দোকান কর্মচারী থেকে শামীম চৌধুরী শত কোটি টাকার মালিক- মুদ্রা পাচারের বড় অংশ জঙ্গী ও উলফাদের দেয়া হতো by গাফফার খান চৌধুরী
মুদ্রা পাচারকারী চক্রের গডফাদার ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সাংসদ প্রার্থী হাজী মুজিব ওরফে সোনা মুজিবের সহোদর ছোট ভাই বিএনপি নেতা মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যান শামীম চৌধুরীকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দারা।
এই চেয়ারম্যানকে রিমান্ড থেকে বাঁচাতে গিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন এক বিচারক। গ্রেফতারের পর বেরিয়ে পড়েছে সামান্য দোকান কর্মচারী থেকে কমপৰে শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার মতো চাঞ্চল্যকর কাহিনী। মুদ্রা পাচার ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থের একটি বড় অংশ জঙ্গী ও উলফাদের দেয়া হতো। এদিকে মুদ্রা পাচারকারী চক্রের গডফাদারদের সহায়তা করার অভিযোগে ফেঁসে যাচ্ছেন বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একটি সংস্থার কয়েকজন উর্ধতন কর্মকর্তা।গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত ২১ ডিসেম্বর জিয়া আনত্মর্জাতিক বিমানবন্দরে মুদ্রা পাচারকালে ২ কোটি টাকার মুদ্রাসহ ওসমানকে গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারের পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ে ওসমান। জিজ্ঞাসাবাদে ওসমান গোয়েন্দাদের জানায়, সে দুবাই ছাগল চরানোর কাজ করে। এ ব্যাপারে দুবাইয়ের সংশিস্নষ্ট অফিসে খোঁজ নিয়ে বিষয়টির কোন সত্যতা পায়নি গোয়েন্দারা। পরে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের মুখে মুদ্রা পাচারের অনেক তথ্য প্রকাশ করে দেয় ওসমান। যে ২ কোটি মূল্যমানের বৈদেশিক মুদ্রাসহ ওসমান গ্রেফতার হয়েছে সে মুদ্রাও শামীম চৌধুরীর। গ্রেফতার হওয়ার একদিন আগে পল্টন থেকে বৈদেশিক মুদ্রাগুলো তোলা হয়েছিল। এরপর মুদ্রাগুলো শামীম চৌধুরীর শানত্মিনগরের বাসায় রাখা হয়। পরদিন এসব মুদ্রা বিমানবন্দরে পাঠানো হয়। মুদ্রা পাচারকারীরা বিমান ছেড়ে যাওয়ার মাত্র ২০/২৫ মিনিট আগে বিমানবন্দরে হাজির হয়। তাড়াহুড়া করে এ সময় যাত্রীদের সঠিকভাবে চেকিং করা সম্ভব হয় না। এছাড়া কিছু অসাধু কর্মকর্তা এসব চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকে। কারণ হিসাবে জানা গেছে, বিমানবন্দর কতর্ৃপৰের কারণে কোন বিমান ছাড়তে দেরি হলে সংশিস্নষ্ট দেশ মোটা অঙ্কের জরিমানা করে থাকে। জরিমানা দেয়ার ভয়ে অনেক সময় কতর্ৃপৰ তাড়াহুড়া করে যাত্রীদের লাগেজ চেক না করেই ছেড়ে দেয়। এ সুযোগে মুদ্রা পাচার হয়ে যায়।
ওসমানের দেয়া তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে গোয়েন্দারা শামীম চৌধুরীর মুদ্রা পাচারকারী সিন্ডিকেটের সন্ধান পায়। তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ জানুয়ারি ভোরে রাজধানীর শানত্মিনগরের বাড়ি থেকে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যান শামীম চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় চেয়ারম্যানের গাড়িচালক রফিককেও গ্রেফতার করে গোয়েন্দারা। চালক রফিক অনেক কিছুই প্রকাশ করে দেয়। ওইদিনই পৌর চেয়ারম্যান শামীম চৌধুরীকে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে সিএমএম আদালতে সোপর্দ করা হয়। অনত্মত অর্ধশত আইনজীবী আসামি শামীম চৌধুরীর জামিন প্রার্থনা করেন। আদালত ২০ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য করেন। শুনানি শেষে বিচারক ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। কিন্তু পরে তা স্থগিত করে দেন। বিচারকের এমন কর্মকা-ের বিষয়টি সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয়ে গড়ালে মন্ত্রণালয় বিচারককে এ বিষয়ে সতর্ক করে দেয়। পরে অবশ্য বিচারক ৪ দিনের রিমান্ড বহাল রাখেন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এই বিএনপি নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান '৯০ দশকে ঢাকা স্টেডিয়াম মার্কেটের চাঁদনী ইকেট্রনিক্সের কর্মচারী ছিল। কর্মচারী থাকাকালীন সময় থেকেই সে মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সহোদর বড় ভাই হাজী মুজিব ওরফে সোনা মুজিবের হাত ধরেই শামীম চৌধুরী মুদ্রা পাচার জগতে প্রবেশ করে। এক সময় নিজেই মুদ্রা পাচার জগতের গডফাদার হয়ে ওঠে। কমলগঞ্জ পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মহসীন মধু শামীম চৌধুরীর চোরাচালান সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। মধুর বিরম্নদ্ধে অনত্মত ২০টি মামলা রয়েছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শীর্ষ অবৈধ টাকার মালিক ও দুর্নীতিবাজদের তালিকায় মহসীন মধুর নাম ছিল ৩৫ নম্বরে। দীর্ঘদিন ধরে মুদ্রা পাচার করে শামীম চৌধুরী নিজেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। পরে চাঁদনী ইলেকট্রনিক্সের দোকান কিনে নেয় শামীম চৌধুরী। এছাড়াও নামে বেনামে অঢেল ধন সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তিনি। অনত্মত শত কোটি টাকার মালিক এই মুদ্রা পাচার চক্রের গডফাদার। এই গডফাদারের বড় ভাই হাজী মুজিব সোনা চোরাচালানের গডফাদার হওয়ায় এলাকায় তাকে সবাই সোনা মুজিব হিসেবে চিনে। চোরাচালানের মাধ্যমে বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ায় কালো টাকা সাদা করতে দু'সহোদর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়। ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগে টিকিট পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন সোনা মুজিব। কিন্তু অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকায় তিনি আওয়ামী লীগের টিকিট পাননি। পরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে এমপি প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করেন। এরপর আওয়ামী লীগ থেকে সুবিধা না পেয়ে বিএনপির হয়ে রাজনীতি করতে থাকেন সোনা মুজিব। এক সময় সফলও হন। সর্বশেষ ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের টিকিট পেয়ে যান। শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ আসনে আওয়ামী লীগের উপাধ্যৰ আব্দুস শহীদের বিপৰে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সোনা মুজিবের রাজধানীর শ্যামলী রিং রোডের বাসায় উলফা নেতারা নিয়মিত বৈঠক করতেন। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে সোনা মুজিবের বাড়ির আশপাশেই উলফার ঘাটিও ছিল। অনুপ চেটিয়ার সঙ্গেও সোনা মুজিবের সখ্য ছিল।
দু'সহোদর সোনা মুজিব ও শামীম চৌধুরী চোরাচালান ব্যবসা থেকে উপার্জনের একটি বড় অংশ জঙ্গীদের পিছনে খরচ করে। এছাড়া বিগত দিনে বাংলাদেশে বসবাসকারী উলফার পিছনেও প্রচুর অর্থ ঢেলেছে তারা। বিশেষ করে শামীম চৌধুরী মাদক, অস্ত্রসহ নানা ধরনের ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। মুদ্রাসহ বিভিন্ন ধরনের চোরাচালান ব্যবসার সঙ্গে বিমানবন্দরের কিছু উর্ধতন অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। এ ব্যাপারে তদনত্ম চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মোলস্না নজরম্নল ইসলাম জানান। খবরের সত্যতা স্বীকার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর জোনের ডিসি মাইনুল হাসান জানান, রিমান্ডে শামীম চৌধুরীকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। শামীম চৌধুরী কালো টাকা সাদা করতে নামে বেনামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন। এসব প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। তার কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে তদনত্মের স্বার্থে তা প্রকাশ করা উচিত হবে না।
No comments