ভারত-বাংলাদেশ লাইনকে দূরে রাখার চেষ্টা কেন?
১ নভেম্বর শনিবার দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নজির স্থাপন করে গেল। সর্বব্যাপী বিপরর্যবয় ঘটেছিল দেশের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থায়। লোডশেডিংয়ের ‘কল্যাণে’ দেশে জেনারেটরের মাধ্যমে যে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাও একসময় ‘ফেল’ হতে শুরু করে কিংবা ‘ফেল’ করে। ফলে দুর্যোগকালীন অনিশ্চয়তা ভর করে দেশজুড়ে। এদিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে প্রায় ১১ ঘণ্টা ধরে, বিশেষ করে সন্ধ্যার পর অনিশ্চয়তা-দুর্ভোগ ‘কত প্রকার, কী কী’ তা প্রত্যক্ষ করেছে দেশের প্রায় সব নাগরিক। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ‘দুর্যোগ’ থেকে বাদ যায়নি বঙ্গভবন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিদেশি মিশনসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনাও। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা যে বর্তমান সময়ে মানুষের জীবনযাত্রার ‘রক্তসঞ্চালনী’, তা শনিবার আমাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে। পানির কষ্ট, হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা, খাদ্যের মতো অতি জরুরি মানবিক বিষয় তো আছেই; এমনকি পুলিশের আন্ত-যোগাযোগব্যবস্থাও হুমকির মুখে পড়েছিল্, যা নাগরিকের নিরাপত্তার জন্য আশঙ্কার কারণ হতো। মোবাইল ফোন, এটিএমে টাকা ওঠানো, জ্বালানি সরবরাহ থেকে নাগরিক জীবনের সবকিছুই থেমে গিয়েছিল প্রায়। লোডশেডিংয়ে অভ্যস্থ বাংলাদেশের মানুষের কাছে যদিও বিদ্যুৎ বিপর্যয় নতুন কিছু নয়, তবে শনিবারের সর্বব্যাপী বিপর্যয়ের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের সম্পর্কের বিষয়টি ছিল বলে এটি নতুন মাত্রা পায়। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়েও প্রভাব ফেলেছিল তা। সবচেয়ে বড় কথা, এ অভিজ্ঞতা আমাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতার দিকটি দেখিয়ে গেল। কী কী কারণে জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় ঘটতে পারে, সেগুলো আমাদের প্রকৌশলীরা জানেন না, তা নিশ্চয় নয়। কিন্তু তারা এ বিষয়ে আধুনিক কোনো ব্যবস্থা নেননি বলেই মনে হচ্ছে। এমনকি অন্য দেশ থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ সংযোগ করার আগে জাতীয় গ্রিডের সুরক্ষার জন্য যে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার, সেটিও তারা করেননি বলে আমরা শনিবার দেখলাম। আমরা মনে করি, এই বিপর্যয় আমাদের সচেতন করার সুযোগ করে দিয়ে গেছে। জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন ও কেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তার ব্যাপারে আর কোনো ধরনের ঔদাসীন্য কাম্য নয়। সর্বব্যাপী বিপররয়্য এড়াতে এখনই জাতীয় গ্রিড ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। এমন ব্যবস্থা হতে পারে, জাতীয় গ্রিডের কোনো আঞ্চলিক অংশে ত্রুটি দেখা দিলে বা তা বন্ধ হয়ে গেলেও সম্পূর্ণ গ্রিড বন্ধ হবে না। আবার জাতীয় গ্রিডে কোনো ত্রুটি ঘটলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিযুক্ত হয়ে যাবে আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোর সরবরাহ; কিন্তু কেন্দ্র চালু থাকবে। একই সঙ্গে আমরা বলব, অঞ্চলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সঞ্চালনের আলাদা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হোক, যার মাধ্যমে শুধু সংশ্লিষ্ট অঞ্চলেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। তার জন্য থাকবে আলাদা ব্যবস্থাপনা। আরেকটি বিষয়, শনিবারের বিপর্যয়ে ভারতের সরবরাহ লাইনকে সন্দেহের বাইরে রাখতে অর্থমন্ত্রী ও বিদ্যুৎসচিবের বক্তব্য আমাদের অবাক করেছে। গ্রিড লাইনে যেহেতু ভারতের বিদ্যুৎ আছে, তাই তদন্তের আগেই এর সম্ভাব্য ভূমিকাকে ‘না না না’ বলে উড়িযে দেয়া বা সন্দেহের বাইরে রাখা অনুচিত। তা ছাড়া, দুই দেশের বিদ্যুৎসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রকাশিত ভাষ্য অনুযায়ী, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বাংলাদেশ-ভারতের সরবরাহ লাইনে ত্রুটি থেকেই বিপর্যরয়ের সূত্রপাতের কথা অনুমান করা হচ্ছে। বাকিটা তদন্ত কমিটির ওপর ছেড়ে দেয়া হোক।
No comments