ভিয়েতনামের চেয়ে আফগানিস্তানের পরাজয় বড় কেন
১৩ বছরের আফগান যুদ্ধের যবনিকা টেনে শেষ পর্যন্ত বিদেশি সৈন্য গুটিয়ে নেয়া হলো। লেদারনেক ও বেশন ক্যাম্প থেকে আমেরিকান ও বৃটিশ সৈন্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ক্যাম্প দু’টির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আফগান সেনাদের। এর মধ্য দিয়ে বৃটিশরা পুরোপুরি চলে গেল। আমেরিকার সম্পৃক্ততাও শেষ হতে চললো। সেপ্টেম্বরে আমেরিকা-আফগান দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের পর ১২ হাজার আমেরিকান ও ন্যাটো সৈন্য থাকবে আফগানিস্তানে। যদিও এর মাধ্যমে আফগানিস্তানে আমেরিকার সম্পৃক্ততার চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটছে না, কিন্তু এতে দেশটি নিরাপত্তার বিষয়ে বিদেশিদের হাত থেকে আফগানদের কাছে হস্তান্তরিত হলো। যুদ্ধ শেষ, রয়ে গেছে তালেবান ক্যাম্প বেসিন ও লেদারনেক ছিলো যুদ্ধের সময় যৌথবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি। আফগানিস্তানে সবচেয়ে বড় সামরিক স্থাপনা। এদের অবস্থান হেলমন্দ প্রদেশে। চরিত্রগত দিক থেকে এটি সবচেয়ে সংঘাতপূর্ণ একটি এলাকা। ২০০১ সালে যুদ্ধের পর থেকে হেলমন্দে অনেকগুলো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আর এসব সংঘর্ষে ৩৫০ মেরিন ও ৪৬০ বৃটিশ সেনা নিহত হন। ধারণা করা হয় ওই এলাকার বেশিরভাগই এখনো তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে। আমরিকার নৌসেনা বৃটিশ সেনাদের জীবন বাঁচাতে অতি গোপনে প্রত্যাহারের বিষয়টি সম্পন্ন করা হয়। এখন তালেবানদের নৃশংসতা থেকে রক্ষার দায়িত্ব আফগান সৈন্যদেরই। ব্যর্থতার নাম আফগানিস্তান আফগান যুদ্ধ ছিল আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘতম যুদ্ধ। এবং একই সঙ্গে একটি ভয়াবহ ব্যর্থতা। এই যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানকে তালেবান ও আয় কায়েদা মুক্ত করা। কিন্তু এ দু’টি শক্তি এখনো আফগানিস্তানে বহাল তবিয়তে রয়েছে। এটা সত্য আগ্রাসনের শুরুতে তালেবানরা ক্ষমতাচ্যুত হয়। তবে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্ম দেয়। এ যুদ্ধ তালেবানদের শক্তি জোগায় এবং জনগণকে তাদের দিকে টেনে নেয়ার সুযোগ তৈরি করে। মার্কিন বিদেশনীতির একটি নোটে বলা হয়, যুদ্ধের ১৩ বছর পরেও তালেবানরা আফগানিস্তানের একটি শক্তিশালী ফোর্স। আর আমেরিকা সুমালিয়া, ইরাক ও সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ইসলামী চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেই লিপ্ত। মোদ্দাকথা হলো, এই যুদ্ধ নির্মূলের পরিবর্তে অনেক বেশি সন্ত্রাসীর জন্ম দিয়েছে। হেলমন্দ প্রদেশের অনেকেই মনে করেন তালেবানরা আগে এত শক্তিশালী ছিল না। এছাড়া তালেবানরা মনে করে আমেরিকা ও বৃটিশদের হাত গুটিয়ে নেয়া তাদের জন্য বিরাট বিজয়। ঐতিহাসিকরা প্রায়শই ভিয়েতনাম যুদ্ধকে সত্যিকার অর্থে আমেরিকার প্রথম পরাজয় হিসেবে বিবেচনা করেন। তাদের এই ধারণা ভুল নয়। একই সঙ্গে বর্তমানে আফগানিস্তানে পরাজয়টাও অনেক বড়। এই যুদ্ধ নিয়ে শেষ মন্তব্য করার সময় হয়তো এখনো আসেনি- এমনটা মনে করা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বহু আগেই এই যুদ্ধে আমেরিকা-বৃটিশরা পরাজয় বরণ করে বসে আছে। সম্ভবত শুরুতেই। আফগান যুদ্ধ ভিয়েতনামের চেয়েও ভয়াবহ ভিয়েতনাম যুদ্ধের সূত্রপাত করা হয়েছিল সমাজতন্ত্র ঠেকাতে। আমেরিকার এই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ভিয়েতনাম থেকে চলে যেতে বাধ্য হয় আমেরিকা। এ কারণে ওই সংঘাতকে পরাজয় হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। যদিওবা এ কথা সত্য যে, ভিয়েতনামে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখানে তারা পরাজয় বরণ করে। সারকথা হলো, ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা সামরিক বিজয় অর্জন করলেও রাজনৈতিকভাবে হেরে যায়। আমেরিকা এই যুদ্ধে জনসমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়। আর এর জন্য আমেরিকাকে চরম মূল্য দিতে হয় অনেক বেশি। একই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সমাজতন্ত্র আমেরিকার জন্য কখনোই গুরুত্বপূর্ণ হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়নি। যখনই পরাজয় সম্পর্কে আমেরিকা নিশ্চিত হয়, তখনই ভিয়েতনাম থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। অন্যদিকে আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে আমেরিকা কাল্পনিক সাফল্যের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মারা যায় প্রায় ৬০ হাজার আমেরিকান। গোটা যুদ্ধে নিহত হয় ৩০ লাখ মানুষ। পরিসংখ্যান দিক থেকে আফগানিস্তানের সঙ্গে তুলনা চলে না, আফগানিস্তানে মারা যায় ২৩৪৯ মার্কিন সৈন্য। তবে এটিও সত্য যে, যেকোনো মানুষের মৃত্যুই বিয়োগান্তক, বিশেষ করে যারা নিজের দেশ রক্ষায় প্রাণ দেয়। যে কারণে আফগান যুদ্ধকে ভিয়েতনামের চেয়ে ভয়াবহতম বলা হচ্ছে তাহলো- এটির পরিণতি হলো আমেরিকানরা কেউ আর নিরাপদ নয়। নিউইয়র্ক টাইমসের রবার্ট রাইটের মতে, “ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল মানবিক বিপর্যয়ের দিক থেকে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক এবং কৌশলগতভাবে এটা ছিল মাঝারি গোছের বিপর্যয়। এটি ছিল সম্পদের অপচয়। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধ আমেরিকাকে শত্রুর আক্রমণের টার্গেটে পরিণত করে, যেটি আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক উল্টো। আল কায়েদা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তাদের সহযোদ্ধাদের এ কথা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, আমেরিকা মূলত ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। আমরা সন্ত্রাসীদের নির্মূলের চেয়েও দ্রুতগতিতে তাদের জন্ম দিচ্ছি। যুদ্ধ শেষ হবার পরও এই শত্রুরা আমেরিকানদের হত্যা থেকে নিবৃত্ত হয়নি, যেটি ভিয়েতকংরা করেছিল।” ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট শাসকরা তাদের দেশকে আমেরিকার বিরুদ্ধে আক্রমণের মঞ্চ বানানোর কোনো মানসিকতা দেখায়নি। বিপরীত দিকে তালেবান ও অন্য সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো যখন আফগানিস্তানে আসে তখন তাদের মধ্যে ভিন্ন উদ্দেশ্য দৃশ্যমান হয়। তাদের সার্বক্ষণিক জব হলো ‘ধ্বংস হোক আমেরিকা’। সহজ ভাষায় বলতে গেলে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মূরত চরমপন্থীদের রিক্রুটের পোস্টার হিসেবে কাজ করেছে। ফলে তালেবানরা আরো সক্রিয় ও শক্তিশালী হয়েছে। এখনো সন্ত্রাসবাদ আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের জন্য মূর্তিমান হুমকি। যুদ্ধের মাশুল বেশিরভাগ আমেরিকানদের মতোই আফগান যুদ্ধ ফেরতদের মত হল- খরচের বিষয়টি মূলত বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে আমেরিকার ব্যয় হয়েছে ৪০০ বিলিয়ন ডলার। আফগান যুদ্ধে আমেরিকা যে ব্যয় করেছে তার সবকিছু শেষ হয়েছে মূলত অস্ত্র কেনা ও তালেবানদের পেছনে। আইএস যোদ্ধারা ব্যাপক এলাকা নিজেদের দখলে নেয়ার পর ইরাক এখন একটি বিপর্যয়ের নাম। একই সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর সময় ১৩ বছর আগে আফগানিস্তানে যতটুকু নিরাপত্তা ছিল, এখন ততটুকুও নেই। আফগান যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে আমেরিকা এখন কঠিনভাবে ভাবতে শুরু করেছে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রক্রিয়ায় হয়তো আমেরিকা ব্যয়বহুল, বিপর্যয়কর ও অর্থহীন যুদ্ধ এড়ানোর শিক্ষা নেবে। জন হ্যাটিওয়েঙনার: আমেরিকার এলিট ডেইলি পত্রিকার রাজনৈতিক ভাষ্যকার।
No comments