সব স্তরেই শিক্ষার মান বাড়াতে হবে -সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম by মোহাম্মদ কবীর আহমদ
যুগান্তর : এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফল করা বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত পর্যায়ের নম্বর পেতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে তারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাটি এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার মতো নয়। এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা এবং সেখানে পাস-ফেলের কোনো ব্যাপার নেই; সেটি যোগ্যতা দেখানোর ব্যাপার। ফলে ২০ শতাংশ বা ২১ শতাংশ যারা পাস করেন, তাদের পাস না বলে বলা যায় তারা ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছেন। সেই যোগ্যতা অর্জনের পরও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারছেন না। কারণ আমাদের আসন সংখ্যা সীমিত। এটিকে বড় বিপর্যয় হিসেবে দেখা উচিত নয় বা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিপর্যয় হিসেবে দেখা উচিত নয়। যে কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ক্ষেত্রেই এটি ঘটে থাকে। বিসিএস পরীক্ষা যারা দেন, তারা বেশিসংখ্যক পাস করেন না। তার মানে এই নয় যে, তাদের মাস্টার্স পড়াশোনাটা বৃথা গেছে। এ জন্য আমি মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকে দেখতে হবে এই দৃষ্টিতে- এখানে যোগ্যতাটা প্রধান- যে পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা প্রদর্শন করতে হয়। পরীক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো এ পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত নন। আমি খুশি হতাম, যদি ভর্তিচ্ছু সব শিক্ষার্থীকে আমরা ভর্তি করাতে পারতাম। কিন্তু সেটি আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
যুগান্তর : ইদানীং এসএসসি ও এইচএসসিতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করছে ও জিপিএ-৫ পাচ্ছে। এতে শিক্ষার মান কতটা বাড়ছে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাচ্ছে, আমি এতে আনন্দিত। আমি মনে করি, আমাদের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অধিকার আছে ভালো ফল করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। কিন্তু মানের যে প্রশ্নটি তোলা হচ্ছে, আসলে কিন্তু সেখানে একটা ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে- এটি অনেকে স্বীকার না করলেও আমি বুঝতে পারি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের আমি দেখেছি- তাদের অনেকের ভাষাজ্ঞানে অনেক ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। তাদের অনেকের কোনো কোনো বিষয়ে দশটি বাক্য শুদ্ধভাবে লেখার যোগ্যতায় ঘাটতি দেখা যায়। তার মানে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে যে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, সেখানে একটা ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। সে জন্য আমি মনে করি, প্রাইমারিসহ শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে- ভৌত অবকাঠামোর উন্নতির পাশাপাশি মেধাবীদের শিক্ষক পেশায় আগ্রহী করে তোলা, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া, পাঠ্যপুস্তকের মান আরও উন্নত করা, শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানো, তাদের বৃত্তির পাশাপাশি স্কুলে একবেলা আহারের ব্যবস্থা করা- এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে প্রচুরসংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হবে, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যা কমবে এবং ভালো ফল নিয়ে তারা বের হতে পারবে। মানের বিষয়টি আমি বিবেচনা করি একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কোনো একটি পরীক্ষায় এত সংখ্যক জিপিএ পেয়ে পাস করে বের হল বলে শিক্ষার মান বেড়ে গেছে বা কমে গেছে- এ বিষয়টি বিবেচনা না করে বরং সার্বিক মানের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। একেবারে প্রাইমারি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত আমাদের মানকে আরও উন্নত করতে হবে। যাতে আমরা আমাদের শিক্ষাকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করতে পারি। সেটি যেদিন হবে সেদিন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কম হলেও আমি সেটা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করব।
যুগান্তর : বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থী পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে পারছে না। এটা শিক্ষার্থীর পরবর্তী জীবনে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে একটি আসনের জন্য অনেক শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতা করে। ফলে প্রত্যেকে তার কাক্সিক্ষত আসনটি পায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিতসংখ্যক আসনে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হতে আসে। এ প্রতিযোগিতায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও পিছিয়ে পড়ে। কাক্সিক্ষত বিষয়টি না পেয়ে অনেকে হতাশ হয়, অনেকে বিষয় বদল করে; শুনেছি অনেকে পড়াশোনাও ছেড়ে দেয়। কেউ কেউ হয়তো বিদেশেও চলে যায়, কেউ কেউ চাকরিতে যোগদান করে। এ সমস্যার সমাধান হল- যদি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সামগ্রিকভাবে মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমে যাবে।
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অধিকার আছে তার পছন্দের বিষয়ে পড়ার। দেশের যোগ্য প্রতিটি শিক্ষার্থীর মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের। তাই শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে সফল হতে পারে সে ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে মানসম্মত করতে সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের চাপ কমবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে উন্নীত করা গেলে উল্লিখিত সমস্যাগুলো স্বাভাবিকভাবেই সমাধান হয়ে যাবে। কাক্সিক্ষত বিষয়ে ভর্তি হতে না পারলে শিক্ষা-পরবর্তী জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাবটা থেকে যায়। যে শিক্ষার্থীর বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন ছিল, তিনি কাক্সিক্ষত বিষয়ে ভর্তির সুযোগ না পেলে তার হতাশা থেকেই যাবে। কাজেই শিক্ষার্থীরা যাতে কাক্সিক্ষত বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পান এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
যুগান্তর : আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারসহ বিভিন্ন অসৎ উপায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইয়ে দিতে একটি চক্র তৎপর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগও নিয়েছে। এসব প্রক্রিয়ার কথা শুনে স্বাভাবিকভাবেই অনেক শিক্ষার্থী হতাশ হয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার কী উপদেশ?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : ভর্তি পরীক্ষার সময় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারকারী বিভিন্ন চক্রের অপতৎপরতা বৃদ্ধির কারণ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ। এমসিকিউ পদ্ধতি মেধা যাচাইয়ের কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা নয়। বিশ্বব্যাপী এ পদ্ধতি প্রচলিত থাকলেও এর সঙ্গে লিখিত পরীক্ষার বিষয়টিও সম্পর্কিত। লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের বিষয়টি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি, বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা নেয়া হোক- যাতে গুচ্ছ পদ্ধতিতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি পরীক্ষা নেয়া হয়। সেখানে এমসিকিউ পদ্ধতির কিছু প্রশ্ন থাকলেও পাশাপাশি কিছু প্রশ্ন থাকা উচিত, যেগুলোর লিখিত উত্তর দিতে হবে। যেমন বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য যারা পড়তে ইচ্ছুক, তাদের ভাষা বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা দেখাতে হবে। যারা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুক, তাদের গণিতে দক্ষতা দেখাতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের লিখিত জবাব দিতে হলে অসৎ উপায় অবলম্বনকারীরা সেখানে ভূমিকা রাখতে পারবে না। কাজেই তখন ওই চক্রগুলো স্বাভাবিকভাবেই নিষ্ক্রিয় হবে।
অসৎ চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি আইনশৃংখলা রক্ষায় যারা কাজ করেন তাদের এখতিয়ারভুক্ত। আমি মনে করি, সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। অসৎ চক্রের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে অন্যরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। অসৎ উপায় অবলম্বন করে কোনো কোনো শিক্ষার্থী ভালো ফল অর্জন করলে অন্য শিক্ষার্থীরা হতাশ হবে- এটাই স্বাভাবিক। একজন শিক্ষার্থী সৎভাবে পরীক্ষা দিল, অন্য একজন অসৎ উপায় অবলম্বন করে হয়তো অনেক ভালো ফল অর্জন করল; এ ক্ষেত্রে যে শিক্ষার্থী সৎভাবে পরীক্ষা দিচ্ছে তার জন্য এটি চাপ সৃষ্টি করবে, হতাশা সৃষ্টি করবে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা কোনোভাবেই আপনাদের সন্তানকে অসাধু চক্রের হাতে তুলে দেবেন না। কারণ আপনার সন্তান অসাধু পন্থা অবলম্বন করে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তাহলে সারা জীবন সে অসাধু পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করবে। এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীদেরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে। কোনো অসৎ চক্র ধারে-কাছে এলে এদের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করতে হবে।
যুগান্তর : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তো আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষার্থীরা পছন্দের বিষয়ে ভর্তির সুযোগ না পাওয়ার বিষয়টি আমাদের দেশে নতুন নয়। এ চাহিদা বা শূন্যতা পূরণের লক্ষ্য থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। অন্য কথায় বললে উল্লিখিত সমস্যার সমাধানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ অবদান রাখছে। একসময় প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পড়তে যেতেন। এ প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিভিন্ন দেশে চলে যেত। যারা বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতেন, তারা যে বিশ্বমানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেতেন তা নয়। কারণ তারা যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেতেন সেসবের অনেক প্রতিষ্ঠানই খুব মানসম্পন্ন ছিল না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বিস্তৃত হয়েছে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গমনের হার অনেক কমেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুযোগও বেড়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীদের যত্নসহ পড়ালেখা করানো হয় এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু বৃত্তির ব্যবস্থাও আছে। বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক প্রবণতাই বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। ফলে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কাক্সিক্ষত মান রক্ষা করা সম্ভব হয় না। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আমরা শুনতে পাই। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও শুনতে পাই। সেসব ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। যে প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয়ের কথা বলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেই প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালনের ব্যাপারে তাদের সচেষ্ট হতে হবে।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়ার অনেক কারণ রয়েছে। অনেক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক র্যাংকিং করা হয়। শিক্ষকদের যোগ্যতা থেকে শুরু করে শিক্ষাদানের পদ্ধতি, পরীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি, স্বচ্ছতার প্রশ্ন, শ্রেণীকক্ষের সুযোগ-সুবিধা- এরকম অনেক কিছু আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অবকাঠামোগত অনেক সমস্যা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরলেই দেখা যাবে শ্রেণীকক্ষগুলো একেবারেই দুর্দশাগ্রস্ত। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগেই ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে শ্রেণীকক্ষে প্রযুক্তির ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা এতই কম যে, অনেকে বাধ্য হয়ে বাইরে খণ্ডকালীন চাকরি করতে চান, কেউ কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ফলে শিক্ষকরা যে পুরোপুরি নিজেদের উজাড় করে শ্রেণীকক্ষে পাঠ দেবেন, সেটিও সম্ভব হয় না।
আমি মনে করি আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং উন্নতির জন্য আমাদের একটি সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। আমি যে শিক্ষা বিনিয়োগের কথা বলছি- সে বিনিয়োগটা এখানেও আসতে হবে। প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের মান বাড়াতে হবে। শিক্ষাদান পদ্ধতির মান বাড়াতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের মান বাড়াতে হবে। তারপর শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসবে, তখন তারা যাতে পছন্দের বিষয়ে ভর্তির পর্যাপ্ত সুযোগ পায়, সেখানে যেন আন্তর্জাতিক মানের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হয়, গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত বই থাকে, বৃত্তির ব্যবস্থা থাকে, আবাসন ব্যবস্থা উন্নত হয়, শিক্ষকদের জীবনমান উন্নত হয়- এ বিষয়গুলোর প্রতি যদি সঠিকভাবে নজর দেয়া হয় তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হারিয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধার করা খুব একটা কঠিন হবে না।
যুগান্তর : অনেক শিক্ষিত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার জ্ঞানে অনেক সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : কোনো শিক্ষিত ব্যক্তির মাতৃভাষায় সীমাবদ্ধতার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের বিভাগে (ইংরেজিতে) যারা প্রথমবর্ষে ভর্তি হয় তাদের ইংরেজির মান ক্রমে কমছে, এটা আমি স্বয়ং পরীক্ষা করে দেখেছি। তাদের বাংলা ভাষায় দখলের মানও কমছে, ভয়ানকভাবে কমছে। একসময় (সত্তরের দশকে) বিএ (পাস) পরীক্ষা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো- এখন যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়- তখন বিএ (পাস) শ্রেণীতে ইংরেজি বাধ্যতামূলক ছিল। তখন বিএ (পাস) পরীক্ষায় পাসের হার ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। ওই সময়ের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যারা ইংরেজিতে পাস করতে সক্ষম হতেন তারাই বিএ (পাস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেন বলে ধরে নেয়া হতো। বিএ (পাস) শ্রেণীর সিলেবাসে ইংরেজিকে যখন ঐচ্ছিক বিষয় করা হল তখনও পাসের হার ওই ১৪ বা ১৫ শতাংশই রয়ে গেল। তখন দেখা গেল আবশ্যকীয় বাংলাতেই ১৫ শতাংশ পাস করছেন। এখন বাংলায় পাস করলেই বিএ (পাস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া নিশ্চিত বলে ধরে নেয়া হয়। বাংলায় পাসের হার এত কম হওয়ার অন্যতম কারণ বাংলার প্রতি শিক্ষার্থীদের উদাসীনতা। অনেকে মনে করেন, বাংলা তো মাতৃভাষা, এর প্রতি বাড়তি মনোযোগ দেয়ার কী আছে? যারা এমনটি মনে করেন, যথাযথ প্রস্তুতি না নিয়ে পরীক্ষা দেন, তারাই অকৃতকার্য হন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার মনে রাখা দরকার- যে কোনো ভাষা শেখার একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে, সে বিষয়গুলোর প্রতি অবহেলার ফলেই অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও সাধারণ বাংলা শব্দের বানানও ভুল করেন।
আমি মনে করি, মাতৃভাষার প্রতি যে দুর্বলতা এটি সাময়িক একটি অবস্থা। আমি নিশ্চিত, একটু চেষ্টা করলেই আমরা কেবল বানান কেন, মাতৃভাষায় সুন্দরভাবে নিজেকে প্রকাশ করা এবং লেখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারব। তার জন্য প্রয়োজন যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক এবং সেই শিক্ষক তৈরির জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। কাজেই আমি কোনো বিষয়কেই খণ্ডিতভাবে দেখব না। পুরো বিষয়টিকে সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করব।
যুগান্তর : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক মাঠ পর্যায়ের সমীক্ষার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এইচএসসি পর্যন্ত ঝরে পড়ছে ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ অবস্থার উত্তরণে কী করণীয়?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এসএসসি, এইচএসসিসহ শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সমস্যা সহজেই সমাধান করা যায়। শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রচুর বৃত্তির ব্যবস্থা করা গেলে, শিক্ষার্থীদের একবেলা মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থা করা গেলে, একই সঙ্গে মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হলে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম অনেক বেশি বিস্তৃত করা সম্ভব হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা সম্ভব হলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার সামগ্রিক মান অনেক বেড়ে যাবে। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বিভিন্ন সুকুমার বৃত্তির চর্চা অব্যাহত থাকলে শ্রেণীকক্ষ আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। সরকার বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের বই প্রদান করছে। এটি প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ। এর পাশাপাশি শিক্ষার অন্যান্য উপকরণ বিনামূল্যে প্রদান করা সম্ভব হলে দরিদ্র অভিভাবকদের ওপর চাপ কমবে। ফলে তারা সন্তানদের শিক্ষামুখী করার বাড়তি আগ্রহ অনুভব করবেন।
যুগান্তর : বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমছে। এতে আগামীতে দেশের সামগ্রিক অবস্থার ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : দেশের অনেক বিদ্যালয়েই বিজ্ঞান শিক্ষার আধুনিক উপকরণের অভাব রয়েছে, যোগ্যতাসম্পন্ন বিজ্ঞান শিক্ষকের অভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে মেয়েদের তেমন উৎসাহ প্রদান করা হয় না, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে মেয়েদের নিরুৎসাহিত করা হয়। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীকে শৈশব থেকে বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী করতে হবে। স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষার আধুনিক উপকরণ সরবরাহ করা হলে বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়বে। বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ যত বাড়ানো হবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তত বাড়বে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমলে স্বাভাবিকভাবেই দেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যাও কমে যাবে। দেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যা কমলে সামান্য প্রযুক্তির জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। বিজ্ঞানীর সংখ্যা কমে গেলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার আশংকা দেখা দেবে।
যুগান্তর : শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের যে গতি লক্ষ্য কার যাচ্ছে এ ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের গতি আরও বাড়াতে হবে। শিক্ষানীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে। আমি একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। যেমন- প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই বছরের কলেজ শিক্ষার জন্য যে ব্যয় হয়, তা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভৌত কাঠামোর উন্নয়ন ঘটবে। এ ধরনের আনুষ্ঠানিক কিছু বিষয় দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার কাক্সিক্ষত পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়বে।
যুগান্তর : উন্নত দেশগুলোতে একাধিক বিদেশী ভাষা শেখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশে ভাষা শেখার এ প্রবণতা অনুপস্থিত কেন? বিদেশী ভাষা শেখার ক্ষেত্রে কী করণীয়?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : উন্নত অনেক দেশেই একাধিক ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়। এমনকি ভারত, শ্রীলংকায়ও দুটি ভাষা শেখার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। বাংলা যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা, তাই আমি চাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একেবারে শেষ পর্যায় পর্যন্ত বাংলা ভাষায় অধ্যয়নের সুযোগ তৈরি হোক। পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা অত্যন্ত ভালোভাবে রপ্ত করা দরকার। কারণ বিশ্বের যোগাযোগের মাধ্যম এখন ইংরেজি। বিশ্বের বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যের ভাষা এখন ইংরেজি। বিশ্বের যে কোনো উদ্যোগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার অন্যতম মাধ্যম ইংরেজি। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের শুরুতেই ইংরেজি শেখার জন্য যথাযথ সুযোগ সৃষ্টি করা হলে তারা ইংরেজি ভালোভাবে রপ্ত করতে পারবে। যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি করে তাদের অব্যাহত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়ানো গেলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে যে অরাজকতা রয়েছে সেটি দূর হবে। কোনো শিক্ষার্থী দুটি ভাষা ভালোভাবে রপ্ত করতে পারলে তার আÍবিশ্বাস বেড়ে যায়, নিজেকে প্রকাশ করার অনেক পথ তৈরি হয়। ফলে ওই শিক্ষার্থীর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেকে বিদেশের চাকরিতে সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন ভাষা আয়ত্ত করে থাকেন। এ বিষয়টিকে আমি তেমন গুরুত্ব দিতে চাই না। আমি গুরুত্ব দিতে চাই জ্ঞানের চর্চার পরিধি বৃদ্ধির জন্য কোন শিক্ষার্থী কয়টি বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করছেন তার ওপর। কোনো শিক্ষার্থী বা কোনো ব্যক্তি যদি অনেক ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারেন তাহলে ওই ব্যক্তির মুঠোয় বিশ্ব চলে আসে।
যুগান্তর : মঙ্গলগ্রহে ভারতের সফল অভিযান আমাদের জন্য কি কেবল একটি তথ্য? প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মহাকাশ গবেষণায় আমাদের কী ধরনের প্রস্তুতি নেয়া দরকার?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : ভারতের মঙ্গল অভিযানে বড় ধরনের সাফল্যের নেপথ্যে তাদের বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে। নেহেরু যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের একটা বিশাল বিনিয়োগ আছে। কলকাতায় একটি সায়েন্স সিটি রয়েছে। আমাদের দেশে অন্য শহরে তো দূরের কথা, খোদ রাজধানীতেও সায়েন্স সিটি এখনও তৈরি হয়নি। ভারতে বিজ্ঞানীদের প্রচুর উৎসাহ প্রদান করা হয়। আমাদের দেশে তেমনটি লক্ষ্য করা যায় না। আমাদের যে একটি উপগ্রহ পাঠানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেখানেও বিদেশী প্রযুক্তির প্রাধান্য। আমরা দেশীয় প্রযুক্তিতে উপগ্রহ তৈরি করে যেদিন তা উৎক্ষেপণ করতে পারব, সেদিনই আমি করতালি দিয়ে বিষয়টিকে অভিনন্দন জানাব। বিদেশী প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা যদি একটি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করি, তাহলে বড় কোনো গৌরব হল বলে আমার মনে হয় না। মঙ্গলযান যা ভারত মহাকাশে পাঠিয়েছে তার পুরোটাই দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করেছেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে মঙ্গলের কক্ষপথে একটি নভোযান রেখেছে ভারত। মেধার দিক থেকে আমরা যে খুব পিছিয়ে আছি তা নয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে তেমন বিনিয়োগ হচ্ছে না, অথচ ভারত শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রচুর বিনিয়োগ করছে। আমি সব সময় মনে করি আমরা যদি জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২৫ শতাংশ শিক্ষায় বিনিয়োগ করতাম, তাহলে বিজ্ঞান শিক্ষায় এমন অগ্রগতি দৃশ্যমান হতো যে, এক প্রজন্ম পরে আমাদের বিজ্ঞানীরাই নিজের ল্যাবরেটরিতে এ ধরনের উপগ্রহ তৈরি করে পৃথিবীর বা অন্য যে কোনো গ্রহের কক্ষপথে তা উৎক্ষেপণ করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারতেন। এ ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক গবেষণার প্রয়োজন, প্রায়োগিক গবেষণাও প্রয়োজন। সব ধরনের গবেষণাকেই বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
যুগান্তর : প্রতিবছর দেশের বিপুলসংখ্যক তরুণ যাতে গবেষণার জন্য বিদেশে যেতে পারে সেজন্য কী করণীয়?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : প্রতিবছর প্রচুর শিক্ষার্থী নিজেদের চেষ্টায় বিদেশে অধ্যয়ন করতে যাচ্ছে, সেখানে সরকার খুব বেশি সাহায্য করছে না। আমার মনে হয়, সরকার প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে তরুণদের প্রশিক্ষিত করে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করলে এর মাধ্যমে দেশ বিশেষভাবে উপকৃত হতো। বিদেশে অবস্থানরত অনেক তরুণ তাদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-গবেষণা শেষে দেশে ফিরতে আগ্রহী। এটি অত্যন্ত ভালো একটি প্রবণতা। তরুণদের আরও উৎসাহিত করার জন্য সরকারের উচিত হবে এসব তরুণকে দেশে ফিরিয়ে এনে যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে আরও প্রচুরসংখ্যক তরুণকে বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়ে প্রশিক্ষণ শেষে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনাও সরকারের দায়িত্ব। শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় অংকের বিনিয়োগ করা হলে উল্লিখিত কাজগুলো সহজেই সম্পন্ন করা সম্ভব।
যুগান্তর : অনেকে বলেন, শিশুদের ওপর বাড়তি বোঝা চাপানো হচ্ছে? তাদের যদি যোগ্য করে তোলা না হয়, তাহলে তারা আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে কী করে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিশুদের ওপর পাঠ্যক্রমের বড় বোঝা চাপিয়ে দেয়া কোনোক্রমেই উচিত নয়। আমি মনে করি, প্রাথমিকের শিক্ষা হতে হবে অত্যন্ত আনন্দদায়ক, শিক্ষা হবে জীবন কুশলতা শেখার সমান্তরাল একটি বিষয়। শিশুদের বেশি বিষয় পড়ানোর প্রয়োজন নেই। আমার মনে হয়, তাদের প্রধানত গণিত ও ভাষা এ দুই বিষয়ে শিক্ষা দেয়া উচিত। গণিত ও ভাষায় যদি একটি শিশু সুশিক্ষিত হতে পারে, তাহলে তার নিজেকে প্রকাশ করার সব রাস্তা খুলে যাবে, তার মেধা শক্তিশালী হবে। প্রতিটি মানব শিশুই মেধাবী হিসেবেই জন্ম নেয়। তার মেধার অপচয় হয় বা মেধাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি না বলেই কোনো কোনো শিশু তার মেধার প্রকাশ ঘটাতে পারে না। আমরা যদি প্রাথমিকে আনন্দঘন পরিবেশে পাঠদান শুরু করি- যেখানে শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য কার্যক্রম যেমন শিশুরা গান শিখতে পারবে, অভিনয় শিখতে পারবে, সুন্দর খেলার মাঠ থাকবে, সেখানে
শিশুরা খেলাধুলা করতে পারবে- যদি এরকম আনন্দঘন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে শিশুদের ওপর পাঠ্যক্রমের বোঝা চাপানোর প্রয়োজন নেই। বছরের নয় মাস তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে; তারা শুরু থেকেই শিখবে ভাষা ও গণিত; তারপর দেখা যাবে সমাজ, বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস- এসব বিষয় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তাদের আয়ত্তে চলে আসবে। যে শিশু গণিত আর ভাষা জানে, তার যে কোনো গ্রন্থ আয়ত্তে আনা কঠিন কিছু নয়। সে চিন্তাও করতে শিখবে, নিজেকে প্রকাশ করতেও শিখবে।
যুগান্তর : দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাত্ত্বিক বা প্রায়োগিক কোন ধরনের শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : সব ধরনের প্রায়োগিক শিক্ষার প্রতি আমাদের গুরুত্ব দেয়া উচিত। আমাদের একটা ধারণা আছে, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ বোধহয় খুব উচ্চ ধরনের শিক্ষা নয়। বিদেশে এমনটি লক্ষ্য করা যায় না। আমাদের এখানে লক্ষ্য করা যায়, যিনি তাঁত শিল্পে দক্ষতা অর্জন করলেন বা ওয়েল্ডিং শিখলেন তার তুলনায় যিনি দর্শন বা সাহিত্যের কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করলেন তাকে অনেক বেশি মূল্যবান বিবেচনা করা হয়। আমি মনে করি, সব বিষয়ের শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। যে কোনো বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিয়ে যে কেউ দেশের জন্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। বৃত্তিমূলক পেশার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে সাহিত্যের কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারীও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন।
প্রযুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানে গুরুত্ব বাড়ানো উচিত। আমাদের দেশে প্রচুর ডাক্তার প্রয়োজন, নার্সের প্রয়োজন। আমাদের দেশে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে বিএসসি ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই বৈষম্য দূর করা গেলে, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি নেতিবাচক ধারণা দূর করা গেলে প্রতিটি বিষয়েই বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আগ্রহ বাড়বে। তবে তাত্ত্বিক শিক্ষা ও গবেষণায় অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক এ দুই শিক্ষার সমন্বয় সাধন করতে হবে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : ধন্যবাদ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাটি এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার মতো নয়। এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা এবং সেখানে পাস-ফেলের কোনো ব্যাপার নেই; সেটি যোগ্যতা দেখানোর ব্যাপার। ফলে ২০ শতাংশ বা ২১ শতাংশ যারা পাস করেন, তাদের পাস না বলে বলা যায় তারা ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছেন। সেই যোগ্যতা অর্জনের পরও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারছেন না। কারণ আমাদের আসন সংখ্যা সীমিত। এটিকে বড় বিপর্যয় হিসেবে দেখা উচিত নয় বা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিপর্যয় হিসেবে দেখা উচিত নয়। যে কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ক্ষেত্রেই এটি ঘটে থাকে। বিসিএস পরীক্ষা যারা দেন, তারা বেশিসংখ্যক পাস করেন না। তার মানে এই নয় যে, তাদের মাস্টার্স পড়াশোনাটা বৃথা গেছে। এ জন্য আমি মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকে দেখতে হবে এই দৃষ্টিতে- এখানে যোগ্যতাটা প্রধান- যে পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা প্রদর্শন করতে হয়। পরীক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো এ পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত নন। আমি খুশি হতাম, যদি ভর্তিচ্ছু সব শিক্ষার্থীকে আমরা ভর্তি করাতে পারতাম। কিন্তু সেটি আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
যুগান্তর : ইদানীং এসএসসি ও এইচএসসিতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করছে ও জিপিএ-৫ পাচ্ছে। এতে শিক্ষার মান কতটা বাড়ছে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাচ্ছে, আমি এতে আনন্দিত। আমি মনে করি, আমাদের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অধিকার আছে ভালো ফল করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। কিন্তু মানের যে প্রশ্নটি তোলা হচ্ছে, আসলে কিন্তু সেখানে একটা ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে- এটি অনেকে স্বীকার না করলেও আমি বুঝতে পারি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের আমি দেখেছি- তাদের অনেকের ভাষাজ্ঞানে অনেক ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। তাদের অনেকের কোনো কোনো বিষয়ে দশটি বাক্য শুদ্ধভাবে লেখার যোগ্যতায় ঘাটতি দেখা যায়। তার মানে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে যে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, সেখানে একটা ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। সে জন্য আমি মনে করি, প্রাইমারিসহ শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে- ভৌত অবকাঠামোর উন্নতির পাশাপাশি মেধাবীদের শিক্ষক পেশায় আগ্রহী করে তোলা, তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া, পাঠ্যপুস্তকের মান আরও উন্নত করা, শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানো, তাদের বৃত্তির পাশাপাশি স্কুলে একবেলা আহারের ব্যবস্থা করা- এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে প্রচুরসংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হবে, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যা কমবে এবং ভালো ফল নিয়ে তারা বের হতে পারবে। মানের বিষয়টি আমি বিবেচনা করি একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কোনো একটি পরীক্ষায় এত সংখ্যক জিপিএ পেয়ে পাস করে বের হল বলে শিক্ষার মান বেড়ে গেছে বা কমে গেছে- এ বিষয়টি বিবেচনা না করে বরং সার্বিক মানের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। একেবারে প্রাইমারি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত আমাদের মানকে আরও উন্নত করতে হবে। যাতে আমরা আমাদের শিক্ষাকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করতে পারি। সেটি যেদিন হবে সেদিন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কম হলেও আমি সেটা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করব।
যুগান্তর : বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থী পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে পারছে না। এটা শিক্ষার্থীর পরবর্তী জীবনে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে একটি আসনের জন্য অনেক শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতা করে। ফলে প্রত্যেকে তার কাক্সিক্ষত আসনটি পায় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিতসংখ্যক আসনে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হতে আসে। এ প্রতিযোগিতায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও পিছিয়ে পড়ে। কাক্সিক্ষত বিষয়টি না পেয়ে অনেকে হতাশ হয়, অনেকে বিষয় বদল করে; শুনেছি অনেকে পড়াশোনাও ছেড়ে দেয়। কেউ কেউ হয়তো বিদেশেও চলে যায়, কেউ কেউ চাকরিতে যোগদান করে। এ সমস্যার সমাধান হল- যদি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সামগ্রিকভাবে মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ কমে যাবে।
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অধিকার আছে তার পছন্দের বিষয়ে পড়ার। দেশের যোগ্য প্রতিটি শিক্ষার্থীর মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের। তাই শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে সফল হতে পারে সে ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে মানসম্মত করতে সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের চাপ কমবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে উন্নীত করা গেলে উল্লিখিত সমস্যাগুলো স্বাভাবিকভাবেই সমাধান হয়ে যাবে। কাক্সিক্ষত বিষয়ে ভর্তি হতে না পারলে শিক্ষা-পরবর্তী জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাবটা থেকে যায়। যে শিক্ষার্থীর বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন ছিল, তিনি কাক্সিক্ষত বিষয়ে ভর্তির সুযোগ না পেলে তার হতাশা থেকেই যাবে। কাজেই শিক্ষার্থীরা যাতে কাক্সিক্ষত বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পান এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
যুগান্তর : আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারসহ বিভিন্ন অসৎ উপায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইয়ে দিতে একটি চক্র তৎপর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগও নিয়েছে। এসব প্রক্রিয়ার কথা শুনে স্বাভাবিকভাবেই অনেক শিক্ষার্থী হতাশ হয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার কী উপদেশ?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : ভর্তি পরীক্ষার সময় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারকারী বিভিন্ন চক্রের অপতৎপরতা বৃদ্ধির কারণ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ। এমসিকিউ পদ্ধতি মেধা যাচাইয়ের কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা নয়। বিশ্বব্যাপী এ পদ্ধতি প্রচলিত থাকলেও এর সঙ্গে লিখিত পরীক্ষার বিষয়টিও সম্পর্কিত। লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের বিষয়টি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি, বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা নেয়া হোক- যাতে গুচ্ছ পদ্ধতিতে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে একটি পরীক্ষা নেয়া হয়। সেখানে এমসিকিউ পদ্ধতির কিছু প্রশ্ন থাকলেও পাশাপাশি কিছু প্রশ্ন থাকা উচিত, যেগুলোর লিখিত উত্তর দিতে হবে। যেমন বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য যারা পড়তে ইচ্ছুক, তাদের ভাষা বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা দেখাতে হবে। যারা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুক, তাদের গণিতে দক্ষতা দেখাতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের লিখিত জবাব দিতে হলে অসৎ উপায় অবলম্বনকারীরা সেখানে ভূমিকা রাখতে পারবে না। কাজেই তখন ওই চক্রগুলো স্বাভাবিকভাবেই নিষ্ক্রিয় হবে।
অসৎ চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি আইনশৃংখলা রক্ষায় যারা কাজ করেন তাদের এখতিয়ারভুক্ত। আমি মনে করি, সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। অসৎ চক্রের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে অন্যরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। অসৎ উপায় অবলম্বন করে কোনো কোনো শিক্ষার্থী ভালো ফল অর্জন করলে অন্য শিক্ষার্থীরা হতাশ হবে- এটাই স্বাভাবিক। একজন শিক্ষার্থী সৎভাবে পরীক্ষা দিল, অন্য একজন অসৎ উপায় অবলম্বন করে হয়তো অনেক ভালো ফল অর্জন করল; এ ক্ষেত্রে যে শিক্ষার্থী সৎভাবে পরীক্ষা দিচ্ছে তার জন্য এটি চাপ সৃষ্টি করবে, হতাশা সৃষ্টি করবে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা কোনোভাবেই আপনাদের সন্তানকে অসাধু চক্রের হাতে তুলে দেবেন না। কারণ আপনার সন্তান অসাধু পন্থা অবলম্বন করে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তাহলে সারা জীবন সে অসাধু পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করবে। এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীদেরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে। কোনো অসৎ চক্র ধারে-কাছে এলে এদের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করতে হবে।
যুগান্তর : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তো আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষার্থীরা পছন্দের বিষয়ে ভর্তির সুযোগ না পাওয়ার বিষয়টি আমাদের দেশে নতুন নয়। এ চাহিদা বা শূন্যতা পূরণের লক্ষ্য থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। অন্য কথায় বললে উল্লিখিত সমস্যার সমাধানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ অবদান রাখছে। একসময় প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পড়তে যেতেন। এ প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিভিন্ন দেশে চলে যেত। যারা বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতেন, তারা যে বিশ্বমানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেতেন তা নয়। কারণ তারা যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেতেন সেসবের অনেক প্রতিষ্ঠানই খুব মানসম্পন্ন ছিল না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বিস্তৃত হয়েছে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গমনের হার অনেক কমেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুযোগও বেড়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীদের যত্নসহ পড়ালেখা করানো হয় এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু বৃত্তির ব্যবস্থাও আছে। বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক প্রবণতাই বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। ফলে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কাক্সিক্ষত মান রক্ষা করা সম্ভব হয় না। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আমরা শুনতে পাই। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও শুনতে পাই। সেসব ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। যে প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয়ের কথা বলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেই প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালনের ব্যাপারে তাদের সচেষ্ট হতে হবে।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়ার অনেক কারণ রয়েছে। অনেক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক র্যাংকিং করা হয়। শিক্ষকদের যোগ্যতা থেকে শুরু করে শিক্ষাদানের পদ্ধতি, পরীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি, স্বচ্ছতার প্রশ্ন, শ্রেণীকক্ষের সুযোগ-সুবিধা- এরকম অনেক কিছু আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অবকাঠামোগত অনেক সমস্যা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরলেই দেখা যাবে শ্রেণীকক্ষগুলো একেবারেই দুর্দশাগ্রস্ত। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগেই ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে শ্রেণীকক্ষে প্রযুক্তির ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা এতই কম যে, অনেকে বাধ্য হয়ে বাইরে খণ্ডকালীন চাকরি করতে চান, কেউ কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ফলে শিক্ষকরা যে পুরোপুরি নিজেদের উজাড় করে শ্রেণীকক্ষে পাঠ দেবেন, সেটিও সম্ভব হয় না।
আমি মনে করি আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং উন্নতির জন্য আমাদের একটি সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। আমি যে শিক্ষা বিনিয়োগের কথা বলছি- সে বিনিয়োগটা এখানেও আসতে হবে। প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের মান বাড়াতে হবে। শিক্ষাদান পদ্ধতির মান বাড়াতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের মান বাড়াতে হবে। তারপর শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসবে, তখন তারা যাতে পছন্দের বিষয়ে ভর্তির পর্যাপ্ত সুযোগ পায়, সেখানে যেন আন্তর্জাতিক মানের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হয়, গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত বই থাকে, বৃত্তির ব্যবস্থা থাকে, আবাসন ব্যবস্থা উন্নত হয়, শিক্ষকদের জীবনমান উন্নত হয়- এ বিষয়গুলোর প্রতি যদি সঠিকভাবে নজর দেয়া হয় তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হারিয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধার করা খুব একটা কঠিন হবে না।
যুগান্তর : অনেক শিক্ষিত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার জ্ঞানে অনেক সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : কোনো শিক্ষিত ব্যক্তির মাতৃভাষায় সীমাবদ্ধতার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের বিভাগে (ইংরেজিতে) যারা প্রথমবর্ষে ভর্তি হয় তাদের ইংরেজির মান ক্রমে কমছে, এটা আমি স্বয়ং পরীক্ষা করে দেখেছি। তাদের বাংলা ভাষায় দখলের মানও কমছে, ভয়ানকভাবে কমছে। একসময় (সত্তরের দশকে) বিএ (পাস) পরীক্ষা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো- এখন যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়- তখন বিএ (পাস) শ্রেণীতে ইংরেজি বাধ্যতামূলক ছিল। তখন বিএ (পাস) পরীক্ষায় পাসের হার ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। ওই সময়ের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যারা ইংরেজিতে পাস করতে সক্ষম হতেন তারাই বিএ (পাস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেন বলে ধরে নেয়া হতো। বিএ (পাস) শ্রেণীর সিলেবাসে ইংরেজিকে যখন ঐচ্ছিক বিষয় করা হল তখনও পাসের হার ওই ১৪ বা ১৫ শতাংশই রয়ে গেল। তখন দেখা গেল আবশ্যকীয় বাংলাতেই ১৫ শতাংশ পাস করছেন। এখন বাংলায় পাস করলেই বিএ (পাস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া নিশ্চিত বলে ধরে নেয়া হয়। বাংলায় পাসের হার এত কম হওয়ার অন্যতম কারণ বাংলার প্রতি শিক্ষার্থীদের উদাসীনতা। অনেকে মনে করেন, বাংলা তো মাতৃভাষা, এর প্রতি বাড়তি মনোযোগ দেয়ার কী আছে? যারা এমনটি মনে করেন, যথাযথ প্রস্তুতি না নিয়ে পরীক্ষা দেন, তারাই অকৃতকার্য হন। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার মনে রাখা দরকার- যে কোনো ভাষা শেখার একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে, সে বিষয়গুলোর প্রতি অবহেলার ফলেই অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও সাধারণ বাংলা শব্দের বানানও ভুল করেন।
আমি মনে করি, মাতৃভাষার প্রতি যে দুর্বলতা এটি সাময়িক একটি অবস্থা। আমি নিশ্চিত, একটু চেষ্টা করলেই আমরা কেবল বানান কেন, মাতৃভাষায় সুন্দরভাবে নিজেকে প্রকাশ করা এবং লেখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারব। তার জন্য প্রয়োজন যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক এবং সেই শিক্ষক তৈরির জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। কাজেই আমি কোনো বিষয়কেই খণ্ডিতভাবে দেখব না। পুরো বিষয়টিকে সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করব।
যুগান্তর : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক মাঠ পর্যায়ের সমীক্ষার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এইচএসসি পর্যন্ত ঝরে পড়ছে ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ অবস্থার উত্তরণে কী করণীয়?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এসএসসি, এইচএসসিসহ শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সমস্যা সহজেই সমাধান করা যায়। শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রচুর বৃত্তির ব্যবস্থা করা গেলে, শিক্ষার্থীদের একবেলা মানসম্মত খাবারের ব্যবস্থা করা গেলে, একই সঙ্গে মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হলে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম অনেক বেশি বিস্তৃত করা সম্ভব হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা সম্ভব হলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার সামগ্রিক মান অনেক বেড়ে যাবে। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বিভিন্ন সুকুমার বৃত্তির চর্চা অব্যাহত থাকলে শ্রেণীকক্ষ আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। সরকার বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের বই প্রদান করছে। এটি প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ। এর পাশাপাশি শিক্ষার অন্যান্য উপকরণ বিনামূল্যে প্রদান করা সম্ভব হলে দরিদ্র অভিভাবকদের ওপর চাপ কমবে। ফলে তারা সন্তানদের শিক্ষামুখী করার বাড়তি আগ্রহ অনুভব করবেন।
যুগান্তর : বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমছে। এতে আগামীতে দেশের সামগ্রিক অবস্থার ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : দেশের অনেক বিদ্যালয়েই বিজ্ঞান শিক্ষার আধুনিক উপকরণের অভাব রয়েছে, যোগ্যতাসম্পন্ন বিজ্ঞান শিক্ষকের অভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে মেয়েদের তেমন উৎসাহ প্রদান করা হয় না, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে মেয়েদের নিরুৎসাহিত করা হয়। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীকে শৈশব থেকে বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী করতে হবে। স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষার আধুনিক উপকরণ সরবরাহ করা হলে বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়বে। বিজ্ঞানের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ যত বাড়ানো হবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তত বাড়বে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমলে স্বাভাবিকভাবেই দেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যাও কমে যাবে। দেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যা কমলে সামান্য প্রযুক্তির জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। বিজ্ঞানীর সংখ্যা কমে গেলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হওয়ার আশংকা দেখা দেবে।
যুগান্তর : শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের যে গতি লক্ষ্য কার যাচ্ছে এ ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের গতি আরও বাড়াতে হবে। শিক্ষানীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে। আমি একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। যেমন- প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই বছরের কলেজ শিক্ষার জন্য যে ব্যয় হয়, তা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিনিয়োগ করলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভৌত কাঠামোর উন্নয়ন ঘটবে। এ ধরনের আনুষ্ঠানিক কিছু বিষয় দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার কাক্সিক্ষত পরিবেশ সৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়বে।
যুগান্তর : উন্নত দেশগুলোতে একাধিক বিদেশী ভাষা শেখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশে ভাষা শেখার এ প্রবণতা অনুপস্থিত কেন? বিদেশী ভাষা শেখার ক্ষেত্রে কী করণীয়?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : উন্নত অনেক দেশেই একাধিক ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়। এমনকি ভারত, শ্রীলংকায়ও দুটি ভাষা শেখার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। বাংলা যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা, তাই আমি চাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একেবারে শেষ পর্যায় পর্যন্ত বাংলা ভাষায় অধ্যয়নের সুযোগ তৈরি হোক। পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা অত্যন্ত ভালোভাবে রপ্ত করা দরকার। কারণ বিশ্বের যোগাযোগের মাধ্যম এখন ইংরেজি। বিশ্বের বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যের ভাষা এখন ইংরেজি। বিশ্বের যে কোনো উদ্যোগের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার অন্যতম মাধ্যম ইংরেজি। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের শুরুতেই ইংরেজি শেখার জন্য যথাযথ সুযোগ সৃষ্টি করা হলে তারা ইংরেজি ভালোভাবে রপ্ত করতে পারবে। যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি করে তাদের অব্যাহত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়ানো গেলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে যে অরাজকতা রয়েছে সেটি দূর হবে। কোনো শিক্ষার্থী দুটি ভাষা ভালোভাবে রপ্ত করতে পারলে তার আÍবিশ্বাস বেড়ে যায়, নিজেকে প্রকাশ করার অনেক পথ তৈরি হয়। ফলে ওই শিক্ষার্থীর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেকে বিদেশের চাকরিতে সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন ভাষা আয়ত্ত করে থাকেন। এ বিষয়টিকে আমি তেমন গুরুত্ব দিতে চাই না। আমি গুরুত্ব দিতে চাই জ্ঞানের চর্চার পরিধি বৃদ্ধির জন্য কোন শিক্ষার্থী কয়টি বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করছেন তার ওপর। কোনো শিক্ষার্থী বা কোনো ব্যক্তি যদি অনেক ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারেন তাহলে ওই ব্যক্তির মুঠোয় বিশ্ব চলে আসে।
যুগান্তর : মঙ্গলগ্রহে ভারতের সফল অভিযান আমাদের জন্য কি কেবল একটি তথ্য? প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মহাকাশ গবেষণায় আমাদের কী ধরনের প্রস্তুতি নেয়া দরকার?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : ভারতের মঙ্গল অভিযানে বড় ধরনের সাফল্যের নেপথ্যে তাদের বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে। নেহেরু যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের একটা বিশাল বিনিয়োগ আছে। কলকাতায় একটি সায়েন্স সিটি রয়েছে। আমাদের দেশে অন্য শহরে তো দূরের কথা, খোদ রাজধানীতেও সায়েন্স সিটি এখনও তৈরি হয়নি। ভারতে বিজ্ঞানীদের প্রচুর উৎসাহ প্রদান করা হয়। আমাদের দেশে তেমনটি লক্ষ্য করা যায় না। আমাদের যে একটি উপগ্রহ পাঠানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেখানেও বিদেশী প্রযুক্তির প্রাধান্য। আমরা দেশীয় প্রযুক্তিতে উপগ্রহ তৈরি করে যেদিন তা উৎক্ষেপণ করতে পারব, সেদিনই আমি করতালি দিয়ে বিষয়টিকে অভিনন্দন জানাব। বিদেশী প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা যদি একটি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করি, তাহলে বড় কোনো গৌরব হল বলে আমার মনে হয় না। মঙ্গলযান যা ভারত মহাকাশে পাঠিয়েছে তার পুরোটাই দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করেছেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে মঙ্গলের কক্ষপথে একটি নভোযান রেখেছে ভারত। মেধার দিক থেকে আমরা যে খুব পিছিয়ে আছি তা নয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে তেমন বিনিয়োগ হচ্ছে না, অথচ ভারত শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রচুর বিনিয়োগ করছে। আমি সব সময় মনে করি আমরা যদি জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২৫ শতাংশ শিক্ষায় বিনিয়োগ করতাম, তাহলে বিজ্ঞান শিক্ষায় এমন অগ্রগতি দৃশ্যমান হতো যে, এক প্রজন্ম পরে আমাদের বিজ্ঞানীরাই নিজের ল্যাবরেটরিতে এ ধরনের উপগ্রহ তৈরি করে পৃথিবীর বা অন্য যে কোনো গ্রহের কক্ষপথে তা উৎক্ষেপণ করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারতেন। এ ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক গবেষণার প্রয়োজন, প্রায়োগিক গবেষণাও প্রয়োজন। সব ধরনের গবেষণাকেই বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
যুগান্তর : প্রতিবছর দেশের বিপুলসংখ্যক তরুণ যাতে গবেষণার জন্য বিদেশে যেতে পারে সেজন্য কী করণীয়?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : প্রতিবছর প্রচুর শিক্ষার্থী নিজেদের চেষ্টায় বিদেশে অধ্যয়ন করতে যাচ্ছে, সেখানে সরকার খুব বেশি সাহায্য করছে না। আমার মনে হয়, সরকার প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে তরুণদের প্রশিক্ষিত করে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করলে এর মাধ্যমে দেশ বিশেষভাবে উপকৃত হতো। বিদেশে অবস্থানরত অনেক তরুণ তাদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-গবেষণা শেষে দেশে ফিরতে আগ্রহী। এটি অত্যন্ত ভালো একটি প্রবণতা। তরুণদের আরও উৎসাহিত করার জন্য সরকারের উচিত হবে এসব তরুণকে দেশে ফিরিয়ে এনে যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে আরও প্রচুরসংখ্যক তরুণকে বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়ে প্রশিক্ষণ শেষে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনাও সরকারের দায়িত্ব। শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় অংকের বিনিয়োগ করা হলে উল্লিখিত কাজগুলো সহজেই সম্পন্ন করা সম্ভব।
যুগান্তর : অনেকে বলেন, শিশুদের ওপর বাড়তি বোঝা চাপানো হচ্ছে? তাদের যদি যোগ্য করে তোলা না হয়, তাহলে তারা আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে কী করে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিশুদের ওপর পাঠ্যক্রমের বড় বোঝা চাপিয়ে দেয়া কোনোক্রমেই উচিত নয়। আমি মনে করি, প্রাথমিকের শিক্ষা হতে হবে অত্যন্ত আনন্দদায়ক, শিক্ষা হবে জীবন কুশলতা শেখার সমান্তরাল একটি বিষয়। শিশুদের বেশি বিষয় পড়ানোর প্রয়োজন নেই। আমার মনে হয়, তাদের প্রধানত গণিত ও ভাষা এ দুই বিষয়ে শিক্ষা দেয়া উচিত। গণিত ও ভাষায় যদি একটি শিশু সুশিক্ষিত হতে পারে, তাহলে তার নিজেকে প্রকাশ করার সব রাস্তা খুলে যাবে, তার মেধা শক্তিশালী হবে। প্রতিটি মানব শিশুই মেধাবী হিসেবেই জন্ম নেয়। তার মেধার অপচয় হয় বা মেধাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি না বলেই কোনো কোনো শিশু তার মেধার প্রকাশ ঘটাতে পারে না। আমরা যদি প্রাথমিকে আনন্দঘন পরিবেশে পাঠদান শুরু করি- যেখানে শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য কার্যক্রম যেমন শিশুরা গান শিখতে পারবে, অভিনয় শিখতে পারবে, সুন্দর খেলার মাঠ থাকবে, সেখানে
শিশুরা খেলাধুলা করতে পারবে- যদি এরকম আনন্দঘন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে শিশুদের ওপর পাঠ্যক্রমের বোঝা চাপানোর প্রয়োজন নেই। বছরের নয় মাস তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে; তারা শুরু থেকেই শিখবে ভাষা ও গণিত; তারপর দেখা যাবে সমাজ, বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস- এসব বিষয় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তাদের আয়ত্তে চলে আসবে। যে শিশু গণিত আর ভাষা জানে, তার যে কোনো গ্রন্থ আয়ত্তে আনা কঠিন কিছু নয়। সে চিন্তাও করতে শিখবে, নিজেকে প্রকাশ করতেও শিখবে।
যুগান্তর : দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাত্ত্বিক বা প্রায়োগিক কোন ধরনের শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : সব ধরনের প্রায়োগিক শিক্ষার প্রতি আমাদের গুরুত্ব দেয়া উচিত। আমাদের একটা ধারণা আছে, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ বোধহয় খুব উচ্চ ধরনের শিক্ষা নয়। বিদেশে এমনটি লক্ষ্য করা যায় না। আমাদের এখানে লক্ষ্য করা যায়, যিনি তাঁত শিল্পে দক্ষতা অর্জন করলেন বা ওয়েল্ডিং শিখলেন তার তুলনায় যিনি দর্শন বা সাহিত্যের কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করলেন তাকে অনেক বেশি মূল্যবান বিবেচনা করা হয়। আমি মনে করি, সব বিষয়ের শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। যে কোনো বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিয়ে যে কেউ দেশের জন্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। বৃত্তিমূলক পেশার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে সাহিত্যের কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনকারীও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন।
প্রযুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানে গুরুত্ব বাড়ানো উচিত। আমাদের দেশে প্রচুর ডাক্তার প্রয়োজন, নার্সের প্রয়োজন। আমাদের দেশে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে বিএসসি ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই বৈষম্য দূর করা গেলে, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি নেতিবাচক ধারণা দূর করা গেলে প্রতিটি বিষয়েই বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আগ্রহ বাড়বে। তবে তাত্ত্বিক শিক্ষা ও গবেষণায় অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক এ দুই শিক্ষার সমন্বয় সাধন করতে হবে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : ধন্যবাদ।
No comments