আইনজীবী রওশন আক্তারের দুই খুনী গ্রেফতার- ভুয়া পরিচয়ে ফ্ল্যাটে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি ॥ গোয়েন্দা দলের অভিযানে ৫শ’ ডলার ও চাকু উদ্ধার
বহুল আলোচিত আইনজীবী রওশন আক্তার খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়েছে নিরাপত্তা কর্মীর ছদ্মবেশে চাকরি নেয়া ২ খুনীকে।
ফ্ল্যাট মালিককে হত্যা করে নিরাপদে লুণ্ঠন করার পরিকল্পনা মোতাবেক রওশন আক্তারকে খুন করা হয় বলে গ্রেফতারকৃত খুনীরা স্বীকার করেছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে চুরি যাওয়া টাকা পয়সা, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাকুসহ অন্যান্য মালামাল। গ্রেফতারকৃতদের ৬ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।গত ৩১ ডিসেম্বর সোমবার দুপুর ২টায় রাজধানীর মিরপুর মডেল থানাধীন ৬ নম্বর সেকশনের এ ব্লকের ৩ নম্বর রোডের ৪ নম্বর শেলটেক টিউলিপ নামে আবাসিক ভবনের তৃতীয় তলার সি/৩ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ (ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ) এর সহযোগী অধ্যাপক মাহবুব-ই সাত্তারের স্বাক্ষী আইনজীবী রওশন আক্তারের (৬০) লাশ হাত-মুখ ও গলা রশি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করে মিরপুর থানা পুলিশ।
নিহতের ছোট ভাই ড. মোঃ খালেকুজ্জামান জনকণ্ঠকে জানান, ঘটনার সম্ভাব্য সময়ে রওশন একাই ছিলেন। একমাত্র মেয়ে ডা. রেজওয়ান আক্তার মাহবুব মিনা ওই সময় বাসার বাইরে ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মিরপুর মডেল থানায় নিহতের স্বামী বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় কাউকে এজাহারনামীয় আসামি না করেই মামলাটি দায়ের করেন তিনি।
মামলাটির তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা মিরপুর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক মাসুদুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই বাড়ির নিরাপত্তা কর্মী রাসেল ও তাজুল উধাও হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, লুণ্ঠনের উদ্দেশেই বাড়ির দুই নিরাপত্তাকর্মী রওশন আক্তারের ফ্ল্যাটে যেতে পারে। লুণ্ঠনে বাঁধা দেয়ায় দুই নিরাপত্তা কর্মী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। ফ্ল্যাট থেকে ২০ হাজার টাকা, প্রায় ৩ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কারসহ দামী মালামাল খোয়া যাওয়ার আলামত পাওয়া যায়।
এদিকে ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পরেও আসামিরা গ্রেফতার না হওয়ায় গত ৫ জানুয়ারি মামলাটি মিরপুর মডেল থানা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে স্থানান্তর করা হয়। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মাইনুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার রাত ৩টায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলামের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান, জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম ও আবু তোরাব মোঃ শামসুর রহমানের নেতৃত্বে দুটি দল একই সঙ্গে চাঁদপুর এবং ময়মনসিংহ জেলায় অভিযান চালায়।
অভিযানে চাঁদপুর রেলস্টেশনের একটি চায়ের দোকান থেকে রাসেল ওরফে সাকিবকে (১৯) গ্রেফতার করা হয়। তার পিতার নাম সোবহান জমাদ্দার। বাড়ি পটুয়াখালী জেলা সদরের চান্দুখালী গ্রামে। আর ময়মনসিংহ জেলা সদরের বাগমারার চরপাড়ার ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় সোলায়মান ওরফে রবিন ওরফে তাজুলকে (১৯)। তার পিতার নাম কামাল লুন্দি। বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানাধীন ভৈরবগাছতলা গ্রামে। তাজুলের মা ময়মনসিংহের চরপাড়ায় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আয়া। সেখানেই অবস্থান করছিল তাজুল। তাজুলের বাড়ি থেকে ৩শ’ মার্কিন ডলার এবং রাসেলের কাছ থেকে হত্যাকা-ে ব্যবহৃত ১টি চাকু, সাড়ে ৬ হাজার টাকা ও ২শ’ মার্কিন ডলার উদ্ধার করা হয়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে গ্রেফতারকৃত ২ জন সর্ম্পকে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, গ্রেফতারকৃতরা শেলটেক টিউলিপ আবাসিক ভবনের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে কর্মরত ছিল। তারা রাজধানীর মৌচাকের একটি নামসর্বস্ব সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ১০ হাজার টাকা জমা রেখে ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে এমিকন সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি নেয়। পরে ওই কোম্পানির মাধ্যমেই শেলটেকের ওই বাড়িতে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর সকালে নিয়োগ পান তাজুল আর রাতে নিয়োগ পান রাসেল। এ দু’জন অসৎ উদ্দেশ্যেই ভুয়া নামঠিকানা ব্যবহার করে চাকরি নেয়। এরপর হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটায়। এ হত্যাকা-ের পেছনে আরও কোন কারণ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযান পরিচালনাকারী সকল ডিবি কর্মকর্তা ও নিহতের একমাত্র মেয়ে ডা. মীনা উপস্থিত ছিলেন।
ডিবির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার তোরাব আলী জনকণ্ঠকে জানান, গ্রেফতারকৃতরা সিকিউরিটি কোম্পানির কাছে যে তথ্য দিয়েছে তাও ভুয়া। ন্যূনতম যাচাইবাছাই ছাড়াই সিকিউরিটি কোম্পানিটি ওই বাড়িতে নিরাপত্তা কর্মী সরবরাহ করে। এ ব্যাপারে আরও অনুসন্ধান চলছে।
মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মাইনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, সিকিউরিটি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটি ফ্ল্যাট মালিক সমিতির কাছে নাম ঠিকানা যাচাইবাছাই না করেই গ্রেফতারকৃতদের সরবরাহ করে। ফ্ল্যাট মালিক সমিতিও নিয়োগপ্রাপ্ত নিরাপত্তা কর্মীদের নামপরিচয় যাচাইবাছাই করেনি। তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও জানান, নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই ফ্ল্যাটে চুরির পরিকল্পনা করতে থাকে গ্রেফতারকৃতরা। গত ১৮ ডিসেম্বর তারা আইনজীবী রওশন আক্তারের ফ্ল্যাটে চুরির উদ্যোগ নেয়। পরিকল্পনা মোতাবেক ঘটনার দিন সকালে গার্ড রুমের সিলিং ফ্যানটি ৫শ’ টাকায় বিক্রি করে দেয়। ফ্যান বিক্রির টাকায় ৭/৮ ইঞ্চি লম্বা একটি ধারাল চাকু কেনে।
ঘটনার দিন সকাল ১০টায় তারা নিচে পড়ে যাওয়া একটি বালিশের কভার ফেরত দেয়ার ছল করে রওশন আক্তারের ফ্ল্যাটে যায়। ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিং বেল টেপে। রওশন আক্তার দরজা খুলে দেয়ামাত্র তারা ঘরে ঢোকে। সোলায়মান বালিশের কভার দিয়ে রওশন আক্তারের মুখ চেপে ধরে। আর রাসেল চাকু দিয়ে ভয় দেখায়। পরে তারা রওশন আক্তারকে টেনে ভিতরের রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর বিছানার চাদর গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে। হত্যার পর রওশন আক্তারের আলমারি ও ওয়্যারড্রপ ভেঙ্গে ২০ হাজার টাকা, আনুমানিক ৫শ’ মার্কিন ডলার, কয়েকটি ঘড়ি, কয়েকটি স্বাক্ষর করা ব্ল্যাঙ্ক চেক নিয়ে গার্ড রুমে চলে যায়।
এদিকে রওশন আক্তারকে হত্যার সময় ধস্তাধস্তিকালে চাকুতে রাসেল ও সোলায়মানের হাত কেটে যায়। গার্ডরুমে গিয়ে তারা ছেঁড়া লুঙ্গির কাপড় দিয়ে হাত বাঁধে। এ সময় এক চালক বিষয়টি দেখে ফেলেন। চালক রাসেল ও তাজুলের কাছে হাত কাটার কারণ জানতে চান। রাসেল ও সোলায়মান জানায়, তারা উপরে খেলতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছে। হাত বাধার পর দু’জনেই গেটের বাইরে গিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এমন ঘটনায় চালকের সন্দেহ হয়। তিনি উপরে গিয়ে ঘটনাটি জানতে পারেন। পরে পুলিশ রওশন আক্তারের মরদেহ উদ্ধার করে।
এদিকে গ্রেফতার এড়াতে রাসেল হত্যাকা-ের পর পরই পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল ও সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জে এবং সোলায়মান ময়মনসিংহে অবস্থান করতে থাকে। নিরাপদে টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার লুণ্ঠন করতেই পরিকল্পিতভাবে রওশন আক্তারকে হত্যা করা হয় বলে গ্রেফতারকৃতরা স্বীকার করেছে। ইতোপূর্বে গ্রেফতারকৃতরা অল্প সময়ে বড়লোক হতে গাড়ি চুরি করার পরিকল্পনা করেছিল। গাড়ি চুরিতে ব্যর্থ হয়ে তারা বাসাবাড়ি থেকে টাকা-পয়সা সোনাদানা লুণ্ঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক লুণ্ঠন করতে গিয়েই রওশন আক্তারকে খুন করে গ্রেফতারকৃত ২ আসামি। আসামিরা ভুয়া এসএসসি পাসের সনদ দিয়ে সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিল। সিকিউরিটি কোম্পানিতে দেয়া তাদের নামঠিকানা পুরোপুরি ভুয়া।
আসামিদের বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম তানভীর আহমেদের আদালতে সোপর্দ করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি শেষে প্রত্যেককেই ৬ দিনের করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
No comments