'ভাল রেজাল্টের জন্য প্রয়োজন পজেটিভ চিনত্মা '- ডা. মোহিত কামাল 0 মনোচিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক।
শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবে, ভাল রেজাল্টের জন্য প্রয়োজন ইতিবাচক চিনত্মা, সময়ের যথাযথ ব্যবহার ও পড়াশোনায় মনোযোগ। মনে রাখতে হবে, 'এসএসসি পরীক্ষা' বৃহত্তর জীবনে প্রবেশদ্বার। বড় সিলেবাস। পড়তে হয় অনেক। অথচ সময় কম।
এক্ষেত্রে দুটি বৈজ্ঞানিক ইসু্য মনে রাখা দরকার-'ওয়ার্ক ওভার লোড' বা বেশি পড়ালেখার অতিরিক্ত চাপ। 'টাইম প্রেসার' বা সময়ের চাপ। দুটি বিষয়ই পরীক্ষার্থীর দক্ষতা ক্ষতিগ্রসত্ম করে। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সময়ের যথাযথ ব্যবহার। পরিকল্পিতভাবে সময়ের ব্যবহার করা গেলে কাজের চাপ কমে, পড়ার চাপ কমে। পড়া নিয়ে টেনশন থাকবে কিন্তু অতিরিক্ত টেনশনের ভারে নত হওয়া যাবে না পরীক্ষার্থীর। সৃজনশীল উৎসবে অংশগ্রহণ করলে একঘেয়েমি থেকে মুক্ত হবে মন, কমে যাবে চাপ, সহজ হবে সময়ের পরিকল্পিত ব্যবহার। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল উৎসবে অংশ গ্রহণের সুযোগ তৈরি করার দায়িত্ব বিদ্যালয়ের। মনে রাখতে হবে স্কুল পরিচালনা পর্ষদকে।সময়ের পরিকল্পিত ব্যবহার না হলে, অতিরিক্ত চাপে পড়ে যাবে পরীক্ষার্থী। ব্রেন সঠিকভাবে কাজ করতে চাইবে না। মনোযোগে ধস নামবে। মেমোরি রেজিস্ট্রেশনে ত্রম্নটি ঢুকে যাবে। পড়া মুখস্থ হবে না, পঠিত বিষয় মনে থাকবে না ।
'পরীক্ষার আগে আগে সব পড়ে নেব', 'আমার মেরিট ভাল' 'সব সময়ই তো পরীক্ষার আগে পড়ে ভাল রেজাল্ট করেছি' ইত্যাদি ধারণা আঘাত হানবে অবহিতির শেকড়ে । আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হবে সাহস, চির ধরবে আত্মবিশ্বাসের দেয়ালে। আত্মবিশ্বাস ভেঙে গেলেই বিপদ। অনত্মর্গত প্রেষণায়ও তখন তৈরি হবে ভাটির টান, উৎসহ-উদ্দীপনার গতি হারিয়ে যাবে। তখন কেবল হা হুতাশ করতে হবে সময় নিয়ে, টেনশনের দাবদাহে পুড়ে যাবে মনের গতি-মনে রাখতে হবে শিক্ষার্থীদের। পরীক্ষার্থীদের অনেকেই সময় হারিয়ে ঠেকে শেখে। কেউ বা যথাযথ গাইডেন্সের কারণে পারিবারিক পরিবেশ কিংবা টিচারদের কাছ থেকে 'এসএসসি'র গুরম্নত্ব আগে থেকেই জেনে যায়। নিজেকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
যে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাবে সেও কিন্তু টেনশনমুক্ত না। স্বাভাবিক টেনশন তারও থাকে। যে সময়ের নির্যাস নিংড়ে নিতে পারেনি সেই বিধ্বসত্ম থাকবে। পরীক্ষার আগে এ ধরনের ছাত্রছাত্রীরা নানা ধরনের নেতিবাচক চিনত্মার জালে পঁ্যাচাতে থাকবে, নিজের চিনত্মায় ত্রম্নটি ঢুকে যাবে। ভয় বাড়বে ত্রম্নটিপূর্ণ চিনত্মার কারণে বা ভয়ের কারণে চিনত্মাগুলো নেতিবাচক হয়ে যেতে থাকবে। মনে ধারণা তৈরি হতে পারে 'আমার দ্বারা পার পাওয়া সম্ভব না' 'আমার পক্ষে ভাল রেজাল্ট করা সম্ভব না' 'পরীক্ষা খারাপ করা মানেই জীবন শেষ' 'আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার' ইত্যাদি নেতিবাচক চিনত্মা মনে আসন গাড়লে পারফরমেন্স অবশ্যই খারাপ হতে বাধ্য। গেল দু'বছর পড়ে যেটুকু বিদ্যা অর্জন করেছে, নেতিবাচক চিনত্মায় আক্রানত্ম হলে সেটুকুরও যথাযথ প্রতিফলন ঘটাতে পারবে না। আশানুরূপ ফল অর্জিত হবে না।
নেতিবাচক চিনত্মা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে কীভাবে?
নেতিবাচক চিনত্মা থেকে মুক্ত থাকতে হলে তিনটি ধাপ সম্পর্কে জানতে হবে :
প্রথমে শনাক্ত করতে হবে নিজের নেতিবাচক চিনত্মাগুলো। শনাক্ত করার পর চিনত্মাগুলো চ্যালেঞ্জ করতে হবে-চিনত্মাগুলো কি সঠিক? প্রয়োজনীয়? উপকারী?
ইতিবাচক চিনত্মা দিয়ে তাড়াতে হবে নেতিবাচক চিনত্মাগুলো। অর্থাৎ ইতিবাচক চিনত্মা প্রতিস্থাপন করার প্রশিক্ষণ নিতে হবে। কীভাবে ইতিবাচক চিনত্মার শক্তি বাড়ানো যায়, শিখতে হবে। মনের উদ্বেগ বাড়ায় নেতিবাচক চিনত্মা, উদ্বেগ কমায় ইতিবাচক চিনত্মা, মনের ফ্রেমে শিথিলতা জাগায়, মন রিলাঙ্ করে। পরীক্ষার্থীর পারফরমেন্স প্রভাবিত করে চিনত্মার ধরন।
পরীক্ষার হলে ময়ূখ এবং সানমুনের দিকে তাকাতে পারি আমরা :
পরীক্ষার সময় শেষ হতে এখনও ২০ মিনিট বাকি আছে।
সানমুন হঠাৎ খেয়াল করল, চারপাশের থেকে অনেক উঠে যাচ্ছে, খাতা জমা দিচ্ছে। দৃশ্যটি দেখার সঙ্গে সঙ্গে সানমুনের টেনশন বেড়ে যায়। হাত-পা কাঁপাকাপি শুরম্ন হয়ে যায়। বুক ধড়ফড় বেড়ে যায়।
সানমুনের মনে হতে থাকে, সবাই তার চেয়ে ভাল পরীক্ষা দিচ্ছে, এখনও সে শেষ করতে পারেনি, তার পক্ষে ভাল রেজাল্ট করা সম্ভব নয়। ফলে শেষ প্রশ্নটির উত্তর লিখতে গিয়ে এলোমেলো হয়ে যায় সে, হাতের লেখা বিশ্রী হয়ে যায়। সব কিছু ঠিক ঠিক মনে করতে না পারার কারণে পারফরমেন্স খারাপ হয়ে যায়।
ময়ূখও খেয়াল করেছে, অন্যরা খাতা জমা দিচ্ছে দেখে তার মুখে এক চিলতে হাসি ফোটে। ময়ূখ ভাবে, ওদের বোধ হয় সব প্রশ্ন কমন পড়েনি। তাই উত্তর শেষ না করেই তারা খাতা জমা দিচ্ছে। ভাবতে গিয়ে নিজে প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। শেষ প্রশ্নটি তার ভালই পড়া আছে। দশ মিনিটই যথেষ্ট। ভাবতে ভাবতে পরীক্ষার খাতায় মনোযোগী হয় ময়ূখ।
ইতিবাচক প্রত্যক্ষণ এবং ইতিবাচক চিনত্মার কারণে ময়ূখের পারফরমেন্স ভাল হয়।
নেতিবাচক চিনত্মার কারণে মানসিক চাপে সৃষ্ট দৈহিক উপসর্গের দিকে নজর থাকে বেশি, উদ্বেগ এ কারণে ধাপে ধাপে কিংবা হঠাৎ তীব্রতর হয়, যেমনটি ঘটেছে সানমুনের দৃশ্যপটে।
সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও খেলাধুলায় অংশ গ্রহণ করত ময়ূখ। সামাজিক কাজেও ময়ূখের ছিল সমান দক্ষতা। সানমুন অংশ গ্রহণ করত না সামাজিক অনুষ্ঠানে, খেলাধুলা কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে। ফলে চাপ মোকাবিলা করার ক্ষমতা বেশি অর্জন করেছে ময়ূখ। সানমুন এই দক্ষতা অর্জন করেনি।
ইতিবাচক চিনত্মা পড়ালেখার নেতিবাচক বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে রাখে মন। এভাবে চাপমুক্ত থাকে পরীক্ষার্থী। যাদের প্রিপারেশন ভাল হয়নি, তাদের উচিত গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বাছাই করে আলাদা করে রাখা। গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়ে বেশি মনোযোগী হওয়া। কম গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়গুলো একদম বাতিল রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কম গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতেও চোখ বুলিয়ে নিতে পারলে যে কোন পরীক্ষার আগের রাতে কিংবা পরীক্ষার দিন সকালে কিছুটা হলেও আত্মবিশ্বাস বাড়বে। পরীক্ষার আগের রাতে নিজের অভ্যাস মতো পড়া উচিত। ১১টায় ঘুমের অভ্যাস থাকলে ১১টায় ঘুমিয়ে যেতে হবে। ওই দিন রাত ২-৩টা পর্যনত্ম পড়লে হিতে বিপরীত হবে। পরীক্ষার সময় মাথা জ্যাম হয়ে যেতে পারে, স্বাভাবিক মেমোরি বাধাগ্রসত্ম হয়ে দক্ষতা হ্রাস করে দিতে পারে কিংবা নার্ভাস ব্রেক ডাউনের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। নিজের মনে ভয় বাড়লে, চাপা টেনশন বাড়লে নিজে নিজে ভোগ না করে কারও কাছে শেয়ার করা উচিত, চাপা রাখা উচিত নয়।
উৎকণ্ঠায় আক্রানত্ম ছাত্রছাত্রীর
করণীয় কী?
পরীক্ষার আগে পরীক্ষার্থীকে বেশি সময় পড়ার চেষ্টা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পড়ার ফাঁকে বিশ্রাম নিতে হবে। পানি খেতে হবে। পড়তে হবে স্বাভাবিক নিয়মে। মা-বাবাকে বলতে হবে, 'তুমি পরীক্ষা দাও। চেষ্টা কর। এতেই আমরা খুশি। রেজাল্ট যা হবে তাই মেনে নেব আমরা।' উদ্বেগ শাসন করার ট্রেনিং নিতে হবে পরীক্ষার্থীকে। রিলাঙ্ হওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আগে থেকে নিজের মনোসমস্যা মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। পড়াশোনার প্রস্তুতির মতো মানসিক প্রস্তুতিও গুরম্নত্বপূর্ণ।
আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে পরীক্ষার হলে ঢুকতে হবে। 'আমি পারব,' 'আমার দ্বারা হবে', 'যে কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব-এমনি পজেটিভ চিনত্মা' নিয়ে ঢুকতে হবে পরীক্ষার হলে। প্রশ্ন পাওয়ার আগে বুকের ধড়ফড় বেড়ে যেতে পারে। বেশি নার্ভাস হলে ধড়ফড় বেড়ে যাবে দ্বিগুণ হারে। আগেই বলা হয়েছে, এটি অতি উৎকণ্ঠা সিগন্যাল। উৎকণ্ঠা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ওই মুহূর্তে। কীভাবে?
বড় করে শ্বাস নিতে হবে নাক দিয়ে। বুক ফুলিয়ে শ্বাস ধরে রাখতে হবে তিন থেকে পাঁচ সেকেন্ড। তারপর ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়তে হবে মুখ দিয়ে। এভাবে চর্চা করতে হবে দু-তিনবার। এরপর চোখ বন্ধ করে কল্পনার চোখে ভাসিয়ে তুলতে হবে একটি দেয়ালঘড়ির চিত্র। মনে মনে গুনে আসতে হবে ১২, ১১, ১০, ... ১ পর্যনত্ম। এ সময় স্বাভাবিক শ্বাসক্রিয়া চালাতে মনোসংযোগ থাকবে ঘড়ির সংখ্যামানের ওপর। কৌশলটি সঠিকভাবে চর্চা করতে পারলে নার্ভাসনেস স্বাভাবিক হয়ে যাবে ওই মুহূর্তে। মনোযোগ বাড়বে। স্মৃতিশক্তি ভালভাবে কাজ করবে। সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বেড়ে যাবে কয়েকগুণ বেশি।
অনেকে অহেতুক পরীক্ষাভীতিতে ভোগে। এটিকে বলে 'এঙ্াম ফোবিয়া'। এদের শনাক্ত করতে হবে পরীক্ষার আগেই। মনোচিকিৎসার মাধ্যমে শতভাগ সাফল্য সম্ভব। পরীক্ষার পারফরমেন্স ধরে রাখা সম্ভব। বিষয়টির প্রতি সচেতন হতে হবে অভিভাবকদের।
No comments