কোটার দাবিদার কারা by মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার
৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফল প্রকাশকে
কেন্দ্র করে দেশে লংকাকাণ্ড ঘটে গেছে। শুরু হয়েছে সরকারি চাকরিতে কোটা
প্রথা বাতিলের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের গণআন্দোলন। তবে কোটাধারীরাও বসে
নেই; তারাও মাঠে নেমেছে। অন্যদিকে সুবিধাবাদী একটি গ্র“পও তৎপর। কোটা
বিতর্কে আমরা প্রধানত তিনটি পক্ষ এবং তিন ধরনের যুক্তি পাচ্ছি- ক. সাধারণ
শিক্ষার্থী : কোটা পদ্ধতি সম্পূর্ণ বাতিল করে মেধার মূল্যায়ন করতে হবে, খ.
আওয়ামী ও ছাত্রলীগপন্থী কথিত সাধারণ শিক্ষার্থী : কোটাবিরোধী আন্দোলনে
আমাদের সমর্থন আছে; কোটা একেবারে বাতিল করা যাবে না; কিছু সংস্কার করা যেতে
পারে, শিবিরপন্থীরা এ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে; গ. আমরা মুক্তিযুদ্ধের সন্তান
ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড : কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন
ষড়যন্ত্রমূলক এবং শিবিরের পাতানো ফাঁদ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা কারও করুণা নয়
প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধের সন্তান ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড নামের সংগঠন দুটির সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট, তারাই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের সন্তান নন। তবে তারা সবাই সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান- এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। ওই সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধাদের সবাই আবার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয়। আমরা স্পষ্টতই দেখেছি, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং ওই হাইব্রিড মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেটও প্রদান করা হয়। অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন তার বাংলাদেশের প্রতিরক্ষায় সাধারণ মানুষের ভূমিকা শীর্ষক প্রবন্ধে মন্ত্রণালয়ের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভুয়া নাম সংযোজনের অভিযোগ থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ওই তালিকায় রাজাকারদেরও রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তথ্য আছে। এ বিষয়টি সাম্প্রতিককালের। কিন্তু এর চেয়ে ভয়াবহ তথ্য রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর গ্রন্থে। ওই গ্রন্থে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গঠিত যুব শিবিরের মহাপরিচালক এসআর মীর্জা বলেছেন, যুদ্ধের পরপরই কর্নেল ওসমানীর স্বাক্ষরে হাজার হাজার সার্টিফিকেট দেয়া হল, যারা কোনোদিন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না (পৃ. ১৩৭)।
দেশে এখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৪ হাজার ৮০০। ২০০৯ সালের এপ্রিলে জাতীয় সংসদে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭২ হাজার। অন্য আর একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে- কারা মুক্তিযোদ্ধা? বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এর সহজ উত্তর- সার্টিফিকেটধারী অথবা মন্ত্রণালয়/মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট/মুক্তিবার্তা/গেজেটে নামভুক্তরাই মুক্তিযোদ্ধা। সত্যি কি এরাই কেবল মুক্তিযোদ্ধা? এ প্রশ্নের উত্তর- না। এরা কোনোভাবেই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা নয়। তবে হ্যাঁ, এদের মধ্যে ভুয়া ছাড়া প্রায় সবাই অস্ত্র হাতে শত্র“র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা আর সশস্ত্র যোদ্ধা এক নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রভাগে যারা ছিলেন তারাই সশস্ত্রযোদ্ধা, পশ্চাতে ছিলেন সশস্ত্র যোদ্ধাদের সহযোগী, সাহায্যকারী, আশ্রয়দাতারা। আর এ দুইয়ে মিলেই মুক্তিযোদ্ধা। এ দেশের পাকিস্তানিদের সহযোগী ছাড়া সবাই ছিলেন ওই দলভুক্ত তথা মুক্তিযোদ্ধা। যার সাফল্যকে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন আমজনতার লড়াইয়ের পুঞ্জিত কৃতী বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে ওই সশস্ত্র যোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা গুলিয়ে ফেলার কারণেই যত জট পেকেছে। আর সশস্ত্র যোদ্ধাদের মতো তাদের সহযোগী, সাহায্যকারী, আশ্রয়দাতাদের ভূমিকাও কোনো অংশে কম ছিল না। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও পরবর্তীকালে প্রকাশিত মূলধারা ৭১ গ্রন্থ খ্যাত মঈদুল হাসানের মতে, দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধারা (আমার মতে, সশস্ত্র যোদ্ধারা) আসছে, তখন দেশের মানুষ নিজেরাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাদের আশ্রয় দিত, তাদের আহার দিত, আহত হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করত, তাদের পথ দেখাত, উৎসাহ দিত। ... মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতরে পাকিস্তানিদের প্রায় অচল করে ফেলেছিল। এটা হয়েছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের, যারা অধিকৃত এলাকায় ছিল তাদের সহযোগিতার ফলেই। এটা না হলে মুক্তিযোদ্ধারা কখনোই সফল হতো না।... কাজেই দেশের ভেতরে যেমন নানা প্রতিরোধ গ্র“প, তেমনি নিরস্ত্র মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অবদান মুক্তিযুদ্ধের জন্য ছিল অপরিসীম (পূর্বাপর, পৃ. ১১৩)।
সশস্ত্রযোদ্ধারা যেমন ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, তেমনি তাদের সাহায্যকারী-আশ্রয়দাতাদের ঝুঁকিও কোনো অংশে কম ছিল না। যদি পাকিস্তানি বাহিনী অথবা তাদের দোসররা একবার জানত, সশস্ত্র যোদ্ধাদের সহযোগিতা করা হয়েছে; তবে রক্ষা নেই। শুধু সশস্ত্র যোদ্ধাদের সহযোগিতা করার কারণে গ্রামের পর গ্রাম পাকিস্তানিরা জ্বালিয়ে দিয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে। তাই কতিপয় সশস্ত্র যোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করে শুধু তাদের বা তাদের সন্তান-সন্ততিদের সরকারি চাকরিতে কোটা প্রদান বৈষম্যমূলক। যদি কোটা প্রদান করতেই হয় তবে সশস্ত্রযোদ্ধা, সাহয্যকারী, আশ্রয়দাতা তথা সব মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকেই প্রদান করতে হবে। শুধু সশস্ত্রযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করে কোটা প্রদান অন্যায়। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থীও বটে।
এই কোটা প্রথা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে : ...বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি। এ দেশের সংবিধানও প্রচলিত কোটা প্রথাকে সমর্থন করে না। সংবিধানের ২৯(১) ও (২) অনুচ্ছেদে যথাক্রমে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে এবং কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদে বা জš§স্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না। সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ নাগরিকদের অনগ্রসর অংশের জন্য চাকরিতে বিশেষ কোটা প্রদান অনুমোদন করেছে। কিন্তু বর্তমান প্রচলিত কোটা ব্যবস্থায় সেই অনগ্রসর অংশের সুযোগ অতি সামান্য।
সব মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য বা নারী অনগ্রসর নয়। ঢাকা শহর বা জেলা শহরে বসবাসকারী অনেক সচ্ছল পরিবারের সন্তান মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা নারী হিসেবে কোটার সুবিধা ভোগ করেন। সত্যিকার অনগ্রসর যারা, কোটা তাদেরই প্রাপ্য। আমরা বলছি না, মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা নারীদের সবাই অগ্রসর। তবে তাদের সবাইকে অনগ্রসর বলেও মানতে পারছি না। তাই কোটা প্রদানের আগে চিহ্নিত করা হোক সমাজের অনগ্রসর কারা।
অনগ্রসরদের সমাজের মূল স্রোতে আনতে ভিন্নভাবেও সহযোগিতা করা যেতে পারে। কোটার নামে সরকারি চাকরিতে কম যোগ্যদের সুযোগ করে দেয়ার কোনো মানে হয় না। আমরা বলছি না, যারা কোটাধারী সবাই কম যোগ্য। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, কোটার কারণে অধিকতর যোগ্য বা মেধাবীরা সুযোগ না পেয়ে কম মেধাবীরা অধিক হারে সুযোগ পাচ্ছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা মেধাবী ছিলেন বলেই তারা দেশের স্বাধীনতার বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন। আমার বিশ্বাস, তাদের সন্তানরাও মেধাবী। আর মেধাবীরা কখনও সুযোগসন্ধানী হয় না। তাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের তাদের জন্য মর্যাদাহানিকর কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হওয়া উচিত। নারীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আজ মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংসহ নানা পরীক্ষায় তারা ছেলেদের টপকিয়ে শীর্ষস্থান অধিকার করছেন। বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার কৃতিত্বও তাদের রয়েছে। তাই কোটার নামে তাদের মেধার যে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে, সে প্রহসন বন্ধে তাদের আওয়াজ তোলা উচিত।
কোটাপ্রথা বাতিল বা সংস্কারের দাবির মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল অথবা শিবিরের ইন্ধন না খুঁজে সরকারের উচিত গণমানুষের দাবির বাস্তবতা উপলব্ধি করা। ছাত্রলীগেরও উচিত ছাত্রশিবির যাতে এ যৌক্তিক আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে সাধারণ ছাত্রদের তাদের পক্ষে নিতে না পারে সে বিষয়ে সচেতন থাকা এবং এ আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ছাত্রলীগ সর্বদা সোচ্চার সে বিষয়টি আবারও প্রমাণ করা।
মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মুক্তিযুদ্ধের সন্তান ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড নামের সংগঠন দুটির সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট, তারাই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের সন্তান নন। তবে তারা সবাই সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান- এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। ওই সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধাদের সবাই আবার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয়। আমরা স্পষ্টতই দেখেছি, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং ওই হাইব্রিড মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেটও প্রদান করা হয়। অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন তার বাংলাদেশের প্রতিরক্ষায় সাধারণ মানুষের ভূমিকা শীর্ষক প্রবন্ধে মন্ত্রণালয়ের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভুয়া নাম সংযোজনের অভিযোগ থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ওই তালিকায় রাজাকারদেরও রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তথ্য আছে। এ বিষয়টি সাম্প্রতিককালের। কিন্তু এর চেয়ে ভয়াবহ তথ্য রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর গ্রন্থে। ওই গ্রন্থে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গঠিত যুব শিবিরের মহাপরিচালক এসআর মীর্জা বলেছেন, যুদ্ধের পরপরই কর্নেল ওসমানীর স্বাক্ষরে হাজার হাজার সার্টিফিকেট দেয়া হল, যারা কোনোদিন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না (পৃ. ১৩৭)।
দেশে এখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৪ হাজার ৮০০। ২০০৯ সালের এপ্রিলে জাতীয় সংসদে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭২ হাজার। অন্য আর একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে- কারা মুক্তিযোদ্ধা? বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এর সহজ উত্তর- সার্টিফিকেটধারী অথবা মন্ত্রণালয়/মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট/মুক্তিবার্তা/গেজেটে নামভুক্তরাই মুক্তিযোদ্ধা। সত্যি কি এরাই কেবল মুক্তিযোদ্ধা? এ প্রশ্নের উত্তর- না। এরা কোনোভাবেই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা নয়। তবে হ্যাঁ, এদের মধ্যে ভুয়া ছাড়া প্রায় সবাই অস্ত্র হাতে শত্র“র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা আর সশস্ত্র যোদ্ধা এক নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রভাগে যারা ছিলেন তারাই সশস্ত্রযোদ্ধা, পশ্চাতে ছিলেন সশস্ত্র যোদ্ধাদের সহযোগী, সাহায্যকারী, আশ্রয়দাতারা। আর এ দুইয়ে মিলেই মুক্তিযোদ্ধা। এ দেশের পাকিস্তানিদের সহযোগী ছাড়া সবাই ছিলেন ওই দলভুক্ত তথা মুক্তিযোদ্ধা। যার সাফল্যকে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন আমজনতার লড়াইয়ের পুঞ্জিত কৃতী বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে ওই সশস্ত্র যোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা গুলিয়ে ফেলার কারণেই যত জট পেকেছে। আর সশস্ত্র যোদ্ধাদের মতো তাদের সহযোগী, সাহায্যকারী, আশ্রয়দাতাদের ভূমিকাও কোনো অংশে কম ছিল না। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও পরবর্তীকালে প্রকাশিত মূলধারা ৭১ গ্রন্থ খ্যাত মঈদুল হাসানের মতে, দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধারা (আমার মতে, সশস্ত্র যোদ্ধারা) আসছে, তখন দেশের মানুষ নিজেরাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাদের আশ্রয় দিত, তাদের আহার দিত, আহত হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করত, তাদের পথ দেখাত, উৎসাহ দিত। ... মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ভেতরে পাকিস্তানিদের প্রায় অচল করে ফেলেছিল। এটা হয়েছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের, যারা অধিকৃত এলাকায় ছিল তাদের সহযোগিতার ফলেই। এটা না হলে মুক্তিযোদ্ধারা কখনোই সফল হতো না।... কাজেই দেশের ভেতরে যেমন নানা প্রতিরোধ গ্র“প, তেমনি নিরস্ত্র মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অবদান মুক্তিযুদ্ধের জন্য ছিল অপরিসীম (পূর্বাপর, পৃ. ১১৩)।
সশস্ত্রযোদ্ধারা যেমন ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, তেমনি তাদের সাহায্যকারী-আশ্রয়দাতাদের ঝুঁকিও কোনো অংশে কম ছিল না। যদি পাকিস্তানি বাহিনী অথবা তাদের দোসররা একবার জানত, সশস্ত্র যোদ্ধাদের সহযোগিতা করা হয়েছে; তবে রক্ষা নেই। শুধু সশস্ত্র যোদ্ধাদের সহযোগিতা করার কারণে গ্রামের পর গ্রাম পাকিস্তানিরা জ্বালিয়ে দিয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে। তাই কতিপয় সশস্ত্র যোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করে শুধু তাদের বা তাদের সন্তান-সন্ততিদের সরকারি চাকরিতে কোটা প্রদান বৈষম্যমূলক। যদি কোটা প্রদান করতেই হয় তবে সশস্ত্রযোদ্ধা, সাহয্যকারী, আশ্রয়দাতা তথা সব মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকেই প্রদান করতে হবে। শুধু সশস্ত্রযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করে কোটা প্রদান অন্যায়। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থীও বটে।
এই কোটা প্রথা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে : ...বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি। এ দেশের সংবিধানও প্রচলিত কোটা প্রথাকে সমর্থন করে না। সংবিধানের ২৯(১) ও (২) অনুচ্ছেদে যথাক্রমে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে এবং কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদে বা জš§স্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না। সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ নাগরিকদের অনগ্রসর অংশের জন্য চাকরিতে বিশেষ কোটা প্রদান অনুমোদন করেছে। কিন্তু বর্তমান প্রচলিত কোটা ব্যবস্থায় সেই অনগ্রসর অংশের সুযোগ অতি সামান্য।
সব মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য বা নারী অনগ্রসর নয়। ঢাকা শহর বা জেলা শহরে বসবাসকারী অনেক সচ্ছল পরিবারের সন্তান মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা নারী হিসেবে কোটার সুবিধা ভোগ করেন। সত্যিকার অনগ্রসর যারা, কোটা তাদেরই প্রাপ্য। আমরা বলছি না, মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা নারীদের সবাই অগ্রসর। তবে তাদের সবাইকে অনগ্রসর বলেও মানতে পারছি না। তাই কোটা প্রদানের আগে চিহ্নিত করা হোক সমাজের অনগ্রসর কারা।
অনগ্রসরদের সমাজের মূল স্রোতে আনতে ভিন্নভাবেও সহযোগিতা করা যেতে পারে। কোটার নামে সরকারি চাকরিতে কম যোগ্যদের সুযোগ করে দেয়ার কোনো মানে হয় না। আমরা বলছি না, যারা কোটাধারী সবাই কম যোগ্য। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, কোটার কারণে অধিকতর যোগ্য বা মেধাবীরা সুযোগ না পেয়ে কম মেধাবীরা অধিক হারে সুযোগ পাচ্ছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা মেধাবী ছিলেন বলেই তারা দেশের স্বাধীনতার বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন। আমার বিশ্বাস, তাদের সন্তানরাও মেধাবী। আর মেধাবীরা কখনও সুযোগসন্ধানী হয় না। তাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের তাদের জন্য মর্যাদাহানিকর কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হওয়া উচিত। নারীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আজ মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংসহ নানা পরীক্ষায় তারা ছেলেদের টপকিয়ে শীর্ষস্থান অধিকার করছেন। বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার কৃতিত্বও তাদের রয়েছে। তাই কোটার নামে তাদের মেধার যে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে, সে প্রহসন বন্ধে তাদের আওয়াজ তোলা উচিত।
কোটাপ্রথা বাতিল বা সংস্কারের দাবির মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল অথবা শিবিরের ইন্ধন না খুঁজে সরকারের উচিত গণমানুষের দাবির বাস্তবতা উপলব্ধি করা। ছাত্রলীগেরও উচিত ছাত্রশিবির যাতে এ যৌক্তিক আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে সাধারণ ছাত্রদের তাদের পক্ষে নিতে না পারে সে বিষয়ে সচেতন থাকা এবং এ আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ছাত্রলীগ সর্বদা সোচ্চার সে বিষয়টি আবারও প্রমাণ করা।
মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার : শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
No comments