রাজনৈতিক আলোচনা- ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ by এ এম এম শওকত আলী

প্রায় সব দেশেই দুই ধরনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এক. নগরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, দুই. গ্রামাঞ্চলের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানেরই জন্ম ব্রিটিশ আমলে। এর মধ্যে আরও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর নাম জেলা পরিষদ। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত গ্রামাঞ্চলেই কাজ করে থাকে। ব্রিটিশ আমল থেকেই জেলা পরিষদে নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯২০ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এ প্রথাই ছিল। এরপর ১৯৭২ সাল-পরবর্তীকালে সময় সময় জেলা পরিষদ সম্পর্কে আইন প্রণয়ন করা হলেও আজ পর্যন্ত কোনো নির্বাচিত জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উপজেলা পরিষদসহ থানা, এমনকি গ্রাম পর্যায়ে পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অনেকের মতে জেলা পরিষদের গুরুত্ব অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ আমলের গোড়ার দিকে এ দেশে কোনো সিটি করপোরেশন ছিল না। যা ছিল তা হলো জেলা সদরভিত্তিক পৌরসভা। নগরায়ণের ক্রমবর্ধমান ধারার চাপে প্রথমে ঢাকা পৌরসভাকে করপোরেশনে উন্নীত করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে একের পর এক বিভাগীয় শহরে অবস্থিত পৌরসভাকে করপোরেশনে উন্নীত করা হয়। তবে কী ধরনের মানদণ্ডের ভিত্তিতে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তা অনেকাংশে অস্পষ্ট। কেবল জনসংখ্যা ও আয়তনের ভিত্তিতেই যে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তা নয়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৬ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠার পর একে একে অন্যান্য কয়েকটি বিভাগীয় শহরেও পুলিশ অধিদপ্তরের পৃথক কাঠামোর সঙ্গে ওই সব শহরের পৌরসভাকেও করপোরেশন করার প্রবণতা স্থায়িত্ব লাভ করে। শহরের নাগরিকদের প্রথাগত সুবিধা প্রদানের বিষয়টি চাপা পড়ে যায়।
নতুন নতুন করপোরেশন সৃষ্টির সঙ্গে নাগরিকসুবিধা-সংক্রান্ত যে প্রশাসনিক দক্ষতা, সম্পদ ও আন্তরিকতার প্রয়োজন হবে, সে বিষয়টি উপেক্ষিত। বরং প্রতিষ্ঠিত কিছু সরকারি বা আধাসরকারি সংস্থার সঙ্গে কার্যপরিধি ও ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পানির স্বল্পতার জন্য দায়ী করা হয় ওয়াসাকে। অপরিকল্পিত ইমারত বা রাস্তা নির্মাণের জন্য দায়ী করা হয় রাজউকসহ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরকে। অথচ এ দুটি সুবিধাই নগরবাসীর জন্য অতি জরুরি।
এ কারণে ২০০০ সাল থেকেই সিটি করপোরেশনের মেয়ররা সিটি গভর্নর হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দাবি করেন। এ ধারণার মূল ভিত্তি হলো অত্যাবশ্যকীয় কিছু নাগরিকসুবিধা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় দায়িত্ব ও ক্ষমতা সিটি গভর্নরকে প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনসহ ইমারত, শহরাঞ্চলের রাস্তাঘাট নির্মাণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকেই দিতে হবে। কোনো সরকারই এ দাবি সমর্থন করেনি। রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও এর জন্য অন্যান্য কারণ রয়েছে। যেমন—যে প্রশাসনিক দক্ষতা, কারিগরি জ্ঞান ও সম্পদের স্বল্পতা, তা কোনো সিটি করপোরেশনেরই নেই। এ-সংক্রান্ত দায়িত্ব আজ পর্যন্ত প্রেষণে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তারাই করে থাকেন। সার্বিকভাবে প্রায় সব ধরনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানেই এ প্রথা চালু আছে। এর মূল কারণ, এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও কারিগরি কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কোনো স্থায়ী চাকরিকাঠামো সৃষ্টি করা হয়নি। এ বিষয়ে ২০০৮ সালের স্থানীয় সরকারকে গতিশীল ও শক্তিশালী করার বিষয়ে যে প্রতিবেদন প্রণীত হয়েছিল, সে প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও সেদিকে কোনো নজর দেওয়া হয়নি।
সিটি করপোরেশনসহ সার্বিকভাবে অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানেও রাজনৈতিক প্রভাব দৃশ্যমান। এ বিষয়ে দুটি মতবাদ রয়েছে। এক. এসব প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা বাঞ্ছনীয়। দুই. এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা সম্ভব নয় এবং রাজনৈতিক দল থেকেই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট পদে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন দেওয়া সমীচীন হবে। শেষোক্ত মতবাদই বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে গৃহীত হয়েছে। অতীতে ঢাকা পৌরসভার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, এ শহরে একাধিক পৌরসভা গঠন করলেই প্রয়োজনীয় নাগরিকসুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব ও সহজতর হবে। এ ধারণার বশবর্তী হয়েই সত্তরের দশকে গুলশান ও ধানমন্ডি থেকে মিরপুর শহরাঞ্চল নিয়ে দুটি পৌরসভা গঠন করা হয়েছিল। এ পদক্ষেপের সঠিক মূল্যায়ন না করেই পরবর্তী সময়ে পুরোনো কাঠামোতে ফিরে যাওয়া হয়।
বর্তমানে ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিভক্তির যে চিন্তা বা নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, তা পুরোনো সিদ্ধান্তেরই প্রতিবিম্ব মাত্র। আপাতদৃষ্টিতে বিভক্তির ফলে নাগরিকসুবিধা সহজ হবে বলে মনে করা হলেও তা না-ও হতে পারে। এর মূল কারণ, সম্পদসহ প্রশাসনিক ও কারিগরি দক্ষতার স্বল্পতা। এ বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে পরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। কারণ, ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার পৌরকরসহ অন্যান্য আয়ের মধ্যে বৈষম্য বিদ্যমান। এ জন্য প্রয়োজন হবে বিভক্তির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে এসব বিষয়সহ অন্যান্য বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া। যেমন, যানবাহন থেকে আয়। সত্তরের দশকে এমনও দেখা গিয়েছিল যে কোনো এক পৌরসভার রিকশাসহ অযান্ত্রিক অন্য যানগুলো ভিন্ন পৌর এলাকায় প্রবেশ করতে বাধা ছিল। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট আয়ের বিভাজন থাকার সুযোগ সৃষ্টি করার প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবিত আইনেই এ বিধান সুস্পষ্টভাবে রাখা উচিত হবে।
এর সঙ্গে প্রয়োজন হবে নাগরিক-সুবিধাসংক্রান্ত কার্যাবলির সঠিক সমন্বয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার বিষয়টিও জড়িত। বিগত কয়েক বছরে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় একাধিক থানা এবং ডেপুটি পুলিশ কমিশনারের পদ সৃষ্টিসহ অধিক্ষেত্রও চিহ্নিত করা হয়েছে। বিভক্তিসংক্রান্ত নতুনভাবে সীমানা নির্ধারণের সময় এ বিষয়টির প্রতি নজর দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন হবে পুলিশ-সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট আইনগুলোও পরীক্ষা করা। এ কথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, মেট্রোপলিটন শহরবহির্ভূত এলাকায় জেলা পুলিশের জন্য ১৯৪৩ সালের একটি পুলিশ রেগুলেশন বিদ্যমান। এর কোনো সংস্কারই আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে হয়নি। মেট্রোপলিটন পুলিশ আইনের অধীনে পূর্ণাঙ্গ কোনো রেগুলেশন বা বিধি করা হয়েছে কি না, জানা নেই। যদি হয়ে থাকে, তবে সে বিধিও পরীক্ষা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ও জরুরি। প্রশাসনিকভাবে ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি সৃষ্টি করা হলেও এ নিয়ে অনেক বিভ্রান্তিসহ অন্যান্য বিষয়ও জড়িত। এর মধ্যে প্রধান বিষয়টি হলো ওয়ার্ড কমিশনারদের অপরাধসংক্রান্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্টতা। সিটি করপোরেশনের সুশাসনসংক্রান্ত বিষয়ে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ওয়ার্ড কমিশনারদের প্রায় ৮০ শতাংশই কোনো না কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়টি শুধু নির্বাচনী আইন দিয়ে বন্ধ করা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী মনোনয়নের সময় এ বিষয়ে সচেতন হলে সম্পূর্ণ বন্ধ না হলেও অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
প্রস্তাবিত আইনে বিধিবদ্ধ মেয়াদান্তে পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য প্রশাসক নিয়োগের বিধান রাখার বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রথা অতীতেও ছিল। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ পর্যন্ত সাত বা আট বছরে হয়ে পড়ে। এর মূল কারণ, নির্বাচন সঠিক সময়ে নানা কারণে করা সম্ভব হয় না। তবে এটাও কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। নির্বাচন কমিশন অথবা সরকারের অদক্ষতার কারণে অনেক সময় এটা হয়ে থাকে। এর পেছনে রাজনৈতিক কারণও থাকতে পারে। প্রশাসক নিয়োগ করলেও তার সময়সীমা আইন দ্বারা নির্ধারিত হওয়া সমীচীন হবে।
============================
মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র  দুর্নীতি বেড়েছে দুনিয়াজুড়ে  উইকিলিকসঃ বাঘের ঘরে ঘোগ  আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন  ১০০ কোটি ডলারে ঋণঃ ভারতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত  ট্রেন দুর্ঘটনাঃ চালকের ভুল নাশকতারও গন্ধ!  ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা উইকিলিকস সমর্থকদের  কানকুনঃ মুমূর্ষু পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষ  নারীর হার-নারীর জিত, বেগম রোকেয়া প্রাসঙ্গিক  সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতির বীজ লুক্কায়িত  বরুণ রায়—কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব  মুক্তির গান  এক-এগারোর জুজুটাকে হিমাগারে পাঠান  জব্দকৃত অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে জাগরণ সৃষ্টি করুন  সংসদীয় গণতন্ত্রের গল্পসল্প  রাষ্ট্রীয় সমাজে চিন্তা করার স্বাধীনতার প্রয়োজন  বাঙালের জলবায়ু দর্শন: ইঁদুরই কি শ্রেষ্ঠ জীব  প্রকৃতি- পাহাড়টির সঙ্গে ধ্বংস হবে ঐতিহ্যও  স্মরণ- আজও প্রাসঙ্গিক বেগম রোকেয়া  আলোচনা- উইকিলিকসঃ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ত্রিমুখী সংগ্রাম  মুক্তিযুদ্ধ- মুজিব বললেনঃ তোমাদের এখনই ঢাকা ত্যাগ করা উচিত  আলোচনা- ডিজিটাল-প্র্রযুক্তিই মানুষকে আরও বেশি মানবিক করে!  খবর- সংরক্ষিত বনে শুঁটকিপল্লি  ট্রেনের ওপর ট্রেন  সংকেত অমান্য, দুই ট্রেনের সংঘর্ষ  আলোচনা- রবীন্দ্রনাথের কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন ভাবনা  আলোচনা- 'ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ঠাঁয় নেই দরিদ্রর উচ্চ শিক্ষা  বিশেষ আলোচনা- ফিরে দেখা গঙ্গা চুক্তি  আলোচনা- 'সংসদ বর্জনের অপসংস্কৃতি বন্ধ হোক'  আলোচনা- 'উইকিলিকসে বাংলাদেশ, তারপর?  আলোচনা- 'ওয়াংগালাঃ গারোদের জাতীয় উৎসব'  স্মরণ- 'বাঘা যতীনঃ অগ্নিযুগের মহানায়ক'


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ এ এম এম শওকত আলী
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.