কালো মানুষের দেশে
আজকের সুসভ্য প্রজাতন্ত্র এই রাষ্ট্রদর্শন কল্পনাতেও আনতে পারবে না। প্রাচীন আফ্রিকার শাসন পদ্ধতিতে যে সব প্রতীকী ব্যাপার ছিল, তা সত্যিই অতুলনীয়। আরও একটি উদাহরণের কথা মনে পড়ে গেল।
অতীতে নাইজেরিয়ায় জুকুন বলে একটি রাজ্য ছিল। জুকুনের অধিবাসীদের চোখে তাদের রাজা ছিলেন ঐশ্বরিক পুরুষ। তার রাজকীয় জীবনে ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিল না বলেই চলে। বহু রকমের নিয়ম মেনে তাকে চলতে হতো। জুকুনের রাজাকে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হতো না। শাসন ব্যবস্থায় মাথা ঘামিয়ে জ্ঞানের পরিচয়ও দেয়ার প্রয়োজন হতো না। বিরাট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষও তার হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। রাজাকে মনে করা হতো বিভিন্ন মঙ্গলদায়ী শক্তির আধার। সেই শক্তি, যে শক্তি ভূমিকে উর্বর করবে, বীজকে সুফলা করবে। সেই শক্তির জীবন্ত আধার, যে শক্তি মানুষের জীবনকে প্রাণশক্তিতে ভরপুর করে দেবে, করবে সমৃদ্ধ। এই সব শক্তির যিনি জীবন্ত আধার সেই রাজার প্রতিদিন, জীবনের প্রতিটি বছর নানা অনুষ্ঠানে বাঁধা।জুকুনের রাজা কদাচিৎ লোকসমাজে হাজির হতেন। রাজার নগ্ন পা যেন মাটি স্পশ না করে। কারণ তাতে ফসল জ্বলে যাবে। নিচু হয়ে কোন কিছু মাটি থেকে তার তোলা নিষেধ। রাজা কখনও নত হবেন না। রাজা কখনও অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে মেরে ফেলা হতো। রাজার অসুস্থ হওয়ার উপায় নেই। অসুস্থ হলেই নির্জনে নিয়ে গিয়ে গলা টিপে তাকে মেরে ফেলা হতো। কারণ রাজা অসুস্থ হলে তার গোঙ্গানির শব্দে সাধারণ জনগণের বিভ্রান্ত হবার সম্ভাবনা। জনসমক্ষে রাজার হাঁচি দেয়ার উপায় ছিল না। কোন কারণে রাজা হাঁচি দিয়ে ফেললে, সভায় উপস্থিত সকলে সসম্মানে উরুতে চাপড় মারতেন। রাজাকে শরীর সম্পর্কে প্রশ্ন করা ছিল অসম্মানের। শরীর প্রসঙ্গ তোলাটাই ছিল অপরাধের। তার শরীরকে সাধারণ মানুষ শরীর বলে মনে করত না। রাজার ব্যক্তিত্ব বোঝানোর জন্য বিশেষ কোন শব্দ ব্যবহার করা হতো। রাজার সমস্ত কিছুই ছিল বিশিষ্ট। রাজার মুখ নিঃসৃত বাণী ছিল দেব-দেবীর বাণী।
রাজা আহারে বসা মাত্রই তার অনুচররা বিশাল চিৎকার করে উঠতেন। আর অন্য সকলে উরুতে গুণে গুণে বারো বার চাপড় মারতেন। তখন তো তোপ ছিল না। এটাই ছিল এক ধরনের ঘোষণা বা হুঁশিয়ারি যে, রাজা আহারে বসেছেন। রাজ প্রাসাদের সকলে নীরব হও। যেন অখ- নীরবতা। এমন কি সারা শহর নিস্তব্ধ। কথা বন্ধ, কাজ বন্ধ। রাজা আহারে বসেছেন। রাজার আহার মানে সাধারণ মানুষের আহার নয়, দেবভোগ। অত্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে রাজাকে ভোগে নিবেদন করা হতো। আহার শেষ হওয়া মাত্র অনুচররা বাইরে গিয়ে আবার চিৎকার করতেন, আর উরুতে চাপড় মারতেন। স্বাভাবিক কাজকর্ম কথাবার্তা শুরু হয়ে যেত সঙ্গে সঙ্গে। রাজার রেগে যাওয়াকে সাংঘাতিক ব্যাপার মনে করা হতো। রাজা কারুর দিকে আঙ্গুল তুলে কিছু বললে বা ক্রোধে মাটিতে পা ঠুকলে ভয়ঙ্কর একটা অমঙ্গলের আশঙ্কায় মানুষ আতঙ্কিত হতো। রাজার ক্রোধ মানে দেশ ধ্বংস হওয়া। ফলে সকলেই নজর রাখত রাজা যেন রেগে না যান। রাগার সম্ভাবনা দেখা দিলে তাকে শান্ত করার চেষ্টা হতো। রাজার মুখ নির্যাসকে মনে করা হতো পবিত্র। রাজা তার চুল আর নখ সযতেœ একটি থলেতে ভরে রাখতেন। মৃতদেহের সঙ্গে কবরে দেয়ার জন্য। রাজাকে মনে করা হতো উর্বরতার প্রতীক হিসেবে। সকলেই বিশ্বাস করত রাজা বৃষ্টি আর বায়ু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ফলে খরা হলে বা ফসল না হলে মনে করা হতো রাজার শক্তি কমে এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে গোপনে তাকে গলা টিপে হত্যা করা হতো।
এই দেশে রাজা বরণের স্বতন্ত্র একটি প্রথা ছিল। নবনির্বাচিত রাজাকে একটি ঢিবি তিনবার প্রদক্ষিণ করতে হতো। এই প্রদক্ষিণের সময় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাকে কিল চড় মারতেন। এরপর তিনি একটি ক্রীতদাসকে হত্যা করতেন। নিজে হত্যা করার সাহস না থাকলে ছুরি দিয়ে খোঁচা মেরে ছেড়ে দিতেন, তখন তার প্রতিনিধি হয়ে অন্য কেউ তারই বল্লম ও ছুরি দিয়ে দাসটিকে হত্যা করত। অভিষেকের সময় রাজন্যবর্গীয় কোন নেতা তাকে রাজধর্মের পালনীয় কর্তব্যটি শুনিয়ে দিতেন। আজ থেকে আপনাকে আপনার পিতার প্রাসাদটি দেয়া হলো। আপনি এখন সারা পৃথিবীর মালিক। আপনি আমাদের ‘গিনি-কন’ (শস্য)। আমাদের আত্মশক্তি, আমাদের ভগবান। এখন থেকে আপনার পিতা-মাতা নেই। আপনিই এখন সকলের পিতা-মাতা। আপনি আপনার পূর্ব পুরুষদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রজাপালক হয়ে উঠুন। আপনি কারুর অনিষ্ট করবেন না। প্রজারা যেন আপনার আদেশ পালন করে। আপনার রাজত্বকালের শেষ দিন পর্যন্ত আপনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী থাকুন।
এরপর সকলে রাজার পদপ্রান্তে পড়ে নিজেদের মাথায় মুঠো মুঠো ধুলো ছিটাতে থাকে আর সমস্বরে বলতে থাকে, ‘রাজা তুমি আমাদের শস্য, তুমি আমাদের বারিধারা, তুমি আমাদের স্বাস্থ্য, তুমি আমাদের ঐশ্বর্য।’
রাজা সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হলেও, তার অত্যাচার থেকে বাঁচার অনেক পথ খোলা রাখা হতো। তার একটি উপদেষ্টাম-লী থাকত। এই উপদেষ্টাম-লীর নির্দেশ তাকে মেনেই চলতে হতো। এই উপদেষ্টাম-লীতে থাকতেন দশের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা। তাদের প্রধানকে বলা হতো এ্যাবো। অর্থাৎ একালের প্রধানমন্ত্রী। রাজার কাছে যে কোন সময় এই এ্যাবো যেতে পারতেন। যে কোন ভুলের জন্য তাকে তিরস্কারের ক্ষমতাও ছিলই ওই এ্যাবোর। রাজা সাধারণ যুদ্ধে যেতেন না। কিন্তু অন্য রাজ্য আক্রমণ করে লুণ্ঠিত সম্পদ কেউ নিয়ে এলে রাজা তার অধিকারী হতেন। যে এনেছে তাকে একের তিন অংশ দিয়ে দেয়া হতো পুরস্কার হিসেবে। কখনও কখনও অর্ধেকও দেয়া হতো তাকে উৎসাহিত করার জন্য। যাতে ভবিষ্যতেও সে এভাবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারে।
যোগ্য রাজা এভাবে সাত বছর ক্ষমতায় আসীন থাকতেন। তারপর ফসল উৎসবের সময় যখন মাঠে মাঠে ধান, গম, যব, ভুট্টা কাটা শুরু হতো তখন রাজাকে একান্তে নিয়ে গিয়ে বলি দেয়া হতো। মৃত্যুকে চোখের সামনে রেখে যে জীবন সে জীবন বিনীত হতে বাধ্য।
সেই আফ্রিকার রীতিনীতি সভ্য পৃথিবীতে কোথায় গেল। সভ্য পৃথিবীর রাজাদের দেয়া হয়েছিল প্রবল প্রতাপ, ভোগ বিলাসের স্বাধীনতা। তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার বগলা তুলে নেয়া হয়েছিল। ফলে ইতিহাসের একটি সময় ধরে এই রাজা-মহারাজারা কি না করেছেন? আফ্রিকার রাজাদের রীতি আচার অনুষ্ঠান নিয়ে ভাবতে ভাবতে ব্রাইন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। তার কথায় আমার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল। ফিরে এলাম আজকের দক্ষিণ আফ্রিকায়। ব্রাইন বলল, এবার আমার পাওনা বুঝিয়ে দাও। আমি বললাম, আমাদের প্যাকেজের পুরো অর্থই তোমাকে দিতে হবে। সে বলল, তার কাছে দিলেই চলবে। আমি সবার কাছ থেকে পাঁচশ’ রেন্ড করে তুলে তার হাতে দিলাম। রসিকতা করে বললাম, ‘এ্যানি ডিসকাউন্ট’। সে হাসল। তার কালো মুক্তোর মতো দাতগুলো বেরিয়ে এলো। কালোদের হাসিও যে এত সুন্দর হতে পারে তা না দেখলেই নয়। পুরো টাকা সে গুণে নিয়ে তার ভ্যানিটি ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘সিয়াবুংগা’। অর্থাৎ তোমাদের ধন্যবাদ। আমি বললাম, ‘ওয়াম গে লেগি’। অর্থাৎ তোমাকে স্বাগতম বা ওয়েলকাম। সবশেষে বললাম, ‘গিয়াবুংগা’। অর্থাৎ তোমাকে ধন্যবাদ।
কাওসার রহমান
No comments