ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর উদ্ভব ও তৎপরতা প্রসঙ্গে by বদরুদ্দীন উমর

ধর্মের নামে যে সহিংস বা জঙ্গি তৎপরতা এখন মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা-এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যাচ্ছে, এটা আগে দেখা যেত না। নব্বইয়ের দশকে শুরু হয়ে এই চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি এখন জনজীবনে এক বড় উপদ্রব হিসেবে দেখা দিয়েছে। এর ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড নিয়ে এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতি ক্ষেত্রে তোলপাড় হচ্ছে। এর ওপর নানা ধরনের রিপোর্ট ও আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, হঠাৎ করে এই পর্যায়ে ধর্মীয় জঙ্গিবাদী রাজনীতির উদ্ভব ও বিস্তার কী কারণে ঘটল এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনা তেমন দেখা যায় না।
রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সব সময়ই থেকেছে, কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার আরও বিপজ্জনক ব্যাপার। প্রথমটি এক হিসেবে সামন্তবাদী বা বুর্জোয়া শাসক শ্রেণীর রাজনীতির ক্ষেত্রে এক স্বাভাবিক ব্যাপার। জনগণের মধ্যে সব রকম পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনাকেই তারা নিজেদের শাসন স্বার্থে ব্যবহার করে। ধর্মের ব্যবহারও তার মধ্যে একটি। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের সঙ্গে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের কোনো আকাশ-পাতাল পার্থক্য না থাকলেও তার মধ্যে পার্থক্য আছে। মনে রাখা দরকার যে, আধুনিক যুগে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার দীর্ঘদিনের। ভারতবর্ষে উনিশ শতকে বেশ পরিকল্পিতভাবেই রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার শুরু করে তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা। তারই সব থেকে পরিচিত রূপ হল সাম্প্রদায়িকতা। দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব, তিক্ততা ও সংঘর্ষ সৃষ্টি করে নিজেদের ঔপনিবেশিক স্বার্থ যথাসম্ভব অক্ষুণ্ন রাখা এবং নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবল প্রতাপের যুগেও ধর্মচর্চা ছিল একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেজন্য যারা ধর্মীয় শিক্ষা ও ধর্মচর্চায় নিযুক্ত থাকতেন, তারা রাজনীতির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখতেন না। রাখলেও তার গুরুত্ব তাদের জীবনে বেশি ছিল না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যেমন সহিংসতা দেখা যেত, মানুষকে ধর্মের দিকে টেনে আনার জন্য সে রকম কোনো সহিংসতার ব্যাপার তখন ছিল না। এজন্য তখনকার দিনে মাদ্রাসা থাকলেও সেগুলোতে ছাত্রদের সহিংস জেহাদি বানানোর কোনো চেষ্টা হতো না, এখন যেমন সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সেটা হয় না। ধর্মের জন্য রাজনীতিকে ব্যবহারের প্রয়োজন দেখেই মাদ্রাসাগুলোতে শুরু হয় ছাত্রদের মধ্যে তথাকথিত জেহাদি চিন্তাভাবনার সৃষ্টি, তাদের অস্ত্র চালনা শিক্ষা দেয়া এবং ধর্মযুদ্ধের নামে তাদের জঙ্গি তৎপরতার জন্য তৈরি করা। এ কাজ শুধু যে মাদ্রাসাগুলোতেই হয়ে থাকে এমন নয়। অন্যদের এই প্রক্রিয়ার মধ্যে নানাভাবে টেনে আনা হয়। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের
সময় যেমন অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি করা হয়, তাদের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামার মাধ্যমে সংঘর্ষ হয়, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বেলায় তা হয় না। এক্ষেত্রে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু দাঁড়ায় স্বধর্মাবলম্বীরা, অন্য ধর্মাবলম্বীরা নয়। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে এবং এশিয়া-আফ্রিকার কিছু দেশে ইসলামী শাসন বা খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে যে তথাকথিত জঙ্গি তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, এতে সহিংসতার শিকার হচ্ছে এই জঙ্গিদের স্বধর্মাবলম্বীরাই। ইসলাম ধর্মে শুদ্ধি আন্দোলন ওহাবীসহ অন্য কোনো কোনো সেক্ট-এর মধ্যে দেখা গেলেও এখন এই শুদ্ধি আন্দোলন যেভাবে সহিংস আকার ধারণ করেছে এবং এক বড় সামাজিক উপদ্রবে পরিণত হয়েছে এটা আগে ছিল না।
নব্বইয়ের দশকে ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে যে ইসলামী জঙ্গি সংগঠন গড়ে ওঠে তার পেছনে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইএ, যদিও পরবর্তীকালে আল কায়দা দমন ও ধ্বংস করার জন্য আমেরিকানরা ব্যাপক আকারে নিজেদের সামরিক শক্তি নিয়োগ করে। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করার বিষয় যে, এ ধরনের ধর্মীয় রাজনৈতিক তৎপরতা মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোতেই শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদীদের রাজনৈতিক ও সামরিক তৎপরতা যে এ অঞ্চলের তেলসম্পদ লুণ্ঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত এটা সবারই জানা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগের সহায়তায় ধর্মীয় জেহাদি সংগঠনগুলো প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে গঠিত ও তৎপর হয়। দেখা যায় যে, এরপর শুধু আল কায়দায়ই নয়, একের পর এক ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠন মধ্যপ্রাচ্যে এবং এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠতে থাকে। যে দেশে তেল নেই সেখানেও এ ধরনের সংগঠন গড়ে ওঠে। এগুলোর সঙ্গেও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা যে সম্পর্কিত এর নানা রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ‘ইসলামিক স্টেট’ নামে যে সংগঠনটি এখন ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলছে এবং যাদের ওপর মার্কিন, ফরাসি, ব্রিটিশ বিমান বাহিনী বোমা বর্ষণ করছে, সেই সংগঠনটিও যে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সৃষ্টি এটা ইরাক ও সিরিয়ার কোনো কোনো সরকারি মহল এবং বেসরকারি রাজনৈতিক মহল থেকে বলা হচ্ছে।
এসব জেহাদি সংগঠনের কাছে কৌশলের সঙ্গে নানা পথে মার্কিন সামরিক শিল্প মালিকরা অস্ত্র বিক্রি করছে। এই মার্কিন শিল্প মালিকদের চাপ মার্কিন প্রশাসন ও প্রেসিডেন্টের ওপর এত বেশি যে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি তাদের দ্বারাই অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুদ্ধনীতি এবং দেশে দেশে ধর্মীয় জেহাদি সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা সাধারণভাবে আড়ালে থাকলেও এক কঠিন বাস্তব ব্যাপার। মার্কিন অর্থনীতিতে সংকট যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এই সামরিক শিল্প মালিকদের প্রভাব মার্কিন প্রশাসন ও পররাষ্ট্রনীতির ওপর ততই বিস্তার লাভ ও চাপ সৃষ্টি করছে। সব প্রচার কৌশলেরই দুটি দিক আছে। একটি হল কোনো কোনো বিষয়কে আমলে আনা এবং অপরটি হল অন্য কোনো কোনো বিষয়কে ধাপাচাপা দেয়া। বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা সম্পর্কে ব্যাপকভাবে প্রচার হল প্রথমটির উদাহরণ। দ্বিতীয়টির উদাহরণ হল, এই সংগঠনগুলো সৃষ্টি ও গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী, প্রধানত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা।
বাংলাদেশেও এখন অনেকগুলো ধর্মীয় জেহাদি সংগঠনের অস্তিত্ব আছে। এগুলো বেশিদিনের নয়। হঠাৎ করে এ সংগঠনগুলো গজিয়ে ওঠার পেছনে সরাসরি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এবং সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন তাঁবেদার কিছু রাষ্ট্রের সম্পর্ক কোনো গোপন ব্যাপার নয়। যেভাবে এগুলো গড়ে উঠে ধর্মীয় শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে, স্বধর্মীয় লোকদের হত্যা করছে, তাদের ওপর নানাভাবে জুলুম করছে তার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সঙ্গে অনেকে নিজেদের অজানতেই সম্পর্কিত থেকে এসব সমাজবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল, এমনকি ধর্মবিরোধী কাজে লিপ্ত হচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে যে, এদের কার্যকলাপ ও তৎপরতা নিয়ে প্রচার মাধ্যমে ও রাজনীতি ক্ষেত্রে অনেক আলোচনা, বিতর্ক ইত্যাদি হলেও কেন এই সংগঠনগুলো বিগত দুই-তিন দশকে গড়ে উঠল এবং ধর্মীয় জেহাদের নামে চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হল, এ নিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য আলোচনা কোথাও নেই। এই আলোচনা ব্যাপকভাবে হওয়ার প্রয়োজন আছে। কারণ কেন ও কীভাবে এগুলোর উদ্ভব হল এ বিষয়টি সঠিকভাবে না জানলে এদের বিরুদ্ধে কোনো সঠিক আন্দোলন গড়ে তোলা ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
০২.১১.২০১৪
বদরুদ্দীন উমর: সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.