রম আইন উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করবে by মোহাম্মদ ফজলুল হক
সংশোধিত শ্রম আইন কার স্বার্থ রক্ষা
করেছে? তৈরি পোশাকশিল্পের চলমান অস্থিরতা প্রশমনে তা ভূমিকা রাখতে পারবে
কি? এসব নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ
ফজলুল হক ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক
কল্পনা আক্তার।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো সংশোধিত শ্রম আইন নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন এটি শ্রমিক নয়, মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
মোহাম্মদ ফজলুল হক একটি আইন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মূল্যায়ন করা যায়। অন্যান্য আইন থেকে শ্রম আইনের মৌলিক পার্থক্য হলো, এটি শিল্প তথা এর মালিক ও শ্রমিকের জন্য নির্দিষ্ট। সে ক্ষেত্রে এই আইন কারও পক্ষে বা বিপক্ষে এ কথা বলা যাবে না। যেকোনো শ্রম আইনের লক্ষ্য হতে হবে যাঁরা শ্রম বিনিয়োগ করেন এবং যে প্রতিষ্ঠানে করেন, উভয়ের কল্যাণ। এই আইনে শ্রমিকের যেমন অসন্তোষের জায়গা আছে, তেমনি আছে মালিকদেরও। এতে মালিকদের ওপর অনেক কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আইনে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও নিরাপত্তা সুরক্ষা না হলে মালিকদের ওপর জরিমানার যে বিধান রাখা হয়েছে, তা বেশি বলেই আমার ধারণা।
প্রথম আলো নতুন আইনে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মোহাম্মদ ফজলুল হক অনেকেই বলেন, ট্রেড ইউনিয়নসংবলিত শ্রম আইন। কিন্তু শিল্প কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার তো সব সময়ই ছিল। আগে ট্রেড ইউনিয়ন করার শর্ত হিসেবে রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে শ্রমিকেরা যে তালিকা দিতেন, তার একটি কপি মালিককেও দিতে হতো। এখানে তা তুলে দেওয়া হয়েছে। আইএলওর পরামর্শেই এটি করা হয়েছে। সেখানে শ্রমিক হয়রানির আশঙ্কা থাকত, মালিকপক্ষ তালিকা ধরে ধরে শ্রমিক ছাঁটাই করবে। শ্রমিকদের তালিকা নিয়ে যে সংশয় ও আশঙ্কা, সেটি ডেটাবেইস করা হলে দূর হবে। উন্নত দেশগুলো সেটাই অনুসরণ করে থাকে। এ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য ৩০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন থাকার যে বিধান রাখা হয়েছে, তাতে আপত্তির কিছু নেই। আমি মনে করি, এটি শ্রমিকদের জন্যও ভালো। যদি শ্রমিকদের সমর্থনই না থাকে, তাহলে শ্রমিক সংগঠন কীভাবে হবে?
তবে আমার আশঙ্কা, বিশেষজ্ঞদের নামে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা শ্রমিক ইউনিয়নে ঢুকে পড়লে তাঁরা মালিক বা শ্রমিক কারও স্বার্থ দেখবেন না, নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট থাকবেন। কারখানায় শ্রমিকদের মধ্য থেকেই শ্রমিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। বাইরে থেকে কেন লোক আনতে হবে? শিল্পপ্রতিষ্ঠান হলো একটি পরিবারের মতো। কোনো সমস্যা দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমেই তা সমাধান করতে হবে। মালিকপক্ষ আইন অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে শ্রম অধিদপ্তরে নালিশ করার কিংবা শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগ তো আছেই।
শ্রম আইনে মুনাফার যে ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে, আমি মনে করি তার সবটাই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের জন্য হওয়া উচিত। বর্তমান আইনে ৮০ শতাংশ সরাসরি শ্রমিকদের হাতে ১০ শতাংশ কল্যাণ তহবিলে এবং ১০ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জমা দেওয়ার কথা আছে। প্রথম দুটি যুক্তিযুক্ত হলেও শেষেরটি জটিলতা বাড়াবে। তাই আমি মনে করি, পুরোটাই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য রাখা উচিত।
প্রথম আলো ইপিজেড ট্রেড ইউনিয়ন সুবিধার বাইরে। এটি কতটা যুক্তিযুক্ত?
মোহাম্মদ ফজলুল হক বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতেই ইপিজেড বা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা গঠিত হয়েছিল। বিভিন্ন দেশে নানাভাবে আছে। এখানে বিনিয়োগকারীরা তাঁদের সুরক্ষা চাইবেন, সেটা স্বাভাবিক। তবে আইন সব জায়গায় সমান হওয়া উচিত। ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন হলে আপত্তির কিছু দেখি না।
প্রথম আলো বিদেশি গণমাধ্যমসহ অনেকেই ট্রেড ইউনিয়ন আইনকে অসম্পূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
মোহাম্মদ ফজলুল হক একটি আইনকে একেকজন একেক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কেউ মালিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে, কেউ শ্রমিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে। সব মিলিয়ে দেখতে হবে আইনটি শিল্পের স্বার্থ রক্ষা করছে কি না। আমি বলব, এই আইনটি মালিক-শ্রমিক উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করবে। এখানে যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে, তা হলো অসদাচরণের জন্য মালিকপক্ষ শ্রমিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। অসদাচরণ মানে ভাঙচুর ইত্যাদি। আমার কথা হলো, কারখানায় ভাঙচুর হবে কেন? আলোচনার মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
প্রথম আলো বাংলাদেশের শ্রমিকেরা সর্বনিম্ন বেতন পান বলে অভিযোগ আছে।
মোহাম্মদ ফজলুল হক নিম্নতম মজুরির বিষয়টি ঠিক হয় কীভাবে? এটি জীবনযাত্রার ব্যয়, কাজের দক্ষতা ইত্যাদির মাধ্যমে নিরূপিত হয়। এ ক্ষেত্রে বৈষম্য কমানো যেমন দরকার, তেমনি শ্রমিকের দক্ষতা বাড়ানোও জরুরি। আমাদের কাছাকাছির দেশ কম্বোডিয়া। সেখানে একজন শ্রমিক যে উৎপাদন করেন, আমাদের দেশের একজন শ্রমিক কিন্তু সেটি করেন না। সেখানে কারখানায় কাজ নেওয়ার আগে শ্রমিককে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। আর আমাদের এখানে শ্রমিকেরা নিম্নতম মজুরি পান কাজ না শিখেই। আমরা দাতা সংস্থাগুলোকে বলেছি, গবেষণার জন্য তোমরা যত অর্থ ব্যয় করো, তা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ তথা দক্ষতা বাড়ানোর জন্য করলে তাঁরা অনেক বেশি উপকৃত হবেন।
আরেকটি কথা, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, তা কেবল আইন করে দূর করা যাবে না। আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে উভয় পক্ষকে কাজ করতে হবে। শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা যেমন আমাদের দায়িত্ব, তেমনি কারখানায় কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখাও শ্রমিকদের দায়িত্ব।
প্রথম আলো যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি-সুবিধা বাতিলের বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
মোহাম্মদ ফজলুল হক আমার কাছে বিষয়টি অস্পষ্ট এবং সিদ্ধান্ত অনৈতিকও। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে কোনো জিএসপি-সুবিধা দেয় না। জিএসপি-সুবিধা পায় প্লাস্টিক, সিরামিকসহ বেশ কিছু খাত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার জিএসপি-সুবিধা বাতিল করেছে তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রমিকের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই, এই অজুহাতে। যাঁরা এই সুবিধা পেতেন, তাঁরা তো কোনো অন্যায় করেননি। তাহলে কেন তাঁদের এই শাস্তি দেওয়া হলো?
তবে এখানে সবারই দায় আছে বলে মনে করি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাবশালী দেশ যখন বিষয়টি সামনে নিয়ে এল, তখন সবারই আরও বেশি উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কেননা, এ ক্ষেত্রে রপ্তানি কমার চেয়েও ভাবমূর্তির বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ৮ জুলাই ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যে বৈঠক হয়েছে, তা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ছয় মাসের মধ্যে জিএসপি-সুবিধা ফিরে পাওয়া যাবে। আমরাও আশা করছি।
মালিকপক্ষের সচেতনতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। রানা প্লাজা দেখিয়েছে, আসলেই আমরা যথেষ্ট সচেতন ছিলাম না। এখানে মালিকের যেমন দায় আছে, তেমনি আছে ভবনের মালিকের। সরকারের তদারকি ব্যবস্থাও জোরদার করতে হবে, যাতে কেউ আইন অমান্য করতে না পারে।
প্রথম আলো জিএসপি-সুবিধা বাতিলের পর তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে কি?
মোহাম্মদ ফজলুল হক জুন মাস পর্যন্ত যে হিসাব আমাদের কাছে আছে, তাতে রপ্তানি কমেনি। কিন্তু এসব পণ্যের ক্রয়াদেশ দেওয়া হয়েছিল অনেক আগেই। রপ্তানির ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক. আগের ক্রেতাদের কাছে বিক্রির পরিমাণ বাড়ানো, নতুন ক্রেতা খোঁজা এবং নতুন দেশ খুঁজে বের করা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হয়তো পুরোনো ক্রেতারা চলে যাবে না; কিন্তু নেতিবাচক প্রচার থাকলে নতুন ক্রেতারা আসতে স্বভাবতই ভয় পাবে।
কিছুটা আশার জায়গা তৈরি হয়েছে, রানা প্লাজার ঘটনার পর আইএলওর মহাপরিচালক এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, আমরা যদি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের কাজের পরিবেশ উন্নত করতে চাই, সেটি করতে হবে সুযোগ-সুবিধা চালু রেখেই, বন্ধ করে দিলে তো উন্নতি হবে না।
তাই আমি মনে করি, আমাদের পোশাকশিল্পে যে সমস্যা আছে, তা শিগগিরই কেটে যাবে। এ জন্য মালিক, শ্রমিক ও সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ ফজলুল হক ধন্যবাদ।
সর্বশেষ সংবাদ শুনতে আপনার মোবাইল ফোন থেকে ডায়াল করুন ২২২১
প্রথম আলো সংশোধিত শ্রম আইন নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন এটি শ্রমিক নয়, মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
মোহাম্মদ ফজলুল হক একটি আইন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মূল্যায়ন করা যায়। অন্যান্য আইন থেকে শ্রম আইনের মৌলিক পার্থক্য হলো, এটি শিল্প তথা এর মালিক ও শ্রমিকের জন্য নির্দিষ্ট। সে ক্ষেত্রে এই আইন কারও পক্ষে বা বিপক্ষে এ কথা বলা যাবে না। যেকোনো শ্রম আইনের লক্ষ্য হতে হবে যাঁরা শ্রম বিনিয়োগ করেন এবং যে প্রতিষ্ঠানে করেন, উভয়ের কল্যাণ। এই আইনে শ্রমিকের যেমন অসন্তোষের জায়গা আছে, তেমনি আছে মালিকদেরও। এতে মালিকদের ওপর অনেক কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আইনে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও নিরাপত্তা সুরক্ষা না হলে মালিকদের ওপর জরিমানার যে বিধান রাখা হয়েছে, তা বেশি বলেই আমার ধারণা।
প্রথম আলো নতুন আইনে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মোহাম্মদ ফজলুল হক অনেকেই বলেন, ট্রেড ইউনিয়নসংবলিত শ্রম আইন। কিন্তু শিল্প কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার তো সব সময়ই ছিল। আগে ট্রেড ইউনিয়ন করার শর্ত হিসেবে রেজিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে শ্রমিকেরা যে তালিকা দিতেন, তার একটি কপি মালিককেও দিতে হতো। এখানে তা তুলে দেওয়া হয়েছে। আইএলওর পরামর্শেই এটি করা হয়েছে। সেখানে শ্রমিক হয়রানির আশঙ্কা থাকত, মালিকপক্ষ তালিকা ধরে ধরে শ্রমিক ছাঁটাই করবে। শ্রমিকদের তালিকা নিয়ে যে সংশয় ও আশঙ্কা, সেটি ডেটাবেইস করা হলে দূর হবে। উন্নত দেশগুলো সেটাই অনুসরণ করে থাকে। এ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য ৩০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন থাকার যে বিধান রাখা হয়েছে, তাতে আপত্তির কিছু নেই। আমি মনে করি, এটি শ্রমিকদের জন্যও ভালো। যদি শ্রমিকদের সমর্থনই না থাকে, তাহলে শ্রমিক সংগঠন কীভাবে হবে?
তবে আমার আশঙ্কা, বিশেষজ্ঞদের নামে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা শ্রমিক ইউনিয়নে ঢুকে পড়লে তাঁরা মালিক বা শ্রমিক কারও স্বার্থ দেখবেন না, নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট থাকবেন। কারখানায় শ্রমিকদের মধ্য থেকেই শ্রমিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। বাইরে থেকে কেন লোক আনতে হবে? শিল্পপ্রতিষ্ঠান হলো একটি পরিবারের মতো। কোনো সমস্যা দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমেই তা সমাধান করতে হবে। মালিকপক্ষ আইন অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে শ্রম অধিদপ্তরে নালিশ করার কিংবা শ্রম আদালতে মামলা করার সুযোগ তো আছেই।
শ্রম আইনে মুনাফার যে ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে, আমি মনে করি তার সবটাই কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের জন্য হওয়া উচিত। বর্তমান আইনে ৮০ শতাংশ সরাসরি শ্রমিকদের হাতে ১০ শতাংশ কল্যাণ তহবিলে এবং ১০ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জমা দেওয়ার কথা আছে। প্রথম দুটি যুক্তিযুক্ত হলেও শেষেরটি জটিলতা বাড়াবে। তাই আমি মনে করি, পুরোটাই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য রাখা উচিত।
প্রথম আলো ইপিজেড ট্রেড ইউনিয়ন সুবিধার বাইরে। এটি কতটা যুক্তিযুক্ত?
মোহাম্মদ ফজলুল হক বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতেই ইপিজেড বা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা গঠিত হয়েছিল। বিভিন্ন দেশে নানাভাবে আছে। এখানে বিনিয়োগকারীরা তাঁদের সুরক্ষা চাইবেন, সেটা স্বাভাবিক। তবে আইন সব জায়গায় সমান হওয়া উচিত। ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন হলে আপত্তির কিছু দেখি না।
প্রথম আলো বিদেশি গণমাধ্যমসহ অনেকেই ট্রেড ইউনিয়ন আইনকে অসম্পূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
মোহাম্মদ ফজলুল হক একটি আইনকে একেকজন একেক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কেউ মালিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে, কেউ শ্রমিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে। সব মিলিয়ে দেখতে হবে আইনটি শিল্পের স্বার্থ রক্ষা করছে কি না। আমি বলব, এই আইনটি মালিক-শ্রমিক উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করবে। এখানে যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে, তা হলো অসদাচরণের জন্য মালিকপক্ষ শ্রমিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। অসদাচরণ মানে ভাঙচুর ইত্যাদি। আমার কথা হলো, কারখানায় ভাঙচুর হবে কেন? আলোচনার মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
প্রথম আলো বাংলাদেশের শ্রমিকেরা সর্বনিম্ন বেতন পান বলে অভিযোগ আছে।
মোহাম্মদ ফজলুল হক নিম্নতম মজুরির বিষয়টি ঠিক হয় কীভাবে? এটি জীবনযাত্রার ব্যয়, কাজের দক্ষতা ইত্যাদির মাধ্যমে নিরূপিত হয়। এ ক্ষেত্রে বৈষম্য কমানো যেমন দরকার, তেমনি শ্রমিকের দক্ষতা বাড়ানোও জরুরি। আমাদের কাছাকাছির দেশ কম্বোডিয়া। সেখানে একজন শ্রমিক যে উৎপাদন করেন, আমাদের দেশের একজন শ্রমিক কিন্তু সেটি করেন না। সেখানে কারখানায় কাজ নেওয়ার আগে শ্রমিককে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। আর আমাদের এখানে শ্রমিকেরা নিম্নতম মজুরি পান কাজ না শিখেই। আমরা দাতা সংস্থাগুলোকে বলেছি, গবেষণার জন্য তোমরা যত অর্থ ব্যয় করো, তা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ তথা দক্ষতা বাড়ানোর জন্য করলে তাঁরা অনেক বেশি উপকৃত হবেন।
আরেকটি কথা, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, তা কেবল আইন করে দূর করা যাবে না। আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে উভয় পক্ষকে কাজ করতে হবে। শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা যেমন আমাদের দায়িত্ব, তেমনি কারখানায় কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখাও শ্রমিকদের দায়িত্ব।
প্রথম আলো যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি-সুবিধা বাতিলের বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
মোহাম্মদ ফজলুল হক আমার কাছে বিষয়টি অস্পষ্ট এবং সিদ্ধান্ত অনৈতিকও। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে কোনো জিএসপি-সুবিধা দেয় না। জিএসপি-সুবিধা পায় প্লাস্টিক, সিরামিকসহ বেশ কিছু খাত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার জিএসপি-সুবিধা বাতিল করেছে তৈরি পোশাকশিল্পে শ্রমিকের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই, এই অজুহাতে। যাঁরা এই সুবিধা পেতেন, তাঁরা তো কোনো অন্যায় করেননি। তাহলে কেন তাঁদের এই শাস্তি দেওয়া হলো?
তবে এখানে সবারই দায় আছে বলে মনে করি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাবশালী দেশ যখন বিষয়টি সামনে নিয়ে এল, তখন সবারই আরও বেশি উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কেননা, এ ক্ষেত্রে রপ্তানি কমার চেয়েও ভাবমূর্তির বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ৮ জুলাই ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যে বৈঠক হয়েছে, তা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ছয় মাসের মধ্যে জিএসপি-সুবিধা ফিরে পাওয়া যাবে। আমরাও আশা করছি।
মালিকপক্ষের সচেতনতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। রানা প্লাজা দেখিয়েছে, আসলেই আমরা যথেষ্ট সচেতন ছিলাম না। এখানে মালিকের যেমন দায় আছে, তেমনি আছে ভবনের মালিকের। সরকারের তদারকি ব্যবস্থাও জোরদার করতে হবে, যাতে কেউ আইন অমান্য করতে না পারে।
প্রথম আলো জিএসপি-সুবিধা বাতিলের পর তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে কি?
মোহাম্মদ ফজলুল হক জুন মাস পর্যন্ত যে হিসাব আমাদের কাছে আছে, তাতে রপ্তানি কমেনি। কিন্তু এসব পণ্যের ক্রয়াদেশ দেওয়া হয়েছিল অনেক আগেই। রপ্তানির ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক. আগের ক্রেতাদের কাছে বিক্রির পরিমাণ বাড়ানো, নতুন ক্রেতা খোঁজা এবং নতুন দেশ খুঁজে বের করা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হয়তো পুরোনো ক্রেতারা চলে যাবে না; কিন্তু নেতিবাচক প্রচার থাকলে নতুন ক্রেতারা আসতে স্বভাবতই ভয় পাবে।
কিছুটা আশার জায়গা তৈরি হয়েছে, রানা প্লাজার ঘটনার পর আইএলওর মহাপরিচালক এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, আমরা যদি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের কাজের পরিবেশ উন্নত করতে চাই, সেটি করতে হবে সুযোগ-সুবিধা চালু রেখেই, বন্ধ করে দিলে তো উন্নতি হবে না।
তাই আমি মনে করি, আমাদের পোশাকশিল্পে যে সমস্যা আছে, তা শিগগিরই কেটে যাবে। এ জন্য মালিক, শ্রমিক ও সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ ফজলুল হক ধন্যবাদ।
সর্বশেষ সংবাদ শুনতে আপনার মোবাইল ফোন থেকে ডায়াল করুন ২২২১
No comments