নতুন কোম্পানি ও মিউচু্যয়াল ফান্ডের তালিকাভুক্তি আটকে আছে তিন চক্করে- পুঁজিবাজার by রাজু আহমেদ
তিন চক্করে আটকে আছে পুঁজিবাজারে নতুন কোম্পানি ও মিউচু্যয়াল ফান্ডের তালিকাভুক্তি প্রক্রিয়া। সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সিদ্ধানত্মহীনতা, কোম্পানির ৪০ শতাংশ শেয়ার ছাড়ার বাধ্যবাধকতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক নতুন ইসু্য বাজারে আসতে পারছে না।
এর বিপরীতে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তীব্র হয়ে উঠেছে ভাল শেয়ারের সঙ্কট। চাহিদা ও যোগানের এই অসামঞ্জস্যতা কমাতে স্বল্পসময়ের মধ্যে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বাড়াতে না পারলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়তে পারে বলে বিশেস্নষকরা মনে করেন।এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারে যে হারে বিনিয়োগ বাড়ছে সেই তুলনায় নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিনিয়োগ প্রবাহ আরও বেড়ে গেলে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। অনাকাঙ্ৰিত পরিস্থিতি এড়াতে এখনই উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে নতুন নতুন কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসতে হবে।
সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নানা মাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে। ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়ের সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ পুঁজিবাজারের দিকে ঝুঁকছেন। এ কারণেই প্রতিদিনই নতুন নতুন বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে আসছেন। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশের (সিডিবিএল) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে বিও হিসাবধারীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ৪৬৭ থেকে বেড়ে ১৯ লাখ ২০ হাজার ৮১৪টিতে দাঁড়িয়েছে।
বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি শেয়ারবাজারে নগদ টাকার প্রবাহও ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে গেছে। বিশেষ করে কালো টাকা সাদা করার শর্তহীন সুযোগ গ্রহণ করে অনেকেই বিপুল পরিমাণ টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন। কারণ অন্যান্য খাতের চেয়ে শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগে ঝামেলা কম, মুনাফার সুযোগ বেশি। চলতি অর্থবছরের জন্য কালো টাকা সাদা করার ৰেত্রে বেশ কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে শিল্প ও অবকাঠামো খাতে এ ধরনের টাকা বিনিয়োগের ৰেত্রে কর্মসংস্থানের সংখ্যাসহ সামগ্রিক পরিকল্পনা জমা দিয়ে অনুমোদন নিতে হবে। কোন প্রকল্পে ঘোষিত কর্মসংস্থান না হলে কালো টাকার বৈধতা বাতিল করা হবে। বাড়ি ও জমি কেনার ৰেত্রেও এক ব্যক্তির জন্য একবার সুযোগ দেয়ার বিধান করা হয়েছে। কিন্তু শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ৰেত্রে এ ধরনের কোন শর্ত না থাকায় গত ৬ মাসে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হয়েছে বলে সংশিস্নষ্টরা ধারণা করছেন। মূলত এ কারণেই এ সময়ের মধ্যে বাজারে শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
কালো টাকার আগমনে শেয়ারবাজারে লেনদেন বৃদ্ধির প্রভাবেই বাজারে শেয়ার সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠছে। কারণ অপ্রদর্শিত বা কালো টাকায় কেনা শেয়ার দু'বছরের আগে বিক্রি না করার শর্ত বেঁধে দেয়া হয়েছে। এ কারণে বিপুলসংখ্যক শেয়ার নিয়মিত লেনদেনের বাইরে চলে যাচ্ছে। এসব কারণে বাজারে ভাল শেয়ারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে সংশিস্নষ্টদের ধারণা। এ অবস্থায় নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া গতিশীল করে শেয়ারের সংখ্যা বাড়াতে না পারলে বাজারে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাল শেয়ারের যোগান বাড়াতে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সম কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে সক্রিয় বিদেশী কোম্পানিগুলোকেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নিতে হবে। এতে একদিকে যেমন পুঁজিবাজার শক্তিশালী হবে, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরাও ভাল শেয়ারে বিনিয়োগ করার সুযোগ পাবেন।
সংশিস্নষ্টরা মনে করেন, পুঁজিবাজারে ভাল শেয়ারের সঙ্কট কাটাতে হলে এসইসি'কে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার দিক থেকে কাঙ্ৰিত প্রচেষ্টা লৰ্য করা যাচ্ছে না। বরং তাদের কিছু কিছু সিদ্ধানত্ম নতুন ইসু্য তালিকাভুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে আটকে রাখা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার মিউচু্যয়াল ফান্ড এবং কয়েকটি কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রসত্মাব (আইপিও) প্রক্রিয়া।
অন্যদিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির ৰেত্রে ৪০ শতাংশ শেয়ার ছাড়ার শর্ত বেঁধে দেয়ায় বেসরকারী খাতের অনেক ভাল প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তির সম্ভাবনা কমে গেছে। নতুন এই নীতির কারণে ইতোমধ্যেই শেয়ার ছাড়ার সিদ্ধানত্ম থেকে পিছিয়ে গেছে কয়েকটি কোম্পানি। একইভাবে এসইসি'তে প্রক্রিয়াধীন বেশ কয়েকটি আইপিও আটকে গেছে। ৪০ শতাংশ শেয়ার ছাড়ার বাধ্যবাধকতা বহাল থাকলে অধিকাংশ কোম্পানিই শেয়ারবাজারে আসতে উৎসাহিত হবে না। তবে শুধু কর রেয়াতের সুযোগ নিতে নামমাত্র শেয়ার ছাড়ার প্রবণতা বন্ধ করতে কোম্পানির নির্দিষ্ট অংশ শেয়ারবাজারে ছাড়া বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। এই বাধ্যবাধকতা যাতে সহনীয় হয় সেদিকে বিবেচনায় রেখেই চূড়ানত্ম সিদ্ধানত্ম নেয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
তাঁরা মনে করেন, শেয়ারবাজারকে অস্থিতিশীলতা থেকে রৰা করতে হলে এখনই ভাল শেয়ারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। যেসব কোম্পানির আইপিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে যথাযথভাবে যাচাইয়ের মাধ্যমে সেগুলোকে দ্রম্নত অনুমোদন দেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি নতুন মিউচু্যয়াল ফান্ডগুলোর অনুমোদনে এসইসির নেতিবাচক মনোভাব পরিবর্তন করা প্রয়োজন। একইভাবে সরকারী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার প্রক্রিয়া স্বল্পসময়ের মধ্যে শেষ করা হলে শেয়ারবাজারে বিপুলসংখ্যক শেয়ার যুক্ত হবে_ যা বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সভাপতি রকিবুর রহমান বলেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। নতুন নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে আসছেন। বিনিয়োগকারীদের আস্থার কারণেই সাধারণ সূচক ৫০০০ পয়েন্টের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। কিন্তু বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ভাল শেয়ারের সরবরাহ নেই। ফলে অনেক শেয়ারই অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় বাজারে শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানে এসইসিতে ঝুলে থাকা মিউচু্যয়াল ফান্ডগুলোর আবেদন অতি দ্রম্নত নিষ্পত্তি করে বাজারে আনা উচিত।
No comments