স্মরণ- নারীর হার-নারীর জিত, বেগম রোকেয়া প্রাসঙ্গিক by নাসিম আখতার হোসাইন

বাংলাদেশে নারী শিক্ষাকে নারী উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করা হয়। আর নারী শিক্ষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বেগম রোকেয়ার নাম। নারী শিক্ষার পথিকৃৎ বলে বিবেচিত হলেও বেগম রোকেয়া ছিলেন নারী অধিকারের প্রবক্তা। নারী মুক্তির লক্ষ্যে তিনি জোর দিয়েছেন শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ও নারী-পুরুষ সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর। তাঁর প্রধান পরিচয় 'মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে'। বর্তমানের নারীবাদ অথবা নারী চেতনার মূল বিষয়ও তাই। বেগম রোকেয়ার সঙ্গে আরো নিবিড় পরিচয় ঘটে নারীর অন্তর্গত শক্তির উদ্ঘাটক হিসেবে।
বাংলাদেশে যখন ব্যাপক হারে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে নারী, তখন শক্তির উৎস হিসেবে বেগম রোকেয়া উদাহরণ হয়ে আবির্ভূত হন। সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে, সব হুমকি মোকাবিলা করে, অত্যাচার সহ্য করে তিনি এগিয়ে গেছেন অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে। প্রধানত সাহিত্যকর্মে তাঁর নারী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তবে তিনি ছিলেন কর্মী, সংগঠক ও আন্দোলনকারী। বেগম রোকেয়ার এ বহুমাত্রিক পরিচয় বুঝতে হলে আবিষ্কার করতে হবে কিভাবে তিনি নিপীড়কের দিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের বাণ নিক্ষেপ করেছেন। বাংলাদেশে ঘরে ও বাইরে যেকোনো স্থানে যেকোনো সময় নারী শারীরিক, মানসিক ও যৌন আক্রমণের শিকার হন। এর বিরুদ্ধে অনেক নারী প্রতিরোধ করেন এবং প্রতিদিনের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। তথাপি অনেকে ভীতি ও শঙ্কাগ্রস্ত জীবনের চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করেন। সমাজ-সংসার নারীর প্রতি যে লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, অপমান ও বিরোধিতা করে, তার বিরুদ্ধে নারীকেই আপন শক্তিতে রুখে দাঁড়াতে হবে। এ কথা বোঝার জন্য বেগম রোকেয়ার সাহিত্যকর্ম পাঠ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। তিনি জানিয়েছেন, নারীকে তার চেতনার দ্যুতিতেই রচনা করতে হবে তার নিজস্ব স্বর, ভাষা, ব্যঞ্জনা, কর্ম ও প্রতিবাদী হাতিয়ার।
নারী প্রশ্ন নিয়ে নারীর উত্তর খোঁজার প্রয়াস চলে নিরন্তর। আর এ অন্বেষণের ওপর নির্ভর করে নারী চেতনার জাগরণ। প্রশ্ন অনেক। সমাজে কেন নারী পরিণত হয় পুরুষের যৌনতা ভোগের বস্তুতে? কেন নারীকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই পুরুষের মর্যাদা নির্ভর করে? পুরুষের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করলে, লজ্জাশীলা-ভীরু-কোমল-অনুগত-সতীত্ব রক্ষাকারী না হলে নারীর ওপর পুরুষের বল প্রয়োগ কেন সমাজের বিধান? বেগম রোকেয়া অনেক আগেই নারী প্রশ্নের উত্তরের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাঠামোকে শনাক্ত করেছেন। পুরুষতন্ত্রের দোসর পুঁজিবাদী আগ্রাসন যে নারীকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করে এবং তা যে নারীচেতনা বিনাশের উদ্দেশ্যে নির্মিত প্রকল্প_বেগম রোকেয়া এটাও বোধগম্য করে তোলেন। রোকেয়া দেখিয়েছেন কিভাবে নারী দাসত্বের জন্য সমাজপতিরা ধর্মকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন। 'নবনূর' পত্রিকায় বেগম রোকেয়া লেখেন, 'কেহ বলিতে পারেন যে, তুমি সামাজিক কথা বলিতে গিয়া ধর্ম লইয়া টানাটানি কর কেন। তদুত্তরে বলিতে হইবে যে, ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর ওপর প্রভুত্ব করিতেছে। তাই ধর্ম লইয়া টানাটানি করিতে বাধ্য হইলাম। এ জন্য ধার্মিকগণ আমাকে ক্ষমা করিতে পারেন।' বেগম রোকেয়া নারীর পশ্চাৎপদতার জন্য পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করেন। তাঁর মতে, পুরুষতন্ত্র নারীর অধিকার হরণ করে তাকে জড় পদার্থে পরিণত করে রেখেছে। 'সুবহে সাদেক'-এ তিনি লেখেন, 'মনের মরণ ব্যথা প্রকাশিতে নারি; কত পাপ ছিল হয়েছিনু নারী।' বেগম রোকেয়ার জন্মকাল ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর। তখন বাঙালি মুসলিম সমাজের জন্য ছিল এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সংকটময় কাল। তার প্রধান কারণ ছিল, অশিক্ষার প্রভাব ও অবরোধ প্রথা। মাসিক 'মোহাম্মদী' পত্রিকায় বেগম রোকেয়া তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কয়েকটি ঘটনা 'অবরোধবাসিনী' নামে তুলে ধরেন। 'অপরের কথা দূরে থাকুক। এখন নিজের কথা কিছু বলি। সবেমাত্র পাঁচ বৎসর হইতে আমাকে পর্দা করিতে হইত। পাড়ার স্ত্রীলোকেরাও যদি হঠাৎ বেড়াইতে আসিল, অমনি বাড়ীর কোন লোকচক্ষু ইশারা করিত। আমি যেন প্রাণভয়ে যত্রতত্র কখনও রান্নাঘরে ঝাঁপের অন্তরালে, কখনও কোন চাকরানীর গোল করিয়া জড়াইয়া রাখা পাটির অভ্যন্তরে, কখনও তক্তপোশের নীচে লুকাইতাম।'
তৎকালীন পুরুষশাসিত সমাজ বেগম রোকেয়াকে অপবাদ দিতে ছাড়েনি। তাঁকে উদ্দেশ করে বলা হতো, 'যুবতী বিধবা স্কুল স্থাপন করিয়া নিজের রূপ-যৌবনের বিজ্ঞাপন প্রচার করিতেছেন।' এসব অশ্লীল আক্রমণে কাতর না হয়ে তিনি নিজেকে আরো শক্তিশালী করেছেন। 'সওগাত' পত্রিকায় 'সিসেম ফাঁক'-এ তিনি তীব্র ভাষায় সমালোচনার জবাব দেন_'যে সকল মোল্লা স্ত্রী-শিক্ষার বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়, তারা ছদ্মবেশী শয়তান।' উপরন্তু রোকেয়া দেখিয়েছেন সমাজে কিভাবে নারী-পুরুষ বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। কিভাবে পুরুষতন্ত্র নারীকে অলংকারে আবৃত করে অধস্তন আর বন্দি করে রেখেছে। 'অর্ধাঙ্গী'তে তিনি লেখেন, 'স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মাপেন। স্বামী যখন কল্পনার সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রমালা বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন এবং সূর্যমণ্ডলের ঘনফল তুলাদণ্ডে ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাউল, ডাল ওজন করেন এবং রাঁধুনীর গাতি নির্ণয় করেন। বলি জ্যোতিবর্ে্বত্তা মহাশয়, আপনার পাশ্র্বে আপনার সহধর্মিণী কই?'
অন্যদিকে বেগম রোকেয়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেড়ে ওঠা নারীর রক্ষণশীল মনোভাবকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বর্জন করেছেন। তিনি নারীশক্তির জাগরণ ঘটাতে চেয়েছেন। 'সুবহে সাদেক'-এ লিখেছেন, 'তাহাদের জানা উচিৎ যে তাহারা ইহজগতে কেবল সুদৃশ্য শাড়ী, ক্লিপ ও বহুমূল্য রত্নালংকার পরিয়া পুতুল সাজিবার জন্য আসে নাই; বরং তাহারা বিশেষ কর্তব্য সাধনের নিমিত্ত নারী রূপে জন্মলাভ করিয়াছে। তাহাদের জীবন শুধু পতি দেবতার মনোরঞ্জনের নিমিত্ত উৎসর্গ হইবার বস্তু নহে। তাহারা যেন অন্ন-বস্ত্রের জন্য কাহারও গলগ্রহ না হয়।' 'মতিচূর' গ্রন্থে বেগম রোকেয়া লেখেন, 'এই যে আমাদের অপ্রিয় অলংকারগুলি, এগুলি দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ। কারাগারে বন্দীগণ লৌহ নির্মিত বেড়ী পরে, আমরা আদরের জিনিস বলিয়া স্বর্ণ-রৌপ্যর বেড়ী পরি।' বেগম রোকেয়া যে সময় জন্মগ্রহণ করেন, তখন নারী শিক্ষা ছিল অবধারিতভাবেই অবরুদ্ধ। মুসলিম নারী হিসেবে শিক্ষার পথ ছিল তাঁর জন্য বন্ধ। তবু নারী শিক্ষার আবশ্যকতা তিনি অনুভব করেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হলেও তিনি সব বাধা ডিঙিয়ে নিজেকে শিক্ষিত করে তুলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে নারী শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বেগম রোকেয়া সমাজে নারী-পুরুষ সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছেন। আর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারী সমাজকেই জেগে ওঠার আহ্বান জানান। 'সুবেহ সাদেক' প্রবন্ধে তিনি লেখেন, 'ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন, অগ্রসর হউন। বল মা! আমরা পশু নই। বল ভগিনী! আমরা আসবাব নই। বল কন্যে! আমরা জড়োয়া অলংকার রূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই। সকলে সমস্বরে বল, আমরা মানুষ! আর কার্যত দেখাও যে, আমরা সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ অংশের অর্ধেক।' বেগম রোকেয়া নারী-পুরুষ সমতা বিধানের জন্য নারীদের সংগঠিত হওয়ার ওপর জোর দেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম' নামের মহিলা সমিতি। 'পদ্মরাগ' উপন্যাসে 'তারিণী ভবন' নামে যে নারী আশ্রমের বর্ণনা করেন, সেখানে নানা জাতি, নানা ধর্ম এবং নানা শ্রেণীর মানুষের একত্রে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার উদাহরণ সৃষ্টি করেন। বেগম রোকেয়া নারী সমাজকে জাগরণের সাধনায় ব্রতী হতে আহ্বান করেছেন। 'মতিচূর' গ্রন্থে তিনি লেখেন, 'প্রথমে জাগিয়া ওঠা সহজ নহে, জানি; সমাজ মহাগোলযোগ বাধাইবে, জানি; ভারতবাসী মুসলমান আমাদের জন্য প্রাণদণ্ডের বিধান দিবেন এবং হিন্দু চিতানল বিধান দিবেন, জানি। ভগ্নীদিগেরও জাগিবার ইচ্ছা নাই; জানি। কিন্তু সমাজের কল্যাণের নিমিত্ত জাগিতে হইবেই।' 'সুলতানার স্বপ্ন' রচনায় বেগম রোকেয়া এক 'নারীস্থানের' কল্পনা করেছেন, যেখানে নারীরা প্রকৃত অর্থেই স্বাধীন। যদিও পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বে নারীর পরিচয় প্রান্তিক, ক্ষমতার পরিধি সীমিত, তবুও বেগম রোকেয়া বিপন্নতার ঊধর্ে্ব নারী মুক্তির সম্ভাবনার দিক নির্দেশ করেন।
================================
সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতির বীজ লুক্কায়িত  বরুণ রায়—কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব  মুক্তির গান  এক-এগারোর জুজুটাকে হিমাগারে পাঠান  জব্দকৃত অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে জাগরণ সৃষ্টি করুন  সংসদীয় গণতন্ত্রের গল্পসল্প  রাষ্ট্রীয় সমাজে চিন্তা করার স্বাধীনতার প্রয়োজন  বাঙালের জলবায়ু দর্শন: ইঁদুরই কি শ্রেষ্ঠ জীব  প্রকৃতি- পাহাড়টির সঙ্গে ধ্বংস হবে ঐতিহ্যও  স্মরণ- আজও প্রাসঙ্গিক বেগম রোকেয়া  আলোচনা- উইকিলিকসঃ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ত্রিমুখী সংগ্রাম  মুক্তিযুদ্ধ- মুজিব বললেনঃ তোমাদের এখনই ঢাকা ত্যাগ করা উচিত  আলোচনা- ডিজিটাল-প্র্রযুক্তিই মানুষকে আরও বেশি মানবিক করে!  খবর- সংরক্ষিত বনে শুঁটকিপল্লি  ট্রেনের ওপর ট্রেন  সংকেত অমান্য, দুই ট্রেনের সংঘর্ষ  আলোচনা- রবীন্দ্রনাথের কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন ভাবনা  আলোচনা- 'ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ঠাঁয় নেই দরিদ্রর উচ্চ শিক্ষা  বিশেষ আলোচনা- ফিরে দেখা গঙ্গা চুক্তি  আলোচনা- 'সংসদ বর্জনের অপসংস্কৃতি বন্ধ হোক'  আলোচনা- 'উইকিলিকসে বাংলাদেশ, তারপর?  আলোচনা- 'ওয়াংগালাঃ গারোদের জাতীয় উৎসব'  স্মরণ- 'বাঘা যতীনঃ অগ্নিযুগের মহানায়ক'  খবর, কালের কণ্ঠের- আগেই ধ্বংস মহাস্থানগঃ হাইকোর্টের নির্দেশে কাজ বন্ধ  কেয়ার্নের সঙ্গে স্বার্থবিরোধী চুক্তির পেছনেও জ্বালানি উপদেষ্টা  উইকিলিকস জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের আত্মসমর্পণ  সবুজ মাঠ পেরিয়ে  আলোচনা- 'আরো অনুদানের টাকা সরিয়েছিলেন ইউনূস'  আলোচনা- 'একটি 'উজ্জ্বল ভাবমূর্তির' এভারেস্ট থেকে পতন  গল্পালোচনা- 'আসি আসি করে আশিতে আসবে!'  রাষ্ট্র ও রাজনীতিঃ সবুজ মাঠ পেরিয়ে  স্মরণ- 'রবীন্দ্রনাথ—সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে'  স্মরণ- 'জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী'  আলোচনা- 'প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন পর্যায়'


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ নাসিম আখতার হোসাইন
অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.