বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে নতুন কমিটি গঠন- ডেসটিনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পাঁচ সংস্থাকে চিঠি

ডেসটিনির অবৈধ সব কর্মকাণ্ডের জন্য আরও পাঁচ সরকারি সংস্থাকে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংস্থাগুলো হচ্ছে: বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, সমবায় অধিদপ্তর এবং যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো)।


বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতিটি সংস্থার প্রধানের কাছে এ ব্যাপারে আলাদা চিঠি পাঠিয়েছে। চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডেসটিনির অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তের জন্য রেজসকো নিবন্ধককে প্রধান করে যে আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছিল, তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এতে বলা হয়, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড এবং এদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবৈধ কার্যক্রম সম্পর্কে সংস্থাগুলো যেন যে যার অবস্থান থেকে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়। প্রতিটি চিঠির সঙ্গে ৪৫০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের অনুলিপিও পাঠানো হয়। রেজসকো নিবন্ধক বিজনকুমার চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এই প্রতিবেদন জমা দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের কাছে পাঠানো চিঠিতে ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘনের দায়ে ডেসটিনির ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স না নিয়ে যদি কেউ অবৈধ ব্যাংকিং বা প্রতারণা করে থাকে, তা হলে বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৪, ৫১, ৫২, ৫৩, ৬৬ ও ৬৭ ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে পারে।
এনবিআরের চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দীন আহমেদকে পাঠানো চিঠিতে ডেসটিনি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো কী পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে, তা খতিয়ে দেখে রাজস্ব আদায় করতে বলা হয়েছে।
রেজসকো নিবন্ধককে আইনকানুন লঙ্ঘনের দায়ে ডেসটিনি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবন্ধন বাতিলের উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। আদালতের মাধ্যমেই তা করা যায়। আর ডেসটিনির এসব প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা করেছেন যেসব নিরীক্ষক, তাঁদের বিরুদ্ধেও রেজসকোকে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কারণ ডেসটিনির বহুমাত্রিক আর্থিক অনিয়মের বিষয়গুলো নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বিধিসম্মতভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
সমবায় আইন লঙ্ঘন করে অবৈধ আর্থিক লেনদেন করেছে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি—এ কথা উল্লেখ করে এবং প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধিত হওয়ায় পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মিহিরকান্তি মজুমদারকে চিঠি পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস থেকে অবৈধ সুবিধাভোগী ডেসটিনি গ্রুপের শীর্ষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, ডেসটিনি গ্রুপের অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন লঙ্ঘন করেছে। এই বিভাগ যেন আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়।
অর্থের অবৈধ ব্যবহার বা মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে রাজধানীর কলাবাগান থানায় গত ৩১ জুলাই ডেসটিনি গ্রুপের ২২ শীর্ষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই মামলায় ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রফিকুল আমীন, পরিচালক দিদারুল আলম এবং ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন এখন কারাগারে। গ্রুপের প্রেসিডেন্ট হারুন-অর-রশিদ জামিনে আছেন। চারজন বাদে অন্য ১৮ জন পলাতক।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডেসটিনির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর এ পর্যন্ত তিনটি তদন্ত প্রতিবেদন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে জমা দিয়েছে। এগুলোতে বলা হয়েছে, প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পাঁচ হাজার কোটিরও বেশি পরিমাণ টাকা সংগ্রহ করেছে ডেসটিনি গ্রুপ। এর মধ্যে প্রায় পুরো টাকাই তুলে নিয়েছেন ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিরা।
আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেসটিনির শীর্ষ ব্যক্তিরা পাঁচ হাজার কোটি টাকার মধ্যে তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকারই কোনো হিসাব দিতে পারেননি। এই অর্থের বড় অংশই বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে বলে কমিটির কাছে মনে হয়েছে।
ডেসটিনি হংকংয়ে ৬৪ কোটি টাকার সমপরিমাণ ডলার পাচার করেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে, ডেসটিনি ২০০০ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে গত বুধবার ১০ সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্যসচিবকে আহ্বায়ক করে গঠিত এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন: বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ও রেজসকোর একজন করে যুগ্ম সচিব পর্যায়ের প্রতিনিধি এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। বাণিজ্য সংগঠন পরিচালক (ডিটিও) থাকবেন এর সদস্য সচিব। কমিটি প্রয়োজনে আরও সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবেন।
আগের আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ এসেছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে মূলত কাজ করবে এই কমিটি। ৩১ অক্টোবরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিদের নাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.