বদলে গেছে দিনকাল সবাই এখন ডিজিটাল by মোকাম্মেল হোসেন

বিমানবন্দর রেলস্টেশনের প্লাটফরমে পা ছড়িয়ে বসে আছি। ময়মনসিংহগামী যমুনা এক্সপ্রেস নির্ধারিত সময়ে কমলাপুর ছাড়লে পাঁচটা-সোয়া পাঁচটার মধ্যে এখানে পৌঁছে যাওয়ার কথা। মনে হচ্ছে ট্রেন লেট হবে। এদেশে ট্রেন লেট হওয়ার বিষয়টিকে কেউ অপরাধ হিসেবে গণ্য করে না। কাজেই এটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। এই মুহূর্তে আমার ভাবনার বিষয় হল মানুষ। চারপাশে অগণিত মানুষের মুখ। প্রতিটি মুখের ভাষা ও অভিব্যক্তি আলাদা। আমি মনোযোগ দিয়ে তার ভাষা বোঝার চেষ্টা করছি। এ সময় নোয়াখালীগামী উপকূল এক্সপ্রেস প্লাটফরমে প্রবেশ করে হঠাৎ হুইসেল বাজাতেই পাশে বসে থাকা এক যুবক আমাকে সাক্ষী মানল-
: ড্রাইভারের কারবারটা দেখছুইন ভাই! ব্যাটা আমার কান-মান তবদা লাগাইয়া দিছে!
পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় ট্রেন প্লাটফরমে ঢোকার আগেই আমি হাতের আঙুল দিয়ে দুই কানের ছিদ্র বন্ধ করে রেখেছিলাম। ট্রেন থামার পর তাকে বললাম,
: প্লাটফরমের যে পরিবেশ, এইভাবে হুইসেল না মাইরা উপায় কী?
- তাই বইল্যা এই রকম আতকা মাইরা হর্ন বাজাইব? প্লাটফরমে ঢোকবার আগে বাজাইবার পারল না!
: আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা থেইক্যা শুরু কইরা সাধারণ যানবাহনের চালকের আসনে বইসা থাকা লোকগুলার আক্কল-পছন্দ একেবারেই কম। কী করবাইন, মাইন্যা নেন।
- আর কত মাইন্যা নিবাম! মানতে মানতে তো হাতে লোডা ধরাইয়া দিছে...
কথাবার্তা শুনে যুবকের গন্তব্য অনুমান করা কঠিন হল না। জিজ্ঞেস করলাম-
: মমিসিং যাবাইন?
-।
উপকূল এক্সপ্রেস স্টেশন ছেড়ে চলে যেতেই যুবক বলল-
: ভাই, আপনেরে একটা জিনিস দেখাই!
- কী জিনিস?
: সামনের দিকে তাকাইন!
সামনে তাকালাম। বিপরীত দিকের প্লাটফরমে যাত্রীরা ঢাকাগামী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা একটি প্লাটফরমের চিরাচরিত দৃশ্যের বাইরে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে যুবকের দিকে তাকাতেই সে বলল,
: কিছু দেখলাইন?
আমি না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়তেই যুবক বলল,
: ভালা কইরা খেয়াল করুইন।
- করলাম তো!
: একটা মেয়ে দেখতাছুইন না- মোবাইল ফোনে কথা বলতেছে!
- জ্বি।
: আমি প্রায় একঘণ্টা আগে ইস্টিশনে আসছি। আসার পর থেইক্যাই এই সিন দেখতেছি। নন-স্টপ কথা চলতেছে!
ভালো করে লক্ষ্য করলাম। মেয়েটির বয়স খুব বেশি বলে মনে হল না। প্লাটফরমের একপাশে রোদের মধ্যে আপডাউন করতে করতে সে মোবাইল ফোনে কথা বলছে। যুবক গভীর আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল-
: কী বুঝলাইন?
- বাঙালি মোবাইল ফোন হাতে পাইয়া উন্মাদ হইয়া গেছে...
আমার কথা শুনে যুবক হা-হা করে হাসে। যুবকের হাসি শেষ হওয়ার আগেই আমি বললাম-
: তবে মোবাইল ফোনের ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। এর মাধ্যমে সমাজের মানুষ নানাভাবে উপকৃত হইতেছে। আবার বিরিংতালও কম ঘটতেছে না! কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রেম হওয়ার পর এক মেয়েরে নর্থবেঙ্গল থেইক্যা ভাগাইয়া টঙ্গিতে আনার পর প্রেমিক গং মেয়েটির বাবা-মার কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে। বুঝেন ঠেলা!
একটু পরেই আমাদের সামনে পানির বোতল হাতে এক ছেলে উপস্থিত হল। তার ডান হাতের একটা আঙুল ফেটে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। এ দৃশ্য দেখে যুবক পকেট থেকে ওয়ান টাইম ড্রেসিং প্যাড বা স্ট্রিপ, মেডিকেল পরিভাষায় যাকে বলা হয় ইলাস্টিক অ্যাডহেসিভ ড্রেসিং- ছেলেটির আঙুলের মাথায় লাগিয়ে দিল। ঘটনা দেখে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
: আপনের পরিচিত নাকি?
- উহু।
: তাইলে?
- বেচারার অবস্থা দেইখ্যা একটু হেলপ করলাম...
অভিভূত হওয়ার মতো কোনো ব্যাপার না। তারপরও ঘটনাটা আমার মনে দাগ কাটল। আমি যুবকের পরোপকারিতায় মুগ্ধ হয়ে বললাম,
: ভাই, পট্টি দেয়ায় আক্রান্ত স্থান নিরাপদ হইল ঠিকই কিন্তু ব্যথা-বেদনা তো দূর হইল না। এর এখন ব্যথানাশক ওষুধ দরকার।
যুবক আমাকে অভিভূত করে দিয়ে পকেট থেকে ব্যথানাশক ট্যাবলেট বের করে ছেলেটির হাতে দিয়ে বলল,
: রোজা রাখছ?
- জে।
: ইফতারির পরে এইটা খাইয়া নিবা।
এ পর্যায়ে যুবককে আমি বললাম,
: ভাই, ব্যথানাশক ট্যাবলেট খাওয়ার পর এন্টাসিড জাতীয় ওষুধ খাইতে হয়। এরে এন্টাসিড দিবেন না?
আমার কথা শুনে যুবকের চোখে-মুখে দুষ্টুমি ঝিলিক দিল। ছেলেটিকে সে বলল,
: আমার কাছে তো এই মুহূর্তে কোনো এন্টাসিড নাই। ছোট ভাই, তুমি এক কাম কর। ওই যে ওইপাশের প্লাটফরমে দেখতেছ- মোবাইল ফোনে আপুমনি কথা বলতেছে! তার কাছে এন্টাসিড ট্যাবলেট আছে! যাও, একটা লইয়া আস।
যুবকের কথা শেষ হতে না হতেই মেয়েটি রেললাইন পার হয়ে এপারে আসতে লাগল! আমি হেসে যুবককে বললাম,
: ভাই, আপুমনি আপনের মনের ভাব টের পাইয়া এন্টাসিড দিতে নিজেই আগাইয়া আসতেছে...
এপাশের প্লাটফরমের এক কোণায় মোবাইল ফোনে টাকা লোড করার একটা দোকান। মেয়েটি সেই দোকানে গিয়ে টাকা লোড করে পুনরায় ওপাশের প্লাটফরমে ফিরে গেল। এ দৃশ্য দেখে যুবক বলে উঠল-
: কারবার দেখছুইন ভাই! কথা বলতে বলতে মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ হইয়া যায়- কিন্তু কথা শেষ হয় না!
দেশের মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোও এটাই চায়। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টাই মানুষ যাতে কথার ওপর ভাসতে থাকে, সেজন্য একেক কোম্পানি একেক ধরনের কর্মসূচি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের ঝাঁপাঝাঁপির মধ্যে পড়ে এক মিনিটের একটা কথা বলতে গিয়ে আমরা আধাঘণ্টা পার করে দিচ্ছি। এতে অর্থহানি ও স্বাস্থ্যহানি তো ঘটছেই। আরও একদিক থেকে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কথার উৎসবে যোগ দিয়ে আমরা লিখতে ভুলতে যাচ্ছি। কয়েকদিন আগে আমার বড় ছেলে তাসিন মিয়া একটা বিষয়ে আমাকে অভয় দিয়ে মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠাল- আব্বু, ডোন্ট অরি...। এই হচ্ছে এ যুগে পিতার কাছে পুত্রের পত্র। এখন লোকজনের মধ্যে কথার পরিসর বাড়ছে আর লেখার পরিসর সংক্ষেপ হতে টরে-টক্কা যুগের টেলিগ্রামে পরিণত হচ্ছে। আজকাল ক’জন ছেলেমেয়ে তাদের বাবা-মার কাছে চিঠি লেখে জানি না। তবে ছাত্রজীবনে আমরা মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে নিয়মিত চিঠি লিখতাম। সেসব চিঠির শুরু ও শেষ ছাড়াও প্রতিটি ছত্রে আবেগ-অনুভূতির নানা আলপনা আঁকা থাকত। আজকাল মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটে বাংলা-ইংরেজির মিশেল দেয়া লেখায় সেসব আবেগের দেখা পাওয়া দুষ্কর। এখন একজন অন্যজনকে মোবাইলে মেসেজ পাঠায়- কুইক আস। অন্যজন উত্তরে লেখে- আসতেছি। ব্যস, মামলা ডিসমিস। এই হচ্ছে এ যুগের চিঠির আকার-আয়তন। একবার কানে এলো, চিঠির আকার নিয়ে আব্বা আম্মাকে বলছেন-
: ছেলে তোমার কাছে লেখে তিন পাতার চিঠি। আর আমার কাছে একপৃষ্ঠাও লেখে না। এর কারণ কী!
এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে আম্মা আমাকে লেখা এক চিঠির শেষে বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে লিখলেন-
: তোমার আব্বার কাছে লেখা চিঠির আকার ছোট হওয়ায় তার আফসোসের অন্ত নাই। তার কাছে লেখা চিঠিগুলো আরেকটু বড় করতে পার না?
বড় আকারের চিঠি লিখতে গিয়ে স্কুলজীবনে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এক সহপাঠী একদিন এসে আমাকে ধরল,
: দোস্ত, তর ভাষাজ্ঞান ভালো। তুই আমার হইয়া বিলকিসরে কমসে কম দশ পৃষ্ঠার একটা চিঠি লেইখ্যা দে। প্লিজ দোস্ত, এইটা আমার জীবন-মরণ সমস্যা।
বন্ধুর পীড়াপীড়িতে আমাদের নিচের ক্লাসে পড়া বিলকিসের উদ্দেশে একটা প্রেমপত্র লিখে ফেললাম। চিঠিটা লেখার পর মনে হল, এত উপমা দিয়ে, এত খাটাখাটনি করে চিঠিটা লিখলাম, প্রকৃত লেখক কে- তা প্রাপক জানবে না, সেটা কী করে হয়! এই ভাবনা থেকে চিঠির এক কোণায় ছোট করে লিখে দিলাম- পত্রলেখক : এমএস। চিঠি লেখার কয়েকদিন পরে টিফিন পিরিয়ডে বিলকিস আমাকে ডাক দিল-
: এই যে শুনেন...
- আমারে বলতেছ!
: জ্বি, আপনেরেই বলতেছি।
- বল।
: আরেকজনরে চিঠি লেইখ্যা দিতে যান কেন? নিজে লেখার সাহস নাই?
সেসময় কোনো মেয়েকে সরাসরি চিঠি লেখার সাহস আসলেই আমার ছিল না। এ সাহস আমি অর্জন করি লবণ বেগমের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর। লবণ বেগমকে চিঠি লেখার ধরন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। আমি আমার ডায়েরির পৃষ্ঠায় প্রতিদিন লবণ বেগমের উদ্দেশে একটা করে চিঠি লিখতাম। সাতদিন পর পর ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলো ফটোকপি করে লবণ বেগমের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতাম। সেসব দিনের স্মৃতি হাতড়িয়ে লবণ বেগম একদিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
: তাসিনের আব্বা! আমার প্রতি তোমার প্রেম-প্রীতি, মায়া-মমতা, আবেগ-ভালোবাসা একেবারে শূন্যের কোঠায় নাইম্যা আসছে!
লবণ বেগমের কথায় আপত্তি জানিয়ে আমি বললাম-
: আবেগ-অনুভূতি ঠিকই আছে। তবে সময় পাল্টাইয়া যাওয়ায় তার প্রকাশ ভিন্ন হইয়া গেছে। আমরা এখন ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল মানুষ। ডিজিটাল প্রযুক্তি মানুষের মধ্যে বেগ দিছে, আবেগ কাইড়া নিছে। এখন মোবাইল ফোনের বোতাম টিইপ্যা নিমিষেই সবকিছু ফিনিশ কইরা ফেলা যায়। এই অবস্থায় আবেগ-অনুভূতি পরিমাপ করতে যাইয়া শুধু শুধু দুঃখ বাড়াইয়া লাভ কী?
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.