টিসু্য কালচার পদ্ধতিতে বাঁশের চারা উৎপাদন অর্থনীতি সহায়ক by মোঃ শফিউল আলম
বাঁশ আমাদের দেশে বহুল ব্যবহৃত একটি উদ্ভিদ। এটি ঘাস পরিবারের উদ্ভিদ হলেও বেশ লম্বা এবং কাষ্ঠল। এর বৈজ্ঞানিক নাম ইধসনঁংধ ংঢ়. এ যাবত বাংলাদেশে ৩৫ প্রজাতির বাঁশ শনাক্ত করা হয়েছে।
টিসু্য কালচার পদ্ধতিতে বাঁশের চারা উৎপাদন অতি হালের খবর। যুগের চাহিদায় ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাফল্যে আজ এ পদ্ধতি অবলম্বন করে চারা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। জীবাণুমুক্ত পরিবেশে বাঁশের কচি অংশ, কঞ্চির পর্ব (পর্ব মধ্যসহ) সুবিধামতো কেটে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফাইটো হরমোনের উপস্থিতিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টির মাধ্যমে বংশবৃদ্ধির করিয়ে বাঁশের চারা উৎপাদন করা হয়। গবেষণাগারে উৎপাদিত চারা পরে মুক্ত পরিবেশে পলিব্যাগে স্থানানত্মর করা হয়।পলস্নী এলাকার ঘরবাড়ি এবং আসবাবপত্রসহ শহরাঞ্চলে শৌখিন আসবাবপত্র তৈরিতে বাঁশের ব্যবহার উলেস্নখযোগ্য। বাঁশের কচি পাতা পশুখাদ্য হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বাঁশের অব্যবহৃত অংশ এবং ব্যবহারপরবতর্ী অংশ উৎকৃষ্ট মানের জ্বালানি। আমাদের দেশে কাগজ শিল্পে বাঁশের ব্যবহার অনস্বীকার্য। কর্ণফুলী পেপার মিল সম্পূর্ণ বাঁশনির্ভর।
পরিবেশের ভারসাম্য রায় বাঁশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাঁশ বাতাসের মুক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং আমাদের জীবন বাঁচাতে অত্যাবশ্যকীয় গ্যাসীয় উপাদান অক্সিজেন বায়ুম-লে ছেড়ে দেয়। ভূমিয়রোধসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য উদ্ভিদের চেয়ে বাঁশের ভূমিকা বেশি বলে ধরে নেয়া যায় কারণ অন্যান্য উদ্ভিদের তুলনায় বাশ বেশি স্থিতিস্থাপক। এ ছাড়া বাঁশের শক্ত এবং জট পাকানো শিকড় নদী ভাঙ্গনসহ ভূমিয় রোধে অধিক কার্যকরী।
জীববৈচিত্র্য সংরণে বাঁশ বন বিশাল ভূমিকা পালন করে। বৃহদাকৃতির বাঁশ বাগানে বকসহ নানা প্রজাতির পাখি বাসা বাঁধে এবং তাদের জন্য বাঁশ বাগানই অভয়ারণ্য। একটি আদর্শ বাঁশবন একটি ইকোসিস্টেম তুল্য।
বাঁশের ভেষজ গুণাগুণ আছে বলে লোকমুখে শোনা যায়। উলেস্নখ্য, কচি বাঁশের সবুজ ত্বক গুঁড়ো করে চুন মিশিয়ে কাটা ঘায়ে লাগালে রক্তরণ বন্ধ হয় এবং কাটা ঘা তাড়াতাড়ি শুকায়।
চাষ পদ্ধতি : বাঁশ বাগান তৈরির জন্য প্রথমে জমি নির্বাচন করতে হবে। যদিও বন্যার পানি বাঁশের তেমন কোন তি করতে পারে না তথাপি উঁচু প্রকৃতির জমিই বাঁশ চাষের জন্য উপযোগী। কারণ কুশি গজানোর সময় বন্যা হলে কুশিগুলো নষ্ট হয়ে যায়। সব প্রকৃতির মাটিতেই বাঁশ জন্মে, তবে বেলে দো-অাঁশ বা দো-অাঁশ মাটি বাঁশ চাষের জন্য উপযোগী। জমি নির্বাচনের পর মার্চ-এপ্রিল মাসে জমিতে গভীরভাবে ৩-৪টি চাষ ১০-১৫ দিন দিতে ফেলে রাখতে হবে। উপরের মাটি শুকিয়ে গেলে মই দিয়ে ঢেলা ভেঙ্গে তারপর আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তারপর ৩ মিটার পর পর ১*১*১ হাত আয়তনের গর্ত করতে হবে। গর্তটি ৫-৭ দিন রোদে ভালভাবে শুকাতে হবে। তারপর প্রতিটি গর্তে ১ কেজি পচা গোবর, ৫ গ্রাম টিএসপি ও ৫ গ্রাম এমপি সার এবং জমির উপরিতলের মাটি ভালভাবে মিশিয়ে গর্তটি ভরাট করে ফেলে রাখতে হবে। যখন ভরাটকৃত গর্তের ওপর বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক বা আগাছা জন্মাতে শুরম্ন করবে তখন বাঁশের চারা রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের সময় অবশ্যই পলিব্যাগ খুলে নিতে হবে। গরম্ন-ছাগল যাতে তি করতে না পারে সে জন্য বেড়া দিতে হবে।
রোপণ পরবতর্ী নিয়মিত সেচ দিতে হবে। তবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে সেচের তেমন প্রয়োজন পড়ে না। অধিক ফলনের জন্য তৃতীয় বছর থেকে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে সেচ এবং বাঁশ ঝাড়ের গোড়া মাটি দিয়ে হালকাভাবে ঢেকে দিতে হয়। পঞ্চম বা ষষ্ঠ বছর থেকে প্রতিবছর পরিপক্ব বাঁশ আহরণ করা যায়।
অর্থনৈতিক গুরম্নত্বের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, যে সকল জমিতে ধান বা পাট জন্মানো যায় না সে সকল জমিতে সহজেই বাঁশ উৎপাদন করা যায় যা বাজার মূল্যে ধান বা পাটের তুলনায় পাচগুণেরও বেশি (১৫ বছর মেয়াদী প্রকল্পে)। যেমন এক একর জমিতে প্রতিবছর ধান উৎপাদন করা যায় ৭৫ মণ বা তার চেয়ে একটু বেশি। তাহলে ১৫ বছরে ধানের মোট উৎপাদন হবে ১৫*৭৫=১১২৫ মণ যার বাজার মূল্য ৪৫০ টাকা মণ হিসেবে ৫,০৬,২৫০ টাকা। অপরদিকে এক একর জমিতে বাঁশঝাড় লাগানো যাবে ৫০৭টি। ৫ম বছর থেকে প্রতিবছর প্রত্যেক ঝাড় থেকে কমপ ে৬-৮টি করে পরিপক্ব বাঁশ পাওয়া যাবে। তাহলে ৫ম বছর থেকে ১৫তম বছর পর্যনত্ম মোট ১০ বছরে প্রতি ঝাড় থেকে বাঁশ পাওয়া যাবে ৭০টি। তাহলে ৫০৭টি ঝাড় থেকে বাঁশ পাওয়া যাবে ৭০*৫০৭=৩৫,৪৯০টি। যার বাজার মূল্য প্রতিটি ৮০ টাকা হিসেবে ২৮,৩৯,২০০ টাকা। টিসু্য কালচার পদ্ধতিতে প্রাপ্ত প্রতিটি চারার দর ২৫ টাকা হলে ৫০৭টি চারার দাম ১২,৫০০ টাকা। অতিরিক্ত অন্যান্য খরচ বাবদ মোট খরচ যদি ৩,০০,০০০ টাকাও ধরা হয তথাপি ধানের চেয়ে বাঁশে আয় ২০,৩২, ৯৫০ টাকা বেশি।
আমাদের দেশে ক্রমবর্ধমান বাঁশের অপরিকল্পিত ব্যবহার এবং বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে এর ব্যাপক য়তি হয়েছে। কোন কোন অঞ্চল থেকে বেশ কয়েক প্রজাতির বাঁশ বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমতাবস্থায় এক দিকে বাঁশের বিভিন্ন প্রজাতি রা যেমন জরম্নরী হয়ে পড়েছে অন্যদিকে কাগজ শিল্পসহ বাঁশের অন্যান্য ব্যবহার সচল রাখতে বাঁশের উৎপাদন জরম্নরী হয়ে পড়েছে।
যদিও বাঁশের বীজ পাওয়া যায়। কিন্তু তা বিরল। একটি বাঁশ ঝাড়ের বয়স ৪০ থেকে ১০০ বছর হলেই সাধারণত ফুল আসতে শুরম্ন করে। কোন কোন েেত্র নাও আসতে পারে। এ জন্য বাঁশ বাগান তৈরির জন্য আসত্ম বাঁশই চারা হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। সাধারণত ৭-১০ মাস বয়স্ক বাঁশ চারা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। হিসাব করে দেখা গেছে, গতানুগতিক পন্থায় বাঁশ লাগালে বাঁশের প্রতিটি চারার ক্রয়মূল্য হবে প্রায় দু'শ' আড়াই শ' টাকার কাছাকাছি। কারণ ঝাড়ের মালিক চিনত্মা করে যে বাঁশটি চারা হিসেবে বিক্রি করা হবে সেই বাঁশটি ঝাড়ে থাকলে তা থেকে কমপ ে৩টি সাকার বা কুশি বের হবে। তাই সে সচরাচর বিক্রি করতে রাজি হয় না। আসত্ম বাঁশ চারা হিসেবে ব্যবহার করলে সে চারা পরিবহনের েেত্রও সমস্যা দেখা দেয়। রোপণ পরবতর্ী সময়ে ঝড় ঝাপটা থেকে রা করারও কঠিন হয়ে পড়ে। সে জন্য বাঁশের গোড়ার দিকে ৩-৪ হাত রেখে বাকি অংশ কেটে ফেলা হয়। এতে বাঁশের চারা শরীরতাত্তি্বকভাবে বিরাট তির সম্মুখীন হয়। অনেক চারা রোপণের পর মারা যায়। কিন্তু টিসু্য কালচার পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনে এসব ঝামেলা এড়ানো সম্ভব। টিসু্য কালচার পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারা জীবিত থাকার হার ১০০%। তা ছাড়া প্রতিটি চারা উৎপাদনে খরচও হবে কম। মাত্র পঁচিশ টাকার কাছাকাছি। তা ছাড়া বৃহত্তর কোন প্রকল্প বাসত্মবায়নের জন্য গতানুগতিক পদ্ধতিতে একযোগে কয়েক হাজার চারা বাঁশ পাওয়া বেশ কষ্টকর কিন্তু টিসু্য কালচার পদ্ধতিতে তা লাঘব করা সম্ভব।
No comments