লিবিয়া-৩- গাদ্দাফির অন্তিম প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? by ফারুক ওয়াসিফ
মুয়াম্মার গাদ্দাফি বিদ্রোহীদের হাতে আটক হয়ে নিহত হওয়ার এক বছর পূর্তি হলো ২০ অক্টোবর। এর তিন দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ‘ডেথ অব এ ডিক্টেটর: ব্লাডি ভেনেগান্স ইন সির্তে’ নামের প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
এখানে তারই আলোকে গাদ্দাফির অন্তিম মুহূর্ত এবং লিবিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়েই এই প্রতিবেদন।
মৃত্যুর আগের মুহূর্তে গাদ্দাফি বলে উঠেছিলেন, ‘ডোন্ট শ্যুট, ডোন্ট শ্যুট’। তখন তিনি নিরস্ত্র, আহত ও বন্দী। যুদ্ধবন্দী হত্যা যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কিন্তু ন্যাটো-সমর্থিত বিদ্রোহীদের জবাবদিহি চাইবার কেউ ছিলনা। খোদ ন্যাটোই যেখানে আহত ও বেসামরিক নাগরিক বহনকারী গাড়িবহরে হামলা করেছে, সেখানে বিদ্রোহীরা তাদের দোসর হয়ে গাদ্দাফিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তারা তখন হত্যার লাইসেন্সপ্রাপ্ত।
লিবিয়ায় ক্ষমতা পরিবর্তনকালে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে এইচআরসির প্রতিবেদন মনে করিয়ে দেয় ইরাক দখল-পরবর্তী পরিস্থিতির কথা; আফগানিস্তান, বসনিয়া, কসোভো, সোমালিয়াসহ এ রকম অজস্র দেশের গণহত্যার কথা। সবখানেই মানবাধিকার, শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর তত্ত্বাবধানে যুদ্ধ হয়েছে। সেসব যুদ্ধের বলি হয়েছে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। পরাজিত পক্ষের মানবাধিকারের কথা এসব শান্তিবাদী ভাবেননি। মৃত্যুর আগে আরেকটি কথা গাদ্দাফি বলেছিলেন, কথাটি ভোলা কঠিন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা কি সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য করতে পারো?’
মুতাসিম গাদ্দাফির অন্তিম সময়
মুয়াম্মার গাদ্দাফির কনিষ্ঠ পুত্র মুতাসিম গাদ্দাফির হত্যাকাণ্ড এই দ্বিচারিতারই আরেক নজির। তাঁকে বাঁচানোর যথেষ্ট সময় পাওয়া গেলেও কোনো সাড়াশব্দ করেনি ন্যাটোর মদদপুষ্ট লিবিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এনটিসি। ‘বাবা, তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি’ বলে দলবল নিয়ে লড়াইয়ে যাওয়ার পর পিতা-পুত্রের আর দেখা হয়নি। সির্তের গাদ্দাফিপন্থী যোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। বিদ্রোহীদের সশস্ত্র ঘেরাও ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টার সময় তিনিও বাবার মতো আটক হন। ফোনে ধারণকৃত কয়েকটি ভিডিওতে তাঁর অন্তিম মুহূর্তের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বন্দী হওয়ার কিছুক্ষণ পরের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি পিকআপ ট্রাকে হেলান দিয়ে বসে আছেন। বিমূঢ় ও আহত। বুকের ডান দিকটা রক্তাক্ত। উঠে দাঁড়িয়ে টলমল পায়ে হাঁটতেও দেখা গেল। তাঁকে ঘিরে আছে এক দঙ্গল বন্দুকধারী।
দ্বিতীয় ভিডিওতে দেখা গেল সাদা পিকআপে হেলান দিয়ে আছেন, চোখ বন্ধ, শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। তৃতীয় ভিডিওতে তিনি একটা ঘরের ভেতর, বিছানায় শোয়া। বুকের ক্ষত দেখিয়ে বলছেন, ‘এগুলো আমার পদক।’ গালিগালাজের জবাবে বললেন, ‘বাচ্চাদের মতো আচরণ করা বন্ধ করো!’ এক বন্দুকধারী পাল্টা বলে, ‘সে চায় ভিডিওতে তাকে বীরের মতো দেখাক, চায় মানুষ বলুক মৃত্যুর মুখেও কত নির্ভীক ছিল সে।’ এর কিছুক্ষণ পরই গাদ্দাফি পরিবারের শেষ পুরুষ মুতাসিম গাদ্দাফিকে হত্যা করা হয়। বড় ছেলে সাইফ আগেই বন্দী অবস্থায়নিহত হন।
মাহারি হোটেলের গণহত্যা
সির্তে শহরে ন্যাটোর বিমান হামলা আর স্থানীয় মিলিশিয়াদের হাত থেকে যাঁরা বেঁচে যান, তাঁদের আনা হয় পাশেরই মাহারি হোটেলে। পরের দৃশ্য: সমুদ্রের দিকে মুখ করা সেই হোটেলের সবুজ চত্বরে ছড়ানো-ছিটানো লাশের স্তূপ। অনেকেরই হাত বাঁধা, অনেকেরই নিথর চোখ খোলা সমুদ্রের দিকে মেলে ধরা। গত বছরের অক্টোবর মাসের ২০ তারিখে গাদ্দাফি নিহত হওয়ার পরের কয়েক দিন যেখানেই তাঁর জন্মশহর সির্তের মানুষদের পাওয়া গেছে, কিংবা আটক হয়েছে গাদ্দাফির গাদ্দাফা গোত্রের কেউ—সবাই নির্বিচারে হত্যার শিকার হয়েছে। গাদ্দাফির শেষ যুদ্ধের জায়গায় পাওয়া গিয়েছিল ১০০ জনের লাশ, মাহারি হোটেলে মিলল ৫৩ জনের দেহ। বাকি আরও ১০০ জনের কতজন বেঁচে ছিলেন আর কতজন নিহত, তার হিসাব নেই। পাশের পানি সরবরাহকেন্দ্রেও অনেক লাশ পড়ে থাকে।
গাদ্দাফির অষ্টম আশ্চর্যের পাশেই মৃত্যু
ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস। গাদ্দাফির যে অবদান অবিস্মরণীয় তা হলো, পৃথিবীর বৃহত্তম বিশুদ্ধ পানি সরবরাহব্যবস্থা নির্মাণ করে নব্বই ভাগ মরুময় দেশে পানির অভাব দূর করা। পৃথিবীর বৃহত্তম খনিজ পানির আধার নুবিয়ান ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে মরুভূমির ভেতর দিয়ে হাজার হাজার মাইল দীর্ঘ পাইপ টেনে দেশবাসীর জলকষ্ট দূর করেছিলেন তিনি। সাহারা মরুতে নদী থাকার কথা নয়, গাদ্দাফির মহা মানব-নির্মিত নদীব্যবস্থা (গ্রেট ম্যান মেড রিভার সিস্টেম) হলো সেই কৃত্রিম নদী। এটা ছিল বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য। অথচ তাঁর মৃত্যু হয় সেই পানি সরবরাহব্যবস্থার একটি কেন্দ্রেরই পাশে। লিবিয়ায় শান্তি কায়েমের অভিযানে সেই পানি সরবরাহব্যবস্থাকেও বোমা মেরে বিপর্যস্ত করে দেওয়া হয়।
২৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই পানি সরবরাহব্যবস্থার জন্য গাদ্দাফিকে একটি পয়সাও আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ করতে হয়নি। মরুভূমির অনেক গভীরে চার হাজার মাইল দীর্ঘ এলাকাজুড়ে এই অ্যাকইফায়ার বা পাতাল জলাধারে পানির পরিমাণ ২০০ বছর ধরে নীল নদ দিয়ে প্রবাহিত পানির থেকেও বেশি। খনিজ পানি হওয়ায় এর মূল্য সাধারণ পানির থেকে বেশি। তেলের যুদ্ধের পাশাপাশি লিবিয়া হলো পানির যুদ্ধেরও শিকার। এখন এই পানির নিয়ন্ত্রণ পেতে যাচ্ছে ফ্রান্সের ভিওলিয়া (সাবেক ভিভেন্দি) কোম্পানি। এরাই গোটা দুনিয়ার পানি-বাণিজ্যের ৪০ শতাংশের মালিক। এবং এই ফ্রান্সের রাফালে বিমান থেকেই গাদ্দাফির বহরে বোমা হামলা হয়। সঙ্গে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রিডেটর ড্রোন এবং ব্রিটেনের টর্নেডো বিমান তাঁর অবস্থান চিহ্নিত করে।
সবই শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরে গাদ্দাফি হত্যা হয়ে এ পর্যন্ত লিবিয়ায় যা কিছু হয়েছে সবই হয়েছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে। মানবিক হস্তক্ষেপের (হিউম্যানেটারিয়ান ইন্টারভেনশন) রুপালি ঝালর উড়িয়েই পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মাধ্যমে সামরিক অভিযান, জাতিসংঘের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবরোধ, পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশে লিবিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং সৌদি আরব, কাতার প্রভৃতি রাষ্ট্রের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসজ্জিত করা হয়। আরব গণজাগরণের প্রেরণাও ব্যবহূত হয় বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্য।
দিনের শেষে দেখা গেল, আরব বসন্ত লিবিয় মরুঝড়ে বুমেরাং হয়ে লিবীয়দের গণহত্যা ও অশেষ দুর্ভাগ্য বয়ে আনল। পশ্চিমা অস্ত্রসজ্জিত জিহাদি আল-কায়েদা, গাদ্দাফিবিরোধী মিলিশিয়া এবং হরেক রকমের বন্দুকধারীদের অবাধ রাজত্ব কায়েম হলো লিবিয়ায়। যত্রতত্র প্রাইভেট নির্যাতনখানা, অজস্র নারী ধর্ষিত। বধ্যভূমি আর বোমা-বারুদে অনেক প্রাণ গেল। উত্তর আফ্রিকার মধ্যে জীবনমান ও সম্পদে এগিয়ে থাকা রাষ্ট্রটি পরিণত হলো মগের মুল্লুকে। লিবিয়ার তেল ও গ্যাসক্ষেত্রগুলো এবং বিশ্বের বিস্ময় গ্রেট ম্যান মেড রিভার সিস্টেমও তছনছ হলো। এই ক্ষতি পূরণ করতে অনেক দশক চলে যাবে, তাও যদি লিবিয়ায় স্বাধীন দেশপ্রেমিক সরকার প্রতিষ্ঠিত থাকে। কিন্তু লক্ষ প্রাণের অপচয় কি আর ফেরানো যাবে? কে দায় নেবে এই গণহত্যার? হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিবিয়ার সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার তদন্ত করার দায় বর্তিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি যাদের সৃষ্টি, গাদ্দাফির হত্যাকাণ্ডে যারা সরাসরি জড়িত, তাদের বিচার হবে কোন আদালতে?
গাদ্দাফি অগণতান্ত্রিক শাসক ছিলেন, তাঁর কৃতকর্মের অনেক কিছুই মানবতার লঙ্ঘন করেই ঘটেছে। আবার তিনি যেখানে শেষ করেছিলেন, সেই লিবিয়া ছিল সমৃদ্ধ দেশ। এবং তিনি মোটেই ধর্মপন্থী শাসক ছিলেন না, যেমন ছিলেন না ইরাকের সাদ্দাম হোসেনও। কিন্তু উভয়ের বিলয়ের পর উভয় দেশই সাম্প্রদায়িক আর ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের খপ্পরে পতিত হয়েছে। হয়তো সিরিয়া ও লেবাননের জন্যও একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। শেষ বিচারে মানবিকতার জন্য যুদ্ধ যেমন প্রতারণা, তেমনি দেশপ্রেমিক স্বৈরশাসনও বিপদের কারণ। সাদ্দাম ও গাদ্দাফি যতই দেশপ্রেমিক হোন, অগণতান্ত্রিক শাসক যে সার্বভৌমত্ব বাঁচাতে পারেন না; জীবন দিয়ে তাঁরা সেই শিক্ষাই দিয়ে গেলেন।
লিবিয়া এখন রাষ্ট্রীয় হত্যাপুরী। এই মুহূর্তে গাদ্দাফিপন্থী শেষ মুক্ত শহর বানি ওয়ালিদের ওপর চতুর্দিক থেকে হামলা চলছে। গাদ্দাফির পক্ষ নেওয়ার জন্য গণশাস্তি পাচ্ছে সমগ্র শহরবাসী। অথচ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গাদ্দাফির দুরাচার নিয়ে যতটা সোচ্চার, পশ্চিমা-সমর্থিত এনটিসির হত্যাযজ্ঞ নিয়ে ততটাই নীরব। তারা আফগানিস্তানের তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, আবার তালেবানদের কাতারে অফিস খুলতে দিয়ে যুদ্ধখেলার আলোচনা করে। একদিকে চলছে আল-কায়েদা ধ্বংসের কার্যকলাপ, অন্যদিকে সিরিয়া ও লিবিয়ায় আল-কায়েদা দিয়ে অস্থিতিশীলতা জারি রাখার কায়কারবার। এ অবস্থায় শান্তির ডাকনাম হয়েছে যুদ্ধ, গণতন্ত্রের জন্য দরকার হচ্ছে আগ্রাসন আর মানবাধিকারের নামে মানবের প্রাণ ও সভ্যতার অবাধ ধ্বংস। গাদ্দাফির অন্তিম প্রশ্নটির উত্তর তাই খুঁজতে হচ্ছে আমাদের, ‘তোমরা কি সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য করতে পারো?’ (সমাপ্ত)
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
মৃত্যুর আগের মুহূর্তে গাদ্দাফি বলে উঠেছিলেন, ‘ডোন্ট শ্যুট, ডোন্ট শ্যুট’। তখন তিনি নিরস্ত্র, আহত ও বন্দী। যুদ্ধবন্দী হত্যা যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কিন্তু ন্যাটো-সমর্থিত বিদ্রোহীদের জবাবদিহি চাইবার কেউ ছিলনা। খোদ ন্যাটোই যেখানে আহত ও বেসামরিক নাগরিক বহনকারী গাড়িবহরে হামলা করেছে, সেখানে বিদ্রোহীরা তাদের দোসর হয়ে গাদ্দাফিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তারা তখন হত্যার লাইসেন্সপ্রাপ্ত।
লিবিয়ায় ক্ষমতা পরিবর্তনকালে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে এইচআরসির প্রতিবেদন মনে করিয়ে দেয় ইরাক দখল-পরবর্তী পরিস্থিতির কথা; আফগানিস্তান, বসনিয়া, কসোভো, সোমালিয়াসহ এ রকম অজস্র দেশের গণহত্যার কথা। সবখানেই মানবাধিকার, শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর তত্ত্বাবধানে যুদ্ধ হয়েছে। সেসব যুদ্ধের বলি হয়েছে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। পরাজিত পক্ষের মানবাধিকারের কথা এসব শান্তিবাদী ভাবেননি। মৃত্যুর আগে আরেকটি কথা গাদ্দাফি বলেছিলেন, কথাটি ভোলা কঠিন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা কি সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য করতে পারো?’
মুতাসিম গাদ্দাফির অন্তিম সময়
মুয়াম্মার গাদ্দাফির কনিষ্ঠ পুত্র মুতাসিম গাদ্দাফির হত্যাকাণ্ড এই দ্বিচারিতারই আরেক নজির। তাঁকে বাঁচানোর যথেষ্ট সময় পাওয়া গেলেও কোনো সাড়াশব্দ করেনি ন্যাটোর মদদপুষ্ট লিবিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এনটিসি। ‘বাবা, তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি’ বলে দলবল নিয়ে লড়াইয়ে যাওয়ার পর পিতা-পুত্রের আর দেখা হয়নি। সির্তের গাদ্দাফিপন্থী যোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। বিদ্রোহীদের সশস্ত্র ঘেরাও ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টার সময় তিনিও বাবার মতো আটক হন। ফোনে ধারণকৃত কয়েকটি ভিডিওতে তাঁর অন্তিম মুহূর্তের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বন্দী হওয়ার কিছুক্ষণ পরের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি পিকআপ ট্রাকে হেলান দিয়ে বসে আছেন। বিমূঢ় ও আহত। বুকের ডান দিকটা রক্তাক্ত। উঠে দাঁড়িয়ে টলমল পায়ে হাঁটতেও দেখা গেল। তাঁকে ঘিরে আছে এক দঙ্গল বন্দুকধারী।
দ্বিতীয় ভিডিওতে দেখা গেল সাদা পিকআপে হেলান দিয়ে আছেন, চোখ বন্ধ, শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। তৃতীয় ভিডিওতে তিনি একটা ঘরের ভেতর, বিছানায় শোয়া। বুকের ক্ষত দেখিয়ে বলছেন, ‘এগুলো আমার পদক।’ গালিগালাজের জবাবে বললেন, ‘বাচ্চাদের মতো আচরণ করা বন্ধ করো!’ এক বন্দুকধারী পাল্টা বলে, ‘সে চায় ভিডিওতে তাকে বীরের মতো দেখাক, চায় মানুষ বলুক মৃত্যুর মুখেও কত নির্ভীক ছিল সে।’ এর কিছুক্ষণ পরই গাদ্দাফি পরিবারের শেষ পুরুষ মুতাসিম গাদ্দাফিকে হত্যা করা হয়। বড় ছেলে সাইফ আগেই বন্দী অবস্থায়নিহত হন।
মাহারি হোটেলের গণহত্যা
সির্তে শহরে ন্যাটোর বিমান হামলা আর স্থানীয় মিলিশিয়াদের হাত থেকে যাঁরা বেঁচে যান, তাঁদের আনা হয় পাশেরই মাহারি হোটেলে। পরের দৃশ্য: সমুদ্রের দিকে মুখ করা সেই হোটেলের সবুজ চত্বরে ছড়ানো-ছিটানো লাশের স্তূপ। অনেকেরই হাত বাঁধা, অনেকেরই নিথর চোখ খোলা সমুদ্রের দিকে মেলে ধরা। গত বছরের অক্টোবর মাসের ২০ তারিখে গাদ্দাফি নিহত হওয়ার পরের কয়েক দিন যেখানেই তাঁর জন্মশহর সির্তের মানুষদের পাওয়া গেছে, কিংবা আটক হয়েছে গাদ্দাফির গাদ্দাফা গোত্রের কেউ—সবাই নির্বিচারে হত্যার শিকার হয়েছে। গাদ্দাফির শেষ যুদ্ধের জায়গায় পাওয়া গিয়েছিল ১০০ জনের লাশ, মাহারি হোটেলে মিলল ৫৩ জনের দেহ। বাকি আরও ১০০ জনের কতজন বেঁচে ছিলেন আর কতজন নিহত, তার হিসাব নেই। পাশের পানি সরবরাহকেন্দ্রেও অনেক লাশ পড়ে থাকে।
গাদ্দাফির অষ্টম আশ্চর্যের পাশেই মৃত্যু
ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস। গাদ্দাফির যে অবদান অবিস্মরণীয় তা হলো, পৃথিবীর বৃহত্তম বিশুদ্ধ পানি সরবরাহব্যবস্থা নির্মাণ করে নব্বই ভাগ মরুময় দেশে পানির অভাব দূর করা। পৃথিবীর বৃহত্তম খনিজ পানির আধার নুবিয়ান ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে মরুভূমির ভেতর দিয়ে হাজার হাজার মাইল দীর্ঘ পাইপ টেনে দেশবাসীর জলকষ্ট দূর করেছিলেন তিনি। সাহারা মরুতে নদী থাকার কথা নয়, গাদ্দাফির মহা মানব-নির্মিত নদীব্যবস্থা (গ্রেট ম্যান মেড রিভার সিস্টেম) হলো সেই কৃত্রিম নদী। এটা ছিল বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য। অথচ তাঁর মৃত্যু হয় সেই পানি সরবরাহব্যবস্থার একটি কেন্দ্রেরই পাশে। লিবিয়ায় শান্তি কায়েমের অভিযানে সেই পানি সরবরাহব্যবস্থাকেও বোমা মেরে বিপর্যস্ত করে দেওয়া হয়।
২৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই পানি সরবরাহব্যবস্থার জন্য গাদ্দাফিকে একটি পয়সাও আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ করতে হয়নি। মরুভূমির অনেক গভীরে চার হাজার মাইল দীর্ঘ এলাকাজুড়ে এই অ্যাকইফায়ার বা পাতাল জলাধারে পানির পরিমাণ ২০০ বছর ধরে নীল নদ দিয়ে প্রবাহিত পানির থেকেও বেশি। খনিজ পানি হওয়ায় এর মূল্য সাধারণ পানির থেকে বেশি। তেলের যুদ্ধের পাশাপাশি লিবিয়া হলো পানির যুদ্ধেরও শিকার। এখন এই পানির নিয়ন্ত্রণ পেতে যাচ্ছে ফ্রান্সের ভিওলিয়া (সাবেক ভিভেন্দি) কোম্পানি। এরাই গোটা দুনিয়ার পানি-বাণিজ্যের ৪০ শতাংশের মালিক। এবং এই ফ্রান্সের রাফালে বিমান থেকেই গাদ্দাফির বহরে বোমা হামলা হয়। সঙ্গে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রিডেটর ড্রোন এবং ব্রিটেনের টর্নেডো বিমান তাঁর অবস্থান চিহ্নিত করে।
সবই শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরে গাদ্দাফি হত্যা হয়ে এ পর্যন্ত লিবিয়ায় যা কিছু হয়েছে সবই হয়েছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে। মানবিক হস্তক্ষেপের (হিউম্যানেটারিয়ান ইন্টারভেনশন) রুপালি ঝালর উড়িয়েই পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মাধ্যমে সামরিক অভিযান, জাতিসংঘের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবরোধ, পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশে লিবিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং সৌদি আরব, কাতার প্রভৃতি রাষ্ট্রের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসজ্জিত করা হয়। আরব গণজাগরণের প্রেরণাও ব্যবহূত হয় বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্য।
দিনের শেষে দেখা গেল, আরব বসন্ত লিবিয় মরুঝড়ে বুমেরাং হয়ে লিবীয়দের গণহত্যা ও অশেষ দুর্ভাগ্য বয়ে আনল। পশ্চিমা অস্ত্রসজ্জিত জিহাদি আল-কায়েদা, গাদ্দাফিবিরোধী মিলিশিয়া এবং হরেক রকমের বন্দুকধারীদের অবাধ রাজত্ব কায়েম হলো লিবিয়ায়। যত্রতত্র প্রাইভেট নির্যাতনখানা, অজস্র নারী ধর্ষিত। বধ্যভূমি আর বোমা-বারুদে অনেক প্রাণ গেল। উত্তর আফ্রিকার মধ্যে জীবনমান ও সম্পদে এগিয়ে থাকা রাষ্ট্রটি পরিণত হলো মগের মুল্লুকে। লিবিয়ার তেল ও গ্যাসক্ষেত্রগুলো এবং বিশ্বের বিস্ময় গ্রেট ম্যান মেড রিভার সিস্টেমও তছনছ হলো। এই ক্ষতি পূরণ করতে অনেক দশক চলে যাবে, তাও যদি লিবিয়ায় স্বাধীন দেশপ্রেমিক সরকার প্রতিষ্ঠিত থাকে। কিন্তু লক্ষ প্রাণের অপচয় কি আর ফেরানো যাবে? কে দায় নেবে এই গণহত্যার? হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিবিয়ার সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার তদন্ত করার দায় বর্তিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি যাদের সৃষ্টি, গাদ্দাফির হত্যাকাণ্ডে যারা সরাসরি জড়িত, তাদের বিচার হবে কোন আদালতে?
গাদ্দাফি অগণতান্ত্রিক শাসক ছিলেন, তাঁর কৃতকর্মের অনেক কিছুই মানবতার লঙ্ঘন করেই ঘটেছে। আবার তিনি যেখানে শেষ করেছিলেন, সেই লিবিয়া ছিল সমৃদ্ধ দেশ। এবং তিনি মোটেই ধর্মপন্থী শাসক ছিলেন না, যেমন ছিলেন না ইরাকের সাদ্দাম হোসেনও। কিন্তু উভয়ের বিলয়ের পর উভয় দেশই সাম্প্রদায়িক আর ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের খপ্পরে পতিত হয়েছে। হয়তো সিরিয়া ও লেবাননের জন্যও একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। শেষ বিচারে মানবিকতার জন্য যুদ্ধ যেমন প্রতারণা, তেমনি দেশপ্রেমিক স্বৈরশাসনও বিপদের কারণ। সাদ্দাম ও গাদ্দাফি যতই দেশপ্রেমিক হোন, অগণতান্ত্রিক শাসক যে সার্বভৌমত্ব বাঁচাতে পারেন না; জীবন দিয়ে তাঁরা সেই শিক্ষাই দিয়ে গেলেন।
লিবিয়া এখন রাষ্ট্রীয় হত্যাপুরী। এই মুহূর্তে গাদ্দাফিপন্থী শেষ মুক্ত শহর বানি ওয়ালিদের ওপর চতুর্দিক থেকে হামলা চলছে। গাদ্দাফির পক্ষ নেওয়ার জন্য গণশাস্তি পাচ্ছে সমগ্র শহরবাসী। অথচ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গাদ্দাফির দুরাচার নিয়ে যতটা সোচ্চার, পশ্চিমা-সমর্থিত এনটিসির হত্যাযজ্ঞ নিয়ে ততটাই নীরব। তারা আফগানিস্তানের তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, আবার তালেবানদের কাতারে অফিস খুলতে দিয়ে যুদ্ধখেলার আলোচনা করে। একদিকে চলছে আল-কায়েদা ধ্বংসের কার্যকলাপ, অন্যদিকে সিরিয়া ও লিবিয়ায় আল-কায়েদা দিয়ে অস্থিতিশীলতা জারি রাখার কায়কারবার। এ অবস্থায় শান্তির ডাকনাম হয়েছে যুদ্ধ, গণতন্ত্রের জন্য দরকার হচ্ছে আগ্রাসন আর মানবাধিকারের নামে মানবের প্রাণ ও সভ্যতার অবাধ ধ্বংস। গাদ্দাফির অন্তিম প্রশ্নটির উত্তর তাই খুঁজতে হচ্ছে আমাদের, ‘তোমরা কি সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য করতে পারো?’ (সমাপ্ত)
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments