ব্যাধিগ্রস্ত দুনিয়ার চিকিৎসা by আন-মেরি স্লটার
আমরা কি এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে
তুলতে পারি না, যার ফলে দুনিয়ার শান্তি রক্ষা করা সম্ভব হবে, আর সব দেশ
কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলবে? হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর নতুন বই
ওয়ার্ল্ড অর্ডার-এ ঠিক এ কথাই বলেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রশ্নটি সঠিক নয়।
কিসিঞ্জারের কাছে ‘বিশ্বব্যবস্থা’ একটি আন্তর্জাতিক বন্দোবস্ত মাত্র। ভাবা
হয়, ‘এটা সারা দুনিয়ার জন্যই প্রযোজ্য’। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সৃষ্টির আগে
ইউরোপের কাছে বিশ্বব্যবস্থার অর্থ ছিল বিভিন্ন দেশের মধ্যকার ভারসাম্য,
যার মধ্যে বিভিন্ন ধর্ম ও ধরনের সরকার সহাবস্থান করতে পারবে।
ইসলাম একই সঙ্গে একটি ধর্ম ও সভ্যতা, তার কাছে বিশ্বব্যবস্থার সর্বোচ্চ রূপটি স্বাভাবিকভাবেই একটু ভিন্ন প্রকৃতির। ইসলাম খিলাফতে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ, যেখানে ধর্মবিশ্বাস ও সরকারব্যবস্থা একসঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকে—এ দুয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আর ইসলামের ঘর বা দার আল-ইসলামের সর্বত্র শান্তি বিরাজ করবে। নিঃসন্দেহে এটা সব মুসলমান ও মুসলিম-অধ্যুষিত সব রাষ্ট্রের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নয়। ইসলামিক স্টেটের মতো কট্টর গ্রুপ এখনো খিলাফতের স্বপ্ন দেখে, তারা শুধু কোনো জীবনবিধানই প্রচার করে না, তারা একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিই প্রচার করে। কিসিঞ্জারের দৃষ্টিতে বিশ্বব্যবস্থার নানা রূপ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, এশিয়াজুড়েই গড়ে উঠছে। চীন আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে চললেও তারা অন্যদের চেয়ে যে একটু ভিন্ন, সে কথাটা এখন ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিতে চায়। আইনের চোখে সবাই সমান, কিন্তু তারা একটু বেশি, যেটা যুক্তরাষ্ট্রও মনে করে। চীন ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে, তারা এশিয়ায় নিজেদের ঐতিহাসিক অবস্থান পুনরুদ্ধারের পথে নেমেছে। ফলে কিছুদিনের মধ্যে হয়তো দেখা যাবে, তারাও আন্তর্জাতিক আইন বদলের কথা বলছে। রাশিয়া তো প্রকাশ্যেই আইন লঙ্ঘন করছে, এমনকি আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় তারা নিজেদের অবস্থানের যৌক্তিকতা বিধানেরও চেষ্টা করছে না। উল্টো তারা সোভিয়েত আমলের ভূমি পুনরুদ্ধার করে গৌরব বোধ করছে, আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত রুশদের রক্ষায় বলপ্রয়োগের হুমকি দিচ্ছে।
এ বছরের মার্চে রাশিয়া ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ করেছে। এর আগে ২০০৮ সালে তারা জর্জিয়াতেও আগ্রাসন চালিয়েছিল। তবে এ দুই ক্ষেত্রে রাশিয়ার আচরণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে বলে মনে করেন ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের কাদরি লিক। জর্জিয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া প্রথমে আক্রমণ করেনি, বরং তারা জর্জিয়াকে আক্রমণ করতে উসকানি দিয়েছে। তারপর এমন এক ব্যাখ্যা তারা দিয়েছে, যাতে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় তার কাজের যৌক্তিকতা প্রমাণ করা যায়। কাদরির কথায় এবার ‘মস্কো শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপীয় ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, একই সঙ্গে তার নিয়মনীতিও তছনছ করে দিয়েছে।’
কিসিঞ্জার আশা করেন, এই দেশগুলো এবং ভারত ও ব্রাজিলের মতো উদীয়মান শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে একটি মতৈক্যে পৌঁছাতে পারবে, যার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত বিশ্বে একটি স্থিতাবস্থা বজায় রাখা যাবে (তিনি এর মধ্যে লাতিন আমেরিকা বাদ দিয়েছেন)। বহুত্বের এই ওয়েস্টফালীয় নীতি সমালোচনার মুখে পড়বে, কারণ বিভিন্ন দেশ ও সভ্যতাকে তাদের নিজস্ব নীতিতে চলতে দেওয়া দরকার।
২১ শতকের একটি কার্যকর বিশ্বব্যবস্থার কাজ শুধু শান্তি রক্ষাই নয়, তাকে এর চেয়ে বেশি কিছু করতে হবে। কিসিঞ্জার আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে জোর দিয়েছেন, অর্থাৎ একটি দেশ কীভাবে অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে পারে। আবার কোনো আগ্রাসী শক্তি যাতে আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট করতে না পারে, সে চেষ্টাও জারি রাখতে হবে। আজ পত্রিকার শিরোনামে চোখ বুলালে দেখা যায়, আগামী দিনগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসী ও অপরাধী নেটওয়ার্কের মতো কারণে লাখ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে, যদি সে সংখ্যাটা কোটির কোঠায় নাও যায়। মোদ্দা কথা হচ্ছে, আন্তরাষ্ট্রীয় যুদ্ধের চেয়ে এসবই এখন প্রাণহানির প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে।
তবে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার আগ্রাসনে তিন হাজার ৮০০-এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। আর ইবোলা এখন যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে সামনের জানুয়ারির মধ্যে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এইচআইভি/এইডস রোগে বিশ্বে ৩৬ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা এর চেয়ে ১০ মিলিয়ন কম, আর এ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আরও ৩৫ মিলিয়ন মানুষ।
এসব হুমকির অধিকাংশের সঙ্গেই যুদ্ধের সম্পর্ক আছে। কিন্তু এই যুদ্ধ এখন নিজ দেশের মধ্যেই হবে, মানে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হওয়ার চেয়ে এক রাষ্ট্রের মধ্যে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোরই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি। যেমন: সিরিয়ার কথাই ভাবুন, সেখানকার গৃহযুদ্ধে দেশটির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আরও লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী শিবিরে অসহায় জীবন যাপন করছে। লিবিয়া ও সিয়েরা লিওনে স্বাস্থ্যসেবার যে করুণ দশা, আর সে কারণে ইবোলা যে পরিমাণে ছড়িয়ে পড়ছে, তা আমাদের গৃহযুদ্ধের কথাই মনে করিয়ে দেয়। আফ্রিকার গ্রেট লেক অঞ্চলে চলমান সহিংসতায় লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে, ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যাই এর মূল কারণ। সে কারণে হুতু জনগোষ্ঠী বানের জলের মতো ভেসে গিয়ে আশপাশের দেশগুলোয় আশ্রয় নিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট খরা ও বন্যার কারণে লাখ লাখ মানুষ এখন দৌড়ের ওপর আছে। তারা জনবহুল শহরগুলোয় আশ্রয় নিতে বা সীমান্ত পাড়ি দিতেও বাধ্য হচ্ছে। রাশিয়া ও কানাডার বিপুল পরিমাণ ভূমি খালি পড়ে আছে, ফলে তারা এসব মানুষকে আশ্রয় দিতে পারে। কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলো তাদের আশ্রয় দিতে পারে না। এতে সেসব দেশে একধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে।
শান্তি বজায় রাখার ব্যাপারটা আসলে সংযমের, আবার এর মধ্যে একধরনের চাপ প্রয়োগের ব্যাপার আছে। বৈশ্বিক পরিসরে কার্যকর সহযোগিতার জন্য আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন। সব দেশের সরকারের উচিত একত্রে বসা, সঙ্গে নিতে হবে সুশীল সমাজ ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে। তাদের একত্রে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
পক্ষান্তরে, এরূপ পরিকল্পনা নেওয়া হলে তাতে তহবিল ও জনশক্তি থাকতে হবে। প্রয়োজন হবে সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি ও প্রয়োগক্ষমতার। আজ দুনিয়া ইবোলার মতো মহামারিতে আক্রান্ত হয়েও প্রয়োজনীয় অর্থ ও বস্তুগত সহায়তার বন্দোবস্ত করতে পারেনি। এই মহামারিতে আক্রান্ত অর্ধেক মানুষ মারা যেতে পারে, যা আফ্রিকার একটি অংশ ধ্বংস করে দিতে পারে, দুনিয়ার বিমান যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা বেষ্টনীতে ঠেলে দিতে পারে— অথচ সে বিষয়ে এখনো আমরা যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারিনি।
আমাদের দুনিয়ার সমস্যাগুলোর ধরন বৈশ্বিক, কিন্তু এগুলোর সমাধান মূলত জাতীয় প্রকৃতির। আমাদের এমন কিছু প্রতিষ্ঠান দরকার, যেগুলো কার্যকরভাবে খুব দ্রুততার সঙ্গে বিভিন্ন প্রয়োজনে সাড়া দিতে পারে। সুশাসন আছে—এমন দেশের কোনো আঞ্চলিক সরকার যা করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সময় এসেছে, এগুলোর সংস্কার করতে হবে। বিশ্বের সমস্যা মোকাবিলায় নতুন নতুন হাতিয়ার তৈরি করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
আন-মেরি স্লটার: যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের পলিসি প্ল্যানিংয়ের সাবেক পরিচালক।
ইসলাম একই সঙ্গে একটি ধর্ম ও সভ্যতা, তার কাছে বিশ্বব্যবস্থার সর্বোচ্চ রূপটি স্বাভাবিকভাবেই একটু ভিন্ন প্রকৃতির। ইসলাম খিলাফতে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ, যেখানে ধর্মবিশ্বাস ও সরকারব্যবস্থা একসঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকে—এ দুয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আর ইসলামের ঘর বা দার আল-ইসলামের সর্বত্র শান্তি বিরাজ করবে। নিঃসন্দেহে এটা সব মুসলমান ও মুসলিম-অধ্যুষিত সব রাষ্ট্রের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নয়। ইসলামিক স্টেটের মতো কট্টর গ্রুপ এখনো খিলাফতের স্বপ্ন দেখে, তারা শুধু কোনো জীবনবিধানই প্রচার করে না, তারা একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিই প্রচার করে। কিসিঞ্জারের দৃষ্টিতে বিশ্বব্যবস্থার নানা রূপ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, এশিয়াজুড়েই গড়ে উঠছে। চীন আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে চললেও তারা অন্যদের চেয়ে যে একটু ভিন্ন, সে কথাটা এখন ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিতে চায়। আইনের চোখে সবাই সমান, কিন্তু তারা একটু বেশি, যেটা যুক্তরাষ্ট্রও মনে করে। চীন ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে, তারা এশিয়ায় নিজেদের ঐতিহাসিক অবস্থান পুনরুদ্ধারের পথে নেমেছে। ফলে কিছুদিনের মধ্যে হয়তো দেখা যাবে, তারাও আন্তর্জাতিক আইন বদলের কথা বলছে। রাশিয়া তো প্রকাশ্যেই আইন লঙ্ঘন করছে, এমনকি আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় তারা নিজেদের অবস্থানের যৌক্তিকতা বিধানেরও চেষ্টা করছে না। উল্টো তারা সোভিয়েত আমলের ভূমি পুনরুদ্ধার করে গৌরব বোধ করছে, আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত রুশদের রক্ষায় বলপ্রয়োগের হুমকি দিচ্ছে।
এ বছরের মার্চে রাশিয়া ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ করেছে। এর আগে ২০০৮ সালে তারা জর্জিয়াতেও আগ্রাসন চালিয়েছিল। তবে এ দুই ক্ষেত্রে রাশিয়ার আচরণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে বলে মনে করেন ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের কাদরি লিক। জর্জিয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া প্রথমে আক্রমণ করেনি, বরং তারা জর্জিয়াকে আক্রমণ করতে উসকানি দিয়েছে। তারপর এমন এক ব্যাখ্যা তারা দিয়েছে, যাতে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় তার কাজের যৌক্তিকতা প্রমাণ করা যায়। কাদরির কথায় এবার ‘মস্কো শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপীয় ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, একই সঙ্গে তার নিয়মনীতিও তছনছ করে দিয়েছে।’
কিসিঞ্জার আশা করেন, এই দেশগুলো এবং ভারত ও ব্রাজিলের মতো উদীয়মান শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে একটি মতৈক্যে পৌঁছাতে পারবে, যার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত বিশ্বে একটি স্থিতাবস্থা বজায় রাখা যাবে (তিনি এর মধ্যে লাতিন আমেরিকা বাদ দিয়েছেন)। বহুত্বের এই ওয়েস্টফালীয় নীতি সমালোচনার মুখে পড়বে, কারণ বিভিন্ন দেশ ও সভ্যতাকে তাদের নিজস্ব নীতিতে চলতে দেওয়া দরকার।
২১ শতকের একটি কার্যকর বিশ্বব্যবস্থার কাজ শুধু শান্তি রক্ষাই নয়, তাকে এর চেয়ে বেশি কিছু করতে হবে। কিসিঞ্জার আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে জোর দিয়েছেন, অর্থাৎ একটি দেশ কীভাবে অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে পারে। আবার কোনো আগ্রাসী শক্তি যাতে আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট করতে না পারে, সে চেষ্টাও জারি রাখতে হবে। আজ পত্রিকার শিরোনামে চোখ বুলালে দেখা যায়, আগামী দিনগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসী ও অপরাধী নেটওয়ার্কের মতো কারণে লাখ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে, যদি সে সংখ্যাটা কোটির কোঠায় নাও যায়। মোদ্দা কথা হচ্ছে, আন্তরাষ্ট্রীয় যুদ্ধের চেয়ে এসবই এখন প্রাণহানির প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে।
তবে ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার আগ্রাসনে তিন হাজার ৮০০-এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। আর ইবোলা এখন যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে সামনের জানুয়ারির মধ্যে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এইচআইভি/এইডস রোগে বিশ্বে ৩৬ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা এর চেয়ে ১০ মিলিয়ন কম, আর এ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আরও ৩৫ মিলিয়ন মানুষ।
এসব হুমকির অধিকাংশের সঙ্গেই যুদ্ধের সম্পর্ক আছে। কিন্তু এই যুদ্ধ এখন নিজ দেশের মধ্যেই হবে, মানে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হওয়ার চেয়ে এক রাষ্ট্রের মধ্যে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোরই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি। যেমন: সিরিয়ার কথাই ভাবুন, সেখানকার গৃহযুদ্ধে দেশটির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আরও লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী শিবিরে অসহায় জীবন যাপন করছে। লিবিয়া ও সিয়েরা লিওনে স্বাস্থ্যসেবার যে করুণ দশা, আর সে কারণে ইবোলা যে পরিমাণে ছড়িয়ে পড়ছে, তা আমাদের গৃহযুদ্ধের কথাই মনে করিয়ে দেয়। আফ্রিকার গ্রেট লেক অঞ্চলে চলমান সহিংসতায় লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে, ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যাই এর মূল কারণ। সে কারণে হুতু জনগোষ্ঠী বানের জলের মতো ভেসে গিয়ে আশপাশের দেশগুলোয় আশ্রয় নিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট খরা ও বন্যার কারণে লাখ লাখ মানুষ এখন দৌড়ের ওপর আছে। তারা জনবহুল শহরগুলোয় আশ্রয় নিতে বা সীমান্ত পাড়ি দিতেও বাধ্য হচ্ছে। রাশিয়া ও কানাডার বিপুল পরিমাণ ভূমি খালি পড়ে আছে, ফলে তারা এসব মানুষকে আশ্রয় দিতে পারে। কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলো তাদের আশ্রয় দিতে পারে না। এতে সেসব দেশে একধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে।
শান্তি বজায় রাখার ব্যাপারটা আসলে সংযমের, আবার এর মধ্যে একধরনের চাপ প্রয়োগের ব্যাপার আছে। বৈশ্বিক পরিসরে কার্যকর সহযোগিতার জন্য আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন। সব দেশের সরকারের উচিত একত্রে বসা, সঙ্গে নিতে হবে সুশীল সমাজ ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে। তাদের একত্রে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
পক্ষান্তরে, এরূপ পরিকল্পনা নেওয়া হলে তাতে তহবিল ও জনশক্তি থাকতে হবে। প্রয়োজন হবে সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি ও প্রয়োগক্ষমতার। আজ দুনিয়া ইবোলার মতো মহামারিতে আক্রান্ত হয়েও প্রয়োজনীয় অর্থ ও বস্তুগত সহায়তার বন্দোবস্ত করতে পারেনি। এই মহামারিতে আক্রান্ত অর্ধেক মানুষ মারা যেতে পারে, যা আফ্রিকার একটি অংশ ধ্বংস করে দিতে পারে, দুনিয়ার বিমান যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা বেষ্টনীতে ঠেলে দিতে পারে— অথচ সে বিষয়ে এখনো আমরা যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারিনি।
আমাদের দুনিয়ার সমস্যাগুলোর ধরন বৈশ্বিক, কিন্তু এগুলোর সমাধান মূলত জাতীয় প্রকৃতির। আমাদের এমন কিছু প্রতিষ্ঠান দরকার, যেগুলো কার্যকরভাবে খুব দ্রুততার সঙ্গে বিভিন্ন প্রয়োজনে সাড়া দিতে পারে। সুশাসন আছে—এমন দেশের কোনো আঞ্চলিক সরকার যা করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সময় এসেছে, এগুলোর সংস্কার করতে হবে। বিশ্বের সমস্যা মোকাবিলায় নতুন নতুন হাতিয়ার তৈরি করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
আন-মেরি স্লটার: যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের পলিসি প্ল্যানিংয়ের সাবেক পরিচালক।
No comments