প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি by তৌফিক অপু
ক’দিন থেকেই মনটা ভীষণ খারাপ। হঠাৎ একদিন পড়িমরি করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল নাদিয়া। চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। বাসার লোকজনও হতবাক নাদিয়ার এমন আচরণ দেখে। মা ছুটে গিয়ে দরজা নক করতেই ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো।
কি হয়েছে কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। অনেক বলে কয়ে দরজাটা খোলানো হলো। কিন্তু নাদিয়ার চোখ মুখ দেখে আঁতকে উঠল সবাই। ভয়ে কেমন যেন জড়োসড়ো হয়ে পড়েছে সে। কোন কথাই বেরুচ্ছে না তার মুখ দিয়ে। মা কাছে এসে নাদিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই চিৎকার করে কেঁদে ফেলল সে। সেই সঙ্গে আর ভার্সিটি যাবে না বলেও জানিয়ে দেয়। কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়, ভার্সিটি আসা-যাওয়ার পথে কয়েক দিন ধরেই উঠতি বয়সী কয়েকটি ছেলে তাকে ফলো করে। আজ নাকি পিছু নিতে নিতে বাড়ির সামনে চলে আসে এবং বাজে ইঙ্গিত করতে থাকে। আর সেই ভয়েই নাদিয়া দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে আসে। নাদিয়াকে বাবা আশ্বস্ত করে বলে, কয়েকটি বখাটে ছেলের ভয়ে ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করা যাবে না। স্থানীয় থানায় ইনফর্ম করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কথা মোতাবেক থানায় গিয়ে কয়েক জনের নামে জিডি করে আসে নাদিয়ার বাবা। সংবাদ পেয়ে পুলিশও অভিযুক্তদের ঘটনাস্থলে এসে শাসিয়ে যায়। এবং নাদিয়াকে আশ্বস্ত করে, ভার্সিটি যেতে আর কোন সমস্যা হবে না। ওদেরকে ধরে নিয়ে গেলেন না কেন নাদিয়ার এমন প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ জানায়, মামলা হলে ধরা যেত, তাছাড়া এসবের তেমন কোন কেসটেস হয় না। ওদেরকে আচ্ছা মতো বলে দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে তেমন টেনশন করতে হবে না। আপনারা আপনাদের মতো করে চলতে পারেন। আশ্বস্ত হয়ে নাদিয়া আবার তার স্বাভাবিক চলাফেরা শুরু করে। কিন্তু বাস্তবিক যা ঘটেছে তা হিতেবিপরীত। এলাকার উঠতি বয়সী মাস্তানগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। যার ফলে শ্লীলতাহানির শিকার হয় নাদিয়া। লজ্জা আর অপমানে নির্বাক হয়ে পড়ে সে। এলাকার মাতবর শ্রেণীর লোকদের কাছে বিচার চেয়ে আরও বিপদ যেন ঘনিয়ে আনেন নাদিয়ার বাবা। উল্টো মেয়ের দুশ্চরিত্রার অপবাদ নিয়ে ঘরে ফিরতে হয় নাদিয়ার বাবাকে। নিজের অপমান এবং বাবার অপমানের বিচার না পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয় নাদিয়া। পরের দিনই ফলাও করে দেশের সব পত্রিকার শিরোনাম হয় নাদিয়া। এ দৃশ্য সবারই কমবেশি জানা। তারপরও কেমন যেন অদ্ভূত এক দায়সারা ভাব নিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি সমাজে। মনে হয় কারোরই করার কিছু নেই। কোন মেয়ে প্রবলেমে পড়া মানেই সকল দোষ তার। যাবতীয় দোষ মেয়েটির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সমাজ যেন দায়মুক্ত হয়। কেউ ভাবি না মেয়ে মানেই মা, বোন, স্ত্রীÑযারা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাহলে সমাজ কিভাবে পারে একটি নিষ্পাপ মেয়েকে দোষী সাব্যস্ত করতে? নাদিয়ার মতো অনেকেই পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে, কিন্তু সে সব সংবাদের ভার বইবার ক্ষমতা বুঝি আমাদের হয়নি। তা না হলে প্রতিনিয়ত এমন সংবাদ আমাদের পড়তে হতো না। কেন এভাবে হারাব তাদের। কেনই বখাটেদের সাহস দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। ইভটিজিং শব্দটির গ-ি ছাড়িয়ে গেছে বখাটেরা। যে কারণে সরকার বাধ্য হয়েছে ইভটিজিং শব্দটির নাম পরিবর্তন করে যৌন হয়রানি রাখতে। আদালতের এক আদেশে বলা হয়েছে, ইভটিজিং শব্দটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে কারণ শব্দটি অপরাধের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। প্রস্তাবিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ১০(ক) এ অস্ট্রেলিয়ান স্টকিং ল-ও সারমর্ম করে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই আইনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। গত ০২ নবেম্বর ২০১০ সালে যৌন হয়রানি, নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে গাইডলাইন চেয়ে আবেদন করে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী পরিষদ। তবে গাইডলাইনের চেয়েও জরুরি সচেতনতা বৃদ্ধি। বখাটেদের উত্ত্যক্ত করা ছাড়াও স্কুল, কলেজের ছেলেরা যখন তাদের সহপাঠী কিংবা বান্ধবীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপ্রীতিকর ছবি মোবাইলে ধারণ করে বাজারে ছেড়ে দেয়, তখন সত্যিই শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কেমন শিক্ষা আমরা দিচ্ছিÑযা আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আলোর পথ দেখাতে পারছে না? তাহলে কি অন্যান্য শিক্ষাসূচির মধ্যে নৈতিকতাও পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ? যদি আইনের দিক থেকে দেখি, তাহলে দেখা যায় ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যাওয়া’র মতো অবস্থা। স্টকিং বা কোন মেয়ের পিছু নেয়া থেকেই এ ধরনের অপরাধ শুরু হয়। তারপর নানা রকম কটূক্তি। এসব বিষয় একটা মেয়ের জন্য কতটা অস্বস্তিকর তা ভুক্তভোগীরা ভাল করে জানে। শুরুটা এখান থেকেই। যার শেষ পরিণতি মেয়েটির আত্মহত্যা। এ অপরাধ প্রবণতা সমাজে ব্যাধির আকার ধারণ করেছে।কেউ প্রতিবাদ করলেও তার ভাগ্যে জোটে নির্মম নির্যাতন। অথচ দেখার কেউ নেই কিংবা দেখেও কেউ দেখছে না। আর এ সুযোগে বেড়েই চলে যৌন হয়রানি। পুলিশও সচেষ্ট হয়, তবে তা হচ্ছে মেয়েটির নিথর দেহ নিয়ে। শুরু হয় ধরপাকড়। কিন্তু এ ধরপাকড় নিঃস্ব হয়ে পড়া পরিবারটির কি কাজে আসে? অথচ নিরাপরাধ এ মেয়েদের আত্মহননের পথ থেকে ইচ্ছা করলেই বিরত রাখতে পারে প্রশাসন। বখাটের বিপক্ষে যখন প্রাথমিক অভিযোগ দেয়া হয় তখনই যদি কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া যায় তাহলে হয়ত উপকার পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া স্থানীয় প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে পুলিশ জোরালো একটা ভূমিকা রাখতে পারে। একটি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ভিকটিম প্রাথমিক অভিযোগের কোন সলিউশন পায় না। আর এ গ্যাপেই ঘটে যায় নানা অঘটন। ব্যাপারটা এমন অভিযোগ করাটাই অন্যায় হয়েছে। নীরবে সহ্য করাটাই উত্তম। প্রশাসন বুঝি শুধুমাত্র পয়সাওয়ালাদের জন্য। সত্যিকার অর্থেই প্রশাসন কবে জনগণের বন্ধু হবে ? কবে আসবে সেই দিন যেদিন মানুষ তাদের অসুবিধা প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে উপকার পাবে? আমরা চাই
No comments