স্মরণ- নাটোরের সেলিমকে মনে আছে? by গোলাম কামরান
পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে জিপের পেছনে বেঁধে নওগাঁর সারা রাস্তায় টেনে ঘুরিয়েছিল? ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন সেলিম। সেলিমের কথা বলতে হলে নাটোরের গৌরবগাথা নিয়েও কথা বলতে হয়। নাটোরের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস দেশের অন্যান্য স্থান থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র।
ইতিহাসের এই অবিস্মরণীয় মুহূর্তে নাটোরের তৎকালীন ছাত্ররাজনীতি জাতীয় রাজনীতিতে মুখ্য ভূমিকা রাখে। তাই একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনে নাটোরের ছাত্ররাজনীতি ছিল স্রোতস্বিনীর মতো বহমান। এ সময় নাটোরের প্রধানতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নবাব সিরাজ-উজ-দৌলা কলেজ ছাত্রসংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ব্যাপক গণসংযোগের মাধ্যমে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে স্বাধীনতার প্রশ্নে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হন এবং জনমত গড়ে তোলেন। ছাত্রদের দায়িত্বশীল এই ভূমিকায় কলেজের প্রথম বর্ষ বিকমের ছাত্র এবং তৎকালীন মহকুমা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সেলিম চৌধুরীর সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল ঈর্ষণীয়।
সেলিম ছিলেন নাটোরের ঐতিহ্যবাহী মুসলমান জমিদার চৌধুরী পরিবারের সন্তান। বাবা হাবিবুর রহমান খান চৌধুরী ওরফে ইসাহাক চৌধুরী। তেরো ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ। পরিবারের সবাই মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকলেও সেলিম ছিলেন ব্যতিক্রম। নিয়মিত ব্যায়াম করা পেশিবহুল দেহ, অসীম সাহস আর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৃঢ়তা সেলিমকে দিয়েছিল আলাদা পরিচিতি। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাটোর সফরে এলে সেলিমের সঙ্গে দেখা হয়। বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সেলিম ছাত্রলীগে যোগ দেন।
১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নাটোরের নিয়ন্ত্রণ কব্জা করে নিলে অন্যদের মতো সেলিমও পাড়ি জমান ভারতে। প্রথমে বালুঘাটে, পরে শিলিগুড়িতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে নওগাঁয় প্রবেশ করেন এবং সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোখলেসুর রহমান রাজার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। এরপর তিনি বিভিন্ন অপারেশনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। ওই দিন নওগাঁর মান্দা উপজেলার মৈনম উচ্চবিদ্যালয়ে অবস্থিত রাজাকারদের শক্তিশালী ঘাঁটি আক্রমণের লক্ষ্যে শৈনমের তিনটি সড়কের পৃথক পৃথক জায়গায় মুক্তিবাহিনী শক্তিশালী মাইন স্থাপন করে। মোখলেসুর রহমান রাজা ও ওহিদুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মাঝরাতে ওই ক্যাম্পে হামলা চালায়। সেলিমও এই অপারেশনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনের সংবাদ পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী পেতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণ উপেক্ষা করে রাজাকারদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধ সকাল নয়টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
সফল অভিযান শেষে মুক্তিবাহিনী তাদের শেল্টারে ফিরে গেলেও পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের কারণে সেলিমের আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আহত অবস্থায় সেলিম পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। এরপর তাঁকে জিপের পেছনে বেঁধে নওগাঁ শহর ঘোরানো হয়। একজন জীবন্ত মানুষকে রাস্তা দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখে পথচারীরা ভয়ে ও আতঙ্কে শিউরে ওঠে। কী নির্মম হিংস্রতা, যা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়।
সেলিম আমাদের স্বাধীনতা ইতিহাসের অনিবার্য নাম। তাই শহীদ সেলিমকে নওগাঁবাসী স্মরণ করেছে। ১৯৯৫ সালে শহীদ সেলিমের নামে ‘শহীদ সেলিম পৌর মার্কেট’-এর ভিত্তিপ্রস্তরও উদ্বোধন করা হয়েছে। এ ছাড়া শহরের কেন্দ্রস্থলে শহীদ মিনারের পাশে নওগাঁ জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সেলিমের নাম ঠাঁই পেয়েছে।
কিন্তু নাটোরবাসী হিসেবে আমাদের প্রশ্ন, সেলিমের বাড়ি তো নাটোরে। নওগাঁ জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় তাঁর নাম নেই কেন? উত্তরে সেলিমের সহযোদ্ধারা জানালেন, ‘সেলিম আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় বাংলাদেশজুড়ে ব্যাপ্ত।’
কথাটায় সত্যতা আছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এই বীর শহীদ আজ নাটোরেই উপেক্ষিত। তাঁর স্মৃতি রক্ষায় স্থানীয়ভাবে কোনো কিছুই করা হয়নি। এমনকি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি হিসেবে কোনো রাষ্ট্রীয় খেতাব বা পদকও জোটেনি তাঁর ভাগ্যে। ২০০২ সালের ২৬ মার্চ শহরের মাদ্রাসা মোড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়ও তাঁর নাম নেই।
এ দেশের কোথাও সেলিমের কোনো কবর নেই, যেখানে তাঁর স্বজনেরা দুই ফোঁটা চোখের পানি ফেলতে পারেন। আমরা শুনে এসেছি, শহীদের মৃত্যু নেই। আসলে কি শহীদেরা অমর? মাঝে মাঝে বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি কেঁপে ওঠে।
আজ ২৫ অক্টোবর, সেলিমের শহীদ হওয়ার দিন। তাঁকে আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
গোলাম কামরান
সেলিম ছিলেন নাটোরের ঐতিহ্যবাহী মুসলমান জমিদার চৌধুরী পরিবারের সন্তান। বাবা হাবিবুর রহমান খান চৌধুরী ওরফে ইসাহাক চৌধুরী। তেরো ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ। পরিবারের সবাই মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকলেও সেলিম ছিলেন ব্যতিক্রম। নিয়মিত ব্যায়াম করা পেশিবহুল দেহ, অসীম সাহস আর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৃঢ়তা সেলিমকে দিয়েছিল আলাদা পরিচিতি। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাটোর সফরে এলে সেলিমের সঙ্গে দেখা হয়। বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সেলিম ছাত্রলীগে যোগ দেন।
১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নাটোরের নিয়ন্ত্রণ কব্জা করে নিলে অন্যদের মতো সেলিমও পাড়ি জমান ভারতে। প্রথমে বালুঘাটে, পরে শিলিগুড়িতে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে নওগাঁয় প্রবেশ করেন এবং সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোখলেসুর রহমান রাজার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। এরপর তিনি বিভিন্ন অপারেশনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। ওই দিন নওগাঁর মান্দা উপজেলার মৈনম উচ্চবিদ্যালয়ে অবস্থিত রাজাকারদের শক্তিশালী ঘাঁটি আক্রমণের লক্ষ্যে শৈনমের তিনটি সড়কের পৃথক পৃথক জায়গায় মুক্তিবাহিনী শক্তিশালী মাইন স্থাপন করে। মোখলেসুর রহমান রাজা ও ওহিদুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মাঝরাতে ওই ক্যাম্পে হামলা চালায়। সেলিমও এই অপারেশনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনের সংবাদ পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী পেতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণ উপেক্ষা করে রাজাকারদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধ সকাল নয়টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
সফল অভিযান শেষে মুক্তিবাহিনী তাদের শেল্টারে ফিরে গেলেও পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের কারণে সেলিমের আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আহত অবস্থায় সেলিম পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। এরপর তাঁকে জিপের পেছনে বেঁধে নওগাঁ শহর ঘোরানো হয়। একজন জীবন্ত মানুষকে রাস্তা দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখে পথচারীরা ভয়ে ও আতঙ্কে শিউরে ওঠে। কী নির্মম হিংস্রতা, যা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়।
সেলিম আমাদের স্বাধীনতা ইতিহাসের অনিবার্য নাম। তাই শহীদ সেলিমকে নওগাঁবাসী স্মরণ করেছে। ১৯৯৫ সালে শহীদ সেলিমের নামে ‘শহীদ সেলিম পৌর মার্কেট’-এর ভিত্তিপ্রস্তরও উদ্বোধন করা হয়েছে। এ ছাড়া শহরের কেন্দ্রস্থলে শহীদ মিনারের পাশে নওগাঁ জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সেলিমের নাম ঠাঁই পেয়েছে।
কিন্তু নাটোরবাসী হিসেবে আমাদের প্রশ্ন, সেলিমের বাড়ি তো নাটোরে। নওগাঁ জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় তাঁর নাম নেই কেন? উত্তরে সেলিমের সহযোদ্ধারা জানালেন, ‘সেলিম আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় বাংলাদেশজুড়ে ব্যাপ্ত।’
কথাটায় সত্যতা আছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এই বীর শহীদ আজ নাটোরেই উপেক্ষিত। তাঁর স্মৃতি রক্ষায় স্থানীয়ভাবে কোনো কিছুই করা হয়নি। এমনকি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি হিসেবে কোনো রাষ্ট্রীয় খেতাব বা পদকও জোটেনি তাঁর ভাগ্যে। ২০০২ সালের ২৬ মার্চ শহরের মাদ্রাসা মোড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়ও তাঁর নাম নেই।
এ দেশের কোথাও সেলিমের কোনো কবর নেই, যেখানে তাঁর স্বজনেরা দুই ফোঁটা চোখের পানি ফেলতে পারেন। আমরা শুনে এসেছি, শহীদের মৃত্যু নেই। আসলে কি শহীদেরা অমর? মাঝে মাঝে বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি কেঁপে ওঠে।
আজ ২৫ অক্টোবর, সেলিমের শহীদ হওয়ার দিন। তাঁকে আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
গোলাম কামরান
No comments