যুদ্ধের জীবন ও জীবনের যুদ্ধ by মিলা মাহফুজা রহমান
ফতিমা কোমর থেকে ভারি টুকরিটা ফুটপাথে নামিয়ে রেখে সোজা হতে গিয়ে টের পেল ব্যথাটা আজ আবার চাগাড় দিয়েছে। কিছুদিন ধরে কোমরের এই বেদনা তাকে খুব জ্বালাচ্ছে। রনদা ফার্মেসির ডাক্তারের কাছ থেকে চল্লিশ টাকার বড়ি কিনে খেয়েছে।
তাতে প্রথম দিকে ব্যথা কিছু কম থাকলেও এখন আবার সেই আগের অবস্থা। ডাক্তার অবশ্য ভারি বোঝা টানা কি তোলা একদম নিষেধ করেছিল। কিন্তু সেই নিষেধ মানতে গেলে যে না খেয়ে মরতে হয়! শুধু নিজে প্রাণের দায় হলেও কথা ছিল। আব্দুল কাদের জিলানী নামের নাতিটা রয়েছে না। পীর পয়গম্বরের নামে নাম রেখেছে নাতির। নাতির যতেœর কমতি করা যায় নাকি! নাতিকে না খাইয়ে রাখার কথা সে ভাবতেই পারে না। তাছাড়া শুধু তো খাওয়াই না। জিলানীর পড়ার খরচ রয়েছে। কলেজে পড়ে ছেলেটা। পড়াশোনায় ভাল। জিলানী টিউশনি করতে চায়, ফতিমা দেয় না। টিউশনি করতে গিয়ে পড়াশোনার ক্ষতি হোক তা ফতিমা চায় না। কষ্ট যা করার সে করবে কিন্তু জিলানী ভাল করে পড়ুক। জিলানীই তার শেষকালের একমাত্র ভরসা। আর কদিনই বা সে এমন খাটতে পারবে!ফতিমা হাঁটুর ওপর দুহাতের ভর রেখে আস্তে আস্তে কোমর সোজা করার চেষ্টা করে। আজ আসতে এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। তিনটে বাসা বাড়ির বাসন মাজা, কাপড় কাঁচা, ঘর ঝাড়ামোছার কাজ শেষ করার পরে আর শরীর চলতে চায় না। ঘরে ফিরে বসতেই ঝিমুনি এসে যায়। আজ কখন বুঝি ঘুমই এসে গেছিল। জিলানী ডেকে দেয়নি। নাতিটার খুব মায়া তার ওপর। নানিকে কষ্ট করতে দেখলে দুঃখ পায়। “আহারে নাতিন আমার! তোর লাইগাই তো কষ্ট করতাছি রে বাপ। তুই লেহাপড়া শিকখা চাকরি কইরা আমারে আরাম দিবি নারে বাপ। তহন আর আমি বাসা বাড়িতে কাম করুম না। অবশ্য এই পিঠা বানাইবার কাম ছাড়ুম না। পিঠা বেইচা লাভ বহুত। এক টাকায় তিন টাকা। যতদিন শরীর চলে ততদিন করুম। তহন নানা জাতের পিঠা বানামু। আরও বেশি গাহক হইব। আরও বেশি ট্যাহা হইব। ট্যাহা জমাইয়া তোরে একটা জায়গা কি ঘর কইরা দিয়া যাইতে পারুম রে বাপ? নিজে তো হারা জেবন এই হানে সেই হানে কাটাইলাম। নিজে থাকি না থাকি তুই যেন নিজের ঘরে থাকবার পারিস।”
কথাগুলো নিজের মনে বলছিল। তবে ফতিমার হাত কামাই নেই। এতক্ষণে কেরোসিনের স্টোভে আগুন ভালমতো জ্বলে উঠেছে। হাঁড়ির পানিতে তাপ হচ্ছে। ফতিমা চালের গুঁড়ি, গুড় আর নারকেল গুছিয়ে নিতে থাকে। পাঁচ মিনিট পরেই গরম ভাপ ওঠা ভাপা পিঠা নামিয়ে দেবে। গ্রাহক এসে দাঁড়িয়ে গেছে এর মধ্যেই। ছোট এক বালিকা গ্রাহক বলে, ‘পিঠাওয়ালী, একটু গুড় বেশি দিতে বলছে, মা।’
ফতিমা বাটিতে চালের গুঁড়ার ওপর গুড় সাজিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘গুড় বেশি দিলে দাম বেশি পড়ে রে মা।’
‘গুড় বেশি না দিলে কি পিঠা খেতে মজা লাগে? অন্তত আমার পিঠাটাতে বেশি গুড় দাও।’ ছোট মেয়েটার মিনতিমাখা কথা শুনে ফতিমা বলে, ‘খাড়াও, দিমুনে তোমারে বেশি গুড় দিয়ে পিঠা বানাইয়া।’
মেয়েটার পাশে আরও দুজন দাঁড়িয়ে গেছে। ফতিমা তাদের যোগান দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। শীতের এই মৌসুমে ভাপা আর চিতই পিঠাটা বেশি চলে। শহুরে মানুষ পিঠে বানানোর ঝক্বি করতে চায় না। তাই ফতিমাদের কদর দিনে দিনে বাড়ছে। আর ফতিমার পিঠার বিশেষ সুনাম আছে। তার পিঠে স্বাদ ভাল। তাই তার কিছু নিয়মিত গ্রাহক আছে। এছাড়া পথচলতি লোকজন কেউ দাঁড়িয়ে খায়, কেউ আবার দু/দশটা নিয়েও যায়। তবে সবাই চায় একদম গরম গরম পিঠা। তাই দুহাতে তাকে কাজ করতে হয়। একবার পিঠা বানানো শুরু করলে আর কোনদিকে তাকাবার ফুরসত হয় না। রাত আটটা পর্যন্ত এক নাগাড়ে পিঠা বানিয়ে চলে। পিঠা বানায়, গ্রাহকের কাছ থেকে হিসেব করে পয়সা বুঝে নেয়। প্রত্যেকটা পয়সার দাম তার কাছে অনেক। পিঠা বেচার পয়সা থেকেই সে জমি কিংবা ঘরের জন্য টাকা আলাদা করে সরিয়ে রাখে। জিলানীর পড়াশোনা শেষ হতে আরও পাঁচ ছয় বছর লাগবে। ততদিনে বেশ কিছু তো জমবেই। আর জিলানী চাকরি করে যদি কিছু দেয়Ñ হোক দূরে, তবু একটা নিজের জায়গা হবে। সেই কতকাল আগে উদ্বাস্তু হয়েছে ফতিমা। বছরের হিসাব জানা নেই তবে অনেককাল হয়ে গেছে। এমনকি এখন হয়ত সে চিনে যেতেও পারবে না জন্মভিটায়। সেখানে আপন জন বলতে কেউ আছে কিনা তাও জানা নেই। চলে আসার পর কখনও কখনও খুব যাওয়ার ইচ্ছে করত, কিন্তু যেতে হলে টাকা লাগে। সেই টাকা যোগাড় করতে পারেনি। তারপর কবে যেন অনেকদিন পার হয়ে গেছে। আগ্রহটা মিইয়ে গেছে তখন। যাবার নামে এখন কেবল এই সমস্যা ওই সমস্যার কথাই মনে আসে। তবু সেই নিজের জায়গাটার জন্যে পেট পোড়ে হঠাৎ পাওয়া কোন অবসরে। তবে সে কথা কেবল তার নিজের মনেই থাকে, কোনদিন কাউকে বলেনি।
রাস্তায় লোক চলাচল না কমলেও পিঠে কেনার লোক কমে যায় রাত আটটার পরে। শেষের কয়েকটা পিঠে বেচতে সময় লাগে। কোন কোনদিন শেষ পর্যন্ত দু’একটা পিঠে বিক্রি করাই যায় না। সেদিন সেরকমই দুটো পিঠে নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ বসে থেকে গ্রাহক না পেয়ে ফতিমা জিনিস গুছিয়ে নিতে শুরু“ করে। পিঠেগুলো সে বিলিয়ে দেবে। কারণ ঠা া পিঠে জিলানী খায় না। আর পিঠে বানিয়ে বানিয়ে তার নিজের আর পিঠে খেতে ভালই লাগে না। তাই পিঠে দুটো হাতে নিয়ে দেবার মতো লোক খোঁজে। ঘরে ফিরে জিলানীর জন্যে দুটো গরম ভাত ফুটাতে হবে। ওদিকের ফুটপাতে ভরা পোয়াতি পাগলিটা তার গোদা পা নিয়ে শুয়ে শুয়ে চিল্লায় অন্য দিন, তাকেই এই বাড়তি পিঠে দিয়ে দেয় ফতিমা, কিন্তু আজ তাকে দেখতে পেল না। হয়ত আসেইনি। খেয়াল হয়নি এতক্ষণ। পিঠে সে সিগারেট দোকানি হামিদ কিংবা বাদামওয়ালা তমিজকেও দেয়। ওদের খোঁজে তাকাতে দেখে কাছেই ফুটপাতে খ্যাতা মুড়িয়ে পড়ে কে যেন কঁকাচ্ছে। কখন এখানে এসেছে ফতিমার তা খেয়াল হয়নি। ‘নতুন কোন হাভাইতা হইব’ ফতিমা ভাবে। ইচ্ছে করে পিঠে দুটো তাকেই দিতে কিন্তু আগ বাড়িয়ে খাতির করতে গিয়ে আবার কোন কোন চক্করে পড়ে যায়- ভেবে এগোল না। এগিয়ে গিয়ে তমিজের দিকে পিঠে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কেঠায় রাইখা গেল?’
‘কইতে পারি না। দেখছি না কাউরে।’
ফতিমা একটু হেসে বলে, ‘মনে হয় আমরা আন্ধা হইয়া গেছি।’
‘প্যাটের ধান্দা করতে করতে কোনো মুহি দেখনের অবসর আমরা আর পাই কই? এই বয়সে তুমি যে খাটনি খাটতাছ!’
‘যার যেমন কপাল। আমরা আইছি খাটনের লাইগা। খাটতাছি। কি করবা কও? এহন যাইতাছি বাই, নাতিনডা একা পড়তাছে। কাইল কিন্তু দেইখো। লোক বাড়ন ভালা না। পুলিশ ঝামেলা করবো পরে।’
ফুটপাথে ব্যবসা করার অনেক হ্যাপা। মস্তান, পুলিশ সামলাতে নিজেরা এক থাকতে হয়। নইলে ওরা চাঁদার নামে জুলুম করে। হামিদ আর তমিজ বেশ অনেকদিন ধরেই এই মোড়ে ব্যবসা করে আসছে। ফতিমা ওদের সাথে তাল দিয়ে চলে নিজের স্বার্থেই।
পরদিন ফতিমা আসার খানিক পরে এক কাইসঠা চেহারার মাতারি কাঠের ঠেলায় করে এনে দুটো পা না থাকা লোকটাকে আগের দিনের জায়গায় টেনে হিচড়ে নামিয়ে দিয়ে কারো দিকে না তাকিয়ে চলে গেল। এটা ফুটপাতের নিয়ম না। নতুন কেউ জায়গা নিতে এলে পুরোনোদের সাথে কথার্বাতা বলে পরিচয় করে। কিন্তু মাতারি সেদিকে গেল না দেখে ফতিমারা চোখে চোখে বিরক্তি প্রকাশ করে, আর ভিখিরীটার দিকে কোন মনোযোগই দেয় না। এমনিতেই ভিখিরীদের তারা নিজেদের সমগোত্র বলে ভাবে না। খেটে খাওয়া আর ভিক্ষা করে খাওয়ায় বিস্তর ফারাক। তাই গায়ে পড়া হয়ে ওর সাথে ফতিমা কি তমিজরা কথা বলতে যায় না।
কয়েকদিন পরে ভিখিরীটাকে ওই ফুটপাতে পড়ে থাকতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেল অন্যদের মতো ফতিমাও। প্রায়ই লোকটা জোরে জোরে গোঙ্গায়। যন্ত্রণার গোঙ্গানী। সারাদিনে একবার ওই মাতারি এসে খাইয়ে যায়। খাওয়াতে এসে গজগজ করে বিস্তর। লোকটার গলা তেমন শোনা যায় না। এমনকি ভিক্ষেও চায় না কারও কাছে। পথচারীরা যেটুকু দেয় তা পাশের থালায় পড়ে থাকে। কোন কোন দিন বদমাশ ছেলেরা থালা থেকে কিছু টাকা উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। ভিখিরীটা তাতেও কিছু বলে না। রাতে ভিখিরীকে নিতে এসে মাতারি মুখ খিস্তি করে গালাগাল করে টাকা কম হওয়ার জন্য। গাল দিতে দিতে ঠেলায় তোলে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে। কাজটা সে নিতান্ত বিরক্তি নিয়ে করে বোঝা যায়। ওই নিজের বেচা-বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে যা চোখে পড়ে তা নইলে এসব দিকে খুব বেশি মনোযোগ দেবার সময় ফতিমার হয় না। পিঠে বিক্রি শেষে দ্রুত ঘরে ফিরে জিলানীর ভাত রাঁধতে হয়। ফতিমার দিনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত হিসেবের মধ্যে থাকে। বাড়তি সময় তার নেই মোটেই। মেয়ে ফরিদা কতবার বলে, ‘মা, তুমি আইসা কদিন আরাম কইরা যাও।’ ফতিমা যায় না। এখন আয়েস করবে কেন? আয়েস করবে যখন শরীরে জোর থাকবে না।
খাটনি ভয় পায় না ফতিমা। জানপ্রাণ দিয়ে খেটে টাকা জমিয়েছিল বলেই না মেয়েকে এমন ভাল বিয়ে দিতে পেরেছে। ফরিদার স্বামীর আয় ভালো। জিলানী ছাড়াও আরও দুটো মেয়ে আছে ফরিদার। মেয়েদের নিয়ে স্বামীর সংসারে মোটামুটি সচ্ছলভাবেই দিন কাটাচ্ছে সে। জিলানীকে ফতিমা জোর করেই নিয়ে এসেছে ফরিদার জমজ মেয়ে দুটো জন্মের পর। নাতি হলেও আসলে জিলানীর ওপর তার পুত্র স্নেহ। ফরিদার বদলে যদি একটা ছেলে থাকত তবে মেয়ের বিয়েতে যে টাকা যৌতুক দিতে হয়েছে তা দিয়েই ছেলেকে ব্যবসায় লাগিয়ে দিতে পারত। মোড়ে একটা পান সিগারেটের দোকান দিলেও অনেক আয়। অবশ্য জিলানীকে সে চট করে ছোট কোন কাজে লাগতে দেয়নি। লেখাপড়া শিখবে জিলানী। বাসা বাড়িতে ফতিমা দেখেছে সাহেবদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে কত মোটা বেতনে চাকরি পেয়ে যায়। কত সুখে থাকে তারা। জিলানীকে তাই ফতিমা যত কষ্টই হোক অনেক লেখা পড়া শেখাবেই। জিলানীরও খুব পড়ার ইচ্ছে। ফরিদারা ছেলের পড়া নিয়ে অত ভাবে না। ছেলে বড় হয়েছে, তাকে এখন কাজে ঢুকিয়ে দিতে চায় তারা। সে জন্যে জিলানী বাপ মায়ের কাছে যেতে চায় না। নানিই তার সবচেয়ে আপন। নানিই তার মা।
রাতে জিলানী যখন দুলে দুলে পড়ে তখন ফতিমা মুখে এক খিলি পান পুরে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে থাকে। খুব সুন্দর লাগে জিলানীকে। ভুলে যাওয়া একটা মানুষের ছায়া যেন এই সময়টায় জিলানীর মধ্যে আবছাভাবে ফুটতে দেখে ফতিমা। মাত্র মাস দুয়েক কি তিনেক দেখেছিল মানুষটাকে। তাও দিনের বেলা দেখা মিলত কম। রাতে হারিকেনের আলোয় আর দিনে দূর থেকে চুরি করে দেখতে পেত। নাকের পাশে একটা বড় আঁচিল ছিল। ফতিমা সেই আঁচিল খুটত। খুঁটে একদিন রক্ত বের করে দিয়েছিল। তাও মানুষটা কিছু বলেনি। কদিনেই মানুষটা যেন জাদু করেছিল ফতিমাকে। ফতিমা তার জন্যে পাগল তখন। ইচ্ছে করত সারাক্ষণ কাছে কাছে থাকতে। খুব সোহাগ করতে জানত লোকটা। ফতিমা কি পছন্দ করে তা না জিজ্ঞেস করেই বুঝতে পারত। কোনদিন বকেনি, খারাপ কথা বলেনি। এমন সুন্দর মানুষটা যে কোথায় চলে গেল, ফতিমা কেন বাড়ির কেউ জানতে পারল না কোনদিন। যখন প্রথম গিয়েছিল তখন সকলে ধরেই নিয়েছিল সে গেছে মুক্তিযুদ্ধে। বলে যায়নি বলে ফতিমার খুব মন ভার হয়েছিল। ভেবেছিল ফিরে এলে কিছুতেই পান বানিয়ে দেবে না। কথা বলবে না। তখনও তার একবারও মনে হয়নি আর কখনই লোকটা ফিরে আসবে না। বাড়ির মানুষরা নানা জায়গায় খোঁজ খবর করেছে। উড়ো শোনা যেত ওখানে দেখা গেছে, সেখানে দেখা গেছে। নিজে দেখেছে এমন একটা লোকের সঙ্গে ফতিমাদের কারও দেখা হয়নি কোনদিন। মানুষটা চলে যাবার মাস দেড়েক পরে ফতিমার পোয়াতি অবস্থা ধরা পড়ে। পেটে মেয়েকে নিয়ে ফতিমা ঠোঁট ফুলাত থেকে থেকে। কেমন মানুষ একবারও কি আইতে পারে না? অভিমান নিয়ে প্রতিদিন পথের দিকে তাকিয়ে থাকত। আসবে নিশ্চয়ই। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও যখন মানুষটা আর ফিরল না তখন সকলের মাথায় বাড়ি পড়ল। একসময় তার না ফিরে আসা নিশ্চিন্ত হয়ে গেল। সবাই বলাবলি করে যুদ্ধ করতে গিয়ে কোথাও মারা পড়েছে। ফতিমা সে কথা বিশ্বাস করে না। একদিন মানুষটা ফিরে আসবেই- এই বিশ্বাস তার ছিলই। মাঝে উড়ে খবর আসে কোথায় নাকি বিয়ে করে সংসার পেতেছে লোকটা। ফতিমা পেটে হাত রেখে সন্তান দোহাই দেয়, পোলার কিরা লাগে, একবার দেখা কইরা যান। মানুষটা আসে না। ফতিমারও ছেলে না হয়ে হয় মেয়ে। ফরিদার জন্ম হলো নিবাপ ঘরে। জন্মেই মেয়ে পড়ল গঞ্জনার মধ্যে। একটু ভালবাসা পেল না কারও। মেয়ের মাথার এক ফোঁটা তেলের জন্যে ফতিমা কতদিন কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। বছর দেড়েক অপেক্ষা করার পর সকলের লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে একদিন কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে বুকে নিয়ে ট্রেনে চেপে বসে এসে নেমেছিল এই ঢাকা শহরে। বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ জুটিয়ে কোনমতে জীবন বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধে লড়তে লড়তে পরিচয় হারিয়ে নিজেই কবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে টেরও পায়নি।
এসব কথা এখন আর তেমন মনে পড়ে না। সবই ভাগ্য। ফতিমার কপালে খোদা যা লিখেছে তাই হয়েছে। বয়স হয়েছে, আর তো কিছুদিন। তারপর মরণ হলেই সব শান্তি। ভাবতে ভাবতে ফতিমা ঘুমিয়ে পড়ে।
খুব ভোরে জিলানীকে ভাত খাইয়ে কলেজে পাঠিয়ে তবে কাজে বেরোয় ফতিমা। তিন বাড়ির কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে ভাগের চুলোয় নিজের রান্না বসায়। জিলানীর জন্যে একটু মাছ করার চেষ্টা করে। পড়ার খাটনি অনেক। শক্তি দরকার। জিলানী কোনদিন তাড়াতাড়ি ফিরলে এক সাথে খায় দুজনে। নইলে জিলানীর ভাত বেড়ে রেখে ফতিমা খেয়ে নিয়ে বসে বসে খানিক ঝিমায়। বেশিক্ষণ সময় পায় না। পিঠের জন্য চালের গুঁড়া তৈরি করে আবার ছুটতে হয় পিঠে বেচতে।
সেদিন পিঠের সরঞ্জাম গুছিয়ে বসার পর তার ব্যস্ত চোখেই ধরা পড়ে ফুটপাথের ভিখিরীটা আজ একদম চুপচাপ। রোজকার মতোই পথচারীরা কেউ কেউ টাকা পয়সা ফেলে যাচ্ছে তার থালার ওপর। কিন্তু সে সেগুলো সামলাচ্ছে না। বাতাসে কটা টাকা উড়ে গেলে এক সদয় পথচারী নিজে তা কুড়িয়ে চাপা দিতে দিতে ফতিমাকেই ডেকে বলে, ‘ও পিঠাওয়ালী, এর সাথের মানুষ কই? অসুস্থ মনে হচ্ছে। দেখো একটু।’
ফতিমা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আজ পর্যন্ত কোন একটা কথা বলারও দরকার মনে করেনি নবাবের বাচ্চা ভিখিরী। তাকে এখন ফতিমা দেখতে যাবে! ভারি ঠেকা পড়েছে যেন তার! তার সামনে এখন কয়েকজন গ্রাহক লাইন দিয়ে অপেক্ষা করছে। গ্রাহক অসন্তুষ্ট করা যায় না। পথচারী আরও দুবার তাকে ডেকে সাড়া না পেয়ে নিজের পথ ধরে। তখন ফতিমার চোখ একবার অবচেতনেই ঘুরে আসে ভিখিরীর দিক থেকে। কিন্তু তার দুহাত এখন ভীষণ ব্যস্ত। উঠবার উপায় নেই। আর সে দেখেই বা করবে কী? ভিখিরীর কোন পরিচয় তো সে জানে না। যে মাতারি রোজ নামিয়ে দেয় সে কোনদিন দাঁড়ায় না। নামিয়ে দিয়েই চলে যায়। এরকম আর কেউ নেই। এই মোড়ের প্রতিদিনের বাসিন্দাদের সবার মধ্যে চিন-পরিচয়টা আছে। দায় দরকারে একে অন্যকে সাহায্য করে। কিন্তু এই নয়া আমদানিই এখনও পরিচয় করার গরজ দেখায়নি। তবে ভিখিরীটা উঠে বসে খুবই কম। সারাক্ষণ খ্যাতার ওপর পড়েই থাকে। পান-বিড়ি দোকানদার, কি বাদামওয়ালাও তাই পথচারীর ডাক শুনে চেপে গেছে। এখন কে এই ভিখিরীর ঝামেলায় যাবে?
ফতিমার পিঠা বেচা শেষ হয়। রোজকার মতোই সব গুছিয়ে ছুটছিল বাড়ির দিকে। হঠাৎ কি মনে করে বোঝা নামিয়ে বাড়তি পিঠাটা হাতে নিয়ে ভিখিরীর দিকে এগোয়। খ্যাতার ভেতর থেকে মৃদু গোঙ্গানীর শব্দ আসছে। ফতিমা ঝুঁকে বলে, ‘লও, পিঠা খাও।’
কোন নড়াচড়া নেই। তেমনি গোঙ্গানীই শোনা যায়। আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি আসবে। জোর বাতাস হচ্ছে। তেমনি শীত পড়ছে। সকলে বলছে শৈত্য প্রবাহ শুরু হয়েছে। আজ পিঠা বিক্রি খুব ভাল হয়েছে। ফতিমার মনটা তাই বেশ ভাল। সে একটু উদার হয়ে থালায় জমা টাকা পয়সাগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘মেঘ আইতাছে, তোমারে তো এহনও লইতে আইল না।’
তবু উত্তর আসে না। ফতিমা উবু হয়ে খ্যাতা টেনে মুখটা আলগা করে। চুল দাঁড়িতে আচ্ছন্ন মুখ। রাস্তার আলোতে ঠিকমতো দেখাও যায় না। কিন্তু লোকটার অসাড় দশা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ফতিমা উঠে যায় বাদামওয়ালার কাছে। দুজনে মিলে লোকটার মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করে। ততক্ষণে চারপাশে ভিড় জমে যায়। ফতিমা একসময় সরে আসে সেখান থেকে। এবার কেউ না কেউ একটা ব্যবস্থা নেবেই। ফুটপাথের এই মজা। কেউ দেখছে না হয়ত কিন্তু যদি একবার কেউ এগিয়ে আসে তখন আর লোকের অভাব হয় না। লোকটাকে ঠিক হাসপাতালে নিয়ে যাবে এখন।
পরদিন ফতিমা কেন যে একটু আগে ভাগে পিঠা বেচতে যায় নিজেই জানে না। ফুটপাথের লোকটা নেই। বাদামওয়ালাও নেই। পানওয়ালা বলে, ‘হগলতে তুইলা মেডিকলে লইয়া গেছে, কইব কেডা বাইচা আছে নি, নাকি মরছে। ওই মাতারিতে আইতে দেহি নাই। অহুক দেইখা মন হয় ফালাইয়া ভাগছে।’
ফতিমা পিঠা বানায়। গ্রাহক বলে, ‘পিঠা এমন ভেঙ্গেছে কেন?’
ফতিমা পিঠায় মনোযোগ দেয়। আজ শরীরটা তার জুতের লাগছে না। একটু আগে ভাগেই সে চুলো নিভিয়ে দেয়।
রাতে ফতিমার গায়ে বেশুমার জ্বর আসে। সকালবেলা জিলানীকে ভাত বেড়ে দেবার শক্তি তার হয় না। সেই জ্বরে পাঁচদিন টানা ভোগার পর একদিন ফতিমা আবার ফুটপাতে চুলা জ্বালিয়ে বসে। শৈতপ্রবাহ চলে গেছে। কনকনে ঠা ায় পিঠার চাহিদা হয় খুব। বেশ আয় হয়। সেটা এবার হলো না। মনটা খারাপ হয় ফতিমার। তবে ঠা া এখনও রয়েছে। আরও দিন দশেক ভাপা পিঠা ভালই চলবে। পরে কিছুদিন চিতই চলবে। তারপর তৈরি করবে মিষ্টি পাকান।
বাদামওয়ালা তমিজ তার খোঁজ নেয়। ‘অসুকে পড়ছিলা নাকি, জিলানীর নানি? কাহিল লাগতাছে দেহি।’
‘হ, কাল তমতি জ্বর ছাড়ে নাই। জব্বর কাহিল কইরা দিছে।’
‘আজই আইলা ক্যান। আরও দুই/চাইর দিন বিশ্রাম লইতে।’
‘জিলানীর বই কিনতে হইব। ট্যাহা দরকার।’
‘জিলানীর পড়াটা শ্যাষ হইলে তোমার কষ্ট কমতো। ম্যালা খাটনি হইতাছে তোমার। ’
চুপ করে থাকে ফতিমা, নিজের স্বপ্নের কথা কিছু বলে না। সে বাদামওয়ালাকে দুইটা গরম পিঠা দেয়। দামটা নেয় না। এরাই তার আত্মীয়র মতো। সুখে দুঃখে পাশে থাকে।
তমিজ বেশি জোর করে না। মাঝে মাঝে সেও জিলানীর জন্যে কিছু বাদাম বিনি পয়সায় দিয়ে থাকে।
নুলা ভিখিরির আর দেখা পাওয়া যায় না। ফতিমারাও তার কথা ভুলে যায় দুদিনেই। সারাবছরই এমন কত লোক আসে যায়। কে কার খোঁজ রাখে!
কয়েকদিন পরে আবার একদিন নুলা ভিখিরিকে ফুটপাথে আগের জায়গাতে দেখা গেল। চুল-দাড়ি ছোট করে কাটা। চেহারা সুরতের অবস্থাও বেশ ভাল দেখা যায়।
ফতিমাকে দেখে ছেচড়ে ছেচড়ে এগিয়ে আসে। সারা মুখে কৃতজ্ঞতার হাসি। ফতিমা পিঠের কড়াই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে তাকায়।
তাকিয়েই থাকে। লোকটাকে কই য্যান দেখছি, কই য্যান দেখছি- লাগে তার। ততক্ষণে লোকটা একেবারে কাছে এসে পড়ে। ফতিমার দৃষ্টি আরও ধারালো হয়ে ওঠে। এত কাছ থেকে লোকটাকে আর কখনও দেখেনি সে। দেখতে দেখতে সে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ভয় পাওয়া গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এই, এই!’
তার চিৎকার শুনে বাদামওয়ালা তমিজ, পানওয়ালা হামিদ ঘুরে তাকায়। পথচারীরাও থমকে দাঁড়ায়। হতভম্ব নুলা লোকটা সকলের দিকে তাকিয়ে অসহায়ভাবে বলে, ‘আমি তো কিছু করি নাই?’
ফতিমা দু পা সরে গিয়ে চিৎকার করে, ‘বেইমান, মিত্থুক। কর নাই, কর নাই? কই পালাইছিলা এতদিন?’
চারপাশের পথচারী এই চিৎকারে থমকে দাঁড়ায়।
পা ছাড়া লোকটা চোখে ঘন ঘন পলক ফেলে। ফতিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ফতিমা আবার চেঁচায়। ‘পোয়াতি বউ ফালাইয়া ভাগছিলা ক্যান?’
চারদিকে জমে ওঠা ভিড় মজার গন্ধ পায়। ‘এই পিঠাওয়ালী, চিল্লাও ক্যান? কি হইছে খুইলা কও।’
ফতিমা হঠাৎ নীরব হয়ে যায়। সে নিঃসন্দেহ। কিন্তু প্রমাণ কি। লোকটা যদি অস্বীকার করে?
সকলে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘আরে কি হইল চুপ মাইরা গ্যালা ক্যান? কি করছে নুলা বেটায়?’
মারমুখো ভিড়ের দিকে না চেয়ে ফতিমা লোকটার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে দেখে। যেন ভিমরি খেয়ে চোখ স্থির হয়ে গেছে। ফতিমা নাকের পাশের আঁচিলটার ওপর থেকে চোখ সরায় না। লোকটাও ক্রমে মনোযোগ দিয়ে ফতিমাকে দেখতে শুরু করে। তাদের এই ভাবান্তর জনতা খেয়াল করে না।
‘ওই মিয়া কি হইল?’ জনতা ফুঁসে ওঠে।
ফতিমাকে অবাক করে দিয়ে সহসা লোকটা নিজেই বলে, ‘হ ভাই, আমি অর জামাই আছিলাম।’
‘কয় কি বেটায়? তো এতদিন কই ছিলা মিয়া? পিঠাওয়ালীর জামাই আছে বইলা তো কোনদিন কিছু শুনি নাই?’Ñ আছড়ে পড়ে হাজার প্রশ্ন। এইসব প্রশ্নের জবাবে নুলা লোকটা এক সুদীর্ঘ গল্প শোনায়। সে গল্পে মুক্তিযুদ্ধ আছে, আছে সরাসরি যুদ্ধে পায়ে গুলি লাগার ভয়ঙ্কর গল্প, গুলি লাগা পায়ে পচন ধরার কথা, পা কেটে ফেলার কথা।
নতুন বউ ফেলেই সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গিয়েছিল। বললে যেতে দেবে না বলেই না বলে যাওয়া। ট্রেনিং নিয়ে নানাখানে যুদ্ধ করতে করতে ফুরসত মেলেনি একবারও দেখা করার। তাছাড়া খুব জরুরীও মনে হয়নি। দেশ স্বাধীন করাই ছিল বেশি কাজের। ঘর সংসার সব কিছু তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। একদিন আক্রমণ করতে গিয়ে উল্টো পাকবাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেলে খুব কাছ থেকে ব্রাশ ফায়ারের শিকার হয় গোটা দল। পাকবাহিনী সবাইকে মৃত ভেবে ফেলে গেলে স্থানীয় লোকরা তাকে জীবিত পেয়ে ভারতের হাসপাতালে দিয়ে আসে। হাসপাতালে পা দুটো কেটে ফেলার পর দীর্ঘ সময় লেগেছিল সুস্থ হয়ে উঠতে। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পরই পড়েছিল সবচেয়ে বড় কষ্টে। এমন পঙ্গু জীবন নিয়ে সে কি করে? এর তার সাহায্যে কয়েকদিন চললেও আপনজনের সামনে ফিরে আসার সাহস তার হয়নি। বিশেষ করে নতুন বউ ফতিমাকে কি করে মুখ দেখাবে তা ভাবতেই পারেনি। শেষ পর্যন্ত সে চলে গিয়েছিল অনেকদূরে। পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীর ফেরিঘাটে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছে এতদিন। সেখানেই জীবনটা কেটে যেত হয়ত। কিন্তু কদিন আগে কয়েকটা লোক জোর করে ঢাকা নিয়ে এসেছে তাকে। এখানে তাকে দিয়ে ভিক্ষে করাবে বলে।
অসহায় হাহাকার নিয়ে শেষের কথা ক’টি বলে লোকটা। জনতা উৎসুক মুখে সে কথা শোনে। তারা ক্রমশ আর্দ্র হতে থাকে সমবেদনায়।
ফতিমাও ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে ৩৭ বছর আগের একটি মানুষ। মানুষটাকে নিয়ে ফতিমা এখন কি করে?
৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯, ঢাকা
No comments