তাজমহল ও ফতেহপুর সিক্রি দেখার অভিজ্ঞতা
বিশ্বের ছোট বড় সব দেশের রাষ্ট্রনায়কগণ ভারতের আগ্রায় আসেন সপ্তম আশ্চর্য তাজমহল দেখতে। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার প্রায় সকল রাষ্ট্রপতি বা রাজা-রানী তাজমহল দেখতে আগ্রা গেছেন।
অথচ আমাদের সফর সঙ্গীরা তাজমহল না দেখেই ফিরে এলেন এবং প্রচুর টাকার কেনাকাটা করলেন কলকাতায় এসে ! পরে তারা আফসোসে ফেটে পড়লেন, আর বার বার বললেন সাড়ে সাত শ’ টাকায় তাজমহল না দেখে তারা মহা ভুল করেছেন। একজন তো বলেই ফেললেন ‘এখন ৩২ লাখ কোটি টাকার তিন-চার গুণ খরচ করেও ওই রকম আর একটি তাজমহল নির্মাণ করা যাবে না। হায় রে কপাল ! কপালে নেই, তাই বিশ্বসেরা শ্বেত শুভ্র তাজমহলের সঙ্গে দেখা হলো না।’ফতেহপুর সিক্রির দূরত্ব আগ্রা থেকে ৩৫ কিলোমিটার। এটি একটি ঐতিহাসিক শহর। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে রাজপুত মহারাজা সংগ্রাম সিংহ ফতেহপুরে রাজধানী স্থাপন করেন। সম্রাট আকবরের সৈন্যবাহিনী সাতবার ফতেহপুর আক্রমণ করেন এবং সপ্তমবারে ফতেহপুর দখল করেন। ১৫৭১ থেকে ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সম্রাট আকবরের রাজধানী ছিল ফতেহপুরে। আকবর এর নামকরণ করেন ফতেহাবাদ। পরে এটি ফতেহপুর সিক্রি হিসেবে পরিচিতি পায়। এই শব্দের অর্থ ‘বিজয়পুর’। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে আকবর পুত্র জাহাঙ্গীরের বয়স যখন দু’বছর তখন পানির সঙ্কট দেখা দেয়ায় সম্রাট আকবর রাজধানী আগ্রায় স্থানান্তর করেন। এছাড়া কৌশলগত কারণে বা পার্শ্ববর্তী উত্তর-পশ্চিমের রাজপুতনারা আক্রমণ করতে পারেÑএমন ধারণা থেকে রাজধানী সরিয়ে নেয়া হয়। এখানেই রয়েছে রাজপুত রানী কুলদেবীর (চামাদ দেবী) সমাধি।
দরবেশ সেলিম চিশতির সম্মানে ১৫ বছর ধরে ফতেহপুর সিক্রি গড়ে তোলা হয়। এটি ছিল পরিকল্পিত এক নগরী। মিয়া তানসেনের প্রিয় শহর ছিল ফতেহপুর। সে সময় দুই মাইল দীর্ঘ এবং এক মাইল প্রস্থের শহরটি ছিল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর। আর এই শহরকে এখন বলা হয় ভূতের শহর। এখানেই সম্রাট মোহাম্মদ শাহের সময় ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে মোগল বংশের দুই প্রিন্স সৈয়দ হোসেন খান বরহা ভ্রাতৃদ্বয়কে খুন করা হয়।
আগ্রা থেকে বাসে যাওয়া যায় ফতেহপুর। পর্যটকদের জন্য প্রতি ঘণ্টায় দুপুর ২টা পর্যন্ত আগ্রা থেকে বাস যায় ফতেহপুর পর্যন্ত। সূর্যাস্তের পূর্বেই ফতেহপুর ত্যাগ করতে হয়। বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবেশপথ ‘বুলন্দ দরওয়াজা’ নির্মাণ করা হয় ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে। রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করার জন্য এক বছর ধরে এটি নির্মিত হয়। প্রায় ৪০ ফুট উঁচু বেদির ওপর বুলন্দ দরওয়াজা পথে সম্রাট আকবরের রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করতে হয়। দরওয়াজাটির সর্বমোট উচ্চতা ৫৪ মিটার। দরওয়াজা পথে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়বে দরবেশ শেখ সেলিম চিশতির মাজার। কথিত আছে সম্রাট আকবর তাকে স্বপ্নে দেখেছিলেন এবং স্বপ্নে পুত্র সন্তান লাভের সুসংবাদ তাকে দিয়েছিলেন দরবেশ সেলিম চিশতি। শেখ সেলিম চিশতির জন্ম ১৪৭৮ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যু ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে। উঁচু এই আঙ্গিনায় রয়েছে দেওয়ানী খাস, দেওয়ানী আম, ইবাদতখানা, মসজিদ, আকবরের স্ত্রী যোধা বাঈ এবং মুসলিম স্ত্রীর দুটি বাড়ি ও আকবরের নবরতœ সভার সদস্য এবং প্রিয় মন্ত্রী বীরবলের ঘর। এছাড়াও রয়েছে টাকশাল, ট্রেজারি, সরাইখানা, ওয়ার্কশপ, দারোগার ঘর ইত্যাদি। দীন-ই-এলাহীর প্রচার কার্যালয়ও রয়েছে বিশাল এই চত্বরের দক্ষিণ প্রান্তে। রয়েছে পাঁচ মহল এটি পাঁচতলা একটি বিরাট ইমারত। উপরের তলাগুলো ক্রমশই ছোট। ১৭৬টি গোলাকৃতির খাম্বার ওপর স্থাপিত। ফতেহপুর সিক্রির সকল ইমারত লাল বেলে পাথরে তৈরি।
ফতেহপুর সিক্রি এক বিস্ময়কর নির্মাণ। হাজার হাজার শ্রমিক ১৫ বছরব্যাপী এই পরিকল্পিত শহর নির্মাণ করে। পানির সঙ্কট সেখানে আগেও ছিল এখনও আছে। এর পরও ফতেহপুরের মানুষ অপেক্ষাকৃত নরম স্বভাবের। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য ফতেহপুরে পুতুল নাচ, বানর খেলা এবং ভাল্লুক খেলা দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও ভারতীয় নৃত্য-গান-বাজনার আয়োজন করা হয়।
বুলন্দ দরওয়াজা পর্যন্ত পৌঁছতে বিশাল উঁচু সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠতে ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নেবেন পাশের হোটেলগুলোর যেটি পছন্দ হয় সেটিতে। পাওয়া যায় খাসি এবং ভেড়ার মাংস। সবজি, ডাল ও মুরগির মাংসও পাবেন। তবে সবকিছুর দাম-দর করে নেবেন। দাম বেশ চড়া।
আগ্রায় আরও যেসব দর্শনীয় স্থান রয়েছে সেগুলো হচ্ছে : ১৫২৮ খ্রি. সম্রাট বাবর কর্তৃক নির্মিত আরামবাগ। তাজমহল থেকে বাগানটির দূরত্ব তিন কিমি। সিকান্দ্রার দূরত্ব ১৩ কিমি। এখানে রয়েছে সম্রাট আকবরের কবর। সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করেন। অসাধারণ কারুকার্য খচিত কবরটির ওপরে আল্লাহর ৯৯ নাম লেখা রয়েছে। দেখা যাবে ইতমাদ উদ দৌলা বা মির্জা গিয়াস উদ্দিন বেগের সমাধি। মির্জা গিয়াস উদ্দিন ছিলেন সম্রাট আকবরের অর্থমন্ত্রী। আকবরের মৃত্যুর পর বিচক্ষণ গিয়াস উদ্দিন বেগকে সম্রাট জাহাঙ্গীর চীফ মিনিস্টার করেন। গিয়াস উদ্দিনের আনিন্দ্য সুন্দরী কন্যা মেহেরুন্নেসাকে জাহাঙ্গীর বিয়ে করেন। এই বিদূষী মহিলা ১৬২২ থেকে ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৬ বছরে পিতা গিয়াস উদ্দিন বেগের কবরে দৃষ্টিনন্দন ইমারত নির্মাণ করেন।
হাবিবুর রহমান স্বপন
No comments