পশ্চিমা বিশ্বে নারীর অধিকার
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ও নারীর অধিকার বাস্তবায়নে পশ্চিমাবিশ্ব নানা কর্মসূচী পালন করলেও নিজেদের ঘরেই বৈষম্য বিদ্যমান। নারী নির্যাতনের সমাধান হিসেবে পশ্চিমাবিশ্ব পৃথিবীব্যাপী স্বাধীনতার ধ্যানধারণাকে জোরের সঙ্গে প্রচার করলেও, প্রকৃতপক্ষে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে পশ্চিমের নারীরা হয়েছেন অভিনব দাসত্বের শিকার।
বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা, নামীদামী ফ্যাশন ম্যাগাজিনে নগ্নভাবে শরীরী উপস্থাপন কিংবা চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপনের সাহায্যে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে মুক্ত-স্বাধীনচেতা নারীদের। দেশগুলোর মিডিয়ায় নারীর সরব উপস্থিতি দেখলে মনে হয় জীবনের সবক্ষেত্রেই তারা প্রচণ্ড রকম স্বাধীন। এটা সত্য যে, এই দেশগুলোর নারীরা স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে পারে, স্বাধীন পেশা গ্রহণ করতে পারে, পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারে। অর্থনীতি, রাজনীতিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীরা পুরুষের মতো সমান সুযোগ ভোগ করে। কিন্তু সূক্ষ্ম কৌশলে এ সব দেশের পুরুষরা নারীকে অবদমিত করছে। ইন্ধন জোগাচ্ছে পুরুষ আর নারীরা তাতে তাল মিলাচ্ছে। মিডিয়ায় নারীদের প্রায় নগ্ন বা অর্ধনগ্নভাবে যৌনাবেদনময়ী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অথচ দেখা যায়, পুরুষরা পুরো কোটটাই পরে সুটেট-বুটেট হয়েই আসে। এটা আসলে নারীর অবমাননাই। নগ্নতা কখনও স্বাধীনতার বহির্প্রকাশ হতে পারে না। নারীর সৌর্ন্দযকে বিক্রি করা হচ্ছে এখানে। নারীকে উপস্থাপন করা হচ্ছে সস্তা বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। নারীর সরব উপস্থিতি জানান দেয় যে, তারাও এই ব্যাপারগুলো উপভোগ করছে। আদতে এটা হচ্ছে নারীকে ভিন্ন আঙ্গিকে নতজানু করে রাখার অন্যতম কৌশল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, এই আধুনিক নারীরা স্বাধীনতার আবরণে পুরুষের ক্রীড়নক হিসেবেই যে নিজেদের সঁপে দিচ্ছে মিথ্যা খ্যাতির মোহে। তারা নিজেরাও তা উপলব্ধি করতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা নারীকে সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এই সৌন্দর্যকে যখন পণ্যের মতো ব্যবহার করা হয় তখন তা শুধু নারী সমাজই নয়, পুরো মানবজাতির জন্যই লজ্জার।স্বাধীনতার নামে পশ্চিমাবিশ্বে চলছে আসলে স্বেচ্ছাচারিতা। চূড়ান্ত ব্যক্তি স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে পুরুষরা নারীদের পরিণত করছে মুনাফা হাসিলের পণ্যে। প্রকৃত অর্থে ভোগবাদী বিত্তশালী এই দেশগুলোতে নারীকে বিবেচনা করা হয় নিরেট ভোগ্যপণ্য ও মুনাফা হাসিলের উপকরণ হিসেবেই। ফলে একদিকে নারীকে মুখে মুখে সম্মান-শ্রদ্ধা দেখানো হয় আর অন্যদিকে তাদের উদ্বুদ্ধ করা হয় রাস্তায়, ক্লাব বা পার্টিতে নগ্ন বা অর্ধনগ্ন হয়ে উদ্দাম নৃত্য করতে। কয়েক দিন আগেই দেখলাম পশ্চিমা দেশের কিছু নারী আন্দোলন করছে যেন তারা পুরুষের মতো করে বুক খোলা রেখে রাস্তায় চলার অধিকার পায়। পুরুষরা পারলে তারা কেন বুক খোলা রাখতে পারবে না। তাদের তো পুরুষের মতো সমান অধিকার আছে। সত্যিই সেলুকাস। এই দাবি যদি মেনে নেয়া হয় তাহলে নারীরা নগ্ন স্তন দেখিয়ে রাস্তায় ঘুরবে আর পুরুষরা তাদের কামনা চরিতার্থ করবে লোলুপ দৃষ্টি হেনে। এটা তো প্রকৃতপক্ষে সমানাধিকারের নাম দিয়ে নারীকে অবদমিত করে রাখার এক সূক্ষ্ম কৌশল। নারীর সৌন্দর্যের প্রতি চরমতম আঘাত।
এই দেশগুলোতে পুরুষরা নারীকে পুরুষতান্ত্রিকতার সূক্ষ্ম কৌশলে সমাজে প্রচলিত অন্যান্য পণ্যের মতোই বিকিকিনির পণ্যে পরিণত করে । নারীর দৈহিক সৌন্দর্যকে পুঁজি করে চালানো হয় জমজমাট ব্যবসা। এই দেশগুলোতে যে পরিমাণ নাইট ক্লাব, পতিতালয় আছে তা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি। এগুলোতে চলে নারীর নগ্ন নৃত্য আর দেহ ব্যবসা। নারীকে যদি তারা শ্রদ্ধার আসনে বসাতে পারত তবে নারীকে নগ্ন হয়ে নৃত্য পরিবেশন করতে হতো না। মেটালিকার টার্ন দ্য পেইজ গানটির ভিডিও চিত্রটি সত্যিই কান্নার উদ্রেগ করে। সেখানে মা শিশু মেয়েটির সামনেই নগ্ননৃত্য করে আর দেহ ব্যবসা চালায়। এটি সেই শিশু মেয়েটির সামাজিকীকরণের ওপর চরম আঘাত বৈ কিছু নয়। মুক্ত সমাজ, মুক্ত মানুষ, মুক্ত অর্থনীতি ইত্যাদি পশ্চিমা জীবনদর্শনের মূলমন্ত্র হলেও, মুক্ত সমাজের মুক্ত জীবনের ধারণা নারীকে মুক্তি দেয়নি বরং বহুগুণে বেড়েছে তার ওপর অত্যাচার আর নির্যাতনের পরিমাণ। স্বাধীনতার ধারণা পশ্চিমা সমাজের মানুষকে ঠেলে দিয়েছে স্বেচ্ছাচারী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন এক জীবনের দিকে। স্বাধীনতার অপব্যবহারে নির্যাতিত হচ্ছে নারী। একদিকে সূক্ষ্মভাবে নারীকে অবদমন চলছে অন্যদিকে ব্যক্তি-স্বাধীনতার চূড়ান্ত অপপ্রয়োগে এসব সমাজে বাড়ছে খুন, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও পারিবারিক সহিংসতাসহ সকল প্রকার নারী নির্যাতন।
পশ্চিমা দেশগুলোর ফ্যাশন, ডায়েট আর কসমেটিকস্ ইন্ডাস্ট্রিগুলোই নির্ধারণ করে নারীর পোশাক, তার সাজসজ্জা, এমনকি তার দেহের প্রতিটি অঙ্গের মাপ। স্বাধীনতার মিথ্যা সেøাগানে নারীকে তারা বাধ্য করে জঘন্যভাবে দেহ প্রদর্শন করতে। তারপর, অর্ধনগ্ন সেসব নারীদেহকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। নারীকে মডেল ও সুপার মডেলের ফাঁদে ফেলে তার দেহকে ম্যাগাজিন ও টিভি পর্দায় যৌন আবেদনময়ী হিসেবে তুলে ধরা হয়। নামকরা মডেল বা সুপার মডেল হতে গিয়ে নারীকে কমাতে হয় আশঙ্কাজনক পর্যায়ে তার ওজন। পরিণতিতে বন্ধ্যত্ব, ভয়াবহ নিম্ন রক্তচাপ, এ্যানোরেক্সিয়া কিংবা বুলেমিয়ার মতো মারাত্মক রোগ হয় তার জীবনসঙ্গী। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিগুলোর বেঁধে দেয়া ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস্ অর্জন করতে গিয়েই পশ্চিমে অকালে ঝরে যায় এ সব নারীর জীবন।
নারী-পুরুষের লাগামহীন মেলামেশা আর প্রবৃত্তি পূরণের অবাধ স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ফল স্বরূপ পশ্চিমা সমাজের নারীরা অহরহ হয় ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার। নারী স্বাধীনতার অগ্রপথিক যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে ধর্ষিত হয় একজন নারী, আর বছরে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় সাড়ে সাত লাখে। ব্রিটেনে প্রতি ২০ জনের মধ্যে একজন নারী ধর্ষিত হয়। এসব দেশে অবাধ মেলামেশা, অবাধ যৌনতা, লিভ টুগেদারের সুযোগ থাকার পরও এই চিত্রটিই ফুটিয়ে তোলে এই সমাজগুলোর পুরুষদের হীন ঘৃণ্য মানসিকতা। গণমাধ্যমগুলোতে নারীকে প্রতিনিয়ত সেক্স সিম্বল হিসেবে উপস্থাপন করার ফলে নারীর প্রতি সমাজের সর্বস্তরে তৈরি হয় অসম্মানজনক এক বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি। আর বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গির ফল হিসেবে শিক্ষিত নারীরাও কর্মক্ষেত্রে তাদের পুরুষ সহকর্মীর কাছে প্রতিনিয়ত হয় যৌন হয়রানির শিকার। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ৪০-৬০% নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হয়। আর যুক্তরাজ্যেও ৪০-৫০% নারী তার পুরুষ সহকর্মীর কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয়। এটা সত্যিই খুবই লজ্জার বিষয়। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার প্রধান অসহায় শিকার হয় পশ্চিমের কুমারী অল্পবয়সী নারীরা। যৌন আনন্দের পর্ব শেষে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষসঙ্গী আর্থিক বা সামাজিক কোন দায়দায়িত্ব স্বীকার না করায় একাকী নিতে হয় তাকে অনাহূত সন্তানের দায়িত্ব। অপরিণত বয়সে পর্বতসম দায়িত্ব নিয়ে তাকে হতে হয় ভয়ঙ্কর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ১৫-১৭ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার অবিবাহিত নারী গর্ভবতী হয়। এর ফলে সমাজে অনাহূত বা জারজের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১৮ সেকেন্ডে একজন নারী স্বামী কর্তৃক প্রহৃত হয় যা পুরুষতান্ত্রিকতাকেই চরমভাবে প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ৯ লাখ ৬০ হাজার পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। প্রায় ৪০ লাখ নারী স্বামী অথবা তার বয়ফ্রেন্ডের দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়। এই চিত্রই প্রমাণ করে দেয় যে, এসব উন্নত দেশের নারীরাও অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের নারীদের মতো ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়।
পশ্চিমা সভ্যতা পৃথিবীব্যাপী নারী-পুরুষের সমঅধিকারের বার্তা প্রচার করলেও তাদের নিজেদের সমাজেই নারীরা প্রচ- বৈষ্যমের শিকার। শুধু নারী হবার জন্য একই কাজের জন্য তাকে পুরুষের চাইতে দেয়া হয় কম অর্থ। প্রেসিডেন্ট কেনেডি যুক্তরাষ্ট্রে ইকুয়েল পে এ্যাক্ট আইন পাস করলেও, এখনও নারীরা একই কাজের জন্য পুরুষদের চাইতে প্রতি ডলারে ২৩ সেন্ট কম উপার্জন করে। সে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা বিভাগের মোট কর্মচারীর প্রায় ৭০ ভাগ নারী হলেও নারী ব্যবস্থাপকরা পুরুষের চাইতে কম অর্থ পেয়ে থাকে। পশ্চিমের দেশগুলোতে নারীরা শুধু দুটি পেশায় পুরুষের চাইতে বেশি উপার্জন করে, তার একটি হচ্ছে মডেলিং আর অন্যটি হচ্ছে পতিতাবৃত্তি। পশ্চিমা বিশ্বে নারীরা সবচাইতে জঘন্যভাবে অবদমিত হয় পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে। নগ্ন নারীদেহকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে এই ইন্ডাস্ট্রি। এর জঘন্য শিকার হচ্ছে নারী ও শিশু। যুক্তরাষ্ট্রের পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রির বার্ষিক রাজস্ব সে দেশের বহুল প্রচারিত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবিসি, সিবিএস এবং এনবিসি’র প্রদত্ত মোট রাজস্বের চাইতেও বেশি। পর্নোগ্রাফির মাধ্যেমে নারীকে সত্যিকার বাজারের পণ্য হিসেবে তুলে ধরতে কার্পণ্য করেনি পশ্চিমা বিশ্ব। এখন তো ইন্টারনেটের মাধ্যমে নারীকে আরও বেশি করে পণ্য হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচনা করার এই ধরনের হীনমানসিকতা থেকে যতদিন না পশ্চিমা পুরুষ সমাজ মুক্ত হচ্ছে ততদিন তাদেরকে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলা যাবে না। পশ্চিমা দেশগুলো নারীর অধিকার, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করছে এটা সত্যিই প্রশংসনীয়। কিন্তু নিজ দেশের নারীর অবদমনের ক্ষেত্রে তারা মুখবুজে আছে। এটা দ্বৈতনীতি আর দ্বৈত মানসিকতারই বহির্প্রকাশ। পশ্চিমা দেশগুলো যদি সারা বিশ্বব্যাপী নারীর উন্নয়ন, নারী নির্যাতন রোধ, নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি, নারীর মর্যাদা অসীন রাখতে চায়, তবে প্রথমেই তাদের নিজেদের নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নারীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে বিবেচনা করার মানসিকতা থেকে সরে আসতে হবে। তবেই তারা নারীর জন্য প্রকৃত কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে।
সানজিদা হোসেন
No comments