ভোগ নয়, ত্যাগই ছিল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ by ড. মাহবুব উল্লাহ্
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বীরের রক্তস্রোত এবং মায়ের অশ্র“ধারায় রচিত হয়েছে গৌরবের এ ইতিহাস। এ ব্যাপারে কোনো দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী দ্বিমত পোষণ করবেন না। শত রাজনৈতিক বিভেদ ও অনৈক্যের মধ্যেও এটি আমাদের জাতীয় ঐক্যের সূত্র। এই ঐক্যের সূত্র যতদিন মজবুত থাকবে, ততদিন কোনো শত্র“র পক্ষেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির ক্ষতিসাধন করা সম্ভব হবে না। সুতরাং দলমত নির্বিশেষে আমাদের সবার সম্মিলিত শপথ হল এই সূত্রকে আমরা কখনোই দুর্বল করে ফেলতে দেব না।
দেখতে দেখতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স ৪৩ বছর হয়ে গেল। ৪৩ বছরের সময়কালটি স্থিত হওয়ার সময়। সময়ের পরিমাপে ৪৩ বছর খুব দীর্ঘ না হলেও নাতিদীর্ঘ নয়। এই সময়ে অনেক বিষয় সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি গভীর থেকে গভীরতর হওয়ার কথা। প্রশ্ন হল, আমরা আমাদের উপলব্ধিকে কতটুকু গভীর করতে পেরেছি? সময়ের ব্যবধানে মানুষের প্রজ্ঞা বৃদ্ধি পায়। প্রশ্ন হল, প্রজ্ঞার ক্ষেত্রেই বা আমাদের অর্জন কতটুকু উল্লেখ করার মতো? এতদিনে আমাদের জাতীয় রাজনীতি ও জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে পরিপক্বতা অর্জন করার কথা। আসলে কি আমরা পরিপক্ব হয়েছি? চারদিকে যেসব ঘটনা ঘটছে এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যেসব উক্তি করছেন, সেগুলো দেখে ও শুনে মনে হয় না গত ৪৩ বছরে আমাদের জাতীয় জীবনে যেসব ইতিবাচক অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল তা হয়েছে। ইতিবাচক অগ্রগতি না হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। জাতীয় ঐক্যের জন্যও ক্ষতিকারক। তবুও বলতে চাই, এই হতাশার মেঘ কেটে যাবে এবং আমরা রোদ্রকরোজ্জ্বল আলোকিত দিনের দেখা পাব। জাতি হিসেবে আমরা শক্তি, শৌর্য ও সাহস অর্জন করব। নৈরাশ্যবাদিতাকে পরিহার করতে চাই এ কারণে যে, নৈরাশ্যবাদিতা আমাদের উদ্যোগবিমুখ করে তুলবে, সামনে এগোতে দেবে না। অন্যদিকে আশাবাদ ও ইতিবাচক ভাবনা আমাদের এগিয়ে যেতে দেবে প্রেরণা।
মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরিতে গত ৪৩ বছরে প্রচুর বিশৃংখলা ও বিভ্রান্তি ঘটেছে। এই বিশৃংখলা ও বিভ্রান্তির মূলে রয়েছে স্বার্থপরতা, বিশেষ করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের কূটকৌশল। অথচ এ ব্যাপারটি কারও স্বার্থের বলি হোক এটা কাম্য ছিল না। কারণ বিষয়টি অত্যন্ত পবিত্র এবং সব ধরনের স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত। পৃথিবীর অনেক দেশেই সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম হয়েছে, হয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। সব দেশেই এই যোদ্ধারা জাতীয় অহংকার। তাদের ত্যাগের মহিমা এতই উজ্জ্বল, এতই দেদীপ্যমান যে কালের প্রবাহে এই আলোকছটা নিষ্প্রভ হয়ে যায়নি। জানি না, আত্মঘাতী জাতি বলেই কিনা আমরা সামনে এগোনোর এই আলোকবর্তিকাকে নির্বিচারে ধ্বংস করেছি। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, যেভাবে যে অবস্থায় করুন না কেন, যুদ্ধে যাওয়ার পেছনে তাদের কোনো বৈষয়িক প্রাপ্তির আশা ছিল না। বরং তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন। তাদের এই ত্যাগের মহিমার সঙ্গে যখন বৈষয়িক প্রাপ্তির কালিমা যুক্ত হল, তখন থেকেই তাদের মহান ব্রতকে আমরা খুবই ছোট করে দেখলাম। মুক্তিযুদ্ধটা আদর্শিক হলেও যুদ্ধ শেষ হলে দেখা গেল ত্যাগের মহিমার চেয়ে প্রাপ্তিযোগই প্রাধান্য অর্জন করেছে। এই প্রাপ্তিযোগের মধ্যে অনেক কিছুই আছে- কিছু সঙ্গত, কিছু অসঙ্গত। মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে অবৈষয়িক কিছু পেতেই পারেন। রাষ্ট্রের কর্তব্য হল তাদের বীরত্ব ও ত্যাগকে স্বীকৃতি দেয়া এবং সম্মানিত করা। সেই বিচারে কাউকে কাউকে সম্মান ও খেতাব দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে, যা খুবই সঙ্গত ছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের যেসব যোদ্ধা নাৎসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন, তাদের সম্মানসূচক মেডেল দেয়া হয়েছিল। এই মেডেলকে যোদ্ধারা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করেছেন, যাতে তাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা এটি দেখে গর্ব করতে পারে। এসব যোদ্ধার মধ্যে আজও যারা বেঁচে আছেন, তারা যুদ্ধজয়ের দিবসে ওয়ার ভেটার্ন হিসেবে প্রতিবছর আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান পান। বাংলাদেশেও অনুরূপ কিছু হলে যথার্থ হতো। কিন্তু রাজনৈতিক কিংবা দলীয় স্বার্থপরতার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবৈষয়িক সম্মান প্রদর্শনের বাইরে বিষয়টিকে বৈষয়িকতার দিকে এতটাই প্রলম্বিত করা হয়েছে যে, এখন পুরো বিষয়টি বিতর্কিত এবং দুর্নীতির ঘ্রাণযুক্ত হয়ে পড়েছে। বৈষয়িকতা যোগ করার ফলেই সচিব কিংবা সচিব পর্যায়ের ব্যক্তিরা মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধা সেজে বসেন এবং তদসম্পর্কিত বৈষয়িক সুবিধাগুলো নেয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক ব্যাপারেই বৈষয়িক স্বার্থের ওপরে উঠতে পারি না। কিন্তু জাতীয় জীবনে এমন কিছু বিষয় আছে যার সঙ্গে বৈষয়িক বিবেচনা যুক্ত হলে তার আসল মূল্যটিই হারিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় চেতনার অঙ্গীভূত একটি বিষয়। অর্থ-সম্পদের বিনিময়ে এর মূল্য নির্ধারিত হতে পারে না। অথচ পুরো বিষয়টিকে এতই হালকা ও ঠুনকো করে ফেলা হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্য দাঁড়াচ্ছে অতিরিক্ত সময়ের জন্য চাকরি করা কিংবা চাকরি পাওয়ার সুযোগ। প্রশ্ন দাঁড়ায়, যারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য বৈশিষ্ট্যকে মূল্যহীন করে ফেলছেন কি-না? হ্যাঁ, এটি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত যে, যেসব মুক্তিযোদ্ধা দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত তাদের প্রতি রাষ্ট্রের একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে। তাদের জীবনযাপনকে মসৃণ করে তোলা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু দলীয় কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে কোনো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে এই সুযোগ দিলে সেটা হবে সে ফ দুর্নীতি। রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর একটি কৌশল। সে কারণেই প্রতিক্রিয়াটি হতে হবে অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নৈর্ব্যক্তিক।
সাম্প্রতিককালে আরও একটি বিষয় নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। একে একে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে বলা হচ্ছে পাকিস্তানের চর। মেজর জলিল অনেক আগেই কক্ষচ্যুত বলে ঘোষিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকার একটি বই লিখে অপাঙক্তেয় ঘোষিত হয়েছেন। মীর শওকত আলী বিএনপির রাজনীতি করার দায়ে অনাদৃত হয়ে পড়েছিলেন। কর্নেল নূরুজ্জামান অনেক আগেই আলোচনার বাইরে চলে গেছেন। জেনারেল (অব.) হারুন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। জেনারেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন কি-না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। তাহলে রইলটা কী? মুক্তিযুদ্ধের মিত্রদেশ ভারতের অনেক মহল থেকেই একাধিকবার বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতই এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের চোখে মহাকাব্যের উর্মিলার মতো উপেক্ষিত। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসটি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে পালিত হয় ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড ডে হিসেবে। এই প্রশ্ন উত্থাপন করায় একজন বহুল পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা আমাকে জানিয়েছেন, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের ফলে গত বছর দুয়েক ধরে ভারত নাকি এভাবে ইস্টার্ন কমান্ড ডে পালন করছে না। তার দাবি যদি সত্যও হয়, তাহলে বলতে হবে ভারত গোড়া থেকে অনেক বছর ধরেই এভাবে দিবসটিকে দেখেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার গৌরবটি অনেকাংশেই ভারতের। প্রকৃত সত্য হল, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যদি যুদ্ধ না করত, আত্মাহুতি না দিত এবং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রগাঢ় সংহতিবোধ না থাকত তাহলে ভারতীয় সেনাদের পক্ষে এককভাবে বাংলাদেশে কোনো সাফল্য অর্জন সম্ভব হতো না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে চিত্রিত করার একটি প্রয়াস আছে। পাশ্চাত্যের অনেক পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব বিষয়টিকে এভাবেই দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু তারা বুঝতে চান না যে, বস্তুর পরিবর্তন হয় বস্তুর অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের কারণে। বাংলাদেশের মানুষ নিছক আত্মসংরক্ষণের তাগিদ থেকেই মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের এই তাগিদ না থাকলে কোনো দিনই কোনো বহিঃশক্তি বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে পারত না। এখন যখন দেখি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছেন কিংবা তাদের প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, তখন ভাবতে হয় এর ফলে কাদের দাবি প্রতিষ্ঠিত হবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের গর্ব কোথায় হারিয়ে যাবে?
ড. মাহবুব উল্লাহ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
দেখতে দেখতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স ৪৩ বছর হয়ে গেল। ৪৩ বছরের সময়কালটি স্থিত হওয়ার সময়। সময়ের পরিমাপে ৪৩ বছর খুব দীর্ঘ না হলেও নাতিদীর্ঘ নয়। এই সময়ে অনেক বিষয় সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি গভীর থেকে গভীরতর হওয়ার কথা। প্রশ্ন হল, আমরা আমাদের উপলব্ধিকে কতটুকু গভীর করতে পেরেছি? সময়ের ব্যবধানে মানুষের প্রজ্ঞা বৃদ্ধি পায়। প্রশ্ন হল, প্রজ্ঞার ক্ষেত্রেই বা আমাদের অর্জন কতটুকু উল্লেখ করার মতো? এতদিনে আমাদের জাতীয় রাজনীতি ও জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে পরিপক্বতা অর্জন করার কথা। আসলে কি আমরা পরিপক্ব হয়েছি? চারদিকে যেসব ঘটনা ঘটছে এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যেসব উক্তি করছেন, সেগুলো দেখে ও শুনে মনে হয় না গত ৪৩ বছরে আমাদের জাতীয় জীবনে যেসব ইতিবাচক অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল তা হয়েছে। ইতিবাচক অগ্রগতি না হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। জাতীয় ঐক্যের জন্যও ক্ষতিকারক। তবুও বলতে চাই, এই হতাশার মেঘ কেটে যাবে এবং আমরা রোদ্রকরোজ্জ্বল আলোকিত দিনের দেখা পাব। জাতি হিসেবে আমরা শক্তি, শৌর্য ও সাহস অর্জন করব। নৈরাশ্যবাদিতাকে পরিহার করতে চাই এ কারণে যে, নৈরাশ্যবাদিতা আমাদের উদ্যোগবিমুখ করে তুলবে, সামনে এগোতে দেবে না। অন্যদিকে আশাবাদ ও ইতিবাচক ভাবনা আমাদের এগিয়ে যেতে দেবে প্রেরণা।
মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরিতে গত ৪৩ বছরে প্রচুর বিশৃংখলা ও বিভ্রান্তি ঘটেছে। এই বিশৃংখলা ও বিভ্রান্তির মূলে রয়েছে স্বার্থপরতা, বিশেষ করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের কূটকৌশল। অথচ এ ব্যাপারটি কারও স্বার্থের বলি হোক এটা কাম্য ছিল না। কারণ বিষয়টি অত্যন্ত পবিত্র এবং সব ধরনের স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত। পৃথিবীর অনেক দেশেই সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম হয়েছে, হয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। সব দেশেই এই যোদ্ধারা জাতীয় অহংকার। তাদের ত্যাগের মহিমা এতই উজ্জ্বল, এতই দেদীপ্যমান যে কালের প্রবাহে এই আলোকছটা নিষ্প্রভ হয়ে যায়নি। জানি না, আত্মঘাতী জাতি বলেই কিনা আমরা সামনে এগোনোর এই আলোকবর্তিকাকে নির্বিচারে ধ্বংস করেছি। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, যেভাবে যে অবস্থায় করুন না কেন, যুদ্ধে যাওয়ার পেছনে তাদের কোনো বৈষয়িক প্রাপ্তির আশা ছিল না। বরং তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন। তাদের এই ত্যাগের মহিমার সঙ্গে যখন বৈষয়িক প্রাপ্তির কালিমা যুক্ত হল, তখন থেকেই তাদের মহান ব্রতকে আমরা খুবই ছোট করে দেখলাম। মুক্তিযুদ্ধটা আদর্শিক হলেও যুদ্ধ শেষ হলে দেখা গেল ত্যাগের মহিমার চেয়ে প্রাপ্তিযোগই প্রাধান্য অর্জন করেছে। এই প্রাপ্তিযোগের মধ্যে অনেক কিছুই আছে- কিছু সঙ্গত, কিছু অসঙ্গত। মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে অবৈষয়িক কিছু পেতেই পারেন। রাষ্ট্রের কর্তব্য হল তাদের বীরত্ব ও ত্যাগকে স্বীকৃতি দেয়া এবং সম্মানিত করা। সেই বিচারে কাউকে কাউকে সম্মান ও খেতাব দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে, যা খুবই সঙ্গত ছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের যেসব যোদ্ধা নাৎসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন, তাদের সম্মানসূচক মেডেল দেয়া হয়েছিল। এই মেডেলকে যোদ্ধারা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করেছেন, যাতে তাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা এটি দেখে গর্ব করতে পারে। এসব যোদ্ধার মধ্যে আজও যারা বেঁচে আছেন, তারা যুদ্ধজয়ের দিবসে ওয়ার ভেটার্ন হিসেবে প্রতিবছর আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান পান। বাংলাদেশেও অনুরূপ কিছু হলে যথার্থ হতো। কিন্তু রাজনৈতিক কিংবা দলীয় স্বার্থপরতার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবৈষয়িক সম্মান প্রদর্শনের বাইরে বিষয়টিকে বৈষয়িকতার দিকে এতটাই প্রলম্বিত করা হয়েছে যে, এখন পুরো বিষয়টি বিতর্কিত এবং দুর্নীতির ঘ্রাণযুক্ত হয়ে পড়েছে। বৈষয়িকতা যোগ করার ফলেই সচিব কিংবা সচিব পর্যায়ের ব্যক্তিরা মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধা সেজে বসেন এবং তদসম্পর্কিত বৈষয়িক সুবিধাগুলো নেয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক ব্যাপারেই বৈষয়িক স্বার্থের ওপরে উঠতে পারি না। কিন্তু জাতীয় জীবনে এমন কিছু বিষয় আছে যার সঙ্গে বৈষয়িক বিবেচনা যুক্ত হলে তার আসল মূল্যটিই হারিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় চেতনার অঙ্গীভূত একটি বিষয়। অর্থ-সম্পদের বিনিময়ে এর মূল্য নির্ধারিত হতে পারে না। অথচ পুরো বিষয়টিকে এতই হালকা ও ঠুনকো করে ফেলা হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্য দাঁড়াচ্ছে অতিরিক্ত সময়ের জন্য চাকরি করা কিংবা চাকরি পাওয়ার সুযোগ। প্রশ্ন দাঁড়ায়, যারা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য বৈশিষ্ট্যকে মূল্যহীন করে ফেলছেন কি-না? হ্যাঁ, এটি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত যে, যেসব মুক্তিযোদ্ধা দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত তাদের প্রতি রাষ্ট্রের একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে। তাদের জীবনযাপনকে মসৃণ করে তোলা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু দলীয় কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে কোনো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে এই সুযোগ দিলে সেটা হবে সে ফ দুর্নীতি। রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর একটি কৌশল। সে কারণেই প্রতিক্রিয়াটি হতে হবে অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নৈর্ব্যক্তিক।
সাম্প্রতিককালে আরও একটি বিষয় নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। একে একে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে বলা হচ্ছে পাকিস্তানের চর। মেজর জলিল অনেক আগেই কক্ষচ্যুত বলে ঘোষিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকার একটি বই লিখে অপাঙক্তেয় ঘোষিত হয়েছেন। মীর শওকত আলী বিএনপির রাজনীতি করার দায়ে অনাদৃত হয়ে পড়েছিলেন। কর্নেল নূরুজ্জামান অনেক আগেই আলোচনার বাইরে চলে গেছেন। জেনারেল (অব.) হারুন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। জেনারেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন কি-না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। তাহলে রইলটা কী? মুক্তিযুদ্ধের মিত্রদেশ ভারতের অনেক মহল থেকেই একাধিকবার বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতই এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের চোখে মহাকাব্যের উর্মিলার মতো উপেক্ষিত। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসটি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে পালিত হয় ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড ডে হিসেবে। এই প্রশ্ন উত্থাপন করায় একজন বহুল পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা আমাকে জানিয়েছেন, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের ফলে গত বছর দুয়েক ধরে ভারত নাকি এভাবে ইস্টার্ন কমান্ড ডে পালন করছে না। তার দাবি যদি সত্যও হয়, তাহলে বলতে হবে ভারত গোড়া থেকে অনেক বছর ধরেই এভাবে দিবসটিকে দেখেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার গৌরবটি অনেকাংশেই ভারতের। প্রকৃত সত্য হল, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যদি যুদ্ধ না করত, আত্মাহুতি না দিত এবং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রগাঢ় সংহতিবোধ না থাকত তাহলে ভারতীয় সেনাদের পক্ষে এককভাবে বাংলাদেশে কোনো সাফল্য অর্জন সম্ভব হতো না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলে চিত্রিত করার একটি প্রয়াস আছে। পাশ্চাত্যের অনেক পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব বিষয়টিকে এভাবেই দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু তারা বুঝতে চান না যে, বস্তুর পরিবর্তন হয় বস্তুর অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের কারণে। বাংলাদেশের মানুষ নিছক আত্মসংরক্ষণের তাগিদ থেকেই মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের এই তাগিদ না থাকলে কোনো দিনই কোনো বহিঃশক্তি বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে পারত না। এখন যখন দেখি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছেন কিংবা তাদের প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, তখন ভাবতে হয় এর ফলে কাদের দাবি প্রতিষ্ঠিত হবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের গর্ব কোথায় হারিয়ে যাবে?
ড. মাহবুব উল্লাহ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
No comments