বিচারপতি এসএম মোরশেদ- স্মরণ
চট্ করে তিনি সকলের নজরে পড়ে গেলেন। সকলের চোখের মণিও হয়ে উঠলেন সঙ্গে
সঙ্গে। ইস্ট পাকিস্তান হাইকোর্টের রায় বেরুল দেশের বিভিন্ন কাগজে, তাতে
প্রধান বিচারপতির নির্মেঘ ঘোষণা ‘সিংহের মতো শক্তি থাকা খুবই আনন্দের কথা, কিন্তু সেই শক্তি দুর্বলের ওপর প্রয়োগ হলে তা হয় অত্যাচার।’
শেক্সপিয়ারের কাব্য থেকে উদ্ধৃতি।
গৎবাঁধা জীবনে এই কবিতার সুস্মিত ছন্দ ও তার সুপ্রয়োগ সকলকেই চমকিত করে তুলল। যারা দেশের কারী, যাদের হাতে শাসনের দণ্ড, বিচারপতির এই মেঘমন্দ ঘোষণা তাদেরকে করে তুলল অস্থির ও ক্রুদ্ধ। যিনি এ কা-টি করে সারা পাকিস্তানেই তখন একটি আলোড়ন সৃষ্টি করে তুলেছিলেন; তিনি আর কেউ নন, বিচারপতি এসএম মোরশেদ। তিনি দৈহিক আকৃতিতে যেমন বিশাল ছিলেন, তাঁর অন্তরও ছিল তেমনি বিস্তীর্ণ। উনিশ শ’ চৌষট্টি সালের শেষদিকে আজকের পুরনো হাইকোর্ট ভবনে প্রথমবারের মতো তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
১৯৬৫-৬৬ সালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে আমি যে কাজ করেছিলাম, জাস্টিস মোরশেদ কোর্টে তার প্রশংসা করেছিলেন এভাবে যে, আমার ছয়টি সিভিল রায়ের বিরুদ্ধে আপীল হলে সেগুলোকে তিনি পত্রপাঠ ডিসমিস করে (সামারি ডিসমিসাল) দেন। এছাড়া একটি ফৌজদারি মামলায় একজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিলে তার বিরুদ্ধে আপীল হয়েছিল তাও হাইকোর্ট সামারি ডিসমিসাল করে দেন। হাইকোর্টের সঙ্গে অতিরিক্ত জিলা জজদের সম্পর্ক বেশ দুস্তর। কারণ তারা দূরেই যে শুধু থাকেন তা নয়, তাদের সব কাজই একটা আর হাইকোর্টের নজরে আসে না। শুধু আপীল হলে যেটুকু আসে সেটুকুই। বছরান্তে কাজের খতিয়ান হলে অন্য কিছু পেলাম। আমি আপীল পেশ করলে বিচারপতি মোরশেদ মুখে ও লেখায় যে মন্তব্য করেছিলেন তাতে তাঁর বাস্তবভিত্তিক প্রশংসা প্রশাসনকে আমার কাজকর্ম সম্বন্ধে অবশ্যই উচ্চ ধারণা দিয়েছিল। চাকরিতে নয় বছর অতিবাহিত হতে না হতেই আমি সিলেকশন গ্রেড পেয়েছিলাম (তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম-সচিবের বেতন স্কেল) এবং বয়সের দিক থেকে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ জেলা জজ। মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে আমি জেলা জজ হিসেবে কুমিল্লায় যোগদান করি। পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের আইন সচিব হিসেবে তখন আমি দায়িত্বভার করি। তখন আমি ছিলাম রেকর্ডে সর্বনিম্ন বয়সের আইন সচিব। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, এ সময়ে বিচারপতি মোরশেদের নেতৃত্বে নিম্ন কোর্টের বিচারকদের কাজকর্মের সঠিক মূল্যায়ন আমাদের সকলকেই আশান্বিত ও কাজকর্মে আগ্রহী করে তুলেছিল। তিনি জেলা জজদের সকলকেই চিনতেন ব্যক্তিগতভাবে, নাম ধরে ডাকতেন দেখা হলেই এবং ব্যক্তিগত খবরাখবর আন্তরিকতা ও সহানুভূতির সঙ্গেই নিতেন। অতি অল্প সময়ে মামলা বুঝে ফেলে সবচেয়ে কম সময়ে রায় দিয়ে দেয়ার ব্যাপারে জেলা কোর্ট পর্যায়ের বিচারকদের মধ্যে কে ভাল এ কথা তিনি জানতেন। আমার সমকালীন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিরা সকলেই এটা জানতেন বলে আমি নিজেকে সুখী মনে করি। বিচারপতি মোরশেদের গুণাবলীর মুখে এসব কথা প্রাসঙ্গিক।
দেশ তার এই মহৎপ্রাণ, অপরাজেয় প্রাণশক্তিকে কি সত্যিকারের সম্মান দেখিয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় অবশ্যই একদিন আসবে। আমরা কি তেমন একটা জাতিই থাকব, যার মহাপুরুষদের ধারা ইতিহাস থাকবে না? যাদের ওয়েস্টমিনিস্টার এবির মতো মহাপুরুষদের স্মৃতি-সমাধিস্থল থাকবে না? যারা শুধু নিজেদের মহাসন্তানদের ভুলেই থাকতে চাইবে? নিশ্চয়ই তা হতে পারে না। আমাদের মহৎ ও কৃতী পুরুষদের ইতিহাস নিয়েই আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে।
নুরুল ইসলাম খান
শেক্সপিয়ারের কাব্য থেকে উদ্ধৃতি।
গৎবাঁধা জীবনে এই কবিতার সুস্মিত ছন্দ ও তার সুপ্রয়োগ সকলকেই চমকিত করে তুলল। যারা দেশের কারী, যাদের হাতে শাসনের দণ্ড, বিচারপতির এই মেঘমন্দ ঘোষণা তাদেরকে করে তুলল অস্থির ও ক্রুদ্ধ। যিনি এ কা-টি করে সারা পাকিস্তানেই তখন একটি আলোড়ন সৃষ্টি করে তুলেছিলেন; তিনি আর কেউ নন, বিচারপতি এসএম মোরশেদ। তিনি দৈহিক আকৃতিতে যেমন বিশাল ছিলেন, তাঁর অন্তরও ছিল তেমনি বিস্তীর্ণ। উনিশ শ’ চৌষট্টি সালের শেষদিকে আজকের পুরনো হাইকোর্ট ভবনে প্রথমবারের মতো তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
১৯৬৫-৬৬ সালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে আমি যে কাজ করেছিলাম, জাস্টিস মোরশেদ কোর্টে তার প্রশংসা করেছিলেন এভাবে যে, আমার ছয়টি সিভিল রায়ের বিরুদ্ধে আপীল হলে সেগুলোকে তিনি পত্রপাঠ ডিসমিস করে (সামারি ডিসমিসাল) দেন। এছাড়া একটি ফৌজদারি মামলায় একজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিলে তার বিরুদ্ধে আপীল হয়েছিল তাও হাইকোর্ট সামারি ডিসমিসাল করে দেন। হাইকোর্টের সঙ্গে অতিরিক্ত জিলা জজদের সম্পর্ক বেশ দুস্তর। কারণ তারা দূরেই যে শুধু থাকেন তা নয়, তাদের সব কাজই একটা আর হাইকোর্টের নজরে আসে না। শুধু আপীল হলে যেটুকু আসে সেটুকুই। বছরান্তে কাজের খতিয়ান হলে অন্য কিছু পেলাম। আমি আপীল পেশ করলে বিচারপতি মোরশেদ মুখে ও লেখায় যে মন্তব্য করেছিলেন তাতে তাঁর বাস্তবভিত্তিক প্রশংসা প্রশাসনকে আমার কাজকর্ম সম্বন্ধে অবশ্যই উচ্চ ধারণা দিয়েছিল। চাকরিতে নয় বছর অতিবাহিত হতে না হতেই আমি সিলেকশন গ্রেড পেয়েছিলাম (তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম-সচিবের বেতন স্কেল) এবং বয়সের দিক থেকে আমি ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ জেলা জজ। মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে আমি জেলা জজ হিসেবে কুমিল্লায় যোগদান করি। পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের আইন সচিব হিসেবে তখন আমি দায়িত্বভার করি। তখন আমি ছিলাম রেকর্ডে সর্বনিম্ন বয়সের আইন সচিব। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, এ সময়ে বিচারপতি মোরশেদের নেতৃত্বে নিম্ন কোর্টের বিচারকদের কাজকর্মের সঠিক মূল্যায়ন আমাদের সকলকেই আশান্বিত ও কাজকর্মে আগ্রহী করে তুলেছিল। তিনি জেলা জজদের সকলকেই চিনতেন ব্যক্তিগতভাবে, নাম ধরে ডাকতেন দেখা হলেই এবং ব্যক্তিগত খবরাখবর আন্তরিকতা ও সহানুভূতির সঙ্গেই নিতেন। অতি অল্প সময়ে মামলা বুঝে ফেলে সবচেয়ে কম সময়ে রায় দিয়ে দেয়ার ব্যাপারে জেলা কোর্ট পর্যায়ের বিচারকদের মধ্যে কে ভাল এ কথা তিনি জানতেন। আমার সমকালীন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিরা সকলেই এটা জানতেন বলে আমি নিজেকে সুখী মনে করি। বিচারপতি মোরশেদের গুণাবলীর মুখে এসব কথা প্রাসঙ্গিক।
দেশ তার এই মহৎপ্রাণ, অপরাজেয় প্রাণশক্তিকে কি সত্যিকারের সম্মান দেখিয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় অবশ্যই একদিন আসবে। আমরা কি তেমন একটা জাতিই থাকব, যার মহাপুরুষদের ধারা ইতিহাস থাকবে না? যাদের ওয়েস্টমিনিস্টার এবির মতো মহাপুরুষদের স্মৃতি-সমাধিস্থল থাকবে না? যারা শুধু নিজেদের মহাসন্তানদের ভুলেই থাকতে চাইবে? নিশ্চয়ই তা হতে পারে না। আমাদের মহৎ ও কৃতী পুরুষদের ইতিহাস নিয়েই আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে।
নুরুল ইসলাম খান
No comments