বালুখেকো জাকির বাহিনীর ত্রাসে কাঁপে মেঘনা by আলী হোসেন বাবুল
কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার মেঘনা নদীতে
ইজারার নামে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে অসংখ্য ড্রেজারের মাধ্যমে যত্রতত্র
যথেচ্ছভাবে বালু উত্তোলন করায় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম।
এই ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না নিরীহ
গ্রামবাসী। এর জন্য তারা দায়ী করছেন ‘বালুদস্যু’ আওয়ামী লীগ নেতা জাকির
হোসেনকে। গ্রামবাসী বালু উত্তোলন বন্ধ ও জাকির বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। অভিযোগ থেকে জানা যায়,
উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে মেঘনায়
নদীগর্ভে অসংখ্য ঘরবাড়ি, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল ও সরকারি স্থাপনা বিলীন
হয়ে গেছে। ভুক্তভোগী এলাকাবাসী এই বালু সন্ত্রাস বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রীসহ
বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন। কিন্তু এখনও অবাধে চলছে এলাকার
চিহ্নিত প্রভাবশালী বালু উত্তোলনকারীদের দৌরাত্ম্য। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে
বালুমহাল ইজারার নামে তারা নদীর গভীর থেকে বালু উত্তোলন না করে,
রামপ্রসাদেরচর গ্রামসংলগ্ন এলাকা থেকে অনবরত বালু উত্তোলন করছে। এর
প্রতিক্রিয়া হিসেবে ওই গ্রামের প্রায় অর্ধেক অংশ নদীতে তলিয়ে গেছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলার বৈদ্যার বাজারসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা সেতুর
তলদেশ মাটিশূন্য হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প এখন চরম হুমকির মুখে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ‘বালু জাকির’ নামে পরিচিত জাকির হোসেন অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসীকে পাহারায় রেখে প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে। গ্রামবাসী কোনো প্রতিবাদ করতে গেলেই তাদের ওপর সন্ত্রাসীরা বিভিন্নভাবে হামলা চালায়। কখনও কখনও প্রতিবাদকারীদেরই পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন নং-৫৯৩/০৮ মূলে আদালতের আদেশে ৬নং সেনেরচর ও ১নং সাপমারা চরেরগাঁও বালুমহাল দুটি বন্ধ রয়েছে। তবে সরকারিভাবে ইজারা দেয়া রামপ্রসাদেরচর গ্রামের ২৭০০ ফুট পশ্চিম-উত্তরে অবস্থিত ভাষানিয়া দড়িচর মৌজার বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলনের অনুমতি থাকায় সেই সুযোগের অপব্যবহার ঘটিয়ে সন্ত্রাসীরা গ্রামটির তীর ঘেঁষে বালু তুলে নিচ্ছে। এর ফলে গ্রামের ফসলি জমির বড় একটি অংশ নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বালু উত্তোলনে লাভের পরিমাণ এতই বেশি যে, যে কোনোভাবে এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সন্ত্রাসী চক্র বেপরোয়া। যে কারণে গ্রামের সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের প্রতিরোধ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবে এ নৈরাজ্যের প্রতিকার না মেলায় তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে এলাকাবাসীর মধ্যে।
সরেজমিন মেঘনা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর পাড় ভাঙছে। এমনকি নদীর পাড় থেকে বহুদূরে থাকা কৃষি জমিও ধীরে ধীরে নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। জমি হারিয়ে অনেক কৃষক ভূমিহীন দিনমজুর হয়ে পড়ছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আগে মেঘনা সেতুর নিচ থেকে ড্রেজিং করে বালু তোলা হতো। এতে করে ব্রিজের পিলারের পাশ থেকে মাটি সরে গিয়ে ব্রিজটি ঝুঁকির মুখে পড়ে। এ ঘটনায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সেতু এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেন ১৫ আগস্ট। ওই সময় তিনি মেঘনা সেতুর কাছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের আটকের নির্দেশ দেন।
সম্প্রতি মেঘনা উপজেলার পাঁচটি গ্রামের মানুষ তাদের ভিটেমাটি রক্ষায় নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী নুনেরটেকে ৪১টি ঘর নদীতে বিলীন হওয়ায় সেখানেও অনুরূপ পৃথক কর্মসূচি পালিত হয়। ইতিপূর্বে নদী থেকে বালু উত্তোলন তদন্ত করতে গিয়ে মেঘনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এক সংবাদকর্মী বালু উত্তোলনকারীদের রোষানলে পড়েন। বালু উত্তোলন ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সরেজমিন দেখার জন্য কয়েকদিন আগে এই প্রতিনিধি ঘটনাস্থলে যান এবং জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। বালু সন্ত্রাসে ক্ষতিগ্রস্ত রামপ্রসাদেচর, বড়ইয়াকান্দি, মৈশারচর, টিটির চর, নলচর ও নুনের টেকের লোকজন জানান, তাদের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে। নদীভাঙন থেকে গ্রাম রক্ষা আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক মো. জয়নাল আবেদীন ভাণ্ডারী বলেন, ইজারার নামে জালাল এন্টারপ্রাইজের জাকির বাহিনীর লোকজন রাতের অন্ধকারে নির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করে ঘরবাড়ির নিকটবর্তী এলাকায় মাটি কাটায় বিভিন্ন গ্রামের ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিরীহ গ্রামবাসী ও একজন জনপ্রতিনিধিকে মিথ্যা মামলায় হাজতবাস করতে হয়েছে। জয়নাল আবেদীন ভাণ্ডারী জানান, বালু সন্ত্রাসীরা একবার তাকে গুম করার চেষ্টা করে। কোনোক্রমে তিনি রক্ষা পান। ওই ঘটনায় সোনারগাঁ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, গ্রামের সন্নিকটে অনেকগুলো ড্রেজার মাটি কাটছে। কিছু নোঙর করে রাখা হয়েছে। এর অদূরে দুটি নৌকায় ১০-১২ জন যুবক হিসাব-নিকাশের কাজে ব্যস্ত।
মেঘনা উপজেলার মেঘনা বালুমহাল ইজারা নিয়েছেন বালুদস্যু ও গডফাদার হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের নেতা জাকির হোসেন। জাকির তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করেন। সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাদের প্রশ্রয়ে মেঘনার দুই তীরের মানুষের জীবন, পরিবেশ, নদীর গঠন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে দিচ্ছেন। কেবল গণমাধ্যমে এ বিষয়ে কিছু প্রকাশ হলে তাৎক্ষণিক তৎপরতা দেখায় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, জাকির মেঘনার বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছেন, যার বেশির ভাগ সদস্য সরকারি দলের নেতাকর্মী। এই বাহিনী মেঘনা উপজেলার রামপ্রসাদের চর ও নলচর পর্যন্ত কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র বালু তুলছে।
মেঘনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামছুল হক বলেন, ইজারাদাররা বালুমহালের সীমানা মানছে না। তারা কয়েকটি গ্রাম ঘেঁষে বালু তোলায় গ্রামগুলো এখন হুমকির মুখে। এ রকম কিছু অভিযোগ পেয়ে ২০১৩ সালের ১ জুন ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাতে গিয়ে হামলার শিকার হন। ওই সময় বাধ্য হয়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ৫ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। ওই ঘটনায় মামলা হয়েছে, তবে জনস্বার্থে প্রশাসন সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।
মেঘনা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস ছালাম বলেন, রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারা একটি বৈধ পন্থা। তবে এক টাকা রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে দুই টাকা ভর্তুকি দিতে হলে প্রশাসনকে ভেবে দেখতে হবে।
মেঘনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একেএম মহসীন খান বলেন, আমি এই থানায় যোগ দিয়েছি প্রায় ২০ দিন হয়। তবে সীমানা অতিক্রম করে গ্রামের ঘরবাড়ির সন্নিকটে মাটি কাটার চেষ্টা করা হলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বালুখেকোদের গডফাদার হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা যার নাম বলেছেন তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত জাকির হোসেন। অভিযুক্ত জাকির হোসেনের মোবাইল ফোনে (০১৯৭৩২২৩৩২৮) বহুবার ডায়াল করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তার ম্যানেজার মো. কবির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, জাকির হোসেন বালু ডাকাত বা বালুদস্যু নন। তারা বৈধভাবে বালুর ব্যবসা করছেন। বালুমহাল ইজারা নিয়েছেন ১ কোটি ২ লাখ ৫৮ হাজার টাকায়। নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য সব ধরনের সরকারি অনুমতি তাদের রয়েছে।
No comments