প্রসঙ্গ ইসলাম- ইসালে সওয়াব মহফিল- অধ্যাপক by হাসান আবদুল কাইয়ূম
ইসালে সওয়াব মহফিল বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। ইসালে সওয়াব মহফিলের অর্থ সওয়াব পৌঁছানোর মহফিল। বাংলাদেশে হেমন্ত, শীত, বসন্তু ঋতুতে ইসালে সওয়াব মহফিলের আয়োজন করা হয়।
সাধারণত বছরে একবার বিভিন্ন পীর সাহেবের খান্্কা শরীফে এই মহফিল অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও কোথাও তিন দিনব্যাপী ইসালে সওয়াব মহফিলের আয়োজন করা হয়। এর কর্মসূচীতে রাতব্যাপী ওয়াজ মহফিলও যোগ করা হয়। এ ছাড়া কোথাও কোথাও উরস নামে অনুষ্ঠিত হয় এক ধরনের জলসা। আমাদের দেশে এক ধরনের ফকীর মাযারভিত্তিক এই উরসের আয়োজন করে যার অধিকাংশ র্শ্কি বিদ’আত, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে ভরপুর। সেই সব উরস নামের সমাবেশে সওয়াব প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে না। তবে কিছু কিছু র্উ্স আছে যেগুলোতে ফায়দা আছে। আজমীর শরীফে ৬ রজব হযরত গরীবে নওয়াজ সুলতানুল হিন্দ খাজায়ে খাজেগান খাজা মঈনুদ্দীন হাসান সঞ্জরী চিশ্্তী রহমাতুল্লাহি ‘আল্লায়হির স্মরণে অনুষ্ঠিত হয় উরস মুবারক। বাংলাদেশে যশোরের খড়কী শরীফে ১৬ চৈত্র মুতাবিক ৩০ মার্চ তারিখে যে র্উ্স মুবারক অনুষ্ঠিত হয় তাতে যোগদান করে প্রচুর ফায়দা হাসিল করা যায়। এই উরস ১৮৯১ খৃস্টাব্দে কায়েম করেন বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম নির্ভরযোগ্য তাসাওউফ গ্রন্থ এরশাদে খালেফীয়া বা খোদা প্রাপ্তি তত্ত্বের রচয়িতা হযরত মওলানা শাহ্্ সূফী মোহাম্মদ আবদুল করিম রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি। এই গ্রন্থ সম্পর্কে প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান ও প্রফেসর মুহুম্মদ আবদুল হাইয়ের যৌথ গ্রন্থনায় গ্রন্থিত বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত গ্রন্থের ইসলামী সাহিত্য পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, আবদুল করিম ছিলেন নক্্শবন্দীয়া তরিকার একজন কামিল সূফী সাধক, নিজের জীবনে সূফীতত্ত্বের আমল করেছিলেন বলে দুরূহ সূফীতত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। প্রথম থেকে চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি তাসাওয়াফের জটিল দার্শনিক তত্ত্বের মনোজ্ঞ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এবং পঞ্চম থেকে নবম অধ্যায়ে সূফী সাধনার নকশবন্দীয়া, কাদেরিয়া এবং চিশতিয়া তরিকার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। দশম বা শেষ অধ্যায়ে তিনি বেদ, পুরাণাদিতে প্রচলিত দার্শনিক বিষয়বস্তুর তত্ত্ব উদ্ঘাটন করে ইসলামী সূফী মতবাদের সঙ্গে তার একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। মোহাম্মাদ আবদুল করিমের খোদা প্রাপ্তি তত্ত্বের মতো বাংলায় তাসাওয়াফ সম্পর্কিত বই আর দ্বিতীয়টি দেখা যায় না। (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৫৩)।এই গ্রন্থে উপযুক্ত পীরের লক্ষণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘পীরকে লোভশূন্য হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। লোভী ব্যক্তিকে ফকির জ্ঞান করিতে হইবে না এবং ফকির কখনও ঢং করিয়া অর্থোপার্জনের জন্য বুজুর্গী করিয়া বেড়ায় না। তাঁহারা সততই গুপ্ত থাকিতে চেষ্টা পান, প্রকাশ হওয়াকে ভালোবাসেন না। ... যাহার কোনো রিপু বলবৎ আছে, তাহাকে সিদ্ধ ফকির বলিয়া জানিতে হইবে না। ... তাহাদের মিষ্ঠালাপন-কুহুকজাল হইতে সতর্ক থাকিবেন।’
আমাদের দেশে এক শ্রেণীর উরসে লোক জড়ো করবার জন্য যেসব প্রচারণা কৌশল প্রয়োগ করা হয় তাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় তাতে বেশ এক বড় ধরনের কিন্তু রয়েছে। আর এই কিন্তু কে দূর করবার জন্য ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে ফুরফুরা শরীফের পীর মুজাদ্দিদে যমানা মওলানা শাহ্্ সূফী আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি ফাল্গুন মাসের ২১, ২২, ২৩ তারিখ নির্ধারণ করে ফুরফুরা শরীফে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল কায়েম করেন যা আজও ঐ তিনদিন ধরে সেখানে লাখ লাখ লোকের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
তিনি এই মহফিল সম্পর্কে বলেছেন : আমি জানি, আল্লাহ বলিয়াছেন : ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদিগকে ও নিজেদের পরিজনকে অগ্নি হইতে রক্ষা কর।’ এই আয়াতের মর্ম অবলম্বনে আমার বাড়িতে দেশী-বিদেশী সকলকে আস দাওয়াত দিয়া বহু আলেম-ওলামা, হাফেজ, ক্বারী কর্তৃক ওয়াজনছিহত করাইয়া ও নিজে করিয়া শরিয়তের হুকুম আহ্্কাম জানাইয়া দেই। ... ৬০/৭০ খতম কুরআন শরীফ, শূরা এখলাছ ও ফাতেহা, কালেমা ইত্যাদি পড়ানো হয়। এই সমস্তের ছওয়াব হযরত নবী (স.)-এর ও যাবতীয় অলি-আউলিয়া, গাউছ, কুতুব ও যাবতীয় মুসলমানদের রুহের ওপর সওয়াব রেছানী করা হয়। এই জন্য এই মহফিলের এক নাম ইসালে সওয়াব। এই মহফিল যাহাতে আল্লাহ কায়েম রাখেন, তাহার চেষ্টা আমার পুত্রগণ, খলিফাগণ ও মুরিদগণ করিবেন। খলিফাগণের মধ্যে যদি কাহার বাড়িতে এরূপ মহফিল করিতে কাহারও শক্তি হয়, তবে তিনি তাহা করিবেন। সাবধান! কেহ যেন অর্থের লোভে বা অন্য কোনোরূপে মানমর্যাদার জন্য না করেন। বিশুদ্ধ হেদায়াতের নিয়তে করিলে বহু নেকী পাইবেন। আরও সাবধান থাকিবেন যে, যেন এই মহফিলে কোনো প্রকার বেদায়াত ও হারাম কার্য বা নামাজের জামায়াত তরক না হয়। বাজে তামাসা ইত্যাদি না হয়। (মওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন, ফুরফুরা শরীফের হযরত পীর ছাহেব কেবলার বিস্তারিত জীবনী, প্রথম সংস্করণ, কলিকাতা ১৯৩৯, পৃ. ২৪২-২৪৩
ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে যমানা হযরত মওলানা শাহ সূফী আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.) তাঁর প্রধান প্রধান খলিফাগণের বাড়িতে তারিখ নির্ধারণ করে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল কায়েম করে যান, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শর্ষীনার ইসালে সওয়াব যা অনুষ্ঠিত হয় ১৪, ১৫, ১৬ অগ্রহায়ণ, যশোরের (বর্তমান মাগুরা জেলা) দ্বারিয়াপুর শরীফের ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিলÑ যা প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় ৪ু মাঘ। এছাড়াও কুমিল্লার ধামতিতে, যশোরের ইনায়েতপুরে, ফরিদপুরের জোবরায়, পটুয়াখালীর আমতলীতে, সাতক্ষীরার হামিদপুরে, নোয়াখালীর শ্রীনদীতে এবং অন্যান্য প্রায় শতাধিক স্থানে ইসালে সওয়াব মহফিল অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন তারিখে।
ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে যমানের অন্যতম প্রধান খলীফা দ্বারিয়াপুর শরীফের পীর সাহেব কেবলা হযরত মওলানা শাহ সূফী আলহাজ্জ তোয়াজ উদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি তাঁর পীরের নির্দেশে ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দে যে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল কায়েম করেন তা আজও ৪ মাঘ তারিখেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
দ্বারিয়াপুর শরীফের ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে খতমে কুরআন বহুবার করা হয়। এছাড়াও বাদ মাগরিব তরীকতের নিয়ম অনুযায়ী এক ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে যিক্্র-আয্্কার, তা’লীম-তাকলীন প্রদান করা হয়। হাজার হাজার মানুষ যখন একযোগে অনুচ্চস্বরে আল্লাহ আল্লাহ নাম মুবারক যিক্্র করে লাইলাহা ইল্লাল্লাহু যিক্্র করে কিংবা জীবনের তাবত গোনাহ্্র কথা স্মৃতিতে এনে তওবার ফয়েজ রপ্ত করে রব্বানা জলামনা আন্্ফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফির লানা ওয়া তারহামনা লানা কুনান্না মিনাল্্ খাসেরীন মনে মনে খেয়ালের সাথে পাঠ করে এবং কাঁদতে থাকে তখন এক অনন্য পবিত্র পরিবেশ সমস্ত মহফিল আঙিনা জুড়ে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। ‘ইশার নামায বাদ শুরু হয় বিভিন্ন আলিমের ওয়াজ-নসিহত যা রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত চলে, এক পর্যায়ে তাহাজ্জুদ আদায় করা হয়, তারপর বিভিন্ন স্থানে একজন একজন দাঁড়িয়ে সুমধুর স্বরে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের প্রতি সালাত ও সালাম অর্থাৎ আসসালাতু আস্্সালামু আলায়কা ইয়া রসূলাল্লাহ্ পেশ করতে থাকে। তারপর ফজরের আযান হবার পর ফজরের নামায আদায় করা হয়, তারপর যিক্র-আস্কার, তারপর মিলাদ মহফিল ও কিয়াম অনুষ্ঠিত হয় অন্তত দু’ঘণ্টা ধরে, তারপর সওয়াব রিসানী হয় আখেরী মুনাজাতের মাধ্যমে। তামাম আম্বিয়া কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম, শোহাদায়ে কেরাম, আজওয়াজে মুতাহরো, আশরায়ে মুবাশ্্শারা তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, তরীকতের ইমামগণ, ওলী আল্লাহগণ, মু’মিন-মুমিনাত, মুসলিমিন মুসলিমাতসহ যাঁরা ইন্তিকাল করেছেন সবার রুহে সওয়াব পৌঁছানো হয় এবং বিশ্বশান্তির জন্য বিশ্ব- মানবতার কল্যাণের জন্য তাবত বিষয়ে দু’আ করা হয়। এই সময় বিরাট সমাবেশে যে ক্রন্দনরোল ওঠে তা যেন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করতে তাকে।
ইসালে সওয়াব মহফিলে শরী’আতবিরোধী কোনো কিছু হয় না হতেও পারে না। এই সব ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিলকে হিদায়াত লাভের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বললেও অত্যুক্তি হয় না। প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের মহফিল থেকে বহু লোক হিদায়াত লাভ করে নিজেদের জীবনকে ধন্য করেছে এবং হিদায়াত লাভ করে আসছে।
ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল আয়োজনের মাধ্যমে মানুষকে আলোকিত পথের দিকে আহ্বান করা হয়। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন, উদ‘উ ইলা রব্বিকা বিল্হিকমাতি ওয়াল মাও ‘ইজাতিন হাসানাÑ মানুষকে তোমার রব এর পথে আহ্বান করো হিকমতের মাধ্যমে এবং সুন্দর সুন্দর ওয়াজ নসিহত দ্বারা। (সূরা নহ্্ল : আয়াত ১২৫)।
ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল ঐ আয়াতে কারীমা পালনের এক অনন্য ব্যবস্থা হিসাবে গণ্য হয়ে আসছে।
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (স.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশ বাংলাদেশ
No comments