মুক্তিযুদ্ধ- বিবিসি লন্ডন ১৯৭১: এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ.. by এম এ মোমেন

কাত্তরের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যম ছিল বিবিসি—ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন। বিবিসির বাংলা বিভাগের একটি আবেগময় সম্পৃক্ততা থাকার কথাই। কিন্তু ওয়ার্ল্ড সার্ভিস? বিবিসিতে কী শুনেছে বিশ্ববাসী? কয়েকটি নির্বাচিত সংবাদের অনুবাদ উপস্থাপন করা হচ্ছে এখানে, এবং একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় প্রথম দিককার সংবাদ প্রচারে ওয়ার্ল্ভ্র সার্ভিসের কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব; কিন্তু একটি নতুন স্বাধীন দেশের যে আবির্ভাব ঘটছে, সেই বার্তাটি পড়তে বেশি দিন লাগেনি বিবিসি ওয়ার্ল্ভ্র সার্ভিসের।
তাই ১৯৭১ সালে কেমন ছিল বাংলাদেশ, কোন দিকে যাচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি, তারও জীবন্ত ইতিহাস উঠে এসেছে বিবিসির এসব সংবাদভাষ্যে। এই রচনার প্রথম সংবাদটি প্রচারিত হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ এবং শেষ সংবাদটি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। সংগ্রহ ও অনুবাদ করেছেন এম এ মোমেন

২৬ মার্চ ১৯৭১
পাকিস্তান থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করায় ব্যাপক লড়াই শুরু হয়েছে। আর ভারত থেকে পাওয়া সংবাদে জানা গেছে, শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশটির স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। পূর্বাঞ্চলের রাজধানী ঢাকায় অবস্থানরত মার্কিন কনসাল জেনারেল জানিয়েছেন, বিরোধ দমনে কামান ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারত থেকে পাওয়া আগের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়েছে যে সর্বত্র তীব্র লড়াই শুরু হয়েছে। পূর্ব বাংলার সেনা ইউনিটগুলো পুলিশ ও সশস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা ইউনিটগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সরাসরি কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
কঠোর ভাষায় শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। আওয়ামী লীগ কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে নিয়েছিল। তিনি সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং সংবাদ প্রচারের ওপর সেন্সর আরোপ করেছেন।
১ এপ্রিল ১৯৭১
সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজধানী ঢাকাসহ অন্য প্রধান শহরে দৃঢ় সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিনিধিরা আরও জানিয়েছেন, সেনাবাহিনী নামার পরপরই ঢাকার অংশবিশেষে বেসামরিক নাগরিক, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারীদের ব্যাপক হারে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও সেখানকার কর্মচারীদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবি সৈন্যদের দায়ী করা হয়েছে। শহরের একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে, এখনো সেখানে আগুন জ্বলছে। কোনো কোনো প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, শহরের বাইরে গোলযোগ অব্যাহত রয়েছে। মার্কিন সংবাদ সংস্থা ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের সংবাদদাতা জানিয়েছেন, ভারতীয় সীমান্তের অনতিদূরে পূর্ব পাকিস্তানের একটি শহরে (যশোর) তিনি পৌঁছেছেন। তিনি বলেছেন, সেখানে তাঁকে মহিলা ও শিশুদের মৃতদেহ দেখানো হয়েছে। তিনি জানতে পেরেছেন, শহর ছেড়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তানি সেনারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁদের হত্যা করেছে।
পাকিস্তান অভিযোগ করেছে, ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়েছে; কিন্তু ভারত সরকারের মুখপাত্র তা অস্বীকার করেছে।
৪ এপ্রিল ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্পর্কে নিরপেক্ষ কোনো সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকা থেকে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঘোষণায় বলা হয়েছে, জনগণ যেন কোনো ধরনের গুজবে কান না দেয়। এতে আরও বলা হয়, সোমবার থেকে ঢাকায় কারফিউ শিথিল করা হয়েছে।
এর মধ্যে আকাশবাণী তাদের পাওয়া সংবাদের ভিত্তিতে জানিয়েছে, সামরিক কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম ও আরও পাঁচটি শহরে বিমান আক্রমণ চালিয়ে নাপাম বোমা বর্ষণ করেছে।
৯ এপ্রিল ১৯৭১
রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর তাদের ভাষায় রাষ্ট্রদোহী ও সমাজবিরোধীদের হাত থেকে মুক্ত করা হয়েছে। রেডিওর খবরে বলা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। শহরের অনেক দোকানপাট ও বাজার এখন খোলা এবং জনগণ তাদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে। সামরিক কর্তৃপক্ষের বরাতে রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে, আরও একটি সামরিক বিধি জারি হয়েছে, যাতে কর্তৃপক্ষ কারও কাজকর্ম সন্দেহজনক কিংবা জননিরাপত্তার পরিপন্থী মনে করলে তার গতিবিধি সীমিত করে দিতে পারবে।
আকাশবাণীর সংবাদে বলা হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় শহর রাজশাহী নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য গত দুদিন পাকিস্তান বিমানবাহিনী অনেকবার বোমাবর্ষণ করেছে। তবে তাদের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। পাকিস্তান ভারতীয় প্রতিবেদনকে নির্জলা মিথ্যা আখ্যা দিয়ে বলেছে, এটি প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কহীন দুরভিসন্ধিমূলক প্রচারণা।
১৭ এপ্রিল ১৯৭১
সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি করে পূর্ব পাকিস্তানিদের একটি দল, তাদের ভাষায়, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর একটি গ্রামের (বৈদ্যনাথতলা) আম্রকাননে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের সামনে নজরুল ইসলাম ঘোষণা পাঠ করেন। তিনি বলেন, তাঁর সরকার পৃথিবীর সব দেশের কাছে বাংলাদেশের জনগণের সহায়তায় এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী এবং কে এম আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করে তিনি একটি মন্ত্রিসভার ঘোষণা দিয়েছেন। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য ভারত থেকে একদল বিদেশি সংবাদদাতাও এসেছিলেন।
১০ জুন ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান যেসব শরণার্থী ভারতে পালিয়ে গেছেন, তাঁদের ঘরে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশের আর সব নাগরিকের মতো তাঁরাও একইভাবে বসবাস করতে পারবেন। গভর্নরকে উদ্ধৃত করে রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে, রাজনৈতিক নেতাসহ ছাত্র, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মচারী, সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যদের স্বদেশে স্বাগত জানানো হবে। জেনারেল টিক্কা খান বলেছেন, সীমান্তে শরণার্থী অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, সেখানে খাবার, আশ্রয়, চিকিৎসা ও যানবাহনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। মিথ্যা ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে শরণার্থীরা দেশ ত্যাগ করেছেন এবং এখন অকারণে অপুষ্টি ও রোগে-শোকে ভুগছেন। বিবিসির কমনওয়েলথ সংবাদদাতা বলেছেন, জেনারেল টিক্কা খানের এই বিবৃতির যথার্থতা নিয়ে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা সন্দিহান। আমাদের প্রতিনিধি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে বিপুলসংখ্যক লোকের চলে আসায় পাকিস্তানের যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, পর্যবেক্ষকদের মতে, তারই প্রতিক্রিয়ায় জেনারেল এই বক্তব্য দিয়েছেন।
২০ জুন ১৯৭১
নিজ উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান সফরে বিদেশি সংবাদদাতাদের ওপর পাকিস্তান আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এক সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসায় আগে থেকে অনুমতি না নিয়েই তাঁরা পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসতে পারবেন এবং আর এখন থেকে তাঁদের সফরকালীন সঙ্গীরও প্রয়োজন হবে না। গত মার্চে লড়াই শুরু হয়ে যাওয়ার পর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চিত্রগ্রাহকদের বেলায়ও প্রযোজ্য হবে কি না স্পষ্ট নয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বিভিন্ন বিদেশি সরকারের কাছে পাকিস্তানের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে এবং তাঁদের মতে ‘শত্রুতামূলক প্রচারণা’র বিষয়টি জানাতে সফরে বের হচ্ছেন। কলকাতা বিমানবন্দরের কাছে আশ্রয় নেওয়া ৪০ হাজার শরণার্থীকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিয়েছে। বিমান পরিচালনাকারীরা জানিয়েছেন, শরণার্থীদের সরানো না হলে নিরাপত্তার প্রশ্নে বিমান চালানো বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে।
২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানের একজন সরকারি মুখপাত্র জানিয়েছেন, মাইন বিস্ফোরণে আরও একটি জাহাজ ধ্বংস হয়েছে। এবারের জাহাজটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত। গাঙ্গেয় উপত্যকা চালনায় ঘটে যাওয়া এই বিস্ফোরণের জন্য তিনি ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের দোষারোপ করেছেন। জাহাজটি খাদ্যশস্য নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাচ্ছিল। এর মধ্যে চালনায় মাইন বিস্ফোরণে আরও একটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকারীরা ঘটনার দায়িত্ব স্বীকার করেছেন।
১৭ নভেম্বর ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ চলছে। খুব ভোরের বেতার ঘোষণায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত জনগণকে বাড়ির ভেতর থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘর ঘরে তল্লাশি চলছে। লাইসেন্সবিহীন অস্ত্র, গোলাবারুদ বাড়ির বাইরে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স, বিদ্যুৎ বোর্ড ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের গাড়ি ছাড়া সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শহরের ছয়টি পুলিশ থানার নিয়ন্ত্রণ ব্রিগেডিয়ারদের হাতে রয়েছে।
ঢাকা শহর ও শহরের আশপাশে গতকাল গেরিলা অভিযানের ঘটনা ঘটেছে। বোমা বিস্ফোরণ ও গোলাগুলিতে কেউ কেউ নিহত এবং অনেকেই আহত হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়েছে। বিভিন্ন স্কুলে আক্রমণ চালিয়ে ক্ষতি সাধন করা হয়েছে।
২৩ নভেম্বর ১৯৭১
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে, বহিঃশত্রুর আক্রমণের হুমকির কারণে যে সংকটকালীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সব অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানিরা বলছে, যশোর বিমানঘাঁটি ভারতীয় গোলন্দাজ আক্রমণের শিকার হয়েছে। পাকিস্তান মনে করে, কামান ইউনিটের সহায়তায় সীমান্তের অপর পার থেকে ভারতীয় সৈনিকেরা এই বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করছে। ভারত অবশ্য সেনা আক্রমণের অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং জানাচ্ছে, পাকিস্তান বাঙালি গেরিলাদেরই ভারতীয় সৈন্য বলতে শুরু করেছে। আকাশবাণী থেকে বলা হয়েছে, গেরিলা যোদ্ধারা সিলেট জেলার বেশ ভেতরে ঢুকে পড়েছে, যশোর ও রংপুর এলাকায় তীব্র লড়াই চলছে। রেডিও পাকিস্তান থেকে জানানো হয়েছে, যশোর, সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকায় যুদ্ধ চলছে। তবে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা হয়েছে এবং তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
২ ডিসেম্বর ১৯৭১
বিবিসির বিশেষ সংবাদদাতা ঢাকা থেকে জানিয়েছেন, গেরিলা আক্রমণের তীব্রতা ও পরিধি বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে, কেবল ঢাকা শহরেই কমপক্ষে দুই হাজার গেরিলা সক্রিয় রয়েছে। তিনি বলেন, সর্বশেষ ঘটনায় ঢাকায় ছোট অস্ত্রের গুলির শব্দ শোনা গেছে এবং বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। বুলেটে জখম বহুসংখ্যক লোককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে তিনজন সেনাসদস্য রয়েছেন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি পেট্রলপাম্প উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশ থেকেই জানানো হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক গভর্নর চিকিৎসক আবদুল মালিক বেতার ঘোষণায় সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, পাকিস্তান ধ্বংসাত্মক এক যুদ্ধের মুখোমুখি। বিবিসিকে পাঠানো এক বার্তায় একজন সংবাদদাতা জানিয়েছেন, পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের শমশেরনগর, দিনাজপুর, যশোর, রংপুর, খুলনা, ময়মনসিংহসহ সীমান্তের সর্বত্র তীব্র লড়াই অব্যাহত রয়েছে। আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করেছে এবং ভারতীয়দের জীবন ও সম্পদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আকাশবাণীর খবরে বলা হয়েছে, গত বুধবার থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় বোমা ফেলতে শুরু করলে ভারতীয় বাহিনী, তাদের ভাষায়, প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করেছে। খবরে বলা হয়েছে, গেরিলারা ঠাকুরগাঁও শহর ও বিমানঘাঁটি এবং সিলেটের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত শমশেরনগর বিমানঘাঁটি অধিকার করে নিয়েছে। কিন্তু রাওয়ালপিন্ডির একজন সামরিক মুখপাত্র জানিয়েছেন, ঠাকুরগাঁওয়ে ভারতীয় বাহিনী কৌশলগতভাবে কিছু অর্জন করলেও কর্যত বিমানঘাঁটি এখনো পাকিস্তানি বাহিনীর দখলেই রয়েছে।
১২ ডিসেম্বর ১৯৭১
ভারত জানিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার আশপাশে ভারতীয় প্যারাট্রুপার নামানো হয়েছে, পদাতিক বাহিনী চারদিক থেকে শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার মেজর জেনারেল জ্যাকব জানিয়েছেন, গতকাল পরিচালিত বিমান আক্রমণ সফল হয়েছে। এর বেশি কিছু তিনি বলতে সম্মত হননি। তবে ভারতীয় কমান্ডার বলেছেন, তাঁর বাহিনী মেঘনা নদী অতিক্রম করেছে এবং এখন শহরের ২০ মাইল (৩২ কিলোমিটার) এলাকার মধ্যে পৌঁছে গেছে। তবে তাদের প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী জানাচ্ছে, কুমিল্লার সব নদী ও শাখানদী এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিট ঢাকায় খুবই সক্রিয়। শহরের ভেতর লড়াই চলছে।
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানের অবরুদ্ধ রাজধানী ঢাকার দিকে ভারতীয় সৈন্যরা দ্রুত এগিয়ে আসছে। পাকিস্তান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান (জেনারেল নিয়াজি) বলেছেন, শেষ লোকটি জীবিত থাকা পর্যন্ত তাঁর সেনাবাহিনী লড়াই করে যাবে। আত্মসমর্পণের জন্য ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেক শর আরও একটি আহ্বান তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভারতীয়রা বলছে, তাদের দুটি কামানবহর প্যারাট্রুপারদের সমর্থন নিয়ে উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা এবং উত্তর-পূর্বে নরসিংদী থেকে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে। কয়েকটি অগ্রগামী ইউনিট জয়দেবপুরে ঢাকার সেনাঘাঁটি থেকে মাত্র ১০ মাইল (১৬ কিলোমিটার) দূরত্বের মধ্যে অবস্থান করছে। ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সাংবাদিকেরা জানাচ্ছেন, ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকা থেকে মাত্র নয় মাইল দক্ষিণে ডেমরাঘাট পর্যন্ত পৌঁছেছে। ভারত বলছে, খুলনার কাছে দৌলতপুর ঘাঁটিতে এখনো লড়াই চলছে এবং দক্ষিণাঞ্চলের বন্দর চালনাতে ভারতীয় বাহিনীকে কঠোর প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১
ভারতীয়রা বলছে, তারা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ভারী অস্ত্রের গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছে এবং ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশের গেরিলারা বহিঃপ্রতিরক্ষায় আক্রমণ করে তাদের মনোবল ভেঙে দিচ্ছে। সংবাদদাতাদের পাঠানো একটি সম্মিলিত বার্তায় জানা যাচ্ছে, রেডক্রস ও পাকিস্তানি কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল নিয়াজির মধ্যে অস্ত্রবিরতি নিয়ে দরকষাকষি চলছে, তবে এখনো তা থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু উঠে আসেনি। বার্তায় বলা হয়েছে, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে বিমান আক্রমণ তীব্রতর করা হয়েছে, বিশেষ করে জেনারেল নিয়াজির সদর দপ্তর ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলো এই আক্রমণের প্রধান টার্গেট।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে। রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি হয়েছে এবং ভারতীয় বাহিনী রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করেছে। পাকিস্তান বলেছে, স্থানীয় ভারতীয় ও পাকিস্তানি কমান্ডারদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী সংসদে বলেছেন, দু পক্ষের প্রতিনিধি ঢাকায় আত্মসমর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। পাকিস্তানের পক্ষে এই চুক্তি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। তিনি বলেন, ভারত আশা করে, পূর্ব পাকিস্তানিদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি পাকিস্তানে আটক রয়েছেন, নিজ দেশের মানুষের মধ্যে তাঁর আসন গ্রহণ করবেন এবং বাংলাদেশকে শান্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। মিসেস গান্ধী বলেন, ভারতীয় বাহিনী প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় পাকিস্তানে অবস্থান করবে না। তিনি আরও যোগ করেন, লাখ লাখ শরণার্থী ইতিমধ্যেই দেশের পথে পা বাড়িয়েছে।
=============================
বাঘ  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০  তাঁরা সমালোচিত, আমরা বিব্রত  মুজিবকে নিয়ে সিরাজের একমাত্র লেখা  ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির উদ্যোগ  মহাস্থানগড়ের ধ্বংস-পরিস্থিতিঃ পর্যবেক্ষণ  ওয়ান-ইলেভেনের চেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ আসছে!  ডিসেম্বরঃ গৌরব ও গর্বের মাস  উইকিলিকস বনাম যুক্তরাষ্ট্র  দুর্নীতি বেড়েছে দুনিয়াজুড়ে  উইকিলিকসঃ বাঘের ঘরে ঘোগ  আইন অপূর্ণাঙ্গঃ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার কঠিন  ১০০ কোটি ডলারে ঋণঃ ভারতের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত  ট্রেন দুর্ঘটনাঃ চালকের ভুল নাশকতারও গন্ধ!  ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা উইকিলিকস সমর্থকদের  কানকুনঃ মুমূর্ষু পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষ  নারীর হার-নারীর জিত, বেগম রোকেয়া প্রাসঙ্গিক  সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতির বীজ লুক্কায়িত  বরুণ রায়—কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব  মুক্তির গান  এক-এগারোর জুজুটাকে হিমাগারে পাঠান  জব্দকৃত অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে জাগরণ সৃষ্টি করুন  সংসদীয় গণতন্ত্রের গল্পসল্প  রাষ্ট্রীয় সমাজে চিন্তা করার স্বাধীনতার প্রয়োজন  বাঙালের জলবায়ু দর্শন: ইঁদুরই কি শ্রেষ্ঠ জীব  প্রকৃতি- পাহাড়টির সঙ্গে ধ্বংস হবে ঐতিহ্যও  স্মরণ- আজও প্রাসঙ্গিক বেগম রোকেয়া  আলোচনা- উইকিলিকসঃ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ত্রিমুখী সংগ্রাম  মুক্তিযুদ্ধ- মুজিব বললেনঃ তোমাদের এখনই ঢাকা ত্যাগ করা উচিত  আলোচনা- ডিজিটাল-প্র্রযুক্তিই মানুষকে আরও বেশি মানবিক করে!  খবর- সংরক্ষিত বনে শুঁটকিপল্লি  ট্রেনের ওপর ট্রেন  সংকেত অমান্য, দুই ট্রেনের সংঘর্ষ  আলোচনা- রবীন্দ্রনাথের কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন ভাবনা  আলোচনা- 'ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ঠাঁয় নেই দরিদ্রর উচ্চ শিক্ষা



দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
সংগ্রহ ও অনুবাদ করেছেন এম এ মোমেন


এই লেখা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.