ব্ল্যাকআউট- স্মরণকালের ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয়
সকাল সাড়ে ১১টায় একসঙ্গে বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে সারা দেশ। দিনভর অপেক্ষার পর সন্ধ্যায়ও কোন সুখবর মিলেনি। অন্ধকারে তলিয়ে যায় পুরো দেশ। ভুতুড়ে পরিবেশ ঢাকার রাজপথে। জ্বলেনি সড়ক বাতি। থুবড়ে পড়ে কল-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকে গুরুত্বপূর্ণ সব সেবা। নগরজীবনে দেখা দেয় পানি ও গ্যাসের সঙ্কট। হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাতে দেখা যায় ভুতুড়ে পরিবেশ। স্মরণকালের নজিরবিহীন বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পেছনে ভারত থেকে আনা বিদ্যুতের লাইন বসে যাওয়ার কথা জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওই লাইনে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় প্রথম দফায় কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় অবস্থিত সঞ্চালন লাইন বসে যাওয়ায় বিপর্যয়ের শুরু। এরপর একে একে সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সচলের কথা বললেও বিকালে আবারও জাতীয় গ্রিডে ট্রিপ করায় বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে সারা দেশ। এদিকে সঞ্চালন লাইন সচল করার চেষ্টা করা হলেও রাত ১০টায় কিছু এলাকা ছাড়া সারা দেশই বিদ্যুৎবিহীন ছিল। জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় দেখা দেয়ায় রাজধানীর অতিগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, বঙ্গভবন, গণভবনেও বিদ্যুৎ ছিল না। এ সব স্থাপনায় বিকল্প ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। ভারত থেকে আনা গ্রিডে সমস্যার কারণে ভয়াবহ এ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বলছে তাদের কোন সমস্যার কারণে এ ঘটনা ঘটেনি। লাইনে ট্রিপ করা স্বাভাবিক বিষয়। এদিকে দিনভর বিদ্যুৎ না থাকায় মোমবাতি, ডিজেল ও কেরোসিন জ্বালিয়ে অনেকে নিত্যদিনের কাজ করেছেন। বিদ্যুৎ না থাকায় টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবারও মারাত্মক বিঘ্ন ঘটে। রাতে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, আমরা দ্রুত রিকভারি করতে গিয়েছিলাম। ৭০০ পর্যন্ত রিকভার করেছিলামও। এর মধ্যেই গ্রিড আবার ফেল করে। দ্রুত এগোনোয় সমস্যা হয়েছে। এখন আমরা ধীরে এগোচ্ছি। ঢাকাতে আমরা বন্ধ রেখেছি। আমরা বাইরের সাইড থেকে চালু করে করে আসছি। এখন আর মিস করা যাবে না। বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে সময় লাগার কারণে দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার হোসেন। এদিকে পিজিসিবির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণ নিরূপণ, দায়দায়িত্ব নির্ধারণ এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অনাকাঙিক্ষত বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) এর নেতৃত্বে ৭ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে আগামী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে সচিব, বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। পিডিবি সূত্র জানায়, গতকাল সারাদেশে ৬৬০০ মেগাওয়াট চাহিদা থাকলেও বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এদিকে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে গতকাল সন্ধ্যা থেকে দোকানে দোকানে মোমবাতি ও কেরোসিন কিনতে মানুষের ভিড় দেখা যায়। পাড়া-মহল্লার অনেক দোকানে শেষতক মোমবাতিও পাওয়া যায়নি। বিদ্যুৎ না থাকায় যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে জ্বালানি সঙ্কটের কারণে।
এদিকে একটি সাব-স্টেশনের কারণে পুরো দেশের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনায় পেছনে নিম্নমানের যন্ত্রপাতিকে দায়ী করেছেন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ। গতকাল তিনি মানবজমিনকে বলেন, ভারত থেকে পর্যাপ্ত ভোল্টেজ না পাওয়া জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে না। সার্কিট ব্রেকারের মান ঠিক থাকলে একটি সাব-স্টেশন বিকল হলেও বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সচল থাকার কথা। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে জাতীয় গ্রিড ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল-বেরুনি জানান, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ন্যাশনাল গ্রিড অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে আশুগঞ্জের ৬টি কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পর্যায়ক্রমে দেশের সব ক’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। বিকাল ৫টা নাগাদ বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করার আশ্বাস দিলেও রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কাজে নিয়োজিত ৫০০ মেগাওয়াট হাই ভোল্টেজ ব্যাক টু ব্যাক ভেড়ামারাস্থ সাব-স্টেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আলমগীর হোসেন বলেন, সকাল থেকেই স্বাভাবিক অবস্থায় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ১১টা ২৭ মিনিট ২৮ সেকেন্ডে ভেড়ামারা সাব স্টেশনে কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয়। এ সময় লাইন বিকল হয়ে পড়ে। সারা দেশের সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রও একযোগে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জাতীয় গ্রিড লাইন ফেল করে। বারবার চেষ্টা করা করেও জাতীয় গ্রিডে সংযোগ স্থাপন করতে পারিনি। তবে একটি সূত্র জানায়, ভারতের বহরমপুর থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। ওই স্টেশন থেকে বাংলাদেশে ২৩০ কিলোভোল্টে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ গ্রহণ করে। কিন্তু আজ উপযুক্ত ভোল্টেজ না পাওয়ায় ভেড়ামারা সাব-স্টেশনের লাইন ট্রিপ করে। ফলে জাতীয় গ্রিডে এর প্রভাব পড়ে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারতের সরকারি খাত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ দেশের জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন শুরু হয়। কুষ্টিয়ার ভেড়মারা গ্রিড উপকেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে আসে। পরে দু’দেশের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ আমদানি ৫০০ মেগাওয়াটে পৌঁছায়। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারে দু’দেশের মধ্যে আলোচনা হয়। পরে এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে ২৫ বছরের চুক্তি হয়। এই আমদানি চুক্তি কার্যকর করতে বাংলাদেশের ভেড়ামারা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে সুইচ স্টেশন স্থাপন করা হয়। একইসঙ্গে দুই দেশের জাতীয় গ্রিড লাইনের সংযোগের জন্য বসানো হয় ৯৮ কি.মি. সঞ্চালন লাইন। ওই বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে সমস্যা দেখা দেয়ায় সারা দেশ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এতে দেশের পাওয়ার স্টেশনগুলো একসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। পিডিবির পরিচালক (জনসংযোগ) সাইফুল ইসলাম জানান, বিদ্যুৎ চালু করতে গেলে একটা একটা করে স্টেশন চালু করতে হয়। বিকালের মধ্যেই কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়ে যায়। এরপর সিলেট ও ময়মনসিংহ চালু হয়। এদিকে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ না থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নয়টি ইউনিটের উৎপাদন। আমাদের আশুগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গ্রিড লাইনে ক্রটির কারণে শনিবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবগুলো ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে ১ হাজার ৭ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আশুগঞ্জের সরকারি ৯টি ও বেসরকারি ৪টিসহ মোট ১৩টি ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিচালক কারিগরি প্রকৌশলী সাজ্জাদুর রহমান জানান, গ্রিড লাইনের ত্রুটির কারণে আশুগঞ্জের সবগুলো ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কোথায় ত্রুটি তা বুঝা যায়নি। বিকল্প ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়েছে। বন্ধ ইউনিটগুলো প্রতিটি ৬৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১নং, ২নং ইউনিট, প্রতিটি ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩, ৪ ও ৫নং ইউনিট, প্রতিটি ৫৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জিটি-১, জিটি-২ ইউনিট, ৩৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এসটি ইউনিট, ৫০ মেগাওয়াটের গ্যাস টারবাইন, বেসরকারি ৫৫ মেগাওয়াটের ইউনাইটেড পাওয়ার, ৫০ মেগাওয়াটের পিসিশন এনার্জি, ৫৫ মেগাওয়াটের মিডলেন্ড পাওয়ার লি., ৮০ মেগাওয়াটের এগ্রিকো পাওয়ার এর উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ থেকে জানান, জাতীয় গ্রিড লাইনে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ফলে বৃহত্তর ময়মনসিংহের ৬টি জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বিকালে বিশেষ ব্যবস্থায় ময়মনসিংহ শহরে আংশিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। ময়মনসিংহ কেওয়াটখালী পাওয়ার গ্রিডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক কুমার নন্দী জানান, শনিবার দুপুর ১২টার পর জাতীয় গ্রিড লাইনে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্য়য় ঘটনার ৪০ মিনিট পর শম্ভুগঞ্জের রুরাল পাওয়ার কোম্পানি থেকে ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় ময়মনসিংহ শহরে আংশিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার বাকি ১২টি উপজেলায় এখনও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। সারা দেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। শনিবার দুপুরে সারা দেশ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে রামপুরায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, সারা দেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের জন্য আমরা দুঃখিত। একটা সিস্টেমে ট্রিপ করে যাওয়াতে সেই চাপ সহ্য করতে পারেনি বাকিগুলো। ফলে বাকিগুলো ট্রিপ করে। এ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। এ রকমটা কখনও কখনও হতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়। নিউ ইয়র্কেও কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ ছিল না। প্রতিমন্ত্রী বলেন, জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের কাজ করা হচ্ছে। জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করার মতো আমাদের প্রযুক্তি আছে।
আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ভারতের বহরমপুর ও বাংলাদেশের ভেড়ামারার মধ্যে চালু বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের বাংলাদেশের দিকে সাব-স্টেশনে লাইন বসে যাওয়ার জন্যই বিপর্যয় ঘটেছে। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের সাব-স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ভারতের দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনও ত্রুটি ঘটেনি। ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাঠানো হয় দু’টি লাইনে। এর মধ্যে একটি লাইন এদিন সচল থাকলেও অন্য লাইনটিতে বাংলাদেশের দিকে বসে গেছে বলে তাদের কাছে খবর এসেছে। তবে এটা কোনও অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। বিদ্যুৎ লাইনে সরবরাহে কোন ত্রুটি হলেই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে লাইন বসে (ট্রিপ) যায়। এটি নিরাপত্তা ব্যবস্থারই অঙ্গ বলে জানানো হয়েছে।
রাজধানীতে পানি সঙ্কট
দেশের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে রাজধানীতে পানি সঙ্কট দেখা দেয় বিকাল থেকে। লালবাগের স্থানীয় বাসিন্দা আতিকুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় সকাল থেকেই অনেকের বাসায় পানির সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাসা-বাড়িতে রিজার্ভ ট্যাঙ্কি না থাকায় হাউজ থেকেও পানি সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে রান্না করতে তাদের ব্যাপক সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। এদিকে, পুরান ঢাকায় পানি সরবরাহকারী ওয়াসার পাম্পগুলো বন্ধ দেখা গেছে। এ কারণে বিভিন্ন এলাকায় ওয়াসার নিজস্ব পাম্প থেকে পানি সংগ্রহ করতে ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। আজিমপুর কলোনি, ঢাকেশ্বরী, ইসলামবাগের চান্দিঘাট এলাকার ওয়াসার পাম্প বন্ধ দেখা গেছে। এসব পাম্পের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্য দিন সব মিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা পাম্প চালু থাকে, কিন্তু গতকাল সাড়ে ৯টা থেকেই বন্ধ। পানির সমস্যা সমাধানে স্থানীয় ওয়াসার পদক্ষেপ জানতে যোগাযোগ করলে মডস জোন-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইমদাদুল হক কথা বলতে রাজি হননি। যদিও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে বিকল্প ব্যবস্থায় তাদের পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।
বিদেশী মিডিয়ায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিপর্যয়
বড় আকারের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে সংযোগকারী বিদ্যুৎ লাইন বিকল হয়ে গেলে গতকাল এ বিপত্তি ঘটে। স্থানীয় সময় আনুমানিক ১২টার দিকে শুরু হয় এ বিদ্যুৎ বিভ্রাট। এতে বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে পুরো দেশ। স্থবির হয়ে পড়ে জীবনযাত্রা। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবদেনে বলা হয়, বিদ্যুৎ সংযোগ কখন ফিরতে পারে সে ব্যাপারে মিশ্র ইঙ্গিত দিচ্ছেন বাংলাদেশী কর্মকর্তারা। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নাসরুল হামিদ বিপু বলেন, গতকাল দিনের শেষে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করার চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। বিদ্যুৎ কখন ফিরবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। রয়টার্সকে তিনি বলেন, ৫০০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে ৪০০ মেগাওয়াটে। এদিকে ভারতের বিদ্যুৎ গ্রিড কর্পোরেশনের হেড অব অপারেশন আর. পি শাসমল বলেন, তাদের দিকে কোন সমস্য নেই। ‘তিনি বলেন, আমাদের লাইন ঠিক আছে। সরবরাহ লাইন আছে দু’টি। একটি লাইনে এখনও সংযোগ রয়েছে। আর আরেকটি লাইনে বাংলাদেশ উপকেন্দ্র থেকে আমরা ‘ট্রিপ কমান্ড’ পেয়েছি। এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হয়, এটা নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলোর একটি।’ রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ গ্রিড প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল বেরুনি বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, কারিগরি ত্রুটির কারণে সৃষ্টি হয় ওই ব্ল্যাকআউট। কিন্তু তিনি কারণ ব্যাখ্যা করেননি। শক্তিশালী জেনারেটর ব্যবহার করে দেশের কয়েকটি স্থানে বিদ্যুৎ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। গতকাল সন্ধ্যার মধ্যে রাজধানী ঢাকায় বিদ্যুৎ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি জানান- দেশের কয়েকটি স্থানে বিদ্যুৎ চালু হয়েছে। তবে দেশের কোন কোন স্থানে তা বিস্তারিত বলেননি। তিনি বলেন, ঢাকাতে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সকল উপকেন্দ্রগুলো চালু করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব শহরে বিদ্যুৎ ফিরবে। ঢাকার হাসপাতালগুলো ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর জরুরি জেনারেটরের সাহায্যে তাদের কর্মকা- পরিচালনা করে। বেরুনির এক সহযোগী জানান, কারিগরি কর্মীরা ভারতের সঙ্গে সংযোগ লাইন নতুন করে চালু করারও চেষ্টা করছেন। মীর মোতাহার হোসেন বলেন, আমাদের কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। সব জায়গাতে না হলেও বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ চালু করার বিষয়ে আমরা আশাবাদী। গত বছর অক্টোবর মাস থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। গতকালের এ বিরাট বিপর্যয়ের প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে বাংলাদেশ জাতীয় গ্রিডের প্রধান চৌধুরী আলমগীর হোসেইন বলেছেন, ভারত থেকে আসা বিদ্যুৎ সরবরাহকারী একটি সাবস্টেশনে কারিগরি ত্রুটির কারণে এ বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে। আর একারণেই একের পর এক বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র। উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনটি পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা কুষ্টিয়ার ভেরামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সংযোগ স্থাপন করেছে। ভারত ছাড়াও বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশ জাপান, চীন, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশের সাড়ে ষোল কোটির অধিক জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষই বিদ্যুৎ সংযোগের বাইরে। বাংলাদেশে লোডশেডিং সাধারণ একটি ব্যাপার। তারপরও বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে অকার্যকর গ্রিড অবকাঠামো আর দুর্বল ব্যবস্থাপনা। গতকালের দেশব্যাপী ব্যাপক বিদ্যুৎ বিপর্যয় ২০০৭ এর পর সব থেকে বড় বিপর্যয়। সেবার শক্তিশালী সাইক্লোনের আঘাতে কয়েক ঘণ্টা বিকল ছিল জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিড।
এদিকে একটি সাব-স্টেশনের কারণে পুরো দেশের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনায় পেছনে নিম্নমানের যন্ত্রপাতিকে দায়ী করেছেন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ। গতকাল তিনি মানবজমিনকে বলেন, ভারত থেকে পর্যাপ্ত ভোল্টেজ না পাওয়া জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে না। সার্কিট ব্রেকারের মান ঠিক থাকলে একটি সাব-স্টেশন বিকল হলেও বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সচল থাকার কথা। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে জাতীয় গ্রিড ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল-বেরুনি জানান, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ন্যাশনাল গ্রিড অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে আশুগঞ্জের ৬টি কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পর্যায়ক্রমে দেশের সব ক’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। বিকাল ৫টা নাগাদ বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করার আশ্বাস দিলেও রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কাজে নিয়োজিত ৫০০ মেগাওয়াট হাই ভোল্টেজ ব্যাক টু ব্যাক ভেড়ামারাস্থ সাব-স্টেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আলমগীর হোসেন বলেন, সকাল থেকেই স্বাভাবিক অবস্থায় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ১১টা ২৭ মিনিট ২৮ সেকেন্ডে ভেড়ামারা সাব স্টেশনে কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয়। এ সময় লাইন বিকল হয়ে পড়ে। সারা দেশের সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রও একযোগে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জাতীয় গ্রিড লাইন ফেল করে। বারবার চেষ্টা করা করেও জাতীয় গ্রিডে সংযোগ স্থাপন করতে পারিনি। তবে একটি সূত্র জানায়, ভারতের বহরমপুর থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। ওই স্টেশন থেকে বাংলাদেশে ২৩০ কিলোভোল্টে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ গ্রহণ করে। কিন্তু আজ উপযুক্ত ভোল্টেজ না পাওয়ায় ভেড়ামারা সাব-স্টেশনের লাইন ট্রিপ করে। ফলে জাতীয় গ্রিডে এর প্রভাব পড়ে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৭শে সেপ্টেম্বর ভারতের সরকারি খাত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ দেশের জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন শুরু হয়। কুষ্টিয়ার ভেড়মারা গ্রিড উপকেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে আসে। পরে দু’দেশের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ আমদানি ৫০০ মেগাওয়াটে পৌঁছায়। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারে দু’দেশের মধ্যে আলোচনা হয়। পরে এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে ২৫ বছরের চুক্তি হয়। এই আমদানি চুক্তি কার্যকর করতে বাংলাদেশের ভেড়ামারা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে সুইচ স্টেশন স্থাপন করা হয়। একইসঙ্গে দুই দেশের জাতীয় গ্রিড লাইনের সংযোগের জন্য বসানো হয় ৯৮ কি.মি. সঞ্চালন লাইন। ওই বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে সমস্যা দেখা দেয়ায় সারা দেশ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এতে দেশের পাওয়ার স্টেশনগুলো একসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। পিডিবির পরিচালক (জনসংযোগ) সাইফুল ইসলাম জানান, বিদ্যুৎ চালু করতে গেলে একটা একটা করে স্টেশন চালু করতে হয়। বিকালের মধ্যেই কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়ে যায়। এরপর সিলেট ও ময়মনসিংহ চালু হয়। এদিকে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ না থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নয়টি ইউনিটের উৎপাদন। আমাদের আশুগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গ্রিড লাইনে ক্রটির কারণে শনিবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবগুলো ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে ১ হাজার ৭ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আশুগঞ্জের সরকারি ৯টি ও বেসরকারি ৪টিসহ মোট ১৩টি ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিচালক কারিগরি প্রকৌশলী সাজ্জাদুর রহমান জানান, গ্রিড লাইনের ত্রুটির কারণে আশুগঞ্জের সবগুলো ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কোথায় ত্রুটি তা বুঝা যায়নি। বিকল্প ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়েছে। বন্ধ ইউনিটগুলো প্রতিটি ৬৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১নং, ২নং ইউনিট, প্রতিটি ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩, ৪ ও ৫নং ইউনিট, প্রতিটি ৫৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জিটি-১, জিটি-২ ইউনিট, ৩৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এসটি ইউনিট, ৫০ মেগাওয়াটের গ্যাস টারবাইন, বেসরকারি ৫৫ মেগাওয়াটের ইউনাইটেড পাওয়ার, ৫০ মেগাওয়াটের পিসিশন এনার্জি, ৫৫ মেগাওয়াটের মিডলেন্ড পাওয়ার লি., ৮০ মেগাওয়াটের এগ্রিকো পাওয়ার এর উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ থেকে জানান, জাতীয় গ্রিড লাইনে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ফলে বৃহত্তর ময়মনসিংহের ৬টি জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বিকালে বিশেষ ব্যবস্থায় ময়মনসিংহ শহরে আংশিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। ময়মনসিংহ কেওয়াটখালী পাওয়ার গ্রিডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক কুমার নন্দী জানান, শনিবার দুপুর ১২টার পর জাতীয় গ্রিড লাইনে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্য়য় ঘটনার ৪০ মিনিট পর শম্ভুগঞ্জের রুরাল পাওয়ার কোম্পানি থেকে ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় ময়মনসিংহ শহরে আংশিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার বাকি ১২টি উপজেলায় এখনও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। সারা দেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। শনিবার দুপুরে সারা দেশ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে রামপুরায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, সারা দেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের জন্য আমরা দুঃখিত। একটা সিস্টেমে ট্রিপ করে যাওয়াতে সেই চাপ সহ্য করতে পারেনি বাকিগুলো। ফলে বাকিগুলো ট্রিপ করে। এ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। এ রকমটা কখনও কখনও হতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়। নিউ ইয়র্কেও কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ ছিল না। প্রতিমন্ত্রী বলেন, জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের কাজ করা হচ্ছে। জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করার মতো আমাদের প্রযুক্তি আছে।
আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ভারতের বহরমপুর ও বাংলাদেশের ভেড়ামারার মধ্যে চালু বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের বাংলাদেশের দিকে সাব-স্টেশনে লাইন বসে যাওয়ার জন্যই বিপর্যয় ঘটেছে। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের সাব-স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ভারতের দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনও ত্রুটি ঘটেনি। ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাঠানো হয় দু’টি লাইনে। এর মধ্যে একটি লাইন এদিন সচল থাকলেও অন্য লাইনটিতে বাংলাদেশের দিকে বসে গেছে বলে তাদের কাছে খবর এসেছে। তবে এটা কোনও অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। বিদ্যুৎ লাইনে সরবরাহে কোন ত্রুটি হলেই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে লাইন বসে (ট্রিপ) যায়। এটি নিরাপত্তা ব্যবস্থারই অঙ্গ বলে জানানো হয়েছে।
রাজধানীতে পানি সঙ্কট
দেশের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে রাজধানীতে পানি সঙ্কট দেখা দেয় বিকাল থেকে। লালবাগের স্থানীয় বাসিন্দা আতিকুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় সকাল থেকেই অনেকের বাসায় পানির সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাসা-বাড়িতে রিজার্ভ ট্যাঙ্কি না থাকায় হাউজ থেকেও পানি সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে রান্না করতে তাদের ব্যাপক সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। এদিকে, পুরান ঢাকায় পানি সরবরাহকারী ওয়াসার পাম্পগুলো বন্ধ দেখা গেছে। এ কারণে বিভিন্ন এলাকায় ওয়াসার নিজস্ব পাম্প থেকে পানি সংগ্রহ করতে ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। আজিমপুর কলোনি, ঢাকেশ্বরী, ইসলামবাগের চান্দিঘাট এলাকার ওয়াসার পাম্প বন্ধ দেখা গেছে। এসব পাম্পের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্য দিন সব মিলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা পাম্প চালু থাকে, কিন্তু গতকাল সাড়ে ৯টা থেকেই বন্ধ। পানির সমস্যা সমাধানে স্থানীয় ওয়াসার পদক্ষেপ জানতে যোগাযোগ করলে মডস জোন-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইমদাদুল হক কথা বলতে রাজি হননি। যদিও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে বিকল্প ব্যবস্থায় তাদের পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।
বিদেশী মিডিয়ায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিপর্যয়
বড় আকারের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে সংযোগকারী বিদ্যুৎ লাইন বিকল হয়ে গেলে গতকাল এ বিপত্তি ঘটে। স্থানীয় সময় আনুমানিক ১২টার দিকে শুরু হয় এ বিদ্যুৎ বিভ্রাট। এতে বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে পুরো দেশ। স্থবির হয়ে পড়ে জীবনযাত্রা। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবদেনে বলা হয়, বিদ্যুৎ সংযোগ কখন ফিরতে পারে সে ব্যাপারে মিশ্র ইঙ্গিত দিচ্ছেন বাংলাদেশী কর্মকর্তারা। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নাসরুল হামিদ বিপু বলেন, গতকাল দিনের শেষে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করার চেষ্টা বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। বিদ্যুৎ কখন ফিরবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। রয়টার্সকে তিনি বলেন, ৫০০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে ৪০০ মেগাওয়াটে। এদিকে ভারতের বিদ্যুৎ গ্রিড কর্পোরেশনের হেড অব অপারেশন আর. পি শাসমল বলেন, তাদের দিকে কোন সমস্য নেই। ‘তিনি বলেন, আমাদের লাইন ঠিক আছে। সরবরাহ লাইন আছে দু’টি। একটি লাইনে এখনও সংযোগ রয়েছে। আর আরেকটি লাইনে বাংলাদেশ উপকেন্দ্র থেকে আমরা ‘ট্রিপ কমান্ড’ পেয়েছি। এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হয়, এটা নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলোর একটি।’ রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ গ্রিড প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল বেরুনি বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, কারিগরি ত্রুটির কারণে সৃষ্টি হয় ওই ব্ল্যাকআউট। কিন্তু তিনি কারণ ব্যাখ্যা করেননি। শক্তিশালী জেনারেটর ব্যবহার করে দেশের কয়েকটি স্থানে বিদ্যুৎ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। গতকাল সন্ধ্যার মধ্যে রাজধানী ঢাকায় বিদ্যুৎ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি জানান- দেশের কয়েকটি স্থানে বিদ্যুৎ চালু হয়েছে। তবে দেশের কোন কোন স্থানে তা বিস্তারিত বলেননি। তিনি বলেন, ঢাকাতে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সকল উপকেন্দ্রগুলো চালু করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব শহরে বিদ্যুৎ ফিরবে। ঢাকার হাসপাতালগুলো ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর জরুরি জেনারেটরের সাহায্যে তাদের কর্মকা- পরিচালনা করে। বেরুনির এক সহযোগী জানান, কারিগরি কর্মীরা ভারতের সঙ্গে সংযোগ লাইন নতুন করে চালু করারও চেষ্টা করছেন। মীর মোতাহার হোসেন বলেন, আমাদের কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। সব জায়গাতে না হলেও বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ চালু করার বিষয়ে আমরা আশাবাদী। গত বছর অক্টোবর মাস থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। গতকালের এ বিরাট বিপর্যয়ের প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে বাংলাদেশ জাতীয় গ্রিডের প্রধান চৌধুরী আলমগীর হোসেইন বলেছেন, ভারত থেকে আসা বিদ্যুৎ সরবরাহকারী একটি সাবস্টেশনে কারিগরি ত্রুটির কারণে এ বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে। আর একারণেই একের পর এক বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র। উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনটি পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা কুষ্টিয়ার ভেরামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সংযোগ স্থাপন করেছে। ভারত ছাড়াও বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশ জাপান, চীন, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশের সাড়ে ষোল কোটির অধিক জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষই বিদ্যুৎ সংযোগের বাইরে। বাংলাদেশে লোডশেডিং সাধারণ একটি ব্যাপার। তারপরও বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে অকার্যকর গ্রিড অবকাঠামো আর দুর্বল ব্যবস্থাপনা। গতকালের দেশব্যাপী ব্যাপক বিদ্যুৎ বিপর্যয় ২০০৭ এর পর সব থেকে বড় বিপর্যয়। সেবার শক্তিশালী সাইক্লোনের আঘাতে কয়েক ঘণ্টা বিকল ছিল জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিড।
No comments