সিটি নির্বাচনের আলোকে আগামী নির্বাচন by এ এম এম শওকত আলী
একের পর এক সিটি নির্বাচনে বিরোধী দল
সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা জয়ী হওয়ায় জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে রাজনৈতিক
বিতর্ক এখন তুঙ্গে। প্রায় প্রতিদিন এ বিষয়ে দুই প্রধান দলের পাল্টাপাল্টি
বক্তব্য মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে।
এ বক্তব্যের সঙ্গে
নির্বাচন কমিশনও জড়িত। তবে ভিন্নভাবে। কমিশন দাবি করছে, অবাধ, সুষ্ঠু ও
নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে কমিশন সক্ষম। এর জন্য কারো দ্বারস্থ হতে
হবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার গাজীপুর সিটি নির্বাচন হওয়ার পর এ দাবি
প্রকাশ্যে করেন। তবে এ সাফল্যের পেছনে অন্য কারণও রয়েছে। এ কারণটি
পরোক্ষভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারই বলেছেন। তাঁর মতে, এখন আর নির্বাচনে
বহিরাগত প্রভাব বিস্তার বা ভোট কারচুপির কোনো সম্ভাবনা বা সুযোগ নেই।
প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতাও এ কথা বলেছেন। তিনি দুই
শতাধিক বেসরকারি পর্যবেক্ষকের উপস্থিতির যুক্তি দিয়ে প্রধান বিরোধী দলের
ভোট কারচুপির অভিযোগ খণ্ডন করেছেন। জানা যায়, এ নির্বাচনে ২৯ এনজিওর
প্রতিনিধিরা পর্যবেক্ষণের কাজ করেছেন। তাঁরাও বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু
হয়েছে।
বিশিষ্টজনসহ নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে ভিন্নতর মত রয়েছে, যা কালের কণ্ঠে ৯ জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত। এ যুক্তি দুই প্রধান দলের নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামোর চলমান বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত। পাঁচটি নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায় ধারণা করা সম্ভব যে জাতীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে এখন হওয়া সম্ভব। ৯ জুলাই বিশিষ্টজনদের অভিমতে এ ধারণা যে ভুল তার সপক্ষে বেশ কিছু যুক্তি দেওয়া হয়েছে। যে কথাটি বলা হয়নি তা হলো, পাঁচটি সিটি নির্বাচনেই মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা দুই প্রধান দলের ছিলেন। সব বিরোধী দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছেন। কাউন্সিলারদের মধ্যে গাজীপুর বাদে প্রায় একই ধারা। এ ছাড়া কিছু উপজেলা পর্যায়ে মেয়ররা হয় বিরোধী দলের, নয় ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। বিরোধী দলের মূল নির্বাচনী স্লোগান তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বলা যায়, এটাই ভোটাররা মেনে নিয়েছেন।
পূর্ববর্তী চার সিটি নির্বাচনে সরকারি প্রভাবের বিষয়ে অপেক্ষাকৃত কম অভিযোগ ছিল। কিন্তু গাজীপুর সিটি নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন ও পরেও এ ধরনের প্রচুর অভিযোগের কথা শোনা গেছে। একের পর এক সিটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধান বিরোধী দল এখন উজ্জীবিত। তারা সরকারকে পদত্যাগ করারও আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তি, সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নেই। সরকারবহির্ভূত রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ বিশিষ্টজনরাও বলেছেন যে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন মন্ত্রীও বলেছেন জনপ্রিয়তা হ্রাসের কথা এবং এ নিয়ে শিক্ষা নেওয়ার কথা। এক বিরোধী দলের নেতা বলেছেন, জনগণ সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছে। পরোক্ষ ইঙ্গিত হলো, জাতীয় নির্বাচনে আসবে রেড কার্ড। এসব বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্নটি অমীমাংসিত তা হলো, প্রধান বিরোধী দলের মূল দাবি ক্ষমতাসীন দল মেনে নেবে কি না। শেষোক্ত দলের নেতাদের যুক্তি ভিন্নতর। পরপর পাঁচটি সিটি নির্বাচন যখন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃ প্রতিষ্ঠার দাবির কোনো যৌক্তিকতা নেই। ক্ষমতাসীন দলের প্রধান এর আগে বলেছিল, সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিরোধী দল প্রমাণ করেছে, তারা নির্বাচন চায়। আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা আশাবাদী।
পক্ষান্তরে প্রধান বিরোধী দল এত দিন ধরে যে দাবির কথা বলে আন্দোলন করেছিল তা থেকে সরে আসবে না বলে জানিয়েছে। অতএব আগামী নির্বাচন হবে কি হবে না এ নিয়েও বিতর্ক চলছে। ৮ জুলাই কালের কণ্ঠে এ বিষয়ে এক বিরোধী রাজনৈতিক নেতার উক্তি প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে না নিলে নির্বাচন না হওয়ারই আশঙ্কা বেশি। নির্বাচন না হলে সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে। এর ফলে অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে। এ প্রশ্নটিই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিরোধী দল শেষ পর্যন্ত কি সিদ্ধান্ত নেবে, তা সহজে বলা সম্ভব নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, কিছুদিন আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃ প্রবর্তনের বিষয়ে একটি দৈনিকের জরিপ অনুযায়ী দেখা যায়, দেশের বেশির ভাগ জনমানুষই এটা সমর্থন করে। এ সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দল এ দাবি মানতে নারাজ। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশেই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে জনমত জরিপ করা হয়। ওই সব দেশে জরিপের ফলাফলকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয় এবং তার আলোকে রাজনৈতিক কৌশলের পরিবর্তনও হয়। বাংলাদেশে এ রীতি এখনো চালু হয়নি। হলে ভালো হতো।
জাতীয় পর্যায়ের সব রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। আইন ও বিধি অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ কাঠামোর সক্ষমতা বা দুর্বলতা যাচাই করা সম্ভব। তা না হলে চাটুকার-মোসাহেব বা হেঁ হেঁ সংঘ পরিবেষ্টিত মতামতের আলোকে ধরে নেওয়া হয় যে দলের সাংগঠনিক শক্তি অক্ষুণ্ন রয়েছে। অনেকের মতে, গাজীপুরের নির্বাচনে এমনটাই হয়েছে। বিরোধী জোটের সাম্প্রতিককালের আন্দোলন ও বিক্ষোভ দমন করার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে ধারণা হয়, এদের কোনো সাংগঠনিক ক্ষমতা এখন আর নেই। পরপর পাঁচটি সিটি নির্বাচন প্রমাণ করেছে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য দলীয় সাংগঠনিক ক্ষমতার প্রয়োজন রয়েছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। জনগণের চিন্তাচেতনা ও ক্ষমতাসীন দলের সুশাসন বা অপশাসনের সঙ্গে জনপ্রিয়তার রদবদল হয়। এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের এক মন্ত্রীর মন্তব্য প্রাসঙ্গিক। তাঁর মতে, জনগণের কাছে দুর্ভেদ্য দুর্গ বলে কিছু নেই। জনগণ যেকোনো দুর্গই ভেঙে দিতে পারে, যদি তারা আস্থা হারায়।
পরপর পাঁচটি সিটি নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার ঘটনা জনমনে যে ধারণার সৃষ্টি করেছে তা হলো ক্ষমতাসীন দলের ওপর জনগণের কোনো আস্থা নেই। এর কারণগুলোও কয়েক সপ্তাহ ধরে মিডিয়ায় প্রকাশ করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি কারণ- দুর্নীতি, অপশাসন, দিনবদলের অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থতা, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ না করা, টেন্ডারবাজ-চাঁদাবাজদের কার্যক্রম বন্ধে ব্যর্থতা, ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থতা, হেফাজতে ইসলাম ও ধর্মীয় প্রচার। এ ছাড়া রয়েছে দলীয় কোন্দল, যার বহিঃপ্রকাশ দৃশ্যমান ছিল গাজীপুরে। সাম্প্রতিককালে আরো একটি কারণ যোগ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনা অনেকেই ভালো চোখে দেখছে না। অধ্যাপক ইউনূসও এ বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন, যা আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে।
এসব কারণের মধ্যে কোনটা সবচেয়ে বেশি সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজয় ত্বরান্বিত করেছে তা নির্ণয় করা কঠিন। গত ৯ জুলাই টিআইবি ২০১২ সালের বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। এ সমীক্ষায় জরিপের আওতাভুক্ত ব্যক্তিদের অভিমতে দেখা যায়, পূর্ববর্তী বছরের (২০১০) তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষেত্রগুলো হলো রাজনীতি, পুলিশ, ভূমিসেবা এবং এর সঙ্গে যোগ করা যায় টেন্ডারবাজ-চাঁদাবাজদের অব্যাহত কার্যক্রম। অনেকে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নীতিকেও জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ হিসেবে মনে করে। এ বিষয়টি অবশ্য অনুসন্ধানসাপেক্ষ।
এসব ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেকেই এখন সংশয় প্রকাশ করছেন। প্রধান বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে আরো শক্ত অবস্থান নিয়েছে। তারা এ প্রশ্নে কোনো ছাড় না দেওয়ার কথা বলেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচন হবে এবং দল ঘুরে দাঁড়াবে। বিরোধী দলের নেতা দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আরো বেশি গোলে হারবে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলনেতা জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, বাংলাদেশে ওই দেশেরই মতো দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৯৬ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল জামায়াতের সমর্থন নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায় করেছিল। ওই সময়ের ক্ষমতাসীন দল যা বর্তমানে প্রধান বিরোধী দল, এ প্রথার তীব্র বিরোধিতা করেছিল। রাজনীতিতে সবই সম্ভব।
জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণে আগামী সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবির বিষয়টি সহজে ধরে নেওয়া যায় না। কারণ সিটি নির্বাচন হয়েছে বড় শহরে। সংসদ নির্বাচন হবে দেশব্যাপী। লোকসংখ্যার অনুপাতে শহরবহির্ভূত এলাকায় ভোটারের আধিক্য। গ্রামের ভোটাররাই দুই প্রধান দলের জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবে। অতীতের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০১ সালে শহরবহির্ভূত অঞ্চলে নির্বাচনী এলাকা ছিল ২০১টি। বাকি ৯০টি ছিল শহুরে নির্বাচনী এলাকা, এ সংখ্যার অল্প কিছু তারতম্য বর্তমানে হতে পারে; কিন্তু সার্বিকভাবে শহরের বাইরেই ভোটার বেশি থাকবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রধান দুই দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি হবে তাৎপর্যপূর্ণ। এ বিষয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ভূমিকা ফলাফল নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। অতীত অভিজ্ঞতা এ কথাই প্রমাণ করে। এ বিষয়টি নির্বাচনী এলাকায় সঠিক প্রার্থীর মনোনয়নের সঙ্গে যুক্ত। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে বিদ্রোহী প্রার্থীর সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি ক্ষমতাসীন দলের জন্য ইতিবাচক প্রভাব রাখেনি। ক্ষমতাসীন দলের এক নীতিনির্ধারক গাজীপুর নির্বাচনের পর তৃণমূল পর্যায়ের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থীর মনোনয়ন দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছেন।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
বিশিষ্টজনসহ নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে ভিন্নতর মত রয়েছে, যা কালের কণ্ঠে ৯ জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত। এ যুক্তি দুই প্রধান দলের নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামোর চলমান বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত। পাঁচটি নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায় ধারণা করা সম্ভব যে জাতীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে এখন হওয়া সম্ভব। ৯ জুলাই বিশিষ্টজনদের অভিমতে এ ধারণা যে ভুল তার সপক্ষে বেশ কিছু যুক্তি দেওয়া হয়েছে। যে কথাটি বলা হয়নি তা হলো, পাঁচটি সিটি নির্বাচনেই মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা দুই প্রধান দলের ছিলেন। সব বিরোধী দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছেন। কাউন্সিলারদের মধ্যে গাজীপুর বাদে প্রায় একই ধারা। এ ছাড়া কিছু উপজেলা পর্যায়ে মেয়ররা হয় বিরোধী দলের, নয় ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। বিরোধী দলের মূল নির্বাচনী স্লোগান তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বলা যায়, এটাই ভোটাররা মেনে নিয়েছেন।
পূর্ববর্তী চার সিটি নির্বাচনে সরকারি প্রভাবের বিষয়ে অপেক্ষাকৃত কম অভিযোগ ছিল। কিন্তু গাজীপুর সিটি নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন ও পরেও এ ধরনের প্রচুর অভিযোগের কথা শোনা গেছে। একের পর এক সিটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধান বিরোধী দল এখন উজ্জীবিত। তারা সরকারকে পদত্যাগ করারও আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তি, সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নেই। সরকারবহির্ভূত রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ বিশিষ্টজনরাও বলেছেন যে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন মন্ত্রীও বলেছেন জনপ্রিয়তা হ্রাসের কথা এবং এ নিয়ে শিক্ষা নেওয়ার কথা। এক বিরোধী দলের নেতা বলেছেন, জনগণ সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছে। পরোক্ষ ইঙ্গিত হলো, জাতীয় নির্বাচনে আসবে রেড কার্ড। এসব বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্নটি অমীমাংসিত তা হলো, প্রধান বিরোধী দলের মূল দাবি ক্ষমতাসীন দল মেনে নেবে কি না। শেষোক্ত দলের নেতাদের যুক্তি ভিন্নতর। পরপর পাঁচটি সিটি নির্বাচন যখন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃ প্রতিষ্ঠার দাবির কোনো যৌক্তিকতা নেই। ক্ষমতাসীন দলের প্রধান এর আগে বলেছিল, সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিরোধী দল প্রমাণ করেছে, তারা নির্বাচন চায়। আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা আশাবাদী।
পক্ষান্তরে প্রধান বিরোধী দল এত দিন ধরে যে দাবির কথা বলে আন্দোলন করেছিল তা থেকে সরে আসবে না বলে জানিয়েছে। অতএব আগামী নির্বাচন হবে কি হবে না এ নিয়েও বিতর্ক চলছে। ৮ জুলাই কালের কণ্ঠে এ বিষয়ে এক বিরোধী রাজনৈতিক নেতার উক্তি প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে না নিলে নির্বাচন না হওয়ারই আশঙ্কা বেশি। নির্বাচন না হলে সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে। এর ফলে অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে। এ প্রশ্নটিই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিরোধী দল শেষ পর্যন্ত কি সিদ্ধান্ত নেবে, তা সহজে বলা সম্ভব নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, কিছুদিন আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃ প্রবর্তনের বিষয়ে একটি দৈনিকের জরিপ অনুযায়ী দেখা যায়, দেশের বেশির ভাগ জনমানুষই এটা সমর্থন করে। এ সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন দল এ দাবি মানতে নারাজ। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশেই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে জনমত জরিপ করা হয়। ওই সব দেশে জরিপের ফলাফলকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয় এবং তার আলোকে রাজনৈতিক কৌশলের পরিবর্তনও হয়। বাংলাদেশে এ রীতি এখনো চালু হয়নি। হলে ভালো হতো।
জাতীয় পর্যায়ের সব রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। আইন ও বিধি অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ কাঠামোর সক্ষমতা বা দুর্বলতা যাচাই করা সম্ভব। তা না হলে চাটুকার-মোসাহেব বা হেঁ হেঁ সংঘ পরিবেষ্টিত মতামতের আলোকে ধরে নেওয়া হয় যে দলের সাংগঠনিক শক্তি অক্ষুণ্ন রয়েছে। অনেকের মতে, গাজীপুরের নির্বাচনে এমনটাই হয়েছে। বিরোধী জোটের সাম্প্রতিককালের আন্দোলন ও বিক্ষোভ দমন করার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে ধারণা হয়, এদের কোনো সাংগঠনিক ক্ষমতা এখন আর নেই। পরপর পাঁচটি সিটি নির্বাচন প্রমাণ করেছে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য দলীয় সাংগঠনিক ক্ষমতার প্রয়োজন রয়েছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। জনগণের চিন্তাচেতনা ও ক্ষমতাসীন দলের সুশাসন বা অপশাসনের সঙ্গে জনপ্রিয়তার রদবদল হয়। এটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের এক মন্ত্রীর মন্তব্য প্রাসঙ্গিক। তাঁর মতে, জনগণের কাছে দুর্ভেদ্য দুর্গ বলে কিছু নেই। জনগণ যেকোনো দুর্গই ভেঙে দিতে পারে, যদি তারা আস্থা হারায়।
পরপর পাঁচটি সিটি নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার ঘটনা জনমনে যে ধারণার সৃষ্টি করেছে তা হলো ক্ষমতাসীন দলের ওপর জনগণের কোনো আস্থা নেই। এর কারণগুলোও কয়েক সপ্তাহ ধরে মিডিয়ায় প্রকাশ করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি কারণ- দুর্নীতি, অপশাসন, দিনবদলের অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থতা, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ না করা, টেন্ডারবাজ-চাঁদাবাজদের কার্যক্রম বন্ধে ব্যর্থতা, ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থতা, হেফাজতে ইসলাম ও ধর্মীয় প্রচার। এ ছাড়া রয়েছে দলীয় কোন্দল, যার বহিঃপ্রকাশ দৃশ্যমান ছিল গাজীপুরে। সাম্প্রতিককালে আরো একটি কারণ যোগ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনা অনেকেই ভালো চোখে দেখছে না। অধ্যাপক ইউনূসও এ বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন, যা আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে।
এসব কারণের মধ্যে কোনটা সবচেয়ে বেশি সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজয় ত্বরান্বিত করেছে তা নির্ণয় করা কঠিন। গত ৯ জুলাই টিআইবি ২০১২ সালের বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। এ সমীক্ষায় জরিপের আওতাভুক্ত ব্যক্তিদের অভিমতে দেখা যায়, পূর্ববর্তী বছরের (২০১০) তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষেত্রগুলো হলো রাজনীতি, পুলিশ, ভূমিসেবা এবং এর সঙ্গে যোগ করা যায় টেন্ডারবাজ-চাঁদাবাজদের অব্যাহত কার্যক্রম। অনেকে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নীতিকেও জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ হিসেবে মনে করে। এ বিষয়টি অবশ্য অনুসন্ধানসাপেক্ষ।
এসব ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেকেই এখন সংশয় প্রকাশ করছেন। প্রধান বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে আরো শক্ত অবস্থান নিয়েছে। তারা এ প্রশ্নে কোনো ছাড় না দেওয়ার কথা বলেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচন হবে এবং দল ঘুরে দাঁড়াবে। বিরোধী দলের নেতা দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আরো বেশি গোলে হারবে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলনেতা জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, বাংলাদেশে ওই দেশেরই মতো দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৯৬ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল জামায়াতের সমর্থন নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায় করেছিল। ওই সময়ের ক্ষমতাসীন দল যা বর্তমানে প্রধান বিরোধী দল, এ প্রথার তীব্র বিরোধিতা করেছিল। রাজনীতিতে সবই সম্ভব।
জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণে আগামী সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবির বিষয়টি সহজে ধরে নেওয়া যায় না। কারণ সিটি নির্বাচন হয়েছে বড় শহরে। সংসদ নির্বাচন হবে দেশব্যাপী। লোকসংখ্যার অনুপাতে শহরবহির্ভূত এলাকায় ভোটারের আধিক্য। গ্রামের ভোটাররাই দুই প্রধান দলের জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবে। অতীতের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০১ সালে শহরবহির্ভূত অঞ্চলে নির্বাচনী এলাকা ছিল ২০১টি। বাকি ৯০টি ছিল শহুরে নির্বাচনী এলাকা, এ সংখ্যার অল্প কিছু তারতম্য বর্তমানে হতে পারে; কিন্তু সার্বিকভাবে শহরের বাইরেই ভোটার বেশি থাকবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রধান দুই দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি হবে তাৎপর্যপূর্ণ। এ বিষয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ভূমিকা ফলাফল নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। অতীত অভিজ্ঞতা এ কথাই প্রমাণ করে। এ বিষয়টি নির্বাচনী এলাকায় সঠিক প্রার্থীর মনোনয়নের সঙ্গে যুক্ত। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে বিদ্রোহী প্রার্থীর সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি ক্ষমতাসীন দলের জন্য ইতিবাচক প্রভাব রাখেনি। ক্ষমতাসীন দলের এক নীতিনির্ধারক গাজীপুর নির্বাচনের পর তৃণমূল পর্যায়ের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থীর মনোনয়ন দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছেন।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments