স্মরণ- বরুণ রায়—কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব by অজয় রায়

রুণদা, বরুণ রায়ের সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হওয়ার আগেই তাঁর কথা শুনেছিলাম কৃষক বন্ধু করুণাসিন্ধু রায়ের তীক্ষ-ধী ছেলে সুরমা ভ্যালি ছাত্র ফেডারেশনের অন্যতম উদীয়মান নেতা হিসেবে। ১৯৪৮ সালের মার্চ কি এপ্রিলে ময়মনসিংহে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের প্রথম সম্মেলনে তিনি উপস্থিত থাকলেও তখন আলাপ হওয়ার সুযোগ ছিল না। সরকারি দমননীতির কারণে সুস্থির সম্মেলন সেদিন সম্ভব হয়নি। তারপর তো এ দেশে কমিউনিস্টদের আবাসন নির্দিষ্ট হয়েছিল কারাগারে।
আর তা না হলে আত্মগোপন। তার ওপর সেই কমিউনিস্ট-কর্মী যদি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে তো কথাই নেই। পাকিস্তান সরকারের অভিধানে তারা ছিল দেশদ্রোহী। এর ধকল বরুণ রায়কেও সইতে হয়েছে। স্বাভাবিক ছাত্রজীবন শেষ করতে পারেননি। সার্বক্ষণিকভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলেন কমিউনিস্ট তথা গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে।
আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপও জেলের মধ্যেই। ১৯৫৫ সালে তথাকথিত পুলিশ ধর্মঘটের পর যখন সদ্যমুক্ত কমিউনিস্টদের আবার গ্রেপ্তার করা হলো, তখন বরুণ রায়ও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিনি তখন এমএলএ, কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন সংখ্যালঘু আসন থেকে (ব্রিটিশ আমলের ধারাবাহিকতায় তখনো প্রচলিত ছিল স্বতন্ত্র নির্বাচনপদ্ধতি)। দরাজ গলায় গান গাইতে পারেন, ভালো ভলিবল খেলতে পারেন আবার রাজনৈতিক আলোচনায় দক্ষতার সঙ্গে অংশ নিতে পারেন—এমনই এক ব্যক্তিত্ব।
বরুণদাকে তখন দেখলে মনে হতো যেন খাপখোলা তলোয়ার, যার ওপর ভরসা করা যায় সব জায়গায়ই, যিনি সবার প্রিয় হয়ে উঠতে পারেন সহজেই।
একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সম্ভবত ১৯৫৬ সাল। আগের দিন আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। শপথ নেওয়ার পরদিনই পুরো মন্ত্রিসভা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জেলে চলে এলেন রাজবন্দীদের মুক্ত করে দিতে। কারণ ক্ষমতা নিয়েই প্রথম যে কাজটি তাঁরা করেছিলেন, তা হলো জননিরাপত্তা আইন বাতিল। মন্ত্রিসভা জেলে এল বিকেলে। পুরোনো হাজতে সভা। সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান। সভা শুরু হবে। এর আগেই বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, ‘বরুণ, তুমি একটি গান গাও।’ রুণদা গাইলেন, ধনধান্য পুষ্পভরা...।
পাকিস্তান আমলে বিশেষত আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের পর হয় জেলে, না হয় আত্মগোপনে থাকতে হওয়ায় বরুণদার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। পুরো সময়টা তিনি ছিলেন আত্মগোপনে আর আমার আবাসন ছিল জেলে।
পরে অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের সময় আবার দেখা হয় বরুণদার সঙ্গে। প্রথমে আগরতলায়, পরে আসামের গৌহাটিতে। বালাট শরণার্থী শিবিরে যে ব্যাপক কলেরা ছড়িয়ে পড়েছিল, সে ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন তখন। জাতীয় পার্লামেন্টের একটি সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল আসামে এসেছিল বিষয়টা জানতে। তাদের সঙ্গে দেখা করতেই গৌহাটি এসেছিলেন তিনি। নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে হয়েছে। কিন্তু নাড়ির টান ছিল নিজ এলাকার জনগণের প্রতি। আশির দশকের শেষ ভাগে আবার আইনসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ফরহাদ ভাইয়ের অকালমৃত্যুর পর কমিউনিস্ট পার্টির সংসদীয় দলের নেতৃত্বের দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর ওপরই। তখনো দেখেছি, নির্দিষ্ট দিনগুলোর বাইরে এক দিনও থাকতে চাইতেন না বাসায়। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, সুনামগঞ্জ ছাড়া অন্যত্র হাঁপিয়ে উঠতে হয়।
নিজের বয়স যখন পঞ্চাশোর্ধ্ব, দেশে যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম মন্ত্রিসভা প্রতিষ্ঠিত, তখন জাতীয় জীবনে আগের অনিশ্চয়তার অবসান হলো মনে করে শেষ পর্যন্ত বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন। পরে অবশ্য জীবনে সেই নিশ্চয়তা আসেনি। নানা দুর্যোগ সব সময় পিছু তাড়া করেছে। তবে এ সময় তিনি তাঁর পাশে পেয়েছেন সুযোগ্য স্ত্রী শীলা রায়কে।
জীবনের শেষ দিকে শরীর ভেঙে পড়েছিল। সুনামগঞ্জের বাইরে যেতে পারতেন না। মণিসিংহ ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টের চিকিৎসাসেবা উদ্বোধন উপলক্ষে সস্ত্রীক এসেছিলেন ঢাকায়। এর পরও একবার এসেছিলেন, লন্ডনে পীর হাবিবুর রহমানের স্মরণসভায় যোগ দিতে যাওয়ার সময়। দুবারই বলেছিলেন, আর আসা হবে না। সম্ভব হয়নি ঠিকই।
জীবনের শেষের দিকে তিনি সক্রিয়ভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও মার্ক্সবাদী ধ্যানধারণা থেকে বিচ্যুত হননি কোনো দিনই। আমাদের দেশের গৌরব কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব। এ দেশের আপামর মানুষের জন্য তাঁর ছিল অপার ভালোবাসা। তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা।
সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন খাপখোলা তলোয়ার।
=============================
মুক্তির গান  এক-এগারোর জুজুটাকে হিমাগারে পাঠান  জব্দকৃত অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে জাগরণ সৃষ্টি করুন  সংসদীয় গণতন্ত্রের গল্পসল্প  রাষ্ট্রীয় সমাজে চিন্তা করার স্বাধীনতার প্রয়োজন  বাঙালের জলবায়ু দর্শন: ইঁদুরই কি শ্রেষ্ঠ জীব  প্রকৃতি- পাহাড়টির সঙ্গে ধ্বংস হবে ঐতিহ্যও  স্মরণ- আজও প্রাসঙ্গিক বেগম রোকেয়া  আলোচনা- উইকিলিকসঃ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ত্রিমুখী সংগ্রাম  মুক্তিযুদ্ধ- মুজিব বললেনঃ তোমাদের এখনই ঢাকা ত্যাগ করা উচিত  আলোচনা- ডিজিটাল-প্র্রযুক্তিই মানুষকে আরও বেশি মানবিক করে!  খবর- সংরক্ষিত বনে শুঁটকিপল্লি  ট্রেনের ওপর ট্রেন  সংকেত অমান্য, দুই ট্রেনের সংঘর্ষ  আলোচনা- রবীন্দ্রনাথের কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন ভাবনা  আলোচনা- 'ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ঠাঁয় নেই দরিদ্রর উচ্চ শিক্ষা  বিশেষ আলোচনা- ফিরে দেখা গঙ্গা চুক্তি  আলোচনা- 'সংসদ বর্জনের অপসংস্কৃতি বন্ধ হোক'  আলোচনা- 'উইকিলিকসে বাংলাদেশ, তারপর?  আলোচনা- 'ওয়াংগালাঃ গারোদের জাতীয় উৎসব'  স্মরণ- 'বাঘা যতীনঃ অগ্নিযুগের মহানায়ক'  খবর, কালের কণ্ঠের- আগেই ধ্বংস মহাস্থানগঃ হাইকোর্টের নির্দেশে কাজ বন্ধ  কেয়ার্নের সঙ্গে স্বার্থবিরোধী চুক্তির পেছনেও জ্বালানি উপদেষ্টা  উইকিলিকস জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের আত্মসমর্পণ  সবুজ মাঠ পেরিয়ে  আলোচনা- 'আরো অনুদানের টাকা সরিয়েছিলেন ইউনূস'  আলোচনা- 'একটি 'উজ্জ্বল ভাবমূর্তির' এভারেস্ট থেকে পতন  গল্পালোচনা- 'আসি আসি করে আশিতে আসবে!'  রাষ্ট্র ও রাজনীতিঃ সবুজ মাঠ পেরিয়ে  স্মরণ- 'রবীন্দ্রনাথ—সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে'  স্মরণ- 'জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী'  আলোচনা- 'প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন পর্যায়'  আলোচনা- 'কর্মপরিবেশঃ স্বর্গে তৈরি'  গল্পালোচনা- ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ অজয় রায়


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.