গণরায়- উপনির্বাচন থেকে জাতীয় নির্বাচনের শিক্ষা by বদিউল আলম মজুমদার
গত ৩০ সেপ্টেম্বর গাজীপুর-৪ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এটি সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ের নির্বাচন। তাই অনেকের মতে, এটি ছিল কম গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া এতে প্রধান বিরোধী দল অংশ নেয়নি, তাই এর মাধ্যমে সরকারের জনপ্রিয়তা যাচাই করারও সুযোগ ছিল না।
উপরন্তু, নির্বাচনে দুই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী শুধু নিকটাত্মীয়ই নন, তাঁরা উভয়েই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব কারণে নির্বাচনটি উত্তাপহীন হলেও এটি সম্পর্কে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের আগ্রহ ছিল প্রবল। এই আগ্রহের মূল উৎস ছিল, নির্বাচন কমিশন এটি পরিচালনার ক্ষেত্রে কেমন কার্যকারিতা প্রদর্শন করে, তা দেখা। কারণ পুনর্গঠিত কমিশনের জন্য এটি ছিল প্রথম নির্বাচন। গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, নির্বাচনটি ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এবং এতে কোনো ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটেনি। এতে সরকারি দলের প্রার্থী সিমিন হোসেন রিমি তাঁরই চাচা স্বতন্ত্র প্রার্থী আফসারউদ্দীন আহমদকে ৩৭ হাজার ৫২ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। রিমি পেয়েছেন ৬৩ হাজার ৪০১ ভোট, আফসারউদ্দীন ২৬ হাজার ৩৪৯ ভোট এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী আসাদুল্লাহ বাদল এক হাজার ৪২৮ ভোট। আমরা নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যকে অভিনন্দন জানাই।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে কমিশন নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করেছে এবং জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে ঢালাওভাবে কমিশনকে ব্যর্থ বলে দাবি করা হয়েছে। পরাজিত প্রার্থীরাও লিখিতভাবে অনেক অভিযোগ উত্থাপন করে নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন।
গাজীপুর উপনির্বাচনটি পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সাফল্য নিরূপণ করতে হলে মূলত দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক: কমিশন সঠিক ও কঠোরভাবে নির্বাচনী আইন প্রয়োগ করেছে কি না এবং ভোটের দিন কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না। বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সালে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইন, ১৯৭২ হলো মূল নির্বাচনী আইন। এর ১২ ধারায় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিধান রয়েছে। আইনের ১২ (১) (ঞ) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হতে হলে তাঁকে অন্তত তিন বছর আগে থেকে সেই দলের সদস্য হতে হবে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধন-সম্পর্কিত সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইন, ১৯৭২-এর ৯০বি (১) (ক) ও (খ) (ঈ) ধারা অনুযায়ী, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা বা ক্ষেত্রমতো থানা ও জেলা কমিটির দলীয় সদস্যরা সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থীর প্যানেল তৈরি করবেন এবং কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড ওই প্যানেলে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে। অর্থাৎ সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সুপারিশ বিবেচনায় নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জারি করা অধ্যাদেশে দলের স্থানীয় কমিটিগুলোর তৈরি প্যানেলের ভিত্তিতে, শুধু বিবেচনায় নিয়ে নয়, মনোনয়ন প্রদানের বিধান ছিল। কিন্তু অধ্যাদেশটি সংসদে অনুমোদনের সময় মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রে দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়। গাজীপুর-৪ আসনের উপনির্বাচনে আইনের এই দুটি বিধানের বাস্তবায়ন নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আমরা যতটুকু জেনেছি, সিমিন হোসেন রিমি তিন বছর আগে থেকে আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন, তার প্রমাণ হিসেবে দলের পক্ষ থেকে সদস্যপদের রসিদ রিটার্নিং অফিসারের কাছে জমা দেওয়া হয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস এবং তাদের অতীতের অন্যায়, বেআইনি ও অনৈতিক আচরণের ইতিহাসের (যেমন: মনোনয়ন-বাণিজ্য, নির্বাচনী আইন মানার ক্ষেত্রে অনীহা, অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদি) কারণে তাদের প্রতি আস্থাশীল হওয়া দুরূহ। এ ধরনের বিতর্ক ভবিষ্যতে এড়াতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের প্রাথমিক সদস্যদের তালিকা দলের ওয়েবসাইটে প্রকাশ এবং নিয়মিত তা হালনাগাদ করতে হবে। আশা করি কমিশন এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নেবে। সিমিন হোসেন রিমিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়ার আগে দলের তৃণমূলের কমিটিগুলোর পক্ষ থেকে কোনো প্যানেল তৈরির কথা আমরা শুনিনি। তবে দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অনুরোধেই তিনি প্রর্থী হয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা, ফেয়ার ইলেকশনস মনিটরিং অ্যালায়েন্সও (ফেমা) গাজীপুর-৪ উপনির্বাচন পর্যবেক্ষণ-সম্পর্কিত প্রাথমিক রিপোর্টে আইনের এই বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেছে। অর্থাৎ কমিশন নির্বাচনী আইন পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আরও কয়েকটি অনিয়মের কথাও ফেমার রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে। ফেমার পক্ষ থেকে আরও অভিযোগ করা হয় যে সব কেন্দ্রে বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন না এবং একটি কেন্দ্রে সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থীর একাধিক এজেন্ট দেখা গেছে, যা আইনের বরখেলাপ।
প্রসঙ্গত, এসব অভিযোগের কারণে ফেমা গাজীপুর-৪ আসনের উপনির্বাচনকে ‘মৌলিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ’ বলে আখ্যায়িত করেছে। গাজীপুর-৪ আসনের নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণের হার নিয়েও একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, মাত্র ৪৩ দশমিক ২৩ শতাংশ ভোটার এ উপনির্বাচনে ভোট প্রদান করেছেন, যা আমাদের গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবং সংশ্লিষ্ট আসনে ভোটার উপস্থিতির হারের অর্ধেকেরও কম। গত নির্বাচনে এ আসনে ৯২ শতাংশ ভোট পড়েছিল। তবে কিছু কিছু গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, যে হারে দিনের অধিকাংশ সময় ভোট প্রদান করা হয়েছে, তাতে এই নির্বাচনে ৪৩ শতাংশ ভোট পড়ার কথা নয় (প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর, ২০১২)।
ভোটার অংশগ্রহণের এমন নিম্নহারের সঙ্গে নির্বাচনী ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গাজীপুর-৪ আসনে মোট ভোটারসংখ্যা দুই লাখ ১১ হাজার ৮৮৪, যার মধ্যে ৯১ হাজার ৭৯৬ জন বা ৪৩ দশমিক ২১ শতাংশ ভোটার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। আর সিমিন হোসেন রিমি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ভোটারদের ৭৯ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও তিনি মোট ভোটারের মাত্র ৩০ শতাংশের সমর্থন পেয়েছেন। কারণ, গণতন্ত্র হলো জনগণের সম্মতির শাসন এবং যে নির্বাচনে মাত্র ৪৩ শতাংশ ভোট পড়ে এবং মোট ভোটারের মাত্র ৩০ শতাংশের সমর্থন পেয়ে একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন, সেই নির্বাচনে জনসম্মতি অর্জিত হয়েছে বললে অত্যুক্তি করা হবে বলে আমরা মনে করি। আর এ কারণেই বহু দেশের নির্বাচনে কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের কম ভোট পেলে রান-অফ বা পুনর্নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। আমাদের দেশেও অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জারি করা অধ্যাদেশে এমনই একটি বিধান ছিল, যা ‘না ভোট’ হিসেবে পরিচিত। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলে এটি অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং অধ্যাদেশের ৪০-এ ধারা অনুযায়ী, ‘উপরোক্ত কোনো প্রার্থী নয়’ এমন ভোটের সংখ্যা মোট প্রদত্ত ভোটের ৫০ শতাংশের বেশি হলে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়। তবে সুজনের প্রস্তাব ছিল ‘না ভোট’ জয়ী হলেই (৫০ শতাংশের কম হলেও) পুনর্নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
সত্যিকার অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক করতে হলে ‘না ভোট’-এর বিধানটি আবার ফিরিয়ে আনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা আবশ্যক। আমরা মনে করি যে ‘না ভোট’-এর বিধান থাকলে উপনির্বাচনটি আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতো। গাজীপুর-৪ আসনের উপনির্বাচনটি অনেক দিক থেকে গুরুত্বহীন হলেও এর ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে। এ উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে সরকারি দলের শত চেষ্টা সত্ত্বেও বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করলে ভোটার উপস্থিতির হার স্বল্প হয়, যার ফলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তা ছাড়া, বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া একটি আসনে উপনির্বাচন করা সম্ভব হলেও ৩০০ আসনে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব নয়। আর বিরোধী দল নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলে ভোটার অংশগ্রহণের হার আরও নিম্নমুখী হতে পারে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জনবিচ্ছিন্ন, এমনকি প্রহসনে পরিণত করে ফেলতে পারে। এমনই পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে নির্বাচনী ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করাই আজ আমাদের অন্যতম জাতীয় অগ্রাধিকার হওয়া আবশ্যক।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে কমিশন নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করেছে এবং জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে ঢালাওভাবে কমিশনকে ব্যর্থ বলে দাবি করা হয়েছে। পরাজিত প্রার্থীরাও লিখিতভাবে অনেক অভিযোগ উত্থাপন করে নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন।
গাজীপুর উপনির্বাচনটি পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সাফল্য নিরূপণ করতে হলে মূলত দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক: কমিশন সঠিক ও কঠোরভাবে নির্বাচনী আইন প্রয়োগ করেছে কি না এবং ভোটের দিন কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না। বর্তমান সরকারের আমলে ২০০৯ সালে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইন, ১৯৭২ হলো মূল নির্বাচনী আইন। এর ১২ ধারায় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিধান রয়েছে। আইনের ১২ (১) (ঞ) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হতে হলে তাঁকে অন্তত তিন বছর আগে থেকে সেই দলের সদস্য হতে হবে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধন-সম্পর্কিত সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইন, ১৯৭২-এর ৯০বি (১) (ক) ও (খ) (ঈ) ধারা অনুযায়ী, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা বা ক্ষেত্রমতো থানা ও জেলা কমিটির দলীয় সদস্যরা সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থীর প্যানেল তৈরি করবেন এবং কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড ওই প্যানেলে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে। অর্থাৎ সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সুপারিশ বিবেচনায় নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জারি করা অধ্যাদেশে দলের স্থানীয় কমিটিগুলোর তৈরি প্যানেলের ভিত্তিতে, শুধু বিবেচনায় নিয়ে নয়, মনোনয়ন প্রদানের বিধান ছিল। কিন্তু অধ্যাদেশটি সংসদে অনুমোদনের সময় মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রে দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়। গাজীপুর-৪ আসনের উপনির্বাচনে আইনের এই দুটি বিধানের বাস্তবায়ন নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আমরা যতটুকু জেনেছি, সিমিন হোসেন রিমি তিন বছর আগে থেকে আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন, তার প্রমাণ হিসেবে দলের পক্ষ থেকে সদস্যপদের রসিদ রিটার্নিং অফিসারের কাছে জমা দেওয়া হয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস এবং তাদের অতীতের অন্যায়, বেআইনি ও অনৈতিক আচরণের ইতিহাসের (যেমন: মনোনয়ন-বাণিজ্য, নির্বাচনী আইন মানার ক্ষেত্রে অনীহা, অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদি) কারণে তাদের প্রতি আস্থাশীল হওয়া দুরূহ। এ ধরনের বিতর্ক ভবিষ্যতে এড়াতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের প্রাথমিক সদস্যদের তালিকা দলের ওয়েবসাইটে প্রকাশ এবং নিয়মিত তা হালনাগাদ করতে হবে। আশা করি কমিশন এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নেবে। সিমিন হোসেন রিমিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়ার আগে দলের তৃণমূলের কমিটিগুলোর পক্ষ থেকে কোনো প্যানেল তৈরির কথা আমরা শুনিনি। তবে দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অনুরোধেই তিনি প্রর্থী হয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা, ফেয়ার ইলেকশনস মনিটরিং অ্যালায়েন্সও (ফেমা) গাজীপুর-৪ উপনির্বাচন পর্যবেক্ষণ-সম্পর্কিত প্রাথমিক রিপোর্টে আইনের এই বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেছে। অর্থাৎ কমিশন নির্বাচনী আইন পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আরও কয়েকটি অনিয়মের কথাও ফেমার রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে। ফেমার পক্ষ থেকে আরও অভিযোগ করা হয় যে সব কেন্দ্রে বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন না এবং একটি কেন্দ্রে সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থীর একাধিক এজেন্ট দেখা গেছে, যা আইনের বরখেলাপ।
প্রসঙ্গত, এসব অভিযোগের কারণে ফেমা গাজীপুর-৪ আসনের উপনির্বাচনকে ‘মৌলিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ’ বলে আখ্যায়িত করেছে। গাজীপুর-৪ আসনের নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণের হার নিয়েও একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, মাত্র ৪৩ দশমিক ২৩ শতাংশ ভোটার এ উপনির্বাচনে ভোট প্রদান করেছেন, যা আমাদের গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবং সংশ্লিষ্ট আসনে ভোটার উপস্থিতির হারের অর্ধেকেরও কম। গত নির্বাচনে এ আসনে ৯২ শতাংশ ভোট পড়েছিল। তবে কিছু কিছু গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, যে হারে দিনের অধিকাংশ সময় ভোট প্রদান করা হয়েছে, তাতে এই নির্বাচনে ৪৩ শতাংশ ভোট পড়ার কথা নয় (প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর, ২০১২)।
ভোটার অংশগ্রহণের এমন নিম্নহারের সঙ্গে নির্বাচনী ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গাজীপুর-৪ আসনে মোট ভোটারসংখ্যা দুই লাখ ১১ হাজার ৮৮৪, যার মধ্যে ৯১ হাজার ৭৯৬ জন বা ৪৩ দশমিক ২১ শতাংশ ভোটার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। আর সিমিন হোসেন রিমি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ভোটারদের ৭৯ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও তিনি মোট ভোটারের মাত্র ৩০ শতাংশের সমর্থন পেয়েছেন। কারণ, গণতন্ত্র হলো জনগণের সম্মতির শাসন এবং যে নির্বাচনে মাত্র ৪৩ শতাংশ ভোট পড়ে এবং মোট ভোটারের মাত্র ৩০ শতাংশের সমর্থন পেয়ে একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন, সেই নির্বাচনে জনসম্মতি অর্জিত হয়েছে বললে অত্যুক্তি করা হবে বলে আমরা মনে করি। আর এ কারণেই বহু দেশের নির্বাচনে কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের কম ভোট পেলে রান-অফ বা পুনর্নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। আমাদের দেশেও অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জারি করা অধ্যাদেশে এমনই একটি বিধান ছিল, যা ‘না ভোট’ হিসেবে পরিচিত। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলে এটি অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং অধ্যাদেশের ৪০-এ ধারা অনুযায়ী, ‘উপরোক্ত কোনো প্রার্থী নয়’ এমন ভোটের সংখ্যা মোট প্রদত্ত ভোটের ৫০ শতাংশের বেশি হলে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়। তবে সুজনের প্রস্তাব ছিল ‘না ভোট’ জয়ী হলেই (৫০ শতাংশের কম হলেও) পুনর্নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
সত্যিকার অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক করতে হলে ‘না ভোট’-এর বিধানটি আবার ফিরিয়ে আনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা আবশ্যক। আমরা মনে করি যে ‘না ভোট’-এর বিধান থাকলে উপনির্বাচনটি আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতো। গাজীপুর-৪ আসনের উপনির্বাচনটি অনেক দিক থেকে গুরুত্বহীন হলেও এর ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে। এ উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে সরকারি দলের শত চেষ্টা সত্ত্বেও বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করলে ভোটার উপস্থিতির হার স্বল্প হয়, যার ফলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তা ছাড়া, বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া একটি আসনে উপনির্বাচন করা সম্ভব হলেও ৩০০ আসনে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব নয়। আর বিরোধী দল নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলে ভোটার অংশগ্রহণের হার আরও নিম্নমুখী হতে পারে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জনবিচ্ছিন্ন, এমনকি প্রহসনে পরিণত করে ফেলতে পারে। এমনই পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে নির্বাচনী ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করাই আজ আমাদের অন্যতম জাতীয় অগ্রাধিকার হওয়া আবশ্যক।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন।
No comments