একুশ শতক- ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন এবং তার ভিডিও রূপানত্মর-এক মোসত্মাফা জব্বার
একেবারে আকস্মিকভাবেই একটি অবিশ্বাস্য ভিডিও আমার হাতে পেঁৗছায়। ২০১০ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির অফিসে বসে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ সামিটের কার্যবিবরণী চূড়ানত্ম করছিলাম।
গ্রামীণফোনের রায়হান শামসি ও আসলাম হায়াত, চেঞ্জ মেকারের ব্যারিস্টার তামজিদ সাহেব, বিসিএসের টিআইএম নুরম্নল কবির এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে আমি নিজে বসে ডিজিটাল বাংলাদেশ সামিটের সুপারিশগুলো চূড়ানত্ম করার বিষয়ে আলোচনা করছিলাম।আমরা ২০০৯ সালের নবেম্বর মাসে সম্পন্ন করা ডিজিটাল বাংলাদেশ সামিটের প্রতিবেদনটি চূড়ানত্ম করার জন্য বেশ কিছুদিন যাবতই কাজ করছি। সেই সভাতেও একই কাজ করব বলে ঠিক করা ছিল। আলোচনার মাঝখানে রায়হান শামসি প্রসঙ্গ তুলল এবং বলল কেবলমাত্র লিখিত প্রতিবেদন দিয়ে কোন বিষয়ের স্বপ্নটাকে সজীব করা যায় না। তিনি আমাকে সিঙ্গাপুর সরকারের বানানো একটি স্বপ্নের ভিডিও দেখার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন। ভিডিওটির বিষয়ে ভূমিকা দিতে গিয়ে রায়হান জানালেন যে, সিঙ্গাপুর সরকার ইনটেলিজেন্ট ন্যাশন২০১৫ (আইএন২০১৫) নামক যে কর্মসূচিটি গ্রহণ করেছে এটি হচ্ছে তারই ভিশনভিডিও। নুরম্নল কবির জানাল, ওরা কদিন আগে সেটি দেখেছে এবং মুগ্ধ হয়েছে। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর প্রস্তুত ছিল। ল্যাপটপ থেকে ভিডিওটি চালানো হলো। আইএস২০১৫ ইমাজিন ইউর ওয়ার্ল্ড নামের এই ভিডিওটিতে প্রথমেই একজন মহিলাকে দেখানো হয় যিনি নিজে একজন ডিজিটাল এ্যানিমেটর। তার সঙ্গে সিঙ্গাপুরের বাইরে থেকে কেউ একজন একটি এ্যানিমেশন কাজের বিষয়ে কথা বলে। সেই সময়ে এ্যানিমেশনের কাজের নমুনা দেখা যায় এবং তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য আদান-প্রদান করে। চীনা ভাষাকে ইংরেজীতে রূপানত্মর বা আফ্রিকার ভাষাকে ইংরেজীতে রূপানত্মর করা এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্ক্রিন অফ অন করা ছাড়াও মহিলাকে দেখা যায় যে তিনি একটি যন্ত্র দিয়ে মেইল পাঠাচ্ছেন, কথা বলছেন এবং যাবতীয় যোগাযোগ করছেন; যেটি অনেকটাই একটি ধাতুর পাতের মতো। পরৰণেই দেখা যায় যে, একজন ট্যাক্সি ড্রাউভার স্বচ্ছ কাচের একটি ফোল্ডযোগ্য যন্ত্রকে কম্পিউটারের মতো ব্যবহার করছেন এবং মেইল ছাড়াও স্ট্রেইটসটাইমস পত্রিকা পাঠ করছেন। এরপর গাড়িতে বসে ইনভয়েস মেইল করা, টিকেট বুকিং করা, পার্কিংয়ের জন্য জায়গা সন্ধান করার বিষয়গুলো দেখানো হয়। তাদের চোখের গগলসকে কমিউনিকেটর হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়।
তারপর ক্রমশ দেখানো হয়, একজন টিনএজারের মায়ের জন্য লিপস্টিক কেনা, মায়ের ঠোঁটের সঙ্গে রং ম্যাচ করা, হাতের ছাপ দিয়ে পেমেন্ট করা এবং গেস্নাবাল পজিশনিং সিস্টেম ব্যবহার করার দৃশ্য। প্রাইমারি স্কুলের একদল ছাত্র কতর্ৃক কম্পিউটার দিয়ে চিড়িয়াখানার জন্তুর ছবি তোলা ও প্রাণী বিষয়ে শিৰকের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সিং করার দৃশ্যগুলো দেখলে মনে হতে পারে যে কেউ সায়েন্স ফিকশনের ছবি দেখছে। একজন বয়স্ক মহিলার হার্টবিট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল থেকে ফোন করা এবং জন্মদিনের উপহারে ছোট্ট কিশোর কতর্ৃক তার নিজের বাড়ির পরিবেশটাই চিড়িয়াখানার পরিবেশে বদলে ফেলার মধ্য দিয়ে ছয় মিনিটের ভিডিওটা শেষ হয়।
এর একদিন আগে আরেকটি ভিডিও পেলাম আমি কোরিয়া থেকে। ২০১৪ সালে কোরিয়া বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি সম্মেলন আয়োজন করতে চায়। সেই আয়োজনের জন্য তথ্যপ্রযুক্তিতে কোরিয়ার অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য ভিডিওটি নির্মিত। এটিকে কিন্তু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মনে হয় না। বরং একে মনে হয় একটি প্রামাণ্যচিত্র। এতে কোরিয়ার জনগণের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং সার্বিক অগ্রগতি এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যা হয়ত আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেও সমকৰ হতে পারব না। কোরিয়ার এই ভিডিওটিতে দেখানো হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি আবিষ্কার, ব্যবহার ও এর অগ্রগতিতে কোরিয়ার অবস্থান। অর্থনীতির চাকা কেমন করে তথ্যপ্রযুক্তি সচল রাখছে সেটিও দেখানো হয় ভিডিওতে।
এই দুটি ভিডিও দেখে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, কোন কর্মসূচি বাসত্মবায়নের জন্য একটি দৃশ্যমান স্বপ্ন চাই। সিঙ্গাপুরের ভিডিওটিকে অনেকটাই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বলে মনে হয়। ২০০৫ সালে তারা সেই ভিডিওটি নির্মাণ করে এবং ২০১৫ সালের বাসত্মবতা তারা তাতে তুলে ধরে। আমরা যারা ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাই সেই আমাদেরও তেমন একটি স্বপ্নময় ভিডিও চাই। রায়হান বা কবিরকে কিন্তু আমার সঙ্গে একমত হতে দেখলাম। তারাও মনে করে যে কেবলমাত্র হাতে লেখা কাগজের সুপারিশমালা নয়, একটি ভিডিও চাই যাতে আমাদের স্বপ্নটি দৃশ্যমান হবে। আমার এই লেখাটি সেই স্বপ্নটাকে সামনে রেখে প্রস্তুত করা যে স্বপ্নের ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্পিত রূপের একটি বাসত্মব ভিত্তি আমরা দেখতে পাবো।
স্বপ্নের প্রেৰিত : এখন থেকে আর মাত্র ১২ বছরের কম সময়ে যেহেতু ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সময়সীমা নির্দিষ্ট করা আছে, সেহেতু আমাকে প্রায়ই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় যে, ২০২১ সালে আমি এই দেশের রূপটি কেমন হবে বলে মনে করি। তারা জানতে চায়, আমার স্বপ্নটা কেমন দেখতে! বিষয়টি আমি ভীষণভাবে উপভোগ করি। কারণ স্বপ্ন দেখতে ও স্বপ্ন দেখাতে আমি ভীষণ পছন্দ করি। আমি মনে করি, স্বপ্নই হলো বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় উপকরণ। জীবনের প্রথম দিন থেকেই মানুষ স্বপ্ন দেখে এবং সেই স্বপ্ন বাসত্মবায়ন বা পূর্ণতা প্রাপ্তির আশায় সে মরণ চায় না। বিশেষ করে যদি জীবনে কোন স্বপ্নই না থাকে বা কোন স্বপ্নই যদি কখনও পূরণ না হয় কিংবা কোন স্বপ্ন পূরণের আশাই যদি জেগে না থাকে তবেই মানুষ হতাশ হয় এবং কখনও তা আত্মহানির পর্যায়ে নেমে আসে। আমি বা আমাদের প্রজন্মের মানুষেরা জীবনের অনেকগুলো গুরম্নত্বপূর্ণ জাতীয় ঘটনা অতিক্রম করেছি। আমাদের সাফল্য অনেক। আমাদের শৈশবে বাঙালী জাতি ভাষা আন্দোলন করেছে এবং জয়ী হয়েছে। আমাদের যৌবনে আমরা আইয়ূব-ইয়াহিয়াকে হটিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের প্রৌঢ়ত্বে আমরা বাংলাদেশের স্বৈরাচার, রাজাকার ও জঙ্গীবাদকে হারিয়েছি। এখন স্বপ্ন দেখছি ডিজিটাল বাংলাদেশের। ফলে আমাদের সামনে হতাশা কখনও খুব বেশি ঠাঁই পায় না। আমাদের অনেক স্বপ্ন পূরণ না হলেও আবার অনেকগুলো স্বপ্নই পূরণ হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনেও আমার চারপাশের সবারই সাফল্য ঈর্ষণীয় না হলেও মন্দ নয়। সবচেয়ে বড় কথা স্বপ্ন দেখতে পারাটাও একটি বড় ঘটনা। বড় স্বপ্ন দেখে যে একদিন সফল হওয়া যায় তার অনেক নজির আমাদের নিজেদের জীবনেই আছে।
উনিশ শো আটষট্টি সালে যখন মরহুম ফিল্ড মার্শাল জেনারেল আইয়ুব খান উন্নয়নের এক দশক পালন করে তখন এদেশের শতকরা কতজন মানুষ ভাবত যে, সেই লৌহ মানবের একদিন পতন হবে? দেশজুড়ে তখন আইয়ূব খানের জয় জয়কার। মরহুম মোনেম খানের জন্য আইয়ূব হয়ে ওঠেন তৎকালীন পূর্ব পাকিসত্মানের সবচেয়ে ৰমতাবান ভগবান। মুসলিম লীগের জোয়ারে তখন ভাসছে দেশ। অথচ দোর্দ- প্রতাপে পুরো একটি দশক পার করতে গিয়ে হঠাৎ করে হ্যাজাকের বাতি কুপির চেয়েও দ্রম্নত গতিতে নিবে গেল। দেশের বড় বড় রাজনীতিবিদরাও সেদিন ভাবেননি যে আইয়ূব এত দ্রম্নত বিদায় নেবে। কিন্তু তাই ঘটেছিল। পূর্ব বাংলার কিছু ছাত্রছাত্রীর আন্দোলনের মুখে আইযূব বিদায় নিতে বাধ্য হয়। কার্যত এটিই বাসত্মবতা যে, পূর্ব পাকিসত্মানের কিছু সাধারণ ছাত্রছাত্রী সেদিন কেবল আইয়ূবের পতনের স্বপ্ন দেখেছিল।
জেনারেল ইয়াহিয়া যখন রাজাকার বাহিনীর সাহায্যে পুরো পূর্ব পাকিসত্মান তার দৰ সেনাবাহিনী দিয়ে দখল করে ফেলেছিল, তখনও এমনকি একাত্তরের ডিসেম্বরের ৬ তারিখের আগে এই মাটিরই কত ভাগ মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারত যে, লাল সবুজ পতাকা কোন একদিন এই মাটিতে উড়বে বাধাহীনভাবে? মুক্তিফৌজ বা মুজিববাহিনী কি বাংলার সব মানুষের মনে পুরো নয় মাস স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণের আশাবাদ জাগিয়ে রাখতে পেরেছিলাম? আমরা যারা মুজিব বাহিনীতে ছিলাম তারা তো বরং ভিয়েতনামের কথা ভাবতাম। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, রক্তের নদী সাঁতরে আমরা একদিন লাল সবুজ পতাকা পাবো এই ভাবনাটা তো ১৬ ডিসেম্বর পর্যনত্ম ভেবেছি। অথচ মাত্র ১১ দিনের যুদ্ধে পাকিসত্মানীরা ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আমাদের পদতলেই আত্মসমর্পণ করেছে।
খুব কাছের দৃষ্টানত্মই দেখি না কেন? হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৰমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন, এটিইবা কতজন ভেবেছে? আমি নিজে একটি পত্রিকায় সিরিজ লিখেছি এরশাদের পতন হয় না কেন? প্রচ- গণ-আন্দোলনের মুখেও বুড়ো সিংহের নড়বড়ে দাঁতের মতো এরশাদের ৰমতা যেন কোনমতে লটকে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এরশাদকে ৰমতা ছেড়ে দিতে হলো। বেগম জিয়া ১৫ ফেব্রম্নয়ারির নির্বাচন করে আরও পাঁচ বছর ৰমতায় থাকবে তেমনটাই সাধারণ ভাবনা ছিল। আমরা কিছু লোক ভাবতাম তিনি ৰমতার মেয়াদ তো দূরের কথা, সরকবার গঠন করেই দাঁড়াতে পারবেন না। আমাদের স্বপ্নই সফল হয়েছিল। ২০০৮ সালেল ২ জানুয়ারিতে আবারও ১৫ ফেব্রম্নয়ারির ঘটনা ঘটবে তেমনটাই সবাই ভেবেছিল_কিন্তু এসে গেল জরম্নরী অবস্থা। তারেক রহমানের পতন হবে সেটিই বা কয়টি মানুষ ভেবেছে।
আরও কাছের দৃষ্টানত্ম দেখা যাক! কেউ কি ভেবেছে, একদিন বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার বা ফাঁসি হবে? ডালিমদের দম্ভ ফাঁসিতে মিশে যাবে_এটি তো দুঃস্বপ্নও ছিল না। অথচ বাসত্মবতা হলো; সব স্বপ্নেই আমরা সফল হয়েছি। এবার যখন আমাদের স্বপ্নের রূপায়ণ পুরো ১২ বছর বা এক যুগ দূরে আছে, সেই ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, তখন আমাদের স্বপ্ন নাম পেয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ।
এজন্যই আমার বিশ্বাস, যে যাই ভাবুক না কেন, স্বপ্ন যদি মাটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়, তবে সেই স্বপ্ন একদিন সফল হবেই। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নটা দেখার আগে, দিনের পর দিন বা রাতের পর রাত আমি ভেবেছি, এটি কি আমাদের একাত্তরের স্বপ্নের চেয়ে বড় কোন স্বপ্ন। আজ যে মানুষটি ত্রিশের কোঠায় তার তো মনে হতে পারবে না, একাত্তর কত বড় স্বপ্ন ছিল_কত অসাধ্য কাজ মনে হতো যুদ্ধে জয়ী হওয়াকে। আটষট্টি সালে আমরা যারা 'বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর'_এমন সেস্নাগান দিয়েছিলাম তারা যদি তখনকার পাকিসত্মানের বাসত্মবতার দিকে তাকাতাম, তবে কি এমন সেস্নাগান দিতে পারতাম? আমরা যারা ভেবেছিলাম, নিজেরা সশস্ত্র লড়াই করে বাংলাদেশ স্বাধীন করব, তারা ৬ ডিসেম্বরেও হাতে একটি মাত্র গ্রেনেড নিয়েই পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের স্বপ্ন দেখেছিলাম। ভাগ্যিস সেদিন ইন্টারনেট ছিল না এবং আমরা কেউ পাকিসত্মান বাহিনীর পুরো পরিসংখ্যান ও চেহারাটা দেখিনি। মাঝে মধ্যে ভাবি, যদি পাকিসত্মান বাহিনীর ৰমতার হিসাব জানা থাকত তবে কি ভয়ে বুক কাঁপতো?
২২ জানুয়ারি ২০১০ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, ঔপন্যাসিক, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান; সাংবাদিক, কম্পিউটার বিষয়ক বই-পত্র ও নিবন্ধের লেখক ও কলামিস্ট এবং বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ই-মেইল : সঁংঃধভধলধননধৎ@মসধরষ.পড়স, ওয়েবপেজ : িি.িনরলড়ুবশঁংযব.হবঃ
No comments