কোরবানি ঈদের সংস্কৃতি by হাসান আবদুল কাইয়ূম

বাংলাদেশের প্রায় নব্বই ভাগ মানুষ মুসলিম। এই বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যেসব উপাদান দ্বারা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে তার মধ্যে কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা অন্যতম। ঈদুল আজহা পালিত হয় প্রিয় নবীর পূর্বপুরুষ হজরত ইব্রাহিম আলায়হিস সালাম-এর পুত্র হজরত ইসমাইল আলায়হিস সালামের কোরবানির ঘটনার স্মারক


হিসেবে। কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহতে নিবেদিতপ্রাণ হওয়া। তার সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করা। বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ আসার মাসখানেক আগে থেকেই প্রস্তুতি চলে কোরবানির পশু খরিদ করার। কোরবানির পশুর হাট শহরে-নগরে বিশেষ সাজে-সজ্জিত হয়ে বসে। কোথাও কোথাও তো বিরাট বিরাট তোরণ নির্মাণ করে ও ঝালরযুক্ত শামিয়ানা টাঙিয়ে এবং আলোকসজ্জায় সজ্জিত করে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসতে থাকে তত পশু কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যেও ঈদের আনন্দ যেন পশু খরিদের সঙ্গে সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। সবার অজান্তে জাগ্রত হয়ে ওঠে মন-গভীরে কোরবানির চেতনা। তবে এক শ্রেণীর মানুষ বড়লোকি দেখানোর মানসিকতা নিয়ে চড়া দামে পশু কিনে নাম জাহিরের যে চেষ্টা করে তা কোরবানির মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়, তা বরং কোরবানির উদ্দেশ্য ক্ষুণ্নই করে।
যারা পশু খরিদ করতে অপারগ তথা দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ, তারাও গোশতের ভাগ পাবেন, এই আশা পোষণ করে ঈদের আনন্দকে লালন করেন। বাংলাদেশে গরু কিংবা ছাগল কোরবানি দেওয়া হয়। তবে গরু কোরবানিই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেওয়া হয়। এতে সুবিধাটা হচ্ছে, সাতজন ভাগে একটা গরু দেওয়া যায়। গরু কোরবানির ঝোঁক বেশি থাকার আর একটি কারণ হচ্ছে, এই গরু কোরবানির কারণে এককালে এখানকার মুসলমানদের নাজেহাল হতে হয়েছে। সে কারণে আমাদের সংস্কৃতিতে কোরবানির পশুর ক্ষেত্রে গরু কোরবানি প্রাধান্য পেয়েছে। কোরবানির পশুর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া এবং পশুর চামড়া দান করে দেওয়া সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।
কোরবানির এক মাস পরই মহররম আর কারবালার স্মৃতিময় আশুরা। কোরবানির ঈদও ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল। যে কারণে অনেক পরিবারে কোরবানির গোশত আশুরা পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয় ইমাম হুসাইন রাদি আল্লাহুতায়ালা আনহুর ইসালে সওয়াবের জন্য। ঈদের দিনের ভোরবেলায় এক অনন্য আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটে শিশু-কিশোর ও যুবকদের মধ্যে।
সকালে সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করে পরিষ্কার ও পবিত্র ভালো পোশাক পরে, চোখে সুরমা লাগিয়ে, আতর মেখে, মাথায় টুপি দিয়ে সব পুরুষ, শিশু-কিশোর, প্রৌঢ়, যুবকরা ছোটেন ঈদগাহে। কোনো কোনো স্থানে মহিলারাও ঈদের জামাতে শরিক হন। ঈদগাহে বা মসজিদে যাওয়ার সময় উচ্চারিত হতে থাকে তকবির : আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ (আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, সব প্রশংসা তাঁরই জন্য)।
ঈদের নামাজের জামাত এক আনন্দমুখর অনুভবে অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব খুতবা দেন। অনেক স্থানের ঈদগাহে নির্দিষ্ট ইমাম থাকেন আবার কোথাও কোথাও ঈদের সময় কোনো আলেমকে দাওয়াত করে আনা হয়। ঈদের নামাজ শেষ হলে পারস্পরিক কোলাকুলির মধ্য দিয়ে এক অপরূপ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের স্ফুরণ ঘটে। এই বুক মেলানো বা কোলাকুলির মাঝে অনুরণিত হয় ঐক্য ও সংহতির আহ্বান। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জিলহজ আরাফা ময়দানে সমবেত প্রায় এক লাখ চলি্লশ হাজার সাহাবায়ে কেরামের সামনে সেই বিদায় হজের ভাষণে যে বলেছিলেন :তোমাদের একের ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত, রক্ত-প্রাণ অপরের কাছে আজকের এই দিনটির মতো, এই মাসটির মতো, এই জনপদের মতো পবিত্র। তিনি আরও বলেছিলেন, সবাই আদম থেকে আর আদম মাটি থেকে_ ১০ জিলহজ প্রতি বছর ঈদুল আজহায় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অলক্ষ্যে যেন উচ্চকিত হয়ে ওঠে, তা যদি সারা বছরটায় বজায় রাখা যেত তাহলে সে ঐক্যে কতই না ভালো হতো। আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন : তোমরা আল্লাহর রজ্জু সবাই মিলে মজবুত করে আঁকড়ে ধরো এবং কোনো অবস্থাতেই তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না। সুরা আলে ইমরান। আয়াত ১০৩।
ঈদের নামাজ শেষ হয়ে গেলে সামর্থ্যবানরা পশু কোরবানি দেন। ঈদের দিন সকালেই কোরবানির পশু গরু বা ছাগলকে ভালোভাবে গোসল করানো হয় এবং খাবার ও পানি তার সামনে রেখে দেওয়া হয়, যা থেকে ওরা খেয়ে নেয়। নামাজ পড়ে এসে পশুকে শোয়ায়ে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তকবির দিতে দিতে কোরবানি দেওয়া হয়। যদি গরু হয় তবে ৭ জনে মিলে অথবা ৭ নামে কোরবানি দেন আর ছাগল হলে একজনেই কোরবানি দেন। পশু জবেহ করার সময় থেকে গোশত তৈরি এবং ভাগবাটোয়ারা পর্যন্ত প্রত্যেক কোরবানিস্থলে মানুষের, বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের ভিড়ে মুখর হয়ে থাকে। গোশত তৈরি হওয়ার পর তা দাঁড়ি-পাল্লা দিয়ে ওজন করে তিনটি ভাগ করা হয়। এক ভাগ বিতরণ করা হয় পাড়া-প্রতিবেশী, গরিব-দুঃখীদের মধ্যে আর এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে; বাকি এক ভাগ পরিবারের সদস্যদের জন্য রাখা হয়। কোরবানির ঈদ বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে সুদূরপ্রসারী অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিরাজমান। এই কোরবানির প্রেরণা আমাদের ভাষা আন্দোলনকে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে যেন সবার অজান্তেই উদ্দীপনা জুগিয়েছে। বাংলা কাব্যের বিশাল আঙিনাজুড়ে কোরবানির ঈদ স্থান করে নিয়েছে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উচ্চারণ মেখে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলা যায় : ওরে হত্যা নয় এ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন। ঈদুল আজহা শুধু বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয়, বিশ্ব মুসলিম সংস্কৃতিরও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিশ্বের সমগ্র মুসলিম উম্মাহই এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। আজ সারা দুনিয়ায় ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতীয় কবির ভাষায় বলি : ডুবে ইসলাম আসে আঁধার/ইবরাহীমের মত আবার/কুরবানী দাও প্রিয় বিভব/জবীহুল্লাহ ছেলেরা হোক।

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম : সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও ইসলামী চিন্তাবিদ

No comments

Powered by Blogger.