মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সরদার by সিরাজুল ইসলাম
আমাদের কাছে ‘ইনডিয়ান ইনডিপেনডেন্স এ্যাক্ট’-এর ঐতিহাসিক উদাহরণ রয়েছে।
ব্রিটিশরা দেশ চালাত। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রক্কালে বিদায়ী ব্রিটিশরাজ
‘ইনডিয়ান ইনডিপেনডেন্স এ্যাক্ট’ তৈরি করেন যা মূলত ভারত ও পাকিস্তান নামক
দু’টি আলাদা রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া ও ক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখা। উক্ত
রূপরেখায় ভারত-পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য আলাদা সংবিধান তৈরি না হওয়া
পর্যন্ত বিদ্যমান আইনসমূহ বলবত রাখার ব্যবস্থা ছিল।
আমরা যদি আইনের দিকে
তাকাই এবং ব্রিটিশ পাওয়ারের পরিবর্তে মার্শাল ’ল পাওয়ার’ বিবেচনা করি তাহলে
উক্তরূপ বিরাজমান পরিস্থিতি সম্যক উপলব্ধি করতে সক্ষম হব। যদি ক্ষমতা
হস্তান্তরের একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয় তাহলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একটি
‘ডিক্রি’ জারি করে গণ-প্রতিনিধিদের কাছে নির্বিগ্নে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে
পারেন।” বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : দলিলপত্র- ২য় খ- পৃঃ ৭৭৭)। একথা বলার
অপেক্ষা রাখে না যে, এ, কে, ব্রোহি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরাজ যেভাবে ভারত ও
পাকিস্তান নামক দুটি আলাদা রাষ্ট্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল সেভাবে
ইয়াহিয়াকে ব্রিটিশরা ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে সুপারিশ করেন।অসহযোগ আন্দোলনকালে ভুট্টোর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মুজিব-ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সঙ্গে একাধিক বৈঠকে অংশগ্রহণকারী-পাকিস্তান পিপলস পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরী লাহোরে ১৮ এপ্রিল ’৭১ লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “আওয়ামী লীগ আগেই পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্ট্র্যাটেজি স্থির করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার উদ্দেশ্যে কাজ করছিলেন এবং এর জন্য তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, একথা বিশ্বাসযোগ্য নয়, ঢাকায় আকস্মিক কিছু ঘটেছে এবং পূর্ব পাকিস্তানীরা কেন্দ্রের ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের সার্বভৌম প্রধানরূপে প্রতিষ্ঠার জন্য রাতারাতি নিজেদের প্রস্তুত করেছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ অবশ্য মূল পরিকল্পনা পরিবর্তন করে। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগের প্রথম পাকিস্তানের কর্তৃত্ব গ্রহণ এবং পরে পশ্চিম পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য করানোর কথা ছিল। দেশের রাজনৈতিক কার্যকলাপের প্রেক্ষিতে এ পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হয় এবং ২৬ মার্চ শুক্রবার জুমার নামাজের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করা হয়।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে গ্রহণের জন্য আবেদন জানানোর উদ্দেশ্যে একটি খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছিল। এ আবেদনের খসড়াটি মূলত শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ছিল, কিন্তু পরে এ আবেদন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বসবাসকারী পূর্ব পাকিস্তানীদের নামে করা হয় এবং বেসরকারী ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের এ আবেদনটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা সংক্রান্ত লিগ্যাল কমিটির কাছে জমা দেয়া হয়।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ প্রধান যখন ৫ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখেন, তখন ঢাকায় পাকিস্তানের প্রতিটি প্রতীক এই সঙ্গে ধ্বংস করা হচ্ছিল। ২৩ মার্চ পুরো শহরে সরকারী ও বেসরকারী ভবনের শীর্ষে বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয়। এ অবস্থা একদিনে করা সম্ভব হয়নি। ২৩ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশের সার্বভৌম শাসকরূপে নিজেকে তুলে ধরেন।
কাশুরী বলেন, তার কাছে প্রমাণ আছে, সে সময় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ রূপে আওয়ামী লীগ প্রধানের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং তিনি নিজেই এসব নির্দেশ দেন, যার ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৬ জানুয়ারি (৭২) নিউইয়র্ক টাইমসের বিশেষ প্রতিনিধি সিডনি এইচ স্কানবার্গের কাছে প্রদত্ত সাক্ষাতকারে বলেন, সেই চরম মুহূর্তে তাঁর সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। ভারত গমন অথবা বন্দিত্ববরণ। তিনি বন্দিত্ববরণ করেন। এর একটি ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছিলেন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর নিউইয়র্কের বিশেষ প্রতিনিধি সিডনি এইচ সেনবার্গের কাছে যা ১৬.১.৭২ তারিখে উক্ত পত্রিকায় প্রকাশ পায়।
পাকবাহিনীর টার্গেট ছিল ‘বড় পাখীকে’ আটক করলে সব ঠা-া হবে। কৌঁসলি মুজিব তাদের সে সুযোগ দিয়েছেন কিন্তু ধরা দেননি কাউকে। পাকিস্তান, মার্কিন বা ভারত কাউকেই নয়। তিনি ধরা ছিলেন বাঙালী এবং বিশ্ব মানবতার কাছে। জনতার শক্তিতে নির্ভরশীল মুজিব চেয়েছিলেন প্রয়োজনে তাঁর জীবনের বিনিময়ে যেন স্বাধীনতা আসে। পাকরা বুঝতেই পারেনি যে ‘হুকুম’ যা দেবার মুজিব তা দিয়েছেন সেজন্য তৈরি ছিল লাখো মুজিব। আর তাদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য অন্তত সাড়ে চারশ’ এমএনএ/এমপিএ, যুব-ছাত্র নেতাসহ কোটি বাঙালী এবং নেতৃত্ব দেয়ার মতো বিচক্ষণ তাজউদ্দিন। তাই মুজিব বন্দী হলেও একমাত্র ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। যা সামলাতে পাক বাহিনীর কমপক্ষে দু’মাস লেগেছিল।
এটি প্রমাণিত সত্য যে, মুজিবকে বন্দী করা ছিল পাকিস্তানের প্রথম পরাজয়। মূল নেতাকে আটক এবং হত্যার ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রত্যাহার করা যায়নি। তাই একে আত্মসমর্পণ বলার কোন সুযোগ নেই। আটক মুজিবের জীবন রক্ষা ও মুক্তির দাবিটিও স্বাধীনতার পরিপূরক হয়ে মুক্তিযুদ্ধ বেগবান ও বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধানের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আবেদন জানান।
ভারতে যাওয়া ২৫ মার্চ সম্ভব ছিল না। এটা করতে হলে তাঁকে পালাতে হতো আগেই মাঝপথে। মুজিব কি পালানোর লোক। আর ভারতে গেলে কি হতো? পালিয়ে ভারত যাওয়ার অর্থ বিচ্ছিন্নতাবাদী এক অসহায় মানুষ যার প্রতি কোন সমর্থন, সহযোগিতা আসত না। বরং দেশে অপপ্রচার হতো। তাতে বিজয় অর্জিত হলেও তাঁর জন্য অনেক দাম যেন দিতে না হয় বাঙালীর। প্রথমত: মুজিবকে ভারতের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালেই একটি মোটা দাগে চুক্তি করতে হতো যা তাজউদ্দীন আহম্মদ এড়াতে সক্ষম হন এই বলে যে, চুক্তি করার ক্ষমতা যার সেই নেতা মুক্ত হোন এবং দেশ শত্রুমুক্ত হোক। যা করার তিনিই করবেন। এভাবে দুর্বল অবস্থানে থেকেও ভারতের সঙ্গে মুজিবনগর সরকার দর কষাকষির একটি বিরল সুযোগ ভোগ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে আটকের পর সেখান থেকে প্রথমে এ্যাসেম্বলী বিল্ডিংয়ে। পরে ক্যান্টনমেন্টের একটি স্কুলের একটি অন্ধকার আর নোরাং ঘরে। ছয় দিন ধরে তিনি কাটালেন সেই ঘরে। তবে মধ্যরাত থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত রাখা হয় টিক্কা খানের বাড়িতে। এপ্রিল ১ (৭১) তাকে রাওয়ালপিন্ডি, পরে মিয়াওয়ালী জেলে। তাঁর বিচার শেষ হয়েছিল ৪/১২/৭১ তারিখে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। হত্যার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু এক জেলার তাঁকে রক্ষা করেন। মিয়ানওয়ালী জেলের অবস্থান জেনারেল নিয়াজীর এলাকায়। গুজব ছড়ানো হলো যে, ১৫/১২/৭১ তারিখে ঢাকায় নিয়াজীকে হত্যা করা হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ জেল-কয়েদিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য খুঁজতে ছিল। কিন্তু জেলার তাঁকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছিল। সে সময়ের ঘটনা কিঞ্চিত উদ্ধৃত করা হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সিডনি স্কানবার্গের সাক্ষাতকার থেকে।
১৭.১২.৭১ তারিখের ভুট্টো ইয়াহিয়াকে গৃহবন্দী করে ক্ষমতা দখল করার পর ১৯.১২.৭১ তারিখে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডিতে সাক্ষাত করেন। প্রথম সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বলেন, ‘আমি মুক্ত কিনা বলুন।’ ভুট্টো বললেন, ‘আপনি মুক্ত কিন্তু আমি আপনাকে যেতে দেয়ার আগে কয়েকদিন সময় চাই।’ কিন্তু কোন আলোচনা ঐ দিন হয়নি।
জানুয়ারি ৫-এ প্রেসিডেন্ট ভুট্টো শেখ মুজিবের সঙ্গে তৃতীয় আর শেষবারের মতো দেখা করতে গেলেন। বাঙালী নেতা বললেন, তিনি তাঁকে বললেন, আপনি অবশ্যই আমাকে আজকে রাতে মুক্তি দেবেন। আর দেরি করার কোন জায়গা নেই। হয় আমাকে মুক্ত করুন নয় হত্যা করুন।
শেখ মুজিব বললেন, ভুট্টো উত্তর দিয়েছিলেন যে, এত স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়, কিন্তু পরে তাঁকে লন্ডন পাঠিয়ে দিতে রাজি হলেন।
পরের দিন ব্রিটিশ রাজকীয় এয়ারফোর্সে একটি বিমানে ঢাকার পথে থামলেন দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে। সম্মান-শ্রদ্ধা জানালেন ভারত ও তার জনগণ এবং বন্ধু ইন্দিরা গান্ধী। আদায় করলেন সৈন্য প্রত্যাহারের ওয়াদা। যেন সবটাই নিয়ে ঘরে ফিরলেন জাতির জনক।
ঢাকা ফিরে উৎফুল্ল জনগণের প্রত্যাশার জবাব দিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ভুট্টোর উদ্দেশে বললেন, এক সঙ্গে থাকার আর কোন সুযোগ নেই, আপনারা ভাল থাকুন... আরো অনেক কথা। শত্রুকে ভাল থাকার এই মহানুভবতা একেবারেই বিরল। জয়বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু। (সমাপ্ত)
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
No comments