জুরাইনে আওয়ামী লীগ নেতা ইসমাইলের খুনী গ্রেফতার হয়নি- ডিম ব্যবসায়ীকে চড় মারার জের? by গাফফার খান চৌধুরী
এক মহিলাকে চড় থাপ্পড় দেয়ার সূত্র ধরেই ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা ইসমাইল হোসেন খুন হন। ডিম ব্যবসায়ী দ্বীন কাদেরকে বাজারের সালিশে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
দোষী ডিম ব্যবসায়ীকে অনেক মানুষের সামনেই বাজার সভাপতি ইসমাইল হোসেন থাপ্পড় দেন। তার জের ধরেই ডিম ব্যবসায়ীর ছেলে ও তার বন্ধুবান্ধব মিলে বাসার সামনেই মাথায় রিভলভর ঠেকিয়ে ইসমাইল খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। চিহ্নিত খুনীকে মামলার এজাহার নামীয় আসামি না করায় নিহতের পরিবারে আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির জের ধরে অথবা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে তৃতীয় কোন পক্ষও এমন ঘটনা ঘটাতে পারে বলে পুলিশের ধারণা। যদিও ঘটনার ৮ দিন পরেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কেউ গ্রেফতার হয়নি।বিদায়ী বছরের থার্টিফার্স্ট নাইটে সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর কদমতলী থানাধীন পূর্ব জুরাইনের ২৭ নম্বর নিজ বাড়ির সামনে মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ইসমাইল হোসেনকে। নিহত ইসমাইল হোসেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ৮৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক, বৌবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এবং ৮৯ নম্বর ওয়ার্ড পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি স্থানীয়ভাবে খুবই প্রভাবশালী এবং বিত্তশালী ছিলেন। ঢাকার তাঁর ৭টি বাড়ি রয়েছে।
এ ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ঘটনাস্থল থেকে সেভেন পয়েন্ট সিক্স বোরের ২টি বুলেটের খোসা উদ্ধার হয়। হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহতের মেয়ে পাপিয়া সুলতানা পাপড়ি বাদী হয়ে কদমতলী থানায় অজ্ঞাত ৪/৫ সন্ত্রাসীকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার বাদী জনকণ্ঠকে জানান, ঘটনার সময় তাঁর পিতা পাশের বৌবাজার থেকে বাসায় ফিরছিলেন। বাড়ির সামনে পৌঁছলে গলি থেকে ৪-৫ যুবক তাঁর পিতাকে ঘেরাও করে। তাৎক্ষণিকভাবে সন্ত্রাসীরা মাথায় গুলি করে পালিয়ে যায়। তিনি ৪-৫ জনকে গলি দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যেতে দেখেছেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১১টার দিকে তাঁর পিতা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে মারা যান। পরদিন মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গী বাড়ী থানাধীন চানপাড়ার পারিবারিক কবরস্থানে ইসমাইল হোসেনের দাফন সম্পন্ন হয়।
নিহতের একমাত্র পুত্র নূর মোহাম্মদ জনকণ্ঠকে জানান, মূলত একটি থাপ্পড়কে কেন্দ্র করেই তাঁর পিতাকে খুন করা হয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত সামান্য বিষয় নিয়ে। স্থানীয় বৌবাজারের এক দরিদ্র মহিলা ডিম ব্যবসায়ী দ্বীন কাদেরের কাছ থেকে বাকিতে ডিম নেন। ওই টাকা দিতে দেরি করায় প্রায়ই ক্রেতা ও দোকানীর মধ্যে ঝগড়া হতো। গত ৩১ ডিসেম্বর ঘটনার দিন বেলা ১১টার দিকে ডিম ব্যবসায়ী কাদের ওই মহিলার কাছে পাওনা টাকা চায়। এ নিয়ে দোকানি ও ওই মহিলার মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে ডিম বিক্রেতা কাদের সবার সামনেই ভরা বাজারের মধ্যেই ওই মহিলার গালে কষে থাপ্পড় দেয়। বিষয়টি অনেকেই দেখেছেন। তার পিতা বাজারের সভাপতি হওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই ঘটনাটি তাঁর কান পর্যন্ত গড়ায়। এ বিষয়ে বাজারেই এক সালিশ হয়। সালিশে দ্বীন কাদের দোষী সাব্যস্ত হয়। দোষী হওয়ার সাজা হিসেবে তার পিতা দ্বীন কাদেরের গালে বাজারের সবার সামনেই থাপ্পড় দেন। এতে দ্বীন কাদের খুবই অপমানিত বোধ করেন। দ্বীন কাদের প্রায় ৫ বছর ধরে বৌবাজারে ডিম বিক্রি করছে। সপরিবারে পূর্ব জুরাইনেই বসবাস করেন।
বাজারে বিচারের সময় দ্বীন কাদেরের ছেলে রেজাউল করিম (২৩) উপস্থিত ছিল। বাজারে শত শত মানুষের সামনে পিতার অপমানিত হওয়াকে সহ্য করতে পারেনি রেজাউল। মাটি ছুঁয়ে সবার সামনেই তার পিতাকে এমন অপমান করার বদলা নিতে শপথ নেয। রেজাউল আগে ছাত্রলীগ নেতা সুজনের সঙ্গে ঘোরাফেরা করত। প্রায় ২ বছর আগে সুজন পূর্ব জুরাইনে খুন হন। এরপর রেজাউল স্থানীয় সন্ত্রাসী ও হেরোইন ব্যবসায়ী বাপ্পা গ্রুপের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করে। বাপ্পা গ্রুপের সদস্য হিসেবেই সে কাজ করে যাচ্ছে। পিতার অপমানের বদলা নিতেই রেজাউল তার ২/৩ সহযোগী মিলে এমন হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ঘটাতে পারে। অথচ দায়েরকৃত মামলায় রেজাউলকে কেন আসামি করা হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে নূর মোহাম্মদ জনকন্ঠকে বলেন, আমরা মামলার এজাহারে রেজাউলের নাম অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছিলাম। কিন্ত সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে পুলিশ রেজাউলের নাম মামলার এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করেনি। গ্রেফতার হওয়ার পর মামলার এজাহারে রেজাউলকে আসামি করার সুযোগ থাকায় পুলিশ কৌশলগত কারণেও মামলার এজাহারে রেজাউলের নাম নাও রাখতে পারে। আসামি না করায় রেজাউলকে আটক করা সহজ হবে ভেবেও পুলিশ এমন কাজ করতে পারে। তবে খুনীরা গ্রেফতার না হওয়ায় তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এক ধরণের বাড়তি আতঙ্ক কাজ করছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কদমতলী থানার উপ-পরিদর্শক সুজিত কুমার সাহা জনকণ্ঠকে জানান, স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির জের ধরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। হত্যাকান্ডের সঙ্গে বৌবাজারে সালিশেরও যোগসূত্র থাকতে পারে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ বোরের বুলেটের খোসা ২টির ব্যালিস্টিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত কেউ গ্রেফতার হয়নি। প্রাথমিক তদন্তে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোন রাজনৈতিক বিষয়াদির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তবে ঘটনার পেছনে পারিবারিক, ব্যবসায়িক বা ব্যক্তি বিরোধের মত কোন বিষয়াদির সংশ্লিষ্টতা আছে সে বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
কদমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেই এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। এর বাইরেও হত্যাকাণ্ডের অন্যান্য সম্ভাব্য কারণের বিষয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির সূত্র ধরে দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে তৃতীয় কোন পক্ষ এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে কি-না সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। খুনীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।
No comments