রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থান by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

রাজনীতিতে মিথ্যাচার ও সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে কথা বলার রেওয়াজ অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ যুগে সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি এবং পাশাপাশি বিরক্তি ও হতাশার জন্ম দিচ্ছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এবং সর্বোপরি এসব মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য মানুষের মনে যাচাই-বাছাই করার চিন্তা জন্মায়। এর ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কোনটি সঠিক এবং কোনটি সঠিক নয়। অহেতুক দোদুল্যমানতায় থাকা এখন একমাত্র গোঁড়া লোক কিংবা প্রবাদ আছে 'বুঝেও না বোঝার ভান করা' মানুষের মধ্যে শোভা পায়। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, দেশে শিক্ষিতের হার বাড়ছে, মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে- এর অর্থ এই নয় যে মানুষের বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। লক্ষ করে দেখবেন, যখন বলা হয় চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে, তখন অনেকে বিশ্বাস করেছেন। ধর্মীয় বিশ্বাস প্রকট থেকে এ ধারণা জন্মানো অস্বাভাবিক নয় যে সাঈদীর মতো দ্বীনদার মানুষকে চাঁদে দেখা যেতে পারে। সাধারণ মানুষ আপাত যুক্তি না খুঁজে প্রগাঢ় বিশ্বাসবোধ থেকে নিজস্ব যুক্তিকে আপাতত একপাশে রেখে তখন এক প্রকার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যাকে চাঁদে দেখা গেছে, তার মতো ভালো মানুষ কেই বা হতে পারে। এ মানসে তার পক্ষে দাঁড়াতে দেখা যায়।
এ তো গেল চাঁদে সাঈদীকে দেখার কথা। ধর্মীয় বিশ্বাসবোধকে পুঁজি করে মিথ্যাচারের এক সংস্কৃতি। কিন্তু রাজনীতিতে মিথ্যাচারের প্রবণতা এখন দেশীয় পর্যায়ে থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যখন অবাধ তথ্যপ্রবাহ ছিল না, তখন বললে হয়তো মেনে নেওয়া যেত। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন সরকারি অনেক তথ্য মানুষের নাগালের বাইরে ছিল। একমাত্র বিটিভির বদৌলতে আমাদের ভালো-মন্দ সব কিছু হজম করতে হতো। এখন আমাদের জোর করে সব কিছু হজম করানো যায় না। একটি চ্যানেল সত্য বলল তো অন্যটি মিথ্যা বলবে। সত্য-মিথ্যার এ প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের কাছে আসল সত্যটি প্রতীয়মান হবে। সাধারণের এ ক্ষমতার উন্নয়ন ঘটেছে যে কোনটি সঠিক। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা ওয়াশিংটন টাইমসে একটি নিবন্ধ লিখলেন। তখন বিএনপির নেতারা ফুরফুরে মেজাজে এর সাফাই গাইলেন। কিন্তু বাদ সাধল যখন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তৈরি পোশাকশিল্পে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করল তার পর থেকে। সাধারণ মানুষের মনে এ ধারণা হয়তো জন্মায় যে খালেদা জিয়ার এ নিবন্ধের জন্য জিএসপি সুবিধা বাতিল হয়েছে। তবে শিক্ষিত মানুষ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এটিও জোরালোভাবে ভাবেন যে একমাত্র ওই নিবন্ধের কারণে এ সুবিধা বাতিল হয়েছে এমনটি নয়। এখানে প্রশ্ন হলো, তিনি কেনই বা নিবন্ধ লিখলেন এবং পরবর্তী সময়ে অস্বীকার করার হেতুও বা কী? আমরা সাধারণ জ্ঞানে যা বুঝি তা হলো, কারো নামে কোনো নিবন্ধ ছাপা হলে তিনি যদি তার লেখক না হন, সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করেন। কিন্তু তিনি তা না করে অনেক দিন পর সংসদে দাঁড়িয়ে অস্বীকার করলেন যে তিনি লেখেননি। এর মাধ্যমে তাঁর দায় শেষ হয়ে যায় না। তিনি যদি সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করে সাধারণ মানুষদের জানাতেন, তাহলে আজকে তাঁর নিবন্ধ লেখা নিয়ে কোনো ধূম্রজালের সৃষ্টি হতো না। একজন দায়িত্বশীল বিরোধী দলের নেতা হিসেবে আমরা তাঁর কাছে দায়িত্বশীল কর্মকাণ্ড আশা করেছিলাম।
হেফাজতে ইসলামের নেতা আল্লামা শফী মহিলা ও পুরুষ সম্পর্কে, বিশেষ করে মহিলাদের সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ, বিকৃত ও অসম্মানজনক মন্তব্য করেছেন, যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তিনি দেশের বাইরে থাকায় তাঁর বক্তব্য সম্পর্কে মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তিনি হয়তো আমাদের বিরোধীদলীয় নেতার মতো তাঁর বক্তব্যকে অস্বীকার করতেন। তবে তাঁর দলের মুখপাত্র হেফাজতের অন্য এক নেতা বক্তব্য অস্বীকার না করে বলেছেন, আল্লামা শফী গ্রামীণ পরিমণ্ডলে এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। আশার কথা হলো, মুখপাত্র অস্বীকার করেননি যে আমাদের নেতা এ ধরনের বক্তব্য দেননি। অবশ্য অস্বীকার করার কারণ নেই, প্রয়োজনও নেই। কেননা তাঁরা মহিলাদের সম্পর্কে যেভাবে চিন্তা করেন, সেভাবেই বলেছেন। কিন্তু আমাদের হতাশ করে একজন নারী হয়েও যখন বিরোধীদলীয় একজন সংসদ সদস্য আল্লামা শফীর বক্তব্য বিকৃতভাবে মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে দাবি করেন। যেখানে হেফাজতে ইসলাম অস্বীকার করছে না, সেখানে বিএনপির পক্ষ থেকে তাঁর বক্তব্যের মধ্যে বিকৃতির গন্ধ খুঁজে পাওয়া এবং বক্তব্যের সাফাই গাওয়ার মনোবৃত্তি আমাদের দারুণভাবে হতাশ করে। আমাদের হতাশ করে, যখন লাখ লাখ শ্রমজীবী নারীর পরিশ্রমে এ দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল থাকছে, যাঁদের করের টাকায় আমাদের মাননীয় মহিলা সংসদ সদস্যরা শুল্কমুক্ত গাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন; আর যখন তাঁদের সম্পর্কে বিকৃত লালসার মতো মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া হয়, তখন তাঁরা তার সমর্থন করেন।
দুর্নীতির তালিকায় যখন রাজনীতিবিদদের নাম প্রথম, তখন রাজনীতিবিদ অর্থ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। স্বীকার করছি, ক্ষমতাসীনদের কাছে যেহেতু দেশ পরিচালনার সব কৌশল থাকে, সেহেতু দুর্নীতির দায় তাদেরই নিতে হয়। কিন্তু আজকে যিনি বিরোধী দলে থেকে দুর্নীতির দায় থেকে নিজেদের মুক্ত রাখছেন, ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন হলে একই দুর্নীতির তীর তাঁদের দিকে গেলে টিআইবির রিপোর্টকে তাঁরা কি স্বাগত জানাবেন এবং বলবেন, হ্যাঁ আমরা দুর্নীতিবাজ। অবশ্যই তাঁরা তা করবেন না। ইতিহাস তা বলে না। আজকে যিনি সহজে টিআইবির রিপোর্টের পক্ষে সাফাই গাইলেন, ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন হলে একই রিপোর্টকে তুলোধুনা করে ছাড়বেন।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.