হজ- হজ বিশ্ব মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
পবিত্র হজ ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম ফরজ ইবাদত। আরবি ‘হজ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ কোনো স্থান দর্শনের সংকল্প করা, পবিত্র স্থানে গমনের ইচ্ছা করা। ইসলামের পরিভাষায় নির্দিষ্ট দিনসমূহে কাবাগৃহ এবং এর সংলগ্ন
কয়েকটি পবিত্র স্থানে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশ অনুসারে অবস্থান করা, জিয়ারত করা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করার নামই ‘হজ’। প্রত্যেক সুস্থ মস্তিষ্ক, প্রাপ্তবয়স্ক, স্বাধীন মুসলমান, যার আল্লাহর ঘরে ভ্রমণ করার ক্ষমতা আছে এবং হজ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারের আবশ্যকীয় ব্যয় বাদে যাতায়াতের খরচ বহন করতে সক্ষম, তার ওপর হজ ফরজ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহর হজ করা ওই সব লোকের ওপর ফরজ, যাঁরা ওই (কাবাঘর) পর্যন্ত রাস্তা অতিক্রম করার (দৈহিক ও আর্থিক) ক্ষমতা রাখেন।’ (সূরা আলে ইমরান: ৯৭)
নবম হিজরিতে হজ ফরজ হয়। হজ কেবল ধনী মুসলমানদের ওপর জীবনে একবার ফরজ, কিন্তু গরিবদের ওপর এটা ফরজ নয়। যেহেতু আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক ধনী ও সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর হজ ফরজ করেছেন, তাই ধনী ব্যক্তি হজ আদায় না করলে কঠিন গুনাহগার হবে। সে কারণে তার ওপর জীবনে একবার হজ আদায় করা অবশ্যকর্তব্য। তাই নবী করিম (সা.) উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, ‘ওহে লোকেরা! আল্লাহ তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন, অতএব তোমরা হজ আদায় করো।’ (মুসলিম)
ইসলামে হজের ধর্মীয় গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। পৃথিবীর সব দেশের মুসলমান তাদের একমাত্র প্রভু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এক নির্দিষ্ট সময়ে কাবাঘরের চারপাশে এবং মক্কার অপর কয়েকটি স্থানে সম্মিলিত কতগুলো ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে হজ আদায় করেন। মূলত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হজ। প্রতিবছর ৯ জিলহজ বিশ্বের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান আরাফাতের ময়দানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে উচ্চ স্বরে সমবেত কণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ানিন’মাতা লাকা ওয়াল্মুল্ক্ লা শারিকা লাকা’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে হাজির, আমি তোমার দ্বারে উপস্থিত, আমি হাজির, তোমার কোনো অংশীদার নেই, তোমার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিয়ামতের সামগ্রী সবই তোমার, (সর্বযুগে ও সর্বত্র) তোমারই রাজত্ব, তোমার কোনো অংশীদার নেই।’
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তাআলা আরাফার দিনে ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, ‘হে ফেরেশতাগণ! তোমরা লক্ষ করো, আমার বান্দারা কী প্রকারে বহু দূর-দূরান্ত থেকে এসে আজ আরাফাত মাঠে ধুলা-বালুর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তোমরা সাক্ষী থাকো, যারা আমার ঘর (কাবা) জিয়ারত করতে এসে এত কষ্ট স্বীকার করছে, নিশ্চয়ই আমি তাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিলাম।’ (বুখারি) যে ব্যক্তি হজ করে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ এমনভাবে ক্ষমা করে দেন যেন সে নবজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়।
হাজিরা যখন হজ আদায় করেন তখন তাঁরা আল্লাহর কাছে যা প্রার্থনা করেন তিনি তা কবুল করেন। নিজেদের পাপরাশির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি তা মার্জনা করে দেন। হাজিরা যখন আরাফাত ময়দানে অবস্থান করেন, তখন তাঁদের ওপর আল্লাহর অশেষ রহমত বর্ষিত হতে থাকে। প্রকৃত হজকারীর জন্য দোজখ হারাম হয়ে যায় এবং বেহেশত নির্ধারিত হয়ে যায়। হজে মকবুলের প্রতিদান বেহেশত ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। ধনী ব্যক্তির হজ পালন করা অবশ্যকর্তব্য।
ইসলামে হজের যথেষ্ট সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। হজ মানুষকে ঐক্য ও একত্ববোধ শিক্ষা দেয়। বিশ্বের সব মুসলমান হজের মৌসুমে মক্কা শরিফে একতাবদ্ধ হন এবং কাবাঘর তাওয়াফ, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, সাফা-মারওয়ায় দৌড়ানো ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করেন। হজ মানুষের মধ্যে সামাজিক সাম্যবোধ জাগ্রত করে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমান সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই সেলাইবিহীন একই ধরনের সাদা পোশাক শরীরে জড়িয়ে হজ পালন করেন। ফলে তাঁদের মধ্যে যাবতীয় বর্ণবৈষম্য বিদূরিত হয় এবং সাম্যের অনুপম মহড়ার অনুশীলন হয়। হজ মানুষের মনে-প্রাণে ঐক্য ও সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। সবাই এক আল্লাহর বান্দা ও এক রাসুলের উম্মত হিসেবে পরিচিত হয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে বিশ্বের সব মুসলমান একটি অখণ্ড উম্মাহ এবং সবাই পরস্পর ভাই ভাই।
সর্বোপরি হজ মুসলমানদের সর্ববৃহৎ বার্ষিক সম্মেলন। হজ মুসলমানদের মনে সর্ববিষয়ে আল্লাহর আনুগত্যের স্বীকৃতি, হূদয়ের পবিত্রতা, ইমানের শক্তি বৃদ্ধি ও তাদের আধ্যাত্মিক জীবনের চরম উন্নতি সাধনের দ্বারা অন্তরে পারলৌকিক সুখের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। হজে গিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহ খাতাসমূহের জন্য অত্যন্ত বিনয়সহকারে মনের আবেগ মিটিয়ে, অশ্রু বিসর্জন দিয়ে সব অপরাধ ক্ষমা প্রার্থনা ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের জন্য দোয়া করে থাকেন এবং বাকি জীবন আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলার জন্য প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে আসেন। তাই পবিত্র হজকে ইসলামের শ্রেষ্ঠতম দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত বলে অভিহিত করা হয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
নবম হিজরিতে হজ ফরজ হয়। হজ কেবল ধনী মুসলমানদের ওপর জীবনে একবার ফরজ, কিন্তু গরিবদের ওপর এটা ফরজ নয়। যেহেতু আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক ধনী ও সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর হজ ফরজ করেছেন, তাই ধনী ব্যক্তি হজ আদায় না করলে কঠিন গুনাহগার হবে। সে কারণে তার ওপর জীবনে একবার হজ আদায় করা অবশ্যকর্তব্য। তাই নবী করিম (সা.) উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, ‘ওহে লোকেরা! আল্লাহ তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন, অতএব তোমরা হজ আদায় করো।’ (মুসলিম)
ইসলামে হজের ধর্মীয় গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। পৃথিবীর সব দেশের মুসলমান তাদের একমাত্র প্রভু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এক নির্দিষ্ট সময়ে কাবাঘরের চারপাশে এবং মক্কার অপর কয়েকটি স্থানে সম্মিলিত কতগুলো ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে হজ আদায় করেন। মূলত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হজ। প্রতিবছর ৯ জিলহজ বিশ্বের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান আরাফাতের ময়দানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে উচ্চ স্বরে সমবেত কণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ানিন’মাতা লাকা ওয়াল্মুল্ক্ লা শারিকা লাকা’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে হাজির, আমি তোমার দ্বারে উপস্থিত, আমি হাজির, তোমার কোনো অংশীদার নেই, তোমার দরবারে উপস্থিত হয়েছি। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিয়ামতের সামগ্রী সবই তোমার, (সর্বযুগে ও সর্বত্র) তোমারই রাজত্ব, তোমার কোনো অংশীদার নেই।’
হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তাআলা আরাফার দিনে ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, ‘হে ফেরেশতাগণ! তোমরা লক্ষ করো, আমার বান্দারা কী প্রকারে বহু দূর-দূরান্ত থেকে এসে আজ আরাফাত মাঠে ধুলা-বালুর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তোমরা সাক্ষী থাকো, যারা আমার ঘর (কাবা) জিয়ারত করতে এসে এত কষ্ট স্বীকার করছে, নিশ্চয়ই আমি তাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিলাম।’ (বুখারি) যে ব্যক্তি হজ করে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ এমনভাবে ক্ষমা করে দেন যেন সে নবজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়।
হাজিরা যখন হজ আদায় করেন তখন তাঁরা আল্লাহর কাছে যা প্রার্থনা করেন তিনি তা কবুল করেন। নিজেদের পাপরাশির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি তা মার্জনা করে দেন। হাজিরা যখন আরাফাত ময়দানে অবস্থান করেন, তখন তাঁদের ওপর আল্লাহর অশেষ রহমত বর্ষিত হতে থাকে। প্রকৃত হজকারীর জন্য দোজখ হারাম হয়ে যায় এবং বেহেশত নির্ধারিত হয়ে যায়। হজে মকবুলের প্রতিদান বেহেশত ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। ধনী ব্যক্তির হজ পালন করা অবশ্যকর্তব্য।
ইসলামে হজের যথেষ্ট সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। হজ মানুষকে ঐক্য ও একত্ববোধ শিক্ষা দেয়। বিশ্বের সব মুসলমান হজের মৌসুমে মক্কা শরিফে একতাবদ্ধ হন এবং কাবাঘর তাওয়াফ, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, সাফা-মারওয়ায় দৌড়ানো ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করেন। হজ মানুষের মধ্যে সামাজিক সাম্যবোধ জাগ্রত করে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমান সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই সেলাইবিহীন একই ধরনের সাদা পোশাক শরীরে জড়িয়ে হজ পালন করেন। ফলে তাঁদের মধ্যে যাবতীয় বর্ণবৈষম্য বিদূরিত হয় এবং সাম্যের অনুপম মহড়ার অনুশীলন হয়। হজ মানুষের মনে-প্রাণে ঐক্য ও সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। সবাই এক আল্লাহর বান্দা ও এক রাসুলের উম্মত হিসেবে পরিচিত হয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে বিশ্বের সব মুসলমান একটি অখণ্ড উম্মাহ এবং সবাই পরস্পর ভাই ভাই।
সর্বোপরি হজ মুসলমানদের সর্ববৃহৎ বার্ষিক সম্মেলন। হজ মুসলমানদের মনে সর্ববিষয়ে আল্লাহর আনুগত্যের স্বীকৃতি, হূদয়ের পবিত্রতা, ইমানের শক্তি বৃদ্ধি ও তাদের আধ্যাত্মিক জীবনের চরম উন্নতি সাধনের দ্বারা অন্তরে পারলৌকিক সুখের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। হজে গিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহ খাতাসমূহের জন্য অত্যন্ত বিনয়সহকারে মনের আবেগ মিটিয়ে, অশ্রু বিসর্জন দিয়ে সব অপরাধ ক্ষমা প্রার্থনা ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের জন্য দোয়া করে থাকেন এবং বাকি জীবন আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলার জন্য প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে আসেন। তাই পবিত্র হজকে ইসলামের শ্রেষ্ঠতম দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত বলে অভিহিত করা হয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments