পুলিশের অপহরণ বাণিজ্য- বর্ষার প্রেমের ফাঁদ by নুরুজ্জামান লাবু
সুন্দরী তরুণীর প্রেমের ফাঁদ। টার্গেট
ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কিংবা চাকরিজীবী। ফাঁদে ফেলে নিজের বা পরিচিত কোন ফ্ল্যাটে
ডেকে নিয়ে যায় প্রথমে। পরে কৌশলে খবর দেয়া হয় পুলিশকে। পুলিশ গিয়ে তাদের
আটক করে। গ্রেপ্তার কিংবা ঘটনা মিডিয়াতে ফাঁস করে দেয়ার ভয় দেখায় পুলিশ।
দাবি করে বিপুল অর্থ। গাড়িতে তুলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় রাতভর। চাহিদামতো অর্থ
পেলে ছেড়ে দেয়া হয়। রাজধানীর ভাটারা থানার কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা এই
চক্রের সঙ্গে জড়িত। শুক্রবার মধ্যরাতে এই চক্রের পাঁচ সদস্যকে আটক করেছে
র্যাব। এদের মধ্যে মীর সিরাজুল ইসলাম ও কায়সার আহমেদ ভাটারা থানার দুই
সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই)। আবদুর রহমান ভাটারা থানার কনস্টেবল ও
আসাদুজ্জামান ভাটারা থানার সিভিল গাড়িচালক। এছাড়া, আটক করা হয়েছে এই চক্রের
অন্যতম নারী সদস্য বর্ষাকে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় অপহৃত বেসরকারি
একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী শাহজাহান সামছুকে। শাহজাহানকে আটক করে এই
চক্রটি দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। পরিবারের লোকজন ঘটনাটি জানিয়ে
খিলক্ষেত থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং ১৩৪৯) করে। পরে বিষয়টি জানানো
হয় র্যাব-১ কর্মকর্তাদের। র্যাব ১-এর একটি অভিযানিক দল কুড়িল বিশ্বরোড
এলাকা থেকে শাহজাহানকে উদ্ধার করে। আটক করে তিন পুলিশসহ পাঁচজনকে। ঘটনাটি
জানানো হয় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের। পরে তাদের পুলিশে সোপর্দ করা হয়।
গতকাল ভোরে অপহৃত শাহজাহানের ভাগ্নে আবু জাফর বাদী হয়ে এই পাঁচ জনের
বিরুদ্ধে একটি মামলা (নং ২) দায়ের করেছেন।
মামলার বাদী আবু জাফর জানান, তার মামা শাহজাহান সামছু ফিলিপস বাংলাদেশ লিমিটেডে চাকরি করেন। থাকেন খিলক্ষেতের খাঁপাড়ার ক-৫৮/সি নম্বর বাসায়। শুক্রবার দুপুরে হঠাৎ তার মামা তাকে ফোন করেন। একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে দ্রুত তাতে দুই লাখ টাকা বিকাশ করে দিতে বলেন। জানান তিনি বিপদে আছেন। তারা দ্রুত দুই লাখ টাকা যোগাড়ের চেষ্টা করেন। টাকা যোগাড় করতে দেরি হলে আবারও ফোন করেন তিনি। এবার তিনি বলেন- অন্তত ১ লাখ টাকা বিকাশ করতে। বিষয়টিতে পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ হয়। তারা আঁচ করেন শাহজাহানকে অপহরণ করা হয়েছে। এ জন্য তারা দ্রুত ছুটে যান খিলক্ষেত থানায়। থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি দায়ের করেন। সেই জিডির কপি নিয়ে ছুটে যান র্যাব-১ সদর দপ্তরে। স্বজন ও র্যাব সূত্র জানায়, সন্ধ্যায় র্যাব ১-এর একটি দল অপহরণকারীদের ফোনে আড়ি পাতে। পরে অপহরণকারী চক্রের কাছে স্বজন সেজে কথা বলে র্যাব সদস্যরা। ৫০ হাজার টাকা হাতে হাতে দেয়ার কথা বলে। অপহরণকারীরা রাজি হয়। যেতে বলে কুড়িল প্রগতি সরণি এলাকায়। সেখানে গিয়ে ছদ্মবেশী র্যাব সদস্যরা দেখতে পায় একটি মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো চ-৫১-৪৫৯৬) দাঁড়িয়ে আছে। মাইক্রোবাসটি ঘেরাও করলে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে পুলিশের পোশাক পরা এক ব্যক্তি। এরপর বেরিয়ে আসে শুধু পুলিশের শার্ট গায়ে দেয়া আরেক ব্যক্তি। গাড়িচালকসহ অপর দুই জন সিভিল পোশাকের। সঙ্গে একটি মেয়ে। আর মাইক্রোবাসের ভেতরে বসা ভিকটিম শাহজাহান সামছু। র্যাব কর্মকর্তাদের জানায় তারা পুলিশের লোকজন। ভাটারা থানায় কর্মরত। র্যাব কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক বিষয়টি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের জানান। ঘটনাস্থলে ছুটে যান থানার ওসি সরোয়ার হোসেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তিন পুলিশসহ পাঁচ জনকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। পরে রাতেই থানায় একটি মামলা দায়ের করেন অপহৃত শাহজাহানের ভাগ্নে আবু জাফর। ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গতকাল তাদের আদালতে পাঠানো হয়। রিমান্ড আবেদন না করায় আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। র্যাব ১-এর সিও তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ বলেন, আমাদের কাছে অপহৃত এক ব্যক্তির স্বজনরা জিডির কপি নিয়ে এসেছিল। আমরা অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার ও ভিকটিমকে উদ্ধারে অভিযান শুরু করি। ভিকটিম উদ্ধার করে পাঁচ জনকে আটকের পর জানতে পারি তারা পুলিশের সদস্য। পরে বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়।
সূত্র জানায়, এই চক্রটি এর আগেও একাধিক ব্যক্তিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দিয়েছে। এই তিন পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি ভাটারা থানার আরও কয়েক পুলিশ কর্মকর্তা এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। বিষয়টি ওসি সরোয়ার হোসেন ও পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাজিরুর রহমানও জানেন বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে। মুক্তিপণের টাকার একটি অংশ তারাও নেন। কোন ঝামেলা হলে তারা চক্রের সদস্য পুলিশ কর্মকর্তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন। সূত্র আরও জানায়, শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত স্পেশাল ডিউটিতে ছিলেন দুই এএসআই মীর সিরাজুল ইসলাম ও কায়সার আহমেদ। থানায় সিভিল টিম বন্ধ থাকলেও সিভিল টিমের মতোই কাজ করেন তারা। পরিকল্পনামতো তারা শুক্রবার দুপুরে বর্ষাকে দিয়ে শাহজাহান সামছুকে ডেকে নিয়ে যান। সে সামছুকে নিয়ে যায় পূর্ব ভাটারার সাঈদনগরের ২৫১২ দাগের লিটন মিয়ার বাড়ির চতুর্থ তলায়। ওই ফ্ল্যাটে ঢোকার পরপরই আগে থেকেই ওত পেতে থাকা পুলিশ সদস্য অভিযান চালায়। পরে দিনভর তাকে ওই ফ্ল্যাটে আটকে রাখা হয়। তোলা হয় আপত্তিকর ছবি। ওই ছবি ফাঁস ও গ্রেপ্তার এবং মিডিয়াতে জানানোর ভয় দেখিয়ে দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়। এ নিয়ে দিনভর দেন-দরবার চলে। রাতে গাড়িতে তুলে নিয়ে বের হয় পুলিশ সদস্যরা। পুলিশের গাড়িতে ছিল বর্ষাও। এর আগে এএসআই মীর সিরাজুল ইসলাম বাড্ডার নূরের চালা বাজারে গিয়ে নূরজাহান টেলিকম নামে একটি দোকানে গিয়ে তার বিকাশ নম্বরটি নেয়। বিকাশ নম্বরে লক্ষাধিক টাকা আসবে বলে জানিয়ে যায়। নুরজাহান টেলিকমের স্বত্বাধিকারী সোলায়মান মোবাইলে এই প্রতিবেদকের কাছে সব স্বীকার করেন। তিনি বলেন- পোশাক পরা অবস্থায় ওই পুলিশ সদস্য এসেছিল। বিকাশ নম্বরে টাকা আসবে বলে জানিয়ে চলে গেছে। আর আসেনি।
এদিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণের পর অর্থ আদায়ের ঘটনায় খোদ পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলেও তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চাননি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান। এ বিষয়ে তিনি কোন তথ্য দিতেও রাজি হননি। মামলায় পুলিশ অপহরণের কাজে ব্যবহৃত সেই গাড়িটিও জব্দ দেখায়নি। সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃত পুলিশ সদস্যদের বাঁচাতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভুল তথ্য দিচ্ছেন থানার ওসি ও পরিদর্শক (তদন্ত)। তবে পুলিশের গুলশান জোনের ডিসি লুৎফুল কবীর জানান, গ্রেপ্তারের পর তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে এডিসি গুলশান মাহবুব হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
No comments