অর্থনীতি-বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশের গতিপ্রবণতা ও কতিপয় অমীমাংসিত প্রশ্ন by এমএম আকাশ

কার্ল মার্কস পুঁজিকে 'সঞ্চিত শ্রম' বা 'মৃত শ্রম' হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার ভাষায়, মৃত শ্রমের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে (অর্থাৎ কল-কারখানা, সম্পদ ইত্যাদি) জীবন্ত শ্রমেরও (অর্থাৎ শ্রমিক জনগণ) বিকাশ ঘটে। সমাজতন্ত্রের পরীক্ষা-


নিরীক্ষার সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন করে সাম্যবাদীদের মধ্যে যারা 'সংশোধনবাদী' হিসেবে আখ্যায়িত, তারা অবশ্য জীবন্ত শ্রমের দ্বৈত প্রকৃতির সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। তাদের মতে, শুধু কায়িক শ্রম নয়, 'সংগঠক'-এর মানসিক শ্রমও এক বিশেষ ধরনের জীবন্ত শ্রম। বুদ্ধিনির্ভর ব্যবস্থাপনা শ্রমও সামাজিক উৎপাদনের জন্য একটি অপরিহার্য উৎপাদন এবং সেই ব্যবস্থাপনা শ্রমে 'মানসিক সঞ্চিত জ্ঞান' এক ধরনের পুঁজিরূপে ব্যক্তির মস্তিষ্কে সঞ্চিত থাকে। তদুপরি এই ব্যবস্থাপনা জ্ঞান বা পুঁজির মালিকানাকে ব্যবস্থাপকের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয় এবং এটি এমন একটি সম্পদ, যা ব্যবহার করলে তা হ্রাস না পেয়ে অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনীর মাধ্যমে দিন দিন আরও বৃদ্ধি পায়। আরও উৎকর্ষ লাভ করে। এই বোধ থেকে উদ্দীপ্ত হয়ে রাশিয়ার বর্তমান নতুন কমিউনিস্ট পার্টি তাদের চিরায়ত 'কাস্তে-হাতুড়ি' প্রতীকের সঙ্গে যুক্ত করেছেন 'পুস্তক'-এর প্রতীক। এখন তাদের মতে, সমাজে সম্মিলিত 'জীবন্ত শ্রম'-এর প্রতীক হচ্ছে কৃষক-শ্রমিক এবং বুদ্ধিজীবীর সম্মিলিত ঐক্য। সমাজের এই অংশটি শেষ পর্যন্ত কার পক্ষে যাচ্ছেন :বুর্জোয়ার, না শ্রমিকের; নাকি নিজেই নিজের সেবার মাধ্যমে শ্রমজীবীর প্রতিনিধি পদের অপব্যবহার করে কর্তায় পরিণত হচ্ছেন_ এই বিষয়টির ওপরই নির্ভর করে সমাজতান্ত্রিক সমাজের শক্তি ভারসাম্য ও ভবিষ্যৎ গতিপ্রবণতা
মনে রাখতে হবে, উন্নয়নশীল দেশের বুর্জোয়ারা হচ্ছে খধঃব ঝঃধৎঃবৎ. অর্থাৎ দেরিতে যাত্রাকারী বুর্জোয়া। পশ্চিমা দেশের বুর্জোয়ারা দীর্ঘকাল ধরে একটি প্রতিযোগিতামূলক গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের পর্ব অতিক্রম করার সুযোগ পেয়েছিল। পশ্চিমা দেশগুলোতে ঐতিহাসিকভাবে আগেই দেশের বাইরে অবস্থিত উপনিবেশ থেকে প্রাথমিক পুঁজির সঞ্চিত একটি ভাণ্ডার ছিল বলে তাদের দেশের ভেতরে তুলনামূলকভাবে কম নিষ্ঠুর কৌশল গ্রহণ করতে হয়েছে। দেশের ভেতরে নিয়ম-কানুন মেনেই তাদের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল। জাতীয় বুর্জোয়ারা আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্প গড়তে চায়। তাদের অবশ্যই বিশাল পুঁজি নিয়ে যাত্রা শুরু করতে হবে। সেটা ব্যক্তিগত সীমিত সঞ্চয়ের দ্বারা না কুলালে, প্রাক্-পুঁজিবাদী খাত থেকে থাবা দিয়ে, ছোঁ মেরে বা লুণ্ঠন করেই দ্রুততম পন্থায় তাদের তা সংগ্রহ করতে হবে। লুণ্ঠনের পাশাপাশি ব্যাংকিং ব্যবস্থা বা শেয়ারবাজারের মাধ্যমে অন্যের সঞ্চয় কাজে লাগিয়ে বা সুকৌশলে আত্মসাৎ করে তারা অগ্রসর হতে পারে। কিন্তু ব্যাংক ঋণও সভ্য দেশে একটি পরিশোধযোগ্য পুঁজি। তাছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ পুঁজিবাদী শিল্পায়ন ব্যর্থ হলে এটা পরিশোধ করা সম্ভব হবে না এবং তখন সৃষ্টি হবে 'ঋণখেলাপি'র নতুন সমস্যা। সুতরাং এসব দেশে যারা বড় শিল্প গড়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের অতীতটা দেখা যাবে বেশ কদর্য। পুঁজির এই প্রাগৈতিহাসিক পর্বটি শাস্তিহীনভাবে অতিক্রম করতে তাদের প্রয়োজন হয় রাষ্ট্র ও মিডিয়ার সমর্থন।
বর্তমানে রাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহৎ ব্যক্তি পুঁজির যে লেনদেন, তাতে রাষ্ট্রের ভেতরেও পুনরায় দুর্নীতি প্রসারিত হচ্ছে এবং সেখানেও সৃষ্টি হচ্ছে 'আমলা পুঁজি' : সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট পুঁজি। এসব লেনদেনের সময় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষও কেউ কেউ দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে পুঁজির মালিকে পরিণত হচ্ছেন। এসব ঘটনা সচরাচর প্রকাশিত হয় না। কিন্তু প্রকাশিত হলে দেশবাসী এমনকি দেশপ্রেমিক উৎপাদনশীল শিল্পপতিদের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বুর্জোয়ারা কেউ কেউ নিজেদের তখন অন্য লুটেরাদের থেকে আলাদা করে নিজেকে ভাবেন; আবার কখনওবা হতাশ হয়ে অন্যদের পদাঙ্কই অনুসরণে প্রবৃত্ত হন।
বাংলাদেশের বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশের আদি ইতিহাস :১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে এ দেশে হিন্দু ও মাড়োয়ারিরাই মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের মূল অবস্থানগুলো দখল করে রেখেছিল। চট্টগ্রামে মাত্র কয়েকজন বাঙালি মুসলমান সওদাগর ছিলেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর হিন্দু ও মাড়োয়ারি পুঁজির ধীরে ধীরে বহির্গমন সূচিত হয়। কিন্তু সেই শূন্যস্থান বাঙালি মুসলমানরা পূরণ করেনি। করেছে বহিরাগত অবাঙালি গোষ্ঠী।
তবে লিবারেল প্রোফেশন (liberal profession), জমি, স্থাবর সম্পত্তি (Real Estate) ইত্যাদি ক্ষেত্রে শূন্যস্থান পূরণের জন্য বাঙালি মুসলমানদের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে। পাটের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে বাঙালি চাষি বা অপেক্ষাকৃত নিম্নতর স্তর থেকেও কিছু লোক উচ্চশিক্ষাকে পুঁজি করে ওপরে উঠে আসে। ১৯৬০ সাল নাগাদ তৈরি হয় শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত স্তর।
১৯৫৮তে সামরিক আইন জারির পর আইয়ুব খান এ দেশে একটি মুৎসুদ্দি বাঙালি গোষ্ঠী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। গ্রামে বুনিয়াদি গণতন্ত্র এবং শহরে E.P.I.D.C-এর মারফত State Sponsored Capitalism-এর ধারা চালু হয়।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর মাড়োয়ারি ও হিন্দু পুঁজি এ দেশ থেকে সম্পূূর্ণ উৎখাত হয়ে যায়। তখন শত্রু সম্পত্তি আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট শূন্যতা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাকে আশ্রয় করে এ দেশে দ্রুত একটি বাঙালি ধনিকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দ্বারা লব্ধ বাঙালিদের যেসব শিল্পোদ্যোগ ছিল, তার মধ্যে ৭০-৮০টি পাটকল, বস্ত্রকল ও চিনিকলই হচ্ছে প্রধান। স্বাধীনতার পর এর সবই জাতীয়করণ করা হয়। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে তারা শুধু অবাধ বিকাশের অধিকারই হারায়নি; একটি তীব্র অপ্রত্যাশিত আঘাতেরও সম্মুখীন হয়েছিলেন।
১৯৭২-৭৫ কালপর্বে এ দেশে একটি নব্য ধনিক গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। তাদের হাতে অবৈধ পন্থায় অর্জিত প্রচুর কালো টাকা জমা হয়। রাষ্ট্রক্ষমতার ভেতরে রাজনৈতিক আনুকূল্য এবং প্রশ্রয়েই এই গোষ্ঠীর জন্ম ও বিকাশ। কিন্তু তদানীন্তন অনুসৃত রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতিমালার কাঠামোর মধ্যে তারা তাদের অর্জিত অর্থের সামাজিক বৈধতা ও নিরাপত্তা সংহত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হচ্ছিল না। এ ছাড়া পেটিবুর্জোয়া, উগ্র বাম শক্তি, রক্ষণশীল সাম্প্র্রদায়িক শক্তি, ট্র্যাডিশনাল বাঙালি বুর্জোয়া_ সর্বোপরি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রকাশ্যে বা গোপনে কামনা করছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। এর পরিণতিতে এই শক্তিগুলোই কমবেশি ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত ও পুনর্বাসিত হয়।
বস্তুত জিয়া, সাত্তার ও এরশাদের আমলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাভোগীদের নামের তালিকা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের ভূমিকার ইতিহাস প্রণয়ন করলে এ কথা খুবই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর জেনারেল জিয়ার আমলে অপেক্ষাকৃত শ্লথগতিতে এবং জেনারেল এরশাদের আমলে প্রবল বেগে উলি্লখিত সমগ্র বুর্জোয়া গোষ্ঠীই তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে সংহত করেছে। এদেরকে আপাতত আমরা পাঁচটি ভাগে (section) বিভক্ত করতে পারি :
ক. আমলা বুর্জোয়া, খ. ট্র্যাডিশনাল বৃহৎ বাঙালি বুর্জোয়া, গ. বৃহৎ নব্য ধনী, ঘ. মাঝারি মালিক, ঙ. ছোট মালিক।
'ঘ' এবং 'ঙ' ব্যতিক্রমকে বাদ দিলে বাকি সবার বিকাশের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী সাহায্যের অবদান এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ভূমিকাই হচ্ছে নিয়ামক। রাষ্ট্রের অর্থ ও লুণ্ঠনের আপেক্ষিক অবদান আমলা বুর্জোয়া, ট্র্যাডিশনাল বাঙালি বুর্জোয়া ও বৃহৎ নব্য ধনীদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ।
রেহমান সোবহান, বারানভ ও ড. ফারুক প্রদত্ত তথ্যাবলি থেকে বোঝা যায় যে, প্রাক-স্বাধীনতাকালীন ট্র্যাডিশনাল বাঙালি বুর্জোয়াদের অধিকাংশের পিতাই ছিলেন ক্ষুদে ব্যবসায়ী অথবা কৃষক। অর্থাৎ এরা কেউই উত্তরাধিকারসূত্রে ধনী ছিলেন না। এরা ছিলেন প্রথম পুরুষ উদ্যোক্তা। এসব উদ্যোক্তার নিজেদের কর্মজীবনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে ক্ষুদে ব্যবসায়ী বা ক্ষুদে কর্মচারী হিসেবে। অর্থাৎ এরা সম্পদ সঞ্চয় করেছেন ধীরে ধীরে। দ্রুত ধনিক এরা নন। তবে শিল্প বা কলকারখানা বা কোনো উৎপাদনশীল উদ্যোগের মাধ্যমে তারা পুঁজি সঞ্চয় করেননি। মূলত, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ঠিকাদারি বা সরবরাহ ব্যবসা, খুচরা ব্যবসা, স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় এবং ঠিকাদারির মাধ্যমে তারা তাদের প্রাথমিক পুঁজি সঞ্চয় করেন। তবে এভাবে অর্থ সংগ্রহের পর অনেকেই মাঝারি আকারের শিল্প-প্রতিষ্ঠান, পরিবহন ব্যবসা, আমদানি-রফতানি ব্যবসা এবং গৃহ ও জমির ক্রয়-বিক্রয় উদ্যোগে টাকা খাটাতে থাকেন। এই পর্যায়ে ১৯৬০-এর দশকে তাদের সবাই নানাভাবে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতে শুরু করেন। এই রাষ্ট্রীয় সহায়তাকে আশ্রয় করেই এরা বৃহৎ শিল্পোদ্যোগ এবং কেউ কেউ এমনকি ব্যাংক পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করেন। তখন এদের কেউ কেউ মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কেউবা মন্ত্রী হন। এইভাবে এরা পাকিস্তানি বৃহৎ বুর্জোয়াদের কনিষ্ঠ অংশীদারে পরিণত হন।
স্বাধীনতা-উত্তর বৃহৎ নব্য ধনীদের বিকাশের সঙ্গে ট্র্যাডিশনাল বুর্জোয়াদের বিকাশের সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে :
ক. এই ধনীদের অধিকাংশই পৈতৃকসূত্রে সচ্ছল এবং শিক্ষিত। এদের অনেকেরই পিতা ছিলেন শিক্ষিত পেশাজীবী এবং শহরবাসী।
খ. এরা অত্যন্ত দ্রুত ধনীতে পরিণত হয়েছেন। অনেকটা এক লাফে 'ক' থেকে 'চন্দ্রবিন্দুতে' পেঁৗছে যাওয়ার মতো।
গ. এই ধনী হওয়ার প্রক্রিয়ায় আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক আনুকূল্যই মুখ্য এবং নিরঙ্কুুশ ভূমিকা পালন করেছে।
ঘ. এরা রাষ্ট্রের প্রচুর অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। রাষ্ট্রের টাকায় রাষ্ট্রের সম্পদ দখল করেছেন। তবে স্বাধীনতার পর এরশাদ সরকারের আমলে যখন পাটকল, বস্ত্রকল ও চিনিকল তাদের প্রাক্তন ট্র্যাডিশনাল বাঙালি বুর্জোয়াদের কাছে হস্তান্তর করা হয়, তখন দেখা গেছে এরা বা এদের বৈধ উত্তরাধিকারীরাও একইভাবে নব্য ধনীদের মতোই সমান হারে রাষ্ট্রীয় অর্থ লুট ও অপচয় করেছে।
১৯৯০-পরবর্তী বুর্জোয়া বিকাশের গতি-প্রকৃতি :জেনারেল এরশাদের পতনের পর কেউ কেউ আশা করেছিলেন যে, গণতান্ত্রিক আমলে ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী ধনিকশ্রেণীর বিকাশ ঘটবে। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির আগ্রাসনও কমে আসবে। যেহেতু এখন আর সমাজতন্ত্র বা সোভিয়েত ইউনিয়নের পুঁজিবাদবিরোধী শক্তি অনুপস্থিত, সেহেতু আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ জাতীয় বুর্জোয়াদের একটু বর্ধিত জায়গা করে দেবে। তাছাড়া ৯০ দশকে উন্নত দেশগুলোতে শ্রমশক্তির দাম তুলনামূলক অনেক বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার শ্রমঘন শিল্পগুলো উন্নয়নশীল দেশে পুনঃস্থাপন করে সেই উৎপাদন পুনরায় রফতানির মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর চাহিদা মেটানোর নতুন সুযোগ বা স্পেসও এই সময় উন্নত দেশগুলো কর্তৃক অনুমোদিত হয়। এই ধারাতেই পরে একগুচ্ছ 'নয়া শিল্পায়িত দেশের' (Newly Industrialized Countries) উদ্ভব হয়; যাদের বিকাশ প্রক্রিয়াকে উন্নয়ন অর্থনীতিবিদরা 'উড়ন্ত পরিযায়ী হংসের মডেলের' (Flying Geese Model) সঙ্গে তুলনার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন। এ জন্য অনেকেই আশা করেছিলেন, উৎপাদনশীল ধনবাদী ধারায় বাংলাদেশও এবার নতুনভাবে পরিচালিত হবে।
নিঃসন্দেহে বলা যায়, দেশের অর্থনীতিতে শিল্পের বিকাশ থেমে থাকেনি। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হারেই তার প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চোখ ধাঁধানো অগ্রগতি ঘটেছে পোশাক শিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ওষুধ শিল্প এবং চামড়া শিল্পে। কিছু ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পও পাওয়া যাবে, যা উপজেলা পর্যায়ে নতুন Growth Center-কে কেন্দ্র করে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এটাও সুস্পষ্ট যে, আমাদের শিল্প খাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে রফতানিমুখী শিল্প অর্থাৎ বাইরের অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল শিল্প। বস্তুত, বাংলাদেশে পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করেই সর্বপ্রথম একগুচ্ছ নতুন প্রজন্মের উৎপাদনশীল উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও সত্য যে, এই শিল্পে শোষণের হারও তীব্র। সুতরাং এই শিল্পের অগ্রগতি মূলত নির্ভর করছে এই শিল্পের মালিক মাঝারি ও বৃহৎ সংগঠক বুর্জোয়ারা দীর্ঘ মেয়াদি স্বার্থে শ্রমিকদের কল্যাণে তাদের অর্জিত মুনাফার একটি ক্ষুদ্র অংশ (আইনানুসারে তা হচ্ছে মুনাফার মাত্র ৫ শতাংশ) শ্রমিকদের বাসস্থান ও রেশনের জন্য প্রদানে সম্মত হবেন, নাকি রাষ্ট্রের সহায়তায় শিল্প পুলিশ দ্বারা এই শিল্পের ক্রমবর্ধমান শ্রমিক অসন্তোষের মোকাবেলা করবেন? তারা যদি প্রথম ইতিবাচক পথটি বেছে নেন এবং শিল্পে শান্তি ও প্রাথমিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনেন, তাহলে এ ক্ষেত্রে আরও বিকাশের জন্য পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের উচ্চতর দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং এই শিল্পে নতুন প্রযুক্তি এনে ও পশ্চাদবর্তী শিল্পে বিনিয়োগ করে বহুমুখী উৎপাদনে অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। এসব পরবর্তী ধাপের কাজ সরকার ও মালিকরা যৌথভাবে না করলে এই শিল্পের আরও উচ্চতর মাত্রায় উল্লল্ফম্ফন ঘটবে না। শ্রমঘন, স্বল্প মূল্য সংযোজক, নিচুমানের উৎপাদনের মধ্যেই তাদেরকে আটকে থাকতে হবে। 'পরিযায়ী পাখি'র মডেল তখন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
বিদেশের ওপর একপেশে নির্ভরতা কমাতে এবং পাশাপাশি সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণীকে উৎপাদনমুখী করতে অভ্যন্তরীণ বাজারের প্রসার ঘটানো, কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রেখে চালের দাম ও অন্যান্য খাদ্যপণের দাম কম রাখা, বাসস্থানের ভাড়া কম রাখা, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস ইত্যাদির দাম কম রাখা, রাস্তাঘাট ও বন্দর সেবা উন্নত করা ইত্যাদি বিষয় জরুরিভাবে বিবেচনা করতে হবে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারকে অগ্রণী হতে হবে এবং বুর্জোয়াদের সে ক্ষেত্রে যথাযথ মাত্রায় কর প্রদান করে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ এসব খাতে বিনিয়োগ এবং সাময়িক ভর্তুকি প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বিদেশি সাহায্য প্রবাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এইভাবে এক গুচ্ছ ইতিবাচক নীতি ও পদক্ষেপের মাধ্যমে এই উত্তরণকালীন অর্থনীতিতে মুদ্রাস্টম্ফীতি যদি কম রাখা যায়, শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ কমিয়ে আনা যায়, সুশিক্ষিত শ্রমিক বাহিনী সৃষ্টি করা যায়, জীবনযাত্রার ব্যয় কম থাকার দরুন ডলারে মজুরি তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দেশের তুলনায় কম থাকে, ব্যাংক ও শেয়ারবাজারে শৃঙ্খলা ফিরে আসে, আমলা পুঁজির ও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ও দৌরাত্ম্য হ্রাস পায় এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মতো যদি কৃষি খাতে আংশিক হলেও কিছুটা ভূমি সংস্কার ও পরিবর্তিত ভূমি ব্যবহার নীতি কার্যকর করা যায়, তাহলে এই দেশের জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আবার উল্টো দিক থেকে বলা যায় যে, যদি সাম্প্র্র্রতিক প্রবণতা অব্যাহত থাকে, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, রেলে নিয়োগ বাণিজ্য, কুইক রেন্টাল ও জ্বালানি খাতের অন্যান্য টানাপড়েন অব্যাহত থাকে বা ভবিষ্যতে বহুগুণিত হারে আরও বৃদ্ধি পায়, তাহলে পরিস্থিতি জাতীয় বুর্জোয়ার বিকাশের জন্য অনুকূল থাকবে না। এর সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উপাদান হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো এবং এশিয়ার দ্রুত বর্ধিষ্ণু দেশগুলোর (চীন ও ভারত) সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সম্পর্ক কী আকার নেয় সেটি। এর ওপরেও নির্ভর করবে আমাদের এই দুর্নীতিবহুল বুর্জোয়া বিকাশের চরিত্র কতখানি জাতীয় স্বার্থের অনুকূল হবে সেটি। তবে আমাদের সাম্প্র্রতিক অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতার সবচেয়ে বড় 'চুঁুষব' হচ্ছে এত দুর্নীতির মধ্যেও অর্থনীতি ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। দারিদ্র্যও প্রতি বছর ১.৫-২ শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে!
অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো :
প্রশ্ন-১. ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দলের মূল নীতিনির্ধারক কারা? বৃহৎ লুটেরা বুর্জোয়ারা, নাকি তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজনীতিবিদরা, নাকি স্বাধীন রাজনীতিবিদরা, নাকি এসবের বহির্ভূত শক্তির একটি মিশ্র কোয়ালিশন, নাকি কোনো একক ব্যক্তি?
প্রশ্ন-২. আওয়ামী লীগ বা বিএনপি. যে দলই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের ওপর বাইরের শক্তির প্রভাব বিশেষত, আমেরিকার প্রভাব এখন পর্যন্ত খুবই উচ্চ বলে প্রতীয়মান। এই দুই দলের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকরা জাতীয় স্বার্থে এই উচ্চ প্রভাব থেকে কতটুকু বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবেন? নাকি আদৌ মুক্ত হবেন না, নাকি আংশিকভাবে মুক্ত হবেন?
প্রশ্ন-৩. বর্তমানে বাংলাদেশে যে বা যারাই জাতীয় বুর্জোয়া রয়েছেন, তারা কি এই দুই দলের মধ্যেই নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট থাকবেন, নাকি তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা বা রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলবেন?
প্রশ্ন-৪. যদি তারা এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেন, তাহলে এ ধরনের তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি কি কোনো 'দক্ষ স্বৈরতন্ত্র' বা কঠোর রাষ্ট্র (Hard State)) হবে, নাকি তা লুটেরা বুর্জোয়াবহির্ভূর্ত উৎপাদনশীল শ্রেণীগুলোর সংযুক্ত বৃহৎ গণতান্ত্রিক একটি মোর্চা হবে? সেই মোর্চায় কি দুই দল থেকেই অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল কোনো কোনো উপাদান যোগ দেবেন? বামপন্থিরা কোন দিকে থাকবেন?
প্রশ্ন-৫. নাকি সবই আমার জল্পনা-কল্পনা? এসব কিছুই হবে না। এখন যেমন চলছে, তেমনই চলতে থাকবে! দুর্নীতিও হবে, লুটপাটও চলবে; তারপরও কিছুটা প্রবৃদ্ধি হবে, চরম দারিদ্র্যও কিছুটা কমবে; শুধু বাড়তে থাকবে আপেক্ষিক বৈষম্য। এভাবেই দেশ চলছে এবং আরও দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই চলবে।
এসব প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর আমি জানি না। তাই প্রশ্নগুলো ও অনুমানগুলো উত্থাপন করেই আমার আলোচনা শেষ করছি।

ড. এমএম আকাশ :অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.