প্রজ্বলিত মঙ্গলালোক by আবুল হায়াত
‘আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি
আলোর ঢেউয়ে উঠল নেচে মল্লিকা মালতী।’
শুধুই কি মল্লিকা-মালতীরা নেচে ওঠে? আর প্রজাপতিই বুঝি একা স্রোতে পাল তোলে? আমরাও তো ওদের সঙ্গে সঙ্গে স্রোতে ভাসি আনন্দে, নেচে-গেয়ে উঠি আলোর ঝলকানিতে। ভুবনভরা আলোয় আবেগাপ্লুত হই আমরাও। কবিগুরুর ধার করা বাণীই বলছি, ‘আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন–ভরা,/ আলো নয়ন–ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়–হরা।।’
অন্ধকার ছিল বলেই তো আলো। আলো চলে গেলেই আবার অন্ধকার। শুরুকে যদি বলি আলো, তো শেষই আঁধার। আলোর কদর অন্ধকারের জন্য।
শরৎচন্দ্রের সেই আঁধারের রূপ পড়েছিলাম ক্লাস টেনে পড়ার সময়। মানে তখন কত দূর কী উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, বলা কঠিন। তবে পরবর্তী সময়ে অনেক মুহূর্তেই মনে যে ঝিলিক দিয়ে যায়নি সেই কথাগুলো, তা হলফ করে বলতে পারব না। শ্রীকান্ত অন্ধকার রাতে শ্মশানে একাকী বসে অন্ধকারের যে রূপ আবিষ্কার, তথা অনুভব করতে পেরেছিল, তা নিশ্চয় ছিল প্রকৃতির কাছে তার নীরব, নিঃশব্দ, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ফল।
এ নিশ্চয় কোনো সহজলভ্য বস্তু নয়। লেখক নিজের জীবনের উপলব্ধিটাই যে শ্রীকান্তের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন, তাতেও সন্দেহের অবকাশ নেই। তিনি আমাদের অন্ধকারকে চিনিয়েছেন।
মৃত্যুকে আমরা বলি অন্ধকারের পথে যাত্রা, যে অন্ধকারের ঠিক-ঠিকানা আজও অনাবিষ্কৃত। মৃত্যু যদি হয় অন্ধকারযাত্রা, তাহলে জন্ম নিশ্চয় আলোকযাত্রা। একটি প্রাণ যখন মাতৃজঠর থেকে উদ্গত হয় বা ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে, সে অন্ধকার ভেদ করে আসে আলোয়। আলোয় ভরা ভুবনে। হয়ে ওঠে চঞ্চল। আবেগে আপ্লুত। কেউ চিৎকার করে জানান দেয় আলো দেখার অনুভূতি (কেউ কিচিরমিচির করে; কেউ-বা করে ছটফট, ছোটাছুটি। মহোৎসব করে নিজে নিজে)।
আলোর ঢেউয়ে উঠল নেচে মল্লিকা মালতী।’
শুধুই কি মল্লিকা-মালতীরা নেচে ওঠে? আর প্রজাপতিই বুঝি একা স্রোতে পাল তোলে? আমরাও তো ওদের সঙ্গে সঙ্গে স্রোতে ভাসি আনন্দে, নেচে-গেয়ে উঠি আলোর ঝলকানিতে। ভুবনভরা আলোয় আবেগাপ্লুত হই আমরাও। কবিগুরুর ধার করা বাণীই বলছি, ‘আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন–ভরা,/ আলো নয়ন–ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়–হরা।।’
অন্ধকার ছিল বলেই তো আলো। আলো চলে গেলেই আবার অন্ধকার। শুরুকে যদি বলি আলো, তো শেষই আঁধার। আলোর কদর অন্ধকারের জন্য।
শরৎচন্দ্রের সেই আঁধারের রূপ পড়েছিলাম ক্লাস টেনে পড়ার সময়। মানে তখন কত দূর কী উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, বলা কঠিন। তবে পরবর্তী সময়ে অনেক মুহূর্তেই মনে যে ঝিলিক দিয়ে যায়নি সেই কথাগুলো, তা হলফ করে বলতে পারব না। শ্রীকান্ত অন্ধকার রাতে শ্মশানে একাকী বসে অন্ধকারের যে রূপ আবিষ্কার, তথা অনুভব করতে পেরেছিল, তা নিশ্চয় ছিল প্রকৃতির কাছে তার নীরব, নিঃশব্দ, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ফল।
এ নিশ্চয় কোনো সহজলভ্য বস্তু নয়। লেখক নিজের জীবনের উপলব্ধিটাই যে শ্রীকান্তের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন, তাতেও সন্দেহের অবকাশ নেই। তিনি আমাদের অন্ধকারকে চিনিয়েছেন।
মৃত্যুকে আমরা বলি অন্ধকারের পথে যাত্রা, যে অন্ধকারের ঠিক-ঠিকানা আজও অনাবিষ্কৃত। মৃত্যু যদি হয় অন্ধকারযাত্রা, তাহলে জন্ম নিশ্চয় আলোকযাত্রা। একটি প্রাণ যখন মাতৃজঠর থেকে উদ্গত হয় বা ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে, সে অন্ধকার ভেদ করে আসে আলোয়। আলোয় ভরা ভুবনে। হয়ে ওঠে চঞ্চল। আবেগে আপ্লুত। কেউ চিৎকার করে জানান দেয় আলো দেখার অনুভূতি (কেউ কিচিরমিচির করে; কেউ-বা করে ছটফট, ছোটাছুটি। মহোৎসব করে নিজে নিজে)।
আলো এমনই নাচানো নাচায় প্রাণিকুলকে।
এই একটি মুহূর্ত, যখন একটি প্রাণ আলোর স্পর্শ পায়। সেই মুহূর্তটি হয়ে ওঠে অবিস্মরণীয়। সেই ব্রহ্মমুহূর্তটিই জন্মমুহূর্ত। এই মুহূর্তের আলোটিকেই আমরা বলতে পারি প্রথম আলো। নয় কি?
আবার দিনের শুরুতেই যে আলো সর্বপ্রথম ছুঁয়ে ফেলে পৃথিবীকে, সেও প্রথম আলো। জন্ম নেয় একটি নতুন দিন। বুড়িয়ে যায় পৃথিবী আরও একটু।
ভাগ্যিস, পৃথিবীর জন্মদিন পালন হয় না, নইলে বার্থডে কেকের ওপর কতগুলো যে মোমবাতি লাগাতে হতো! ইশ্, কল্পনা করাটাই পাকামি হবে।
তবে এটুকু বোধ করি, কল্পনা করতে দোষ নেই যে কেকের ওপর যাতে মোমবাতির বোঝা না বাড়ে, সে কারণেই ইদানীং এক মোমেই কাজ সারা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য তো বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমেই। মোমের দাম শেষ পর্যন্ত কেকের দাম ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই মানুষকে এখন এক মোমের দিকে ফিরিয়ে এনেছে। এ ছাড়া অবশ্যি আরেকটি কারণও অনুমেয় যে বেশি মোম জ্বালালে হয়তো ফুঁ দিয়ে নেভানো অসম্ভব হবে। ফলে ফায়ার সার্ভিস হায়ার করতে হবে। তাতেও তো টাকার শ্রাদ্ধ!
দুর্মুেখরা অবশ্য বলেন, নারীকুল বয়স প্রকাশে অনীহার কারণেই মোমবাতির সংখ্যা একে এসে ঠেকেছে।
একটা গল্প শোনেন, এক সুন্দরী লাস ভেগাসে জুয়া খেলতে গেছেন। খেলা তখন বেশ জমজমাট। তিনি ভাবছেন, কত নম্বর ঘরে বাজিটা ধরবেন। এক বয়স্ক ভদ্রলোক তাঁকে খেয়াল করছিলেন। তাঁর দেরি দেখে বললেন, ‘এত ভাবছেন কী? আপনার যত বয়স, তত নম্বর ঘরে বাজি ধরেন।’
সুন্দরীর মনে ধরল কথাটা। তিনি ২৪ নম্বর ঘরে বাজি ধরলেন। ঘুরল বোর্ডের চাকা। তিনি অপেক্ষা করছেন। তাঁর কাঁটা এসে থামল ৪২-এর ঘরে। অমনি তিনি মূর্ছা গেলেন। সব সময় বয়স ভাঁড়াতে নেই।
এবার একটা জন্মকাহিনি শুনুন। ভদ্রলোকের স্ত্রীর প্রসববেদনা উঠেছে প্রচণ্ড। ভেতরের সন্তানটি প্রথম আলো দর্শনে ব্যাকুল। তিনি হাসপাতালে ফোন করলেন—
‘এই ঠিকানায় একজন গর্ভবতী নারী প্রসববেদনায় ভীষণ ছটফট করছেন। এখনই দয়া করে একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো যাবে?’
‘এটা কি তাঁর প্রথম সন্তান?’
‘দূর মিঞা, এটা তাঁর হাজব্যান্ড।’
ওই যে প্রথম আলো দর্শনের কথা বলছিলাম, মানে জন্মদিন, ওই মুহূর্তকে আমরা স্মরণ করতে চাই। চাই বন্ধু, আত্মীয়, পরিজন—সবাই স্মরণ রাখুক। শুভেচ্ছা দিক। এতে যদিও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে আমি বুড়িয়েছি, তার পরও শুভেচ্ছা না পেলেই যেন বয়সটা বেশি মনে পড়ে। হারিয়ে যেতে বসে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।
দাম্পত্য জীবনে জন্মদিনের বেশ ভালো ভূমিকা আছে। মনোমালিন্য বা বাগ্বিতণ্ডা দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু স্ত্রীর জন্মদিন ভুলে যাওয়া মানে মহা প্রলয়। মনে রাখার উপায় অবশ্য একজন বাতলেছেন: ‘জীবনে একবার শুধু ভুলে যাবেন স্ত্রীর জন্মদিনটা, তাহলে আর কোনো দিনই ভুলতে হবে না।’
তবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় কখন জানেন? আপনার যমজ বোন বা ভাই যখন আপনার জন্মদিনটা ভুলে যায়।
জন্ম আর জন্মদিন নিয়ে মেলা কিছুই হতে পারে, কিন্তু তার আগে জন্মটা তো নিতে হবে। সেই প্রথম আলো দেখার জন্য অন্ধকারে ভ্রূণ সৃষ্টি তো হতে হবে। এই দেখুন, আবার ঘুরেফিরে অন্ধকারটাই চলে আসছে কলমে। পৃথিবীর ৭২৭ কোটি মানুষের জীবন তো আলো আর আঁধার নিয়েই। জন্ম-মৃত্যু সবই ঘটে চলেছে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে। দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, জয়, পরাজয়—সবই আলো-আঁধারের খেলা বৈ তো নয়।
ও হ্যাঁ, মৃত্যুর একটি গল্প বলি। এক ব্যক্তি বলছেন, ‘মরতে আমি ভয় পাই না। তবে মৃত্যুর সময়টাতে আমি ওখানে থাকতে চাই না।’ আরেকজন বলছেন, ‘আমি স্বর্গে যেতে চাই, কিন্তু মরতে চাই না।’ ভুলে যাই, আমরা আলোতে এলেও একসময় আঁধারের কোলে প্রত্যাগমন করতেই হয়।
নাহ্! ওসব ভয় দেখানো কথা আজ না-ই বললাম। গল্প বলি আরেকটা। এক নারীর যমজ বাচ্চা হয়েছে। তিনি খুবই চিন্তায় পড়ে গেলেন—একটার বাপ কে, তা তো আমি জানি, কিন্তু সর্বনাশ! আরেকটার বাপ কে?
শেষ গল্পটা বলি এবার। এক নিঃসন্তান দম্পতি দরবেশের কাছে হাজির সন্তান লাভের আশায়। দরবেশ দোয়া করে বললেন, ‘আমি এই সপ্তাহে পৃথিবী ভ্রমণে যাব। যাওয়ার পথে প্রথমেই আজমির শরিফে তোমাদের নামে খাজা বাবা (রা.)-র দরগায় মোম জ্বালিয়ে দিয়ে যাব।’ বছর না ঘুরতেই ওই নারীর কোলজুড়ে এল ছয়টি যমজ বাচ্চা। তার কিছুদিন পর দরবেশ বাবা পৃথিবী ভ্রমণ শেষে এসে খবর নিতে গেলেন সেই দম্পতির বাড়ি। খুশির সংবাদে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত। খোঁজ করে জানলেন গৃহকর্তা আজমির গেছেন।
‘কেন? হঠাৎ তিনি আজমির কেন গেলেন?’
‘আপনার জ্বালানো মোমবাতিটা নেভাতে।’
কিন্তু আমি চাই না দেশের প্রতিদিনের সেই ব্রহ্মমুহূর্তের নব-আলোটাকে যে নিজ অস্তিত্বে ধারণ করেছে, সেই প্রথম আলো নামের দৈনিক পত্রিকার মঙ্গল কামনায় লাখো পাঠক কর্তৃক প্রজ্বলিত মঙ্গলালোক নিভে যাক। জ্বলতে থাকুক শুভেচ্ছার মঙ্গলালোক শিখা অনির্বাণ হয়ে। জন্ম নিক নব নব উদ্ভাবন, বৈচিত্র্যের সমাহারে ভরে উঠুক প্রতিটি পাতা। নির্ভীক চিত্তে প্রকাশিত হোক অজানা সব সত্য, গৌরব, অর্জন। জলপ্রপাতের মতো বয়ে চলুক তথ্যপ্রবাহের ধারা। নেচে উঠুক পাঠকের মন, স্রোতে ভেসে যাক আনন্দসাগরে, প্রতিদিন, প্রতি সংখ্যায়, প্রতি পাতায়, প্রতি ছত্রে। সংযুক্ত হোক নব নব ধারার সাময়িকী, ফিচার পাতা—প্রথম আলোর সংসার হোক ফুলে, ফলে, ফসলে সমৃদ্ধ।
দৈনিক পত্রিকার ইতিহাসে এ দেশে যে নতুন ধারার প্রবর্তন সাধন করেছে প্রথম আলো, তা যেন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে দেখা দেয় দেশ ও দেশের আপামর জনসাধারণকে।
জয়তু প্রথম আলো।
ঢাকা, ৩ নভেম্বর ২০১৪
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।
No comments