টাইফুন কেন হয় by ড. জাকিয়া বেগম
এবার বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো অনেকটা শূন্য হাতেই ফিরে এসেছে। বিশেষ করে অর্থপ্রাপ্তির বিবেচনায় খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে।
তবে জলবায়ুর পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির বিষয়ে সামান্য অগ্রগতি হয়েছে এবারের সম্মেলনে। উন্নত দেশগুলো দীর্ঘ দরকষাকষির পর ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যাপারে দায় স্বীকার করে নিয়েছে। এ ব্যাপারে একটি ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে সম্মেলনে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর এটাই প্রাপ্তি।তবে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে কাতার হতাশ করেছে। এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক দরকষকাষি সম্মেলনকে সফল পরিণতির দিকে এগিয়ে নিতে কাতার পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যদিও তারা একটি অন্তঃসারশূন্য জলবায়ু চুক্তিকে ‘দোহা গেটওয়ে’ হিসেবে সাফল্যের দাবি করছে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি সাফল্যের দাবিদার কালো মানুষের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকা শুধু কিয়োটো প্রটোকলকে বাঁচিয়ে দেয়নি, বিশ্বের সব দেশকে একমঞ্চে নিয়ে এসে নতুন আইনি চুক্তি করার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে। দোহা শুধু নির্ধারিত কাজগুলোই সম্পন্ন করেছে, নতুন কোন ব্রেকথ্রো দিতে পারেনি। আলোচনার মাঝপথে যখন দোহা সম্মেলনের ব্যর্থতা ফুটে ওঠে, তখন পরিবেশবাদীদের মধ্যে একটি আশা দেখা দিয়েছিল, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে কাতার হয়ত গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডে বড় অঙ্কের অর্থ প্রদানের ঘোষণা দিয়ে দোহা জলবায়ু সম্মেলনকে স্মরণীয় করে রাখবে। কিন্তু সেখানেও হতাশ করেছে এ দেশটি। উল্লেখ, কাতারের বর্তমান মাথাপিছু জিডিপি হচ্ছে ৮৮ হাজার ২২২ মার্কিন ডলার। এর পরেই অবস্থান লুক্সেমবার্গের। এ দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ৮১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার।
অনেক হতাশার মধ্যদিয়ে শেষ হলো এবারের জাতিসংঘের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন কপ ১৮। কাতারের রাজধানী দোহায় এ জলবায়ু আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকেই অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা জন্ম নেয়। এটা কিছু না পাওয়ার হতাশা। শেষ পর্যন্ত দুই সপ্তাহ ধরে আলোচনায় সেই হতাশা নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়েছে অংশগ্রহণকারীদের। যদিও আয়োজক দেশ কাতার এ সম্মেলনের সফলতা দাবি করছে। সমাপনী সংবাদ সম্মেলনে কনফারেন্স প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ বিন হামাদ আল আতিয়া এ চুক্তিকে ‘দোহা গেটওয়ে’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, এ চুক্তি বড় আকারে কার্বন নির্গমন হ্রাসের নতুন দ্বারোন্মোচন করেছে। তার আশা, দোহা ক্লাইমেট গেটওয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধানে সরকারগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার পথ দেখাবে। দোহা জলবায়ু সম্মেলন মূলত একটি নিয়ম রক্ষার সম্মেলনে পরিণত হয়েছে। যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর আকাক্সক্ষার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন ঘটেনি। যে সিদ্ধান্তগুলো এসেছে তাতে দেখা যায়, নির্ধারিত সময়ের একদিন পর বহুল আলোচিত কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ দ্বিতীয় মেয়াদে আট বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে এ চুক্তিতে নেই বিশ্বের প্রধান কার্বন নিগমনকারী দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের একমাত্র আইনী বাধ্যবাধকতা কিয়োটো প্রটোকলের দ্বিতীয় মেয়াদের আওতায় রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আরও ১০টি দেশ। যাদের কার্বন নির্গমনের পরিমাণ মাত্র ১৫ শতাংশ। বাকি ৮৫ শতাংশ কার্বন নির্গমনকারী দেশই এ আইনের বাইরে রয়েছে। উন্নত দেশগুলোর কার্বন নির্গমন কমিয়ে বিশ্বের উষ্ণায়ন হ্রাস করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল কিয়োটো প্রটোকল। এ প্রটোকলের মেয়াদ শেষ হয়েছে ৩১ ডিসেম্বর। ফলে এর মেয়াদ বৃদ্ধি এ সম্মেলনে জরুরি ছিল। যদিও এ সম্মেলনে যে মেয়াদ বৃদ্ধি করা হবে তা গত ডারবান সম্মেলনেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তেরই বাস্তবায়ন ঘটেছে এ সম্মেলনে। এর বাইরে নতুন কিছু হয়নি। নতুন করে কোন কার্বন দূষণকারী দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি এ প্রটোকলে। বরং ৩৭টি দেশের জন্য কিয়োটো প্রোটোকলের মেয়াদ বাড়িয়ে বিশ্বের শীর্ষক কার্বন দূষণকারী দেশগুলোকে অবাধে কার্বন নির্গমনের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। তবে দোহার সাফল্য বলতে এটাই যে, বিশ্বে কার্বন নির্গমন কমানোর একটি আইনগত চুক্তি অন্তত টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। যদিও দোহা চুক্তিতে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন মোকবেলায় প্রয়োজনীয় কার্বন নির্গমন হ্রাসের ব্যাপারে অতীতের মতো আবারও সম্মত হয়েছে। কিন্তু কোন দেশ কি পরিমাণ কমাবে তার কোন সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতোমধ্যেই অনুভূত হচ্ছে। একটি দিন অতিবাহিত হচ্ছে আর আমরা ক্রমেই অস্থিতিশীল জলবায়ুর অন্ধকার ভবিষ্যতে নিজেদের আবদ্ধ করে ফেলছি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখছি, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস, ঝড়, হারিকেন, টাইফুনের নির্মমতা। এর মধ্যে খুব সাম্প্রতিক ও নির্মম উদাহরণ ফিলিপিন্স আঘাত হানা ভয়ঙ্কর টাইফুন বোফা। যেটি কমপক্ষে ৬০০ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। গৃহহারা করেছে হাজারো মানুষকে।
ফিলিপিন্সে টাইফুন অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু দেশটির ইতিহাসে এটাই রেকর্ডকরা ভয়াবহ টাইফুন এবং নিয়মিত আঘাত হানার রেকর্ড ভেঙ্গে এ বছরের শেষ দিকে এটি আঘাত হানল। তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানা হারিকেন স্যান্ডি কেড়ে নিয়েছে শতাধিক প্রাণ, বাস্তুহারা করেছে হাজারো মানুষকে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর ভয়াবহ জলবায়ু পরিবর্তনের এসব উদাহরণও টলাতে পারেনি কার্বন নির্গমনকারী উন্নত দেশগুলোকে। তবে দোহা কার্বন নির্গমন কমানো বিশ্বের সব দেশকে নিয়ে একটি নতুন আইনগত চুক্তি করার ব্যাপারে একটি ওয়ার্ক প্রোগ্রাম অনুমোদন করা হয়েছে। এ চুক্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল গত ডারবান সম্মেলনে। যাকে ‘ডারবান প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সেই চুক্তির কাজটাই একটু এগিয়েছে দোহায়। দোহা জলবায়ু চুক্তিতে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে কিয়োটো প্রটোকলের স্থান নেবে নতুন আইনি চুক্তি। বিশ্বের সব দেশ মিলে আগামী ২০১৫ সালের জলবায়ু সম্মেলনে এই নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করবে। এ ব্যাপারে দোহা চুক্তিতে রয়েছে অনেক অসঙ্গতি। বিশেষ করে ২০১৫ সালের মধ্যেই যে নতুন আইন হতে হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
মোটকথা ২০১৪ সালের মধ্যেই ঠিক করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নতুন আইনগত বাধ্যবাধকতা প্যারিস প্রটোকলের রূপরেখা। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে প্যারিস প্রটোকল গৃহীত হবে বিশ্বের সব দেশের অংশগ্রহণে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ শিল্পোন্নত দেশগুলোকে যেমন দায়দায়িত্ব নিতে হবে, তেমনি দায়দায়িত্ব চাপবে চীন, ভারত, বাংলাদেশসহ সব দেশের ঘাড়ে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অর্থায়নের ব্যাপারে দোহা জলবায়ু সম্মেলন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। কোপেনহেগেন এ্যাকর্ড অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে অর্থায়নের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে ২০২০ সালে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল উন্নত দেশগুলো। সেই প্রতিশ্রুতিরও বরখেলাপ করছে তারা দোহায়। এ চুক্তিতে বলা হয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলার করে প্রদানে উৎসহিত করা হবেÑযা জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে হতাশাজনক। এ কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো অনেকটা শূন্য হাতেই ফিরে এসেছে দোহা থেকে। তবে এবারের সম্মেলন থেকে এটা পরিষ্কার যে, বহুপাক্ষিক ব্যবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ-খাওয়ানোর জন্য তেমন একটা অর্থ পাওয়া যাবে না। একমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ-খাওয়াতে ন্যাশনাল এডাপটেশন প্ল্যান প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) থেকে ৫০ লাখ থেকে ৮০ লাখ ডলার পাবে। এর বাইরে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থায় অর্থ পাওয়া কঠিন হবে। তাই বাংলাদেশকে যে কাজটি করতে হবে তা হলো দ্বিপাক্ষিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। উন্নত দেশগুলো অবশ্য বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার চেয়ে দ্বিপাক্ষিক ব্যবস্থায়ই অর্থ দিতে বেশি আগ্রহী। তাই আগামী দিনগুলোকে বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক ব্যবস্থায় অর্থ পেতে পারে। এজন্য অবশ্য প্রকল্প নিয়ে এগোতে হবে। দোহা চুক্তিতে অর্থায়নের ব্যাপারে উন্নত দেশগুলোর কোন অঙ্গীকার নেই। বরং তারা তাদের প্রতিশ্রুতি থেকে পিছিয়ে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপখাইয়ে নেয়ার জন্য একটি জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য অর্থায়নের কথা বলা হয়েছে। তবে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থ প্রদানের কোন উল্লেখ নেই। ফলে অর্থ না পেলে আমাদের অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হবে। কারণ উন্নত দেশগুলো কার্বন নির্গমন কমাবে না। পৃথিবীর উষ্ণায়ন আরও বেড়ে গিয়ে দিন দিন দুর্যোগের মাত্রা বেড়ে যাবে। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকেই। কোপেনহেগেন এ্যাকর্ডে উন্নত দেশগুলো ২০১০ থেকে ২০১২ সাল নাগাদ প্রতিবছর ১০ বিলিয়ন ডলার করে তিন বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু ওই অঙ্গীকারের বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো পেয়েছে মাত্র চার বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ১৭ কোটি ডলার। অথচ উন্নত দেশগুলো দাবি করছে, তারা তিন বছরে ৩৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। ফাস্ট স্টার্ট ফান্ডের মতোই, মধ্যমেয়াদী আগামী তিন বছরে অর্থাৎ ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল নাগাদ প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলার করে প্রদানে উন্নত দেশগুলো উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে দোহা চুক্তিতে।
এখন প্রশ্ন হলো-উৎসাহ দিলেই কি উন্নত দেশগুলো অর্থ দিয়ে দেবে? অতীতে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যেখানে উন্নত দেশগুলো অর্থ দেয়নি, সেখানে উৎসাহ প্রদানের কথা উল্লেখ করে চুক্তিতে অর্থায়নের ইস্যুটিকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। এটা এক ধরনের ‘আন্তর্জাতিক ফাঁকি’ ছাড়া আর কিছু নয়।
উল্লেখ্য, উন্নয়নশীল দেশগুলো মধ্যমেয়াদী (২০১৩-১৫) উন্নত দেশগুলোর কাছে ৬০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের দাবি জানিয়েছিল দোহা জলবায়ু সম্মেলনে। এর বিপরীতে উন্নয়নশীল দেশগুলো ৩০ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার ‘উৎসাহ’ পেয়েছে। তবে সম্মেলন চলাকালেই মধ্য মেয়াদে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, সুইডেন ও ইউরোপীয় কমিশন ৬ বিলিয়ন ডলার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। এটাই আমাদের মতো জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য প্রাপ্তি। যদিও এ ধরনের প্রতিশ্রুতি উন্নত দেশগুলো বহুবার দিয়েছে। তবে দোহা জলবায়ু সম্মেলনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একমাত্র প্রাপ্তি হচ্ছে ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবির স্বীকৃতি প্রদান। এতে বলা হয়েছে, লস এন্ড ডেমেজের আওতায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যাপারে উন্নত দেশগুলো উদ্যোগ নেবে। কোনটাকে ক্ষতি ধরা হবে, কিভাবে ক্ষতি নিরূপণ করা হবে এ ব্যাপারে একটি ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়ন করা হবে। এই ফ্রেমওয়ার্ক কি হবে সেটার ওপরই নির্ভর করবে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টি। জলবায়ুর পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে লস এন্ড ডেমেজের এই মেকানিজম সহায়তা করবে বৈকি। এটা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি নৈতিক বিজয় বটে। উন্নয়নশীল দেশগুলোও এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা এটাকেই সম্মেলনের বড় অর্জন হিসেবে দেখছে। এখন আগামী সম্মেলনগুলোতে এ ইস্যুকে আলোচনার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে। গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডের ব্যাপারেও বড় ধরনের অগ্রগতি নেই দোহায়। এ চুক্তিতে শুধু বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার শহর সুন্দগোতে গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডের সদর দফতর স্থাপন করা হবে। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি নাগাদ এটি কাজ শুরু করবে। তবে প্রকৃতিপক্ষে এই নতুন অর্থায়নকারী সংস্থাটির কার্যক্রম শুরু হতে ২০১৪ সাল লেগে যাবে। জলবায়ু নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। ‘তাপ কমাও’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আগাম ধারণা দেয়া হয়েছে, সাধারণ তাপমাত্রার চেয়ে মাত্র ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে কি ঘটবে পৃথিবীতে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে, বাড়বে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা। সাগর পৃষ্ঠের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে, চারদিকে মহামারী আকার ধারণ করবে যেকোনো ধরনের রোগ। প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, উদ্বেগজনক হারে বরফ গলছে, আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পরিবেশবাদী সংগঠন ন্যাশনাল অসিয়ানিক অ্যাটমোসপেয়ারিক এডমিনিস্ট্রেশন (নোয়া) একটি গবেষণায় দেখিয়েছে, এই শতাব্দীর শেষ দিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা গড়ে সাড়ে ছ’ফুটের বেশি বাড়তে পারে। যদিও এ বছরই যুক্তরাষ্ট্রে দেশটির সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ উন্নত রাষ্ট্রটির দুই তৃতীয়াংশে ইতোমধ্যেই খরা অনুভূত হচ্ছে। জ্বালানি তেলের প্রতি অধিক নির্ভরতা বিশ্বের জন্য হয়ে উঠছে আরেকটি টার্নিং পয়েন্ট। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি পরিবেশবাদী সংগঠন ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট (ডব্লিউআরআই) সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে, বিশ্বব্যাপী আরও ১২শ’ নতুন কয়লা উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আর ২০১১ সালের গ্যাস নিঃসরণ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এতসব দুর্যোগের কথা কি জলবায়ুর অব্যাহত পরিবর্তন ঠেকাতে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যথেষ্ট কারণ নয়!
আশার কথা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে। মানুষের এমন সচেতনতার কারণেই দেশে দেশে এখন কার্বন নির্গমনবিরোধী প্রযুক্তির বিস্তার লাভ করছে। তাই জনগণই এক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা। যাদের প্রতিনিধিত্ব করছে পরিবেশবাদীরা। এই পরিবেশবাদীদের চাপই এখন পর্যন্ত জলবায়ু সম্মেলনগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা যোগাচ্ছে। তাই বিশ্ব রক্ষায় এই সাধারণ মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। ক্ষতিকর কার্বন গ্যাস নিঃসরণের মাধ্যমে যে ভয়াবহ জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে তা রুখে দাঁড়াতে হবে। চাপ সৃষ্টি করতে হবে এ পর্যন্ত জলবায়ু সম্মেলগুলোতে নেয়া সিদ্ধান্তগুলোকে বাস্তবায়ন করার।
kawser_rahman@yahoo.com
No comments