পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ_ এ মুহূর্তে জরম্নরী by নিয়ামত হোসেন
বাজারের ব্যাপারে সাধারণভাবে মানুষের চিনত্মা অনেকদিনের। বছরের পর বছর বাজার অর্থাৎ বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য মানুষকে চিনত্মা করতে বাধ্য করেছে। কখনও কখনও এই চিনত্মা রীতিমতো দুশ্চিনত্মায় পরিণত হয়েছে।
বাজার স্বাভাবিক থাকুক, পণ্যমূল্য সাধারণের ক্রয়ৰমতার মধ্যে থাকুক এটাই চেয়েছে। পণ্যমূল্যের ব্যাপারে একটা বিষয় সব সময় দেখা গেছে, একটি-দু'টি পণ্যের দাম খানিকটা কমলো তো অন্য আরেকটি পণ্যের দাম গেল হঠাৎ বেড়ে। অর্থাৎ স্থিতিশীল হচ্ছে না। সবকিছুর দাম একেবারে স্থিতিশীল হয়ে থাকবে_ এটা প্রত্যাশা না করলেও মানুষ প্রত্যাশা করে হঠাৎ হঠাৎ কোন পণ্যের দাম সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে যেন চলে না যায়। অতীতের বেশ কয়েকটি বছরে দেখা গেছে, পণ্যমূল্য উঁচুতেই থেকেছে বেশির ভাগ ৰেত্রে এবং হঠাৎ করেই কোন একটি বা দু'টির দাম বেড়ে গেছে। দাম বাড়ার পেছনে অনেক কথা মানুষ শুনেছে। কিন্তু মূল্য বৃদ্ধির পেছনে যেসব কারণ দেখানো হয়েছে বা যেসব তত্ত্বকথা বলা হয় সেসবে আগ্রহ নেই সাধারণ মানুষের। ওগুলোর কোন্টি ঠিক কোন্টি বেঠিক তা নিয়েও সাধারণ মানুষের বিতর্কে আগ্রহ নেই। তারা কোন পণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে গেলে তারা সেটি কেনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ না করে সেটিকে এড়িয়ে চলতে বাধ্য হয়।বাজার নিয়ন্ত্রণ করে কে? বাজার তথা পণ্যমূল্যের সঙ্গে সকলের স্বার্থ সংশিস্নষ্ট। তাই সেখানে সরকারের সর্বৰণিক নজরদারি দরকার। আমাদের মুক্তবাজার, খোলাবাজার। এখানে সরকারী নিয়ন্ত্রণ চলে না_ এসব কথা অতীতে বহুবার শোনা গেছে। কিন্তু সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকুক, যতটুকু তদারকির প্রয়োজন ছিল ততটুকু তদারকি সব সময় সরকারী তরফে আগে হয়েছে_ এটা বলা যাবে না। তার ফলে যা হবার তাই হয়েছে। সাধারণ মানুষকে দিনের পর দিন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তাই নিয়ন্ত্রণ না হোক, সুষ্ঠু তদারকি অর্থাৎ মনিটরিং এবং সেই অনুযায়ী দ্রম্নত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারী তরফে দরকার_ এটা সব সময়ই মানুষ মনে করেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য মাঝেমধ্যেই যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বাজারে পণ্যের দাম টাঙিয়ে রাখাসহ কয়েকটি পদৰেপ। কিন্তু এ সবে যে কাজ হয় না তা একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে।
মানুষ বাজার করতে গিয়ে দীর্ঘকাল ধরে ঠকে আসছে, ৰতিগ্রসত্ম হয়েছে হয় আর্থিক দিক থেকে, নয়তো পণ্যের দিক থেকে। কোন ৰেত্রেই বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হয়নি। পণ্যের দাম বেঁধে না দিলেও লাভ হয়নি; বেঁধে দিলেও যে লাভ হয়েছে সর্বৰেত্রে তাও বলা যাবে না। রোজা এবং ঈদ উপলৰে বেড়ে থাকা পণ্যের দাম আরেকবার বাড়ে। বাড়ে মাংসের দাম। সে সময় মাংসের দাম বেঁধে দেয়া হয়। ক'টা দোকানে বেঁধে দেয়া দামে মাংস পাওয়া যায় তার সংখ্যা আঙ্গুলে গোনা যাবে। অধিকাংশ ৰেত্রেই পাওয়া যায় না। সেই যে দাম বাড়ে, সে দাম আর কমে না। মাছের বেলায়ও একই ঘটনা। বেড়ে থাকা দাম আর কমতেই চায় না। দফায় দফায় বাড়ানো হয়। বাজারের ৰেত্রে নানা অসঙ্গতি অনেক দিন থেকেই দেখা যায়। সেই অসঙ্গতি এখনও কি পুরোপুরি দূর হয়েছে?
আমাদের বাজারের ব্যাপারে একটা বিষয় দেখা যায়, সরবরাহ যথেষ্ট থাকলেও দাম কমে না। মৌসুমের সময় কোন কোন মৌসুমী পণ্যের প্রচুর সররবাহ থাকলেও দাম একেবারে নেমে যায়, খানিকটা কম থাকে; তাও মাত্র কিছুদিন। তারপর শুরম্ন হয় বাড়ার প্রবণতা এবং পরে একটু একটু করে বাড়তে থাকে। কয়েকটা দিন স্থির থাকে না কিছুটা কমে যাওয়া সেই মূল্যও। এসব দেখে একটা ব্যাপারে মনে হতে পারে বাজারে কোন পণ্যের দাম কমের দিকে থাকুক এটা কোন মহল বা কেউ যেন চাচ্ছে না। নইলে উর্ধমুখী প্রবণতা প্রায় সবকিছুর ব্যাপারে সারাৰণ উর্ধমুখীই থাকবে কেন? নিম্নমুখী প্রবণতা স্থায়ী হয় না কেন?
আমাদের বাজারের অদ্ভুত এই প্রবণতা অনেকদিন ধরে দেখা যায়। অধিকাংশ পণ্যের মূল্য বাড়তে বাড়তে একটা পর্যায়ে গিয়ে থামে। তারপর এক সময় খানিকটা কমে নিচের দিকে যায়। খানিকটা যে গেল ওটুকুই শেষ। তারপর আর নিচে নেমে আগের পর্যায়ে যায় না। অনেক পণ্যের দামের ৰেত্রে এটা দেখা গেছে। এ ধরনের পণ্যের ব্যাপারে কখনও শোনা যায়_ ওটা আমদানি করা পণ্য। বিশ্ববাজারে দাম বেশি তাই দাম বেড়েছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম যখন কমে, যখন আমদানিও হয় অনেক এবং বাজারে সরবরাহও থাকে স্বাভাবিক তখনও দাম সেই আগের পর্যায়ে যায় না। এর পৰে কারও কারও অনেক যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এটা একটা অবাক করার মতো বিষয়।
বাজারে শীতের সবজি উঠেছে বেশ কিছুদিন হলো। প্রায় সব সবজিরই সরবরাহ সকল বাজারে যথেষ্ট। অনেক কিছুর দাম আগের তুলনায় কিছু যে কমেনি তা অবশ্য নয়। কিন্তু এ সময় যতখানি দাম কমে যাওয়া উচিত সেই পরিমাণে কি কমেছে? বাজারের আরেকটি অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে পাইকারি ও খুচরা বাজারমূল্যে সামঞ্জস্যহীনতা। পাইকারি বাজার থেকে কিনে এনে খুচরা বাজারে বিক্রি করতে গেলে যে দামে বিক্রি করা উচিত অনেক ৰেত্রেই সেই দামে বিক্রি করা হয় না। ব্যবসার জন্য যেটুকু লাভ করা দরকার সেটুকু লাভ কি সব খুচরা ব্যবসায়ী করে? বহু ব্যবসায়ীই সৎভাবে ব্যবসা করেন এবং তাঁরা সবাই যুক্তিসঙ্গত লাভ করেন। এ ধরনের ব্যবসায়ী বাজারে সব সময় ব্যবসা করে এসেছেন, এখনও করছেন। তবে এদের বাইরে দেখা যায় অসাধু অতি মুনাফালোভী একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর দাপট। এদের লৰ্যই হচ্ছে যত বেশি সম্ভব লাভ করা। এরা দেখতে পায়, জিনিসের যে দামই রাখা হোক, কেউ না কেউ কিনবেই। একটু আগে আর পরে। বিশেষ করে ঢাকা নগরীর ব্যাপারে এ কথা সত্যি। কেউ কেউ কেনার আগে দশবার কিনবে কি-না ভেবে নিচ্ছে। আবার কেউ কেউ যা-ই দাম হোক কিনে নিয়ে চলে যাচ্ছে। সুতরাং বিক্রি হবেই। কেননা, লোকজনকে কিনতে হবে, খেতে হবে। উপায় নেই। তবে যিনি কিনছেন তিনি ঠকছেন। খুচরা বাজারের কোন কোন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, পাইকারি বাজারে তাঁদের ওজনে ঠকানো হয়। তাই তাঁদের দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় থাকে না। ওজনে কম দেয়ার বিষয়টি একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর যেন মজ্জাগত। এমন অসৎ ব্যবসায়ী পাইকারি বাজারেও রয়েছে, খুচরা বাজারেও রয়েছে। ক্রেতাকে যে কোনভাবে ঠকানো এদের কাজ। পাইকারি বাজারে পালস্না দরে বিক্রি হয়। কেউ কেউ ঐ পালস্নার মাপেই ঠকায়। আবার খুচরা বাজারে কেউ কেউ এমনভাবে পণ্য মাপে যাতে ওজনে কিছু না কিছু কম হবেই। মাংসের ৰেত্রেই হয় এমন সমস্যা। এসব দোকানে খাওয়া সম্ভব নয় এমন জিনিস মাংসের সঙ্গে নিতে বাধ্য করে কোন কোন বিক্রেতা এবং একই সঙ্গে এরা ওজনেও ঠকায়। দিনকয়েক আগে প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা গেল, তেলের ওজনেও কম পাওয়া গেছে। যে পাত্রে তেল রয়েছে তার গায়ে যে ওজন লেখা থাকে ক্রেতারা সেটা দেখে তেল কেনেন। কোনদিন পরীৰা করে দেখেন না, দেখার উপায়ও নেই। প্রস্তুতকারক যা লিখেছে সেটাই বিশ্বাস করতে হয়। অথচ মেপে দেখা গেল ওজনে কম রয়েছে। এগুলো দেখবে কে? ক্রেতার স্বার্থ দেখার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের তথা সরকারের সংশিস্নষ্ট কোন সংস্থার। এই স্বার্থ দেখা না হলে ক্রেতারা পদে পদে ঠকবে বা ৰতিগ্রসত্ম হবে এবং এভাবে অসৎ ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
বাজারের সকল পর্যায়ে সরকারের মনিটরিং তথা তদারকি অবশ্যই জরম্নরী। ইচ্ছেমতো অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে অসুবিধার মধ্যে ফেলবে এটা চিরস্থায়ী কারবার হতে পারে না। চাল-ডাল থেকে শুরম্ন করে তরিতরকারির বাজার পর্যনত্ম সকল পর্যায়ে মনিটরিং থাকতে হবে। চালের বাজারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা লৰ্য করা যায়।
চালের দর সহনীয় পর্যায়ে রাখতে কয়েকদিন আগে দ্রব্যমূল্য সংক্রানত্ম আনত্মঃমন্ত্রণালয় তদারক কমিটি ওএমএস চালু, টিআর ও কাবিখা কর্মসূচী জোরদারের সুপারিশ করেছে। সম্প্রতি এসব ৰেত্রে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগও নিয়েছে। এতে চালের বাজারে ভাল প্রভাব পড়বে বলে আশা করা যায়। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)'র মূল্যায়নের কথা উলেস্নখ করা যেতে পারে। তারা চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের মূল্যায়ন করতে গিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে অভিহিত করেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ব্যাহত হবে। সরকার বিনিয়োগ বাড়ানো এবং নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টিসহ যেসব খাতের ওপর গুরম্নত্ব দিচ্ছে সে লৰ্য অর্জনের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে বিরাজ করছে বাজার পরিস্থিতি। সব ধরনের সকল ৰেত্রের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার যথাযথ প্রস্তুতি খুবই জরম্নরী।
সরকারের এক বছর পার হয়ে গেছে। এক বছরে বাজারের অবস্থা একেবারে পাল্টে গেছে বলা যাবে না, তবে প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে অনেকটা। বাজারকে অস্থিতিশীল করে পণ্যের দাম অকারণে বাড়িয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করার চেষ্টা অনবরত চলবে; মানুষের মনে সৃষ্ট প্রত্যাশা নষ্ট করার চেষ্টা চলবে। তাই সরকারকে বাজারের বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে আরও বেশি করে। ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট সরকারের কাছে ব্যাপক জনগণ এটাই প্রত্যাশা করে।
No comments