৩-১৪ অর্থবছর এবং বর্তমান অর্থবছরেও (২০১৪-১৫) এ অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। জাতীয় সঞ্চয়েরও একই অবস্থা। গত এক দশক ধরে জাতীয় সঞ্চয় স্থবির। আমাদের বেসরকারি খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য মোট ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রায় ৯৫ শতাংশ। যদি এই বেসরকারি খাতেই বিনিয়োগ হ্রাস পায় তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার উন্নীত হবে কী করে? অথচ আমাদের বিনিয়োগের হার কমপক্ষে বর্তমান ২৭-২৮ শতাংশ থেকে ৩২-৩৫ শতাংশে বৃদ্ধি করা দরকার।
বিনিয়োগের এ অবস্থার মধ্যেই আমরা বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে নানা প্রশংসা শুনছি। যেমন কদিন আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা পিউ এক জরিপ করে বলেছে, বাংলাদেশ বাজার অর্থনীতির স্বর্গরাজ্য। দেখা যাচ্ছে তাদের গবেষণায় বাজার অর্থনীতির অনুকূলে যে শীর্ষ পাঁচটি দেশ আছে এর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। প্রথম ভিয়েতনাম। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম দেশগুলো হচ্ছে যথাক্রমে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ঘানা। উল্লেখ্য, এ তালিকায় প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলংকা ও পাকিস্তান নেই। অন্যদিকে মার্কিন প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ফোর্বস বলছে : বাংলাদেশ : ক্যাপিট্যালিস্ট হেভেন। এ ধরনের প্রশংসামূলক অনেক অভিধা আমরা আজকাল পাচ্ছি যা দুদিন আগেও ছিল বিরল। আমাদের রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা, ক্রমবর্ধমান রেমিটেন্স এবং ক্রমবর্ধমান তৈরি পোশাক রফতানির মাধ্যমে রক্ষিত প্রবৃদ্ধির হারই বোধহয় এসব প্রশংসার কারণ। এও বলা হচ্ছে, প্রচুর সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। আমরা নিজেরাও বুঝতে পারছি আমাদের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু জিনিসটা এগোচ্ছে না। বিনিয়োগ বাড়ছে না। উন্নয়নের মূল বিষয়, অর্থনীতির মূল জায়গা অর্থাৎ বিনিয়োগে গতি আসছে না। এর কারণ কী?
কারণ সম্পর্কে যুগান্তর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ৩১ অক্টোবর। তাতে বলা হয়েছে, ১১টি কারণের কথা। এগুলো হচ্ছে : বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ না পাওয়া, ঋণের অপ্রাপ্যতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ হার, অবকাঠামো উন্নয়নে অনুমতি না পাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ব্যবসা শুরুর সমস্যা, কর প্রদান সমস্যা, বিদেশে টাকা পাচার, বিদেশী বাণিজ্য ও সম্পত্তি নিবন্ধন জটিলতা এবং চুক্তির বাস্তবায়ন জটিলতা। এ তালিকার একটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কথা। এটি স্থান পেয়েছে পাঁচ নম্বরে। অথচ সচরাচর দেখা যায় অনেকেই একে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে, যদিও আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাস এক অনিশ্চয়তারই ইতিহাস। ১৯৭২ থেকে ৭৫, ৭৫ থেকে ৮০, ৮০ থেকে ৯০ এবং ৯০ পরবর্তীকালকে স্তরে স্তরে ভাগ করে দেখলে বোঝা যাবে কী হচ্ছে, কী হচ্ছে-এর মধ্যেই আমাদের চলা বা অগ্রযাত্রা। তবু এ সমস্যাটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এটি কোনো কথা নয় যে, একটা দেশ ৪০-৪২ বছর ধরে তার সংবিধান ও জাতির পরিচয় নিয়ে মারামারি করে যাবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ নিয়ে কথা বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এটা যে শিল্পায়নের একটা ভীষণ বড় সমস্যা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দুঃখ হচ্ছে স্থায়ী সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, কয়লা উত্তোলনের দীর্ঘমেয়াদি কথা উঠলেই দেশ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। কোনো সমাধানে পৌঁছা যাচ্ছে না। ব্যাংক ঋণের অপ্রাপ্যতা ও ঋণের সুদের হার সম্পর্কে অনেক অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। ঋণের অপ্রাপ্যতার চেয়ে সুদের হারই বরাবর একটা ইস্যু থেকে যাচ্ছে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা বরাবরই উচ্চহার সম্পর্কে সোচ্চার। কিন্তু বিষয়টার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। আমি আগেও বলছি এখনও বলছি, সুদের হার নির্ধারণে তিনটি পক্ষ রয়েছে যথা-আমানতকারী, ঋণগ্রহীতা ও মূল্যস্ফীতি। আমানতকারীরা ন্যায্য রিটার্ন চায়। ব্যবসায়ীরা কম সুদে ঋণ চায়। ন্যায্য সুদ দিতে গেলে মূল্যস্ফীতির ওপরেই আমানতকারীদের সুদের হার হতে হবে। নতুবা আমানতকারীরা আমানত রাখতে নিরুৎসাহিত হবে। তারা টাকা অন্যদিকে বিনিয়োগ করবে। এ অবস্থায় করণীয় একটাই- ন্যায্য বা কম সুদে শিল্পঋণ-প্রকল্প ও ওয়ার্কিং ক্যাপিটেল দিতে হলে এ দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারকে নিতে হবে। এরা সুদ ভর্তুকি দিতে পারে। বস্তুত সরকার বিভিন্ন খাতে তা দিচ্ছেও। তবে একটা কথা ব্যবসায়ীদের মনে রাখতে হবে। তাদের পণ্যের কস্ট অব প্রডাকশন কত তা হিসাব করতে হবে। একশ টাকা খরচ হলে এর মধ্যে সুদ ব্যয় কত তাও তাদের হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে। কারণ ভর্তুকিপ্রাপ্তি বা ভর্তুকির টাকা প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘমেয়াদে শিল্পের শক্তি জোগায় না। আমি অস্থায়ী একটা পদক্ষেপ হিসেবে সরকারকে শিল্পঋণে অধিকতর ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে সুপারিশ করছি। এর জন্য অবশ্য পুরো সুদ কাঠামোই পর্যালোচনায় নিতে হতে পারে।
পরের ইস্যু বা বাধা ঋণের অপ্রাপ্তি। বর্তমানে ব্যাংক ব্যবসার মোটামুটি ২০ ভাগের মতো নিয়ন্ত্রণ করে সরকারি ব্যাংক। বাকি ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি খাত। সরকারি ব্যাংক সাধারণভাবে বড় বড় ঋণ গ্রহীতার চাহিদা মেটায়। মেটায় তাদের অধিকতর বোঝা বহনের ক্ষমতা আছে বলেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণমূলক বাধা-নিষেধের কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে অনেকটা পিছিয়ে। বড় ঋণ প্রদানে নানারকম বাধা-নিষেধও আছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সমস্যা ভিন্ন। সম্প্রতি কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় সেখানে পরিচালক এবং/অথবা তাদের পোষ্য ছাড়া বাকিদের ঋণপ্রাপ্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। তারা মোটামুটি নিজেদেরই দেখভাল করছেন বলে প্রতীয়মান হয়। এ ধরনের ঘটনা না ঘটলে ব্যাংকের মালিক হওয়ার জন্য এত তদবির হতো না। দেখা যাচ্ছে দুই ধরনের ব্যাংকের সমস্যা দুরকমের। আবার আরেকটি ঘটনাও এখন কার্যকর। এবং তা হচ্ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি। শ্রেণী বিন্যাসকরণের নীতিমালায় কঠোর পরিবর্তন, অনিয়মের বিচার, বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক নানা ধরনের তদারকি এবং বিচারমূলক ব্যবস্থার কারণে ব্যাংকাররা আগের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে কাস্টমারদের ডেকে আনে না। ইতিমধ্যে বাজে উদাহরণও জমা হচ্ছে প্রচুর। নামি-দামি, বিশাল বিজনেস হাউসগুলো ব্যাংক ঋণের টাকা ফেরত দিতে অপারগ হচ্ছে অথবা টাকা হাতে রেখে ব্যাংকগুলোকে বিপদে ফেলছে। এছাড়া খবরের কাগজগুলোতেই ব্যবসা মন্দার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। শিপ বিল্ডিং, শিপব্রেকিং, চিনি, সয়াবিন, বস্ত্র শিল্প, গ্লাস ইত্যাদি শিল্পের ওপর যেসব স্টোরি দিনের পর দিন ছাপা হচ্ছে তাতে ব্যাংকারদের মনে আতংকের সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃত কাস্টমারদের এগিয়ে না আসা, ব্যাংকারদের আÍরক্ষামূলক অবস্থান, ব্যবসায় মন্দা, ঋণ নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিবিধান ইত্যাদি কারণে ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তিতে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এ ফাঁকে বলে দিই, কারণে-অকারণে নানা ধরনের অডিট আপত্তির ফলে বহু ব্যাংকারের অবসর ভাতা ইত্যাদি প্রাপ্তিতে এখন জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এসব কিন্তু বড় কাস্টমারদেরই বিষয়। তাই নয় কি?
টাকা পাচার, ব্যবসা সংক্রান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে বিলম্ব, সম্পত্তি নিবন্ধন, নতুন ব্যবসা শুরুতে জটিলতা ইত্যাদির ওপর যুগান্তরের রিপোর্টে যা বলা হয়েছে তার সঙ্গে দ্বিমতের কোনো সুযোগ নেই। এসব সমস্যার ত্বরিত কোনো সমাধান আছে বলে মনে হয় না। তবে এটা বুঝি যদি ব্যবসায়ীরা চান তাহলে তারা দেয়াল ভেঙে তাদের কাজ এগিয়ে নিতে পারেন। এ ক্ষমতা তাদের আছে। কেন জানি মনে হয়, এ জায়গাটাতে কোথাও কোনো গিট্টু আছে। একটা জিনিস লক্ষ করলাম, রিপোর্টে জমির অপ্রাপ্যতা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু এটিও একটি বড় সমস্যা শিল্পায়নের।
পরিশেষে বলে রাখি, ব্যাংকে কিন্তু প্রচুর টাকা পড়ে আছে। ঋণের ওপর সুদের হার কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমেছে এবং কমছে। পরিস্থিতিটাকে ঘোলাটে করছে খেলাপি ঋণ গ্রহীতারা। তাদের দায়িত্ব বর্তাচ্ছে ব্যাংকারদের ওপর, কিন্তু ভালো ব্যবসায়ী, ব্যবসা ও তার মালিকের ভালো কাজের প্রশংসার কোনো ভাগ ব্যাংকাররা পাচ্ছেন না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ দরকার। দরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ উদারীকরণ নীতির পাশাপাশি সুদ ভর্তুকি। তাহলে আপাতত কিছু ফল পাওয়া যেতে পারে।
ড. আরএম দেবনাথ : সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
rmdebnath@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.