কেলেঙ্কারির শেষ নেই সোনালী ব্যাংকে by আবুল কাশেম
এবার সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে
উদ্ঘাটিত হয়েছে বড় রকমের কেলেঙ্কারির ঘটনা। জালিয়াতি-অনিয়মের অদ্ভুত সব
কাণ্ড ঘটেছে এ শাখায়। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যেমন কোনো কিছু সঠিকভাবে
যাচাই-বাছাই করা হয়নি,
তেমনি পুরনো ঋণ আদায় সম্ভব নয়
জানার পরও নতুন করে শত শত কোটি টাকা বিলানো হয়েছে। ঋণের সুদ আদায় তো দূরের
কথা, আসল পর্যন্ত মওকুফ করে দেওয়ার মতো উদারতাও দেখিয়েছে শাখাটি। টাকা বা
চেক জাল না সঠিক, তা যাচাই করার জন্য মানুষ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে
যায়; কিন্তু সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জাল চেক চেনেন
না! একটি জাল চেকের বিপরীতে এক কোটি টাকা দিয়ে দিয়েছেন এ শাখার
কর্মকর্তারা। সোনালী ব্যাংকের এই গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয়ের এ ধরনের বহু
অনিয়ম উঠে এসেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা
প্রতিবেদনে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ঢাকার স্থানীয় কার্যালয়ে ২০১২ সালের হিসাবগুলো নিরীক্ষা চালানো হয়েছে গত ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত। অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ কে এম হাছিবুর রহমান স্বাক্ষরিত নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি গত ৩ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে। এতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এলসি (ঋণপত্র) জালিয়াতি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, অনিয়ম করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেওয়া সুবিধার বিশদ তথ্য এতে উঠে এসেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্থানীয় কার্যালয় নিয়ে নিরীক্ষা চালানো বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের ওই প্রতিবেদন আমার কাছে আসেনি। তবে আমি যতুটুক জানি, স্থানীয় কার্যালয় নিরীক্ষা করে বড় ধরনের কোনো অনিয়মের ঘটনা পায়নি।'
প্রতিবেদনে ২৪টি প্রতিষ্ঠানকে সোনালী ব্যাংকের এক হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব অনিয়ম ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের একটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ৭৮৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক একজন গ্রাহককে সর্বোচ্চ ৬৬৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ঋণ নেওয়ার সময় কম্পানিটিকে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের এ অর্থ আদায় হওয়া অনিশ্চিত।
অলটেক্স স্পিনিং লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে অনিয়ম করে ১৭০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা দিয়েছে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়। এ টাকা আদায় হওয়ার সুযোগ কম উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় অঙ্কের নগদ ও নগদ নয় (ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড) এমন দায় থাকা সত্ত্বেও বাড়তি ঋণপত্রসীমা অনুমোদন করে প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যাক টু ব্যাক এলসির (ঋণপত্র) মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ দেওয়া হয়েছে। অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি ঋণসীমার আওতায় রপ্তানি ঋণপত্রও ছিল না। রপ্তানি হচ্ছে কি না, তাও আমলে নেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিষ্ঠানটি এ কার্যালয় থেকে এভাবে অবৈধ সুবিধা পেয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া সুবিধা সম্পর্কে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর বলেছে, রপ্তানি ঋণপত্র ছাড়া একের পর এক ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খুলে নতুন দায় সৃষ্টি ও বাড়তি ঋণ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের সংশ্লিষ্টতা নেই- এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।
অলটেক্সকে দেওয়া বেশ কিছু অবৈধ সুবিধার একটি প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশি ক্রেতার চাহিদা নেই, কোনো রপ্তানি আদেশ নেই, তা সত্ত্বেও রপ্তানি হবে- এমন চিন্তায় ২০১১ সালের ৩০ জানুয়ারি ৬৫ কোটি টাকার ৮২টি ব্যাক টু ব্যাক স্থানীয় ঋণপত্র খোলে অলটেক্স। তারা এর কোনো দায় পরিশোধ করেনি, তা এখন মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। সিসি ও প্রকল্প ঋণ ছাড়া ডেফার্ড ও এলটিআর বাবদ প্রতিষ্ঠানটির কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনা ১২৩ কোটি টাকা। অথচ এর বিপরীতে ব্যাংকের কাছে কোনো জামানত নেই, অলটেক্স স্পিনিং মিল এখন আর এ শাখার সঙ্গে ঋণপত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যবসাও করছে না।
প্রকল্প ঋণ ও বিএমআরই ঋণের বড় অংশই মেয়াদোত্তীর্ণ থাকাবস্থায় মেসার্স অ্যাপেক্স উইভিং অ্যান্ড ফিনিশিং মিলসকে অনিয়মিত ও নিয়ন্ত্রণবিহীনভাবে একের পর এক ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খোলা ও পুনঃ তফসিল সুবিধা দেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে এ প্রতিবেদনে। পর্যাপ্ত জামানত না থাকায় প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে খেলাপি ঋণের ১৩০ কোটি ৭৭ লাখ টাকার পুরোটা আদায় অনিশ্চিত বলে উল্লেখ করেছে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর। এ পরিমাণ ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে ১০২ কোটি টাকার সম্পদ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের আসল তো নয়ই, সুদও পরিশোধ করেনি এই গ্রাহক। প্রতিষ্ঠানটির সব ঋণ হিসাব এখন খেলাপি এবং কম্পানিটি আর নতুন করে ঋণপত্র খুলছে না। প্রকল্প শুরুর সময় এর উদ্যোক্তা ছিলেন আটজন। শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে এর মালিকানা এখন এক পরিবারভুক্ত। তথ্য মতে, প্রতিষ্ঠানটি উইভিং, প্রিন্টিং অ্যান্ড ফিনিশিং গার্মেন্ট ব্যবসা পরিচালনার জন্য ১৯৯৫ সালে ৩৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ঋণ নেয় সোনালী ব্যাংকের এই শাখা থেকে। ২০০৪ সালের মে মাসে তা বিএমআরই করার জন্য আরো সাড়ে ছয় কোটি টাকা নেয় কম্পানিটি। প্রকল্প ঋণের মেয়াদ পার হয়ে গেলেও তা পরিশোধ করা হয়নি। উল্টো আরো ৮০ কোটি টাকার ঋণপত্র সীমা মঞ্জুর করে ফোসর্ড ঋণ সৃষ্টির দরজা খুলে দিয়েছে ব্যাংক। আগে দেওয়া ঋণ আদায় না করে বারবার পুনঃ তফসিল করার পাশাপাশি ২০১১ ও ২০১২ সালে ছয়টি রপ্তানি ঋণপত্রের বিপরীতে ৬৮টি ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খুলে ১৫ কোটি টাকারও বেশি ফোর্সড লোন সৃষ্টি করেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। তিনটি ফোর্সড ঋণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির দেনা প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। ঋণ আদায় না হলে এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করেছে নিরীক্ষা দল।
ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে মেসার্স রূপগঞ্জ অনলাইন লিমিটেডকে ছয় কোটি ২৬ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছেন উল্লেখ করে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ দেওয়ার সময় যেসব শর্তের কথা উল্লেখ ছিল, তার কোনোটিই বাস্তবে নেই। এভাবে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে নির্বাহী কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই- এ কথা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের ওই টাকা আদায়ের আর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, কম্পানিও নেই, জামানতও নগণ্য।
আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধ না করা সত্ত্বেও পুরনো ঋণ বারবার নবায়ন করে নতুন নতুন ঋণ পেয়েছে মেসার্স এনএন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের পাওনা এখন প্রায় আট কোটি টাকা। এখন ওই গ্রাহকের কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যাচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর। এ ঋণ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তির কাছ থেকে কাঁচপুরে বিসিক শিল্পনগরীর একটি প্লট কিনে আল্ট্রা মেরিন ব্লু উৎপাদন প্রকল্প স্থাপন করার জন্য এইচএসসি পাস অনভিজ্ঞ এই উদ্যোক্তা ২০০৫ সালে দুই কোটি ৬২ লাখ টাকা ঋণ নেন। কিন্তু ঋণ পরিশোধ করেননি তিনি। ওই ঋণ বারবার নবায়ন করে ২০১০ সালে ওই প্রকল্প বিএমআরই করার জন্য নতুন করে ১২ কোটি ঋণ দেওয়া হয়। সেটা নেওয়ার পরই গ্রাহক সোনালী ব্যাংকের ওই শাখার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। বর্তমানে গ্রাহকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের ঋণ অনাদায়ী থাকা সত্ত্বেও রহস্যজনক কারণে বারবার তা পুনঃ তফসিল করে গ্রাহককে বিএমআরই ঋণ সুবিধা দিয়ে যে দায় সৃষ্টি করা হয়েছে, তা আদায়ই কেবল অনিশ্চিত নয়, এর দায়ভার ঋণ-সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা এড়াতে পারেন না।
একটি এয়ারলাইনসে সোনালী ব্যাংকের ১৩৪ কোটি টাকা ঋণ আদায় অনিশ্চিত উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এয়ারলাইনসটির ৮০ কোটি টাকা এসওডি, ১২ কোটি টাকা মেয়াদি ঋণ ও প্রায় ৫৩ লাখ ডলার স্ট্যান্ডবাই ঋণপত্র সীমার জন্য পর্যাপ্ত জামানত ছিল। পরে মালিকানা পরিবর্তন করে ওএসডি ঋণসীমা ১০ কোটিতে বাড়ানো ও স্ট্যান্ডবাই ঋণপত্র করার ক্ষেত্রে সরকারের ১২১ কোটি টাকা মূল্যের ৯৯ বছরের লিজ সম্পত্তিসহ অন্য একটি গ্রুপের করপোরেট গ্যারান্টি নেওয়া হয়। জামানত হিসেবে এটি পর্যাপ্ত না হলেও আগের গ্রাহকের ৫০ হাজার শেয়ার ফেরত দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্ট্যান্ডবাই ঋণপত্রের লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি কম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে ২৬৪ আসনবিশিষ্ট দুটি উড়োজাহাজ লিজ নিয়ে পরিচালনা করা। কিন্তু ব্যাংক থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের পরই ২০১২ সালে এয়ারলাইনসটি বন্ধ হয়ে যায়। এ প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ঋণ আদায় অনিশ্চিত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
একটি জাল চেক দিয়ে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় থেকে এক কোটি টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'এ শাখায় বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের চলতি হিসাব (নং-৩৩১৩৩১১৩) রয়েছে। ওই হিসাবের অনুকূলে কামাল এন্টারপ্রাইজের বিপরীতে একটি চেকের মাধ্যমে (চেক নং-৩৬৮৯৭৪২, তারিখ ২২ জুন ২০১১) এক কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। ওই চেকটি কামাল এন্টারপ্রাইজের প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের মতিঝিল শাখার মাধ্যমে ক্লিয়ারিংয়ের জন্য পাঠানো হলে ক্লিয়ারিং হাউসের সুপারিশে ২০১১ সালের ২৬ জুন স্থানান্তর দেখানো হয়। কিন্তু বেলহাসা একমের ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারির এক পত্রে দেখা যায়, ওই চেক এবং টাকার অঙ্ক কামাল এন্টারপ্রাইজের নামে ইস্যু করা হয়নি এবং ওই নম্বরের চেক হিসাবধারীর কাছেই আছে। পরে বিস্তারিত অনুসন্ধানে দেখা যায়, যে চেকটির বিপরীতে এক কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, সেই চেক জাল ছিল, তা সোনালী ব্যাংকের ইস্যু করা চেক নয়।'
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে গ্রাহককে তা অবহিত করার নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। এখানে বেলহাসার হিসাব থেকে এক কোটি টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। অন্যদিকে হিসাবধারীর নাম 'বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড' হলেও যে জাল চেকে অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে, সেখানে কম্পানিটির নাম উল্লেখ করা হয়েছে 'বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড লিমিটেড'। জাল চেকের বিপরীতে সোনালী ব্যাংকের এক কোটি টাকা ক্ষতি হলেও দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
জালিয়াতি-অনিয়মের ব্যাপারে অলটেক্স-এর পরিচালক জালাল উদ্দিন, এপেক্স উইভিং অ্যান্ড ফিনিশিংয়ের এমডি হারুনুর রশীদসহ আরো কয়েকটি অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও কেউ সাড়া দেননি।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ঢাকার স্থানীয় কার্যালয়ে ২০১২ সালের হিসাবগুলো নিরীক্ষা চালানো হয়েছে গত ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত। অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ কে এম হাছিবুর রহমান স্বাক্ষরিত নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি গত ৩ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে। এতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এলসি (ঋণপত্র) জালিয়াতি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, অনিয়ম করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেওয়া সুবিধার বিশদ তথ্য এতে উঠে এসেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, 'স্থানীয় কার্যালয় নিয়ে নিরীক্ষা চালানো বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের ওই প্রতিবেদন আমার কাছে আসেনি। তবে আমি যতুটুক জানি, স্থানীয় কার্যালয় নিরীক্ষা করে বড় ধরনের কোনো অনিয়মের ঘটনা পায়নি।'
প্রতিবেদনে ২৪টি প্রতিষ্ঠানকে সোনালী ব্যাংকের এক হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব অনিয়ম ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের একটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ৭৮৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক একজন গ্রাহককে সর্বোচ্চ ৬৬৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ঋণ নেওয়ার সময় কম্পানিটিকে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের এ অর্থ আদায় হওয়া অনিশ্চিত।
অলটেক্স স্পিনিং লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে অনিয়ম করে ১৭০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা দিয়েছে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়। এ টাকা আদায় হওয়ার সুযোগ কম উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় অঙ্কের নগদ ও নগদ নয় (ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড) এমন দায় থাকা সত্ত্বেও বাড়তি ঋণপত্রসীমা অনুমোদন করে প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যাক টু ব্যাক এলসির (ঋণপত্র) মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ দেওয়া হয়েছে। অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি ঋণসীমার আওতায় রপ্তানি ঋণপত্রও ছিল না। রপ্তানি হচ্ছে কি না, তাও আমলে নেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিষ্ঠানটি এ কার্যালয় থেকে এভাবে অবৈধ সুবিধা পেয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া সুবিধা সম্পর্কে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর বলেছে, রপ্তানি ঋণপত্র ছাড়া একের পর এক ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খুলে নতুন দায় সৃষ্টি ও বাড়তি ঋণ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের সংশ্লিষ্টতা নেই- এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।
অলটেক্সকে দেওয়া বেশ কিছু অবৈধ সুবিধার একটি প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশি ক্রেতার চাহিদা নেই, কোনো রপ্তানি আদেশ নেই, তা সত্ত্বেও রপ্তানি হবে- এমন চিন্তায় ২০১১ সালের ৩০ জানুয়ারি ৬৫ কোটি টাকার ৮২টি ব্যাক টু ব্যাক স্থানীয় ঋণপত্র খোলে অলটেক্স। তারা এর কোনো দায় পরিশোধ করেনি, তা এখন মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। সিসি ও প্রকল্প ঋণ ছাড়া ডেফার্ড ও এলটিআর বাবদ প্রতিষ্ঠানটির কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনা ১২৩ কোটি টাকা। অথচ এর বিপরীতে ব্যাংকের কাছে কোনো জামানত নেই, অলটেক্স স্পিনিং মিল এখন আর এ শাখার সঙ্গে ঋণপত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যবসাও করছে না।
প্রকল্প ঋণ ও বিএমআরই ঋণের বড় অংশই মেয়াদোত্তীর্ণ থাকাবস্থায় মেসার্স অ্যাপেক্স উইভিং অ্যান্ড ফিনিশিং মিলসকে অনিয়মিত ও নিয়ন্ত্রণবিহীনভাবে একের পর এক ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খোলা ও পুনঃ তফসিল সুবিধা দেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে এ প্রতিবেদনে। পর্যাপ্ত জামানত না থাকায় প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে খেলাপি ঋণের ১৩০ কোটি ৭৭ লাখ টাকার পুরোটা আদায় অনিশ্চিত বলে উল্লেখ করেছে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর। এ পরিমাণ ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে ১০২ কোটি টাকার সম্পদ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের আসল তো নয়ই, সুদও পরিশোধ করেনি এই গ্রাহক। প্রতিষ্ঠানটির সব ঋণ হিসাব এখন খেলাপি এবং কম্পানিটি আর নতুন করে ঋণপত্র খুলছে না। প্রকল্প শুরুর সময় এর উদ্যোক্তা ছিলেন আটজন। শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে এর মালিকানা এখন এক পরিবারভুক্ত। তথ্য মতে, প্রতিষ্ঠানটি উইভিং, প্রিন্টিং অ্যান্ড ফিনিশিং গার্মেন্ট ব্যবসা পরিচালনার জন্য ১৯৯৫ সালে ৩৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ঋণ নেয় সোনালী ব্যাংকের এই শাখা থেকে। ২০০৪ সালের মে মাসে তা বিএমআরই করার জন্য আরো সাড়ে ছয় কোটি টাকা নেয় কম্পানিটি। প্রকল্প ঋণের মেয়াদ পার হয়ে গেলেও তা পরিশোধ করা হয়নি। উল্টো আরো ৮০ কোটি টাকার ঋণপত্র সীমা মঞ্জুর করে ফোসর্ড ঋণ সৃষ্টির দরজা খুলে দিয়েছে ব্যাংক। আগে দেওয়া ঋণ আদায় না করে বারবার পুনঃ তফসিল করার পাশাপাশি ২০১১ ও ২০১২ সালে ছয়টি রপ্তানি ঋণপত্রের বিপরীতে ৬৮টি ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খুলে ১৫ কোটি টাকারও বেশি ফোর্সড লোন সৃষ্টি করেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। তিনটি ফোর্সড ঋণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির দেনা প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। ঋণ আদায় না হলে এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করেছে নিরীক্ষা দল।
ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে মেসার্স রূপগঞ্জ অনলাইন লিমিটেডকে ছয় কোটি ২৬ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছেন উল্লেখ করে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ দেওয়ার সময় যেসব শর্তের কথা উল্লেখ ছিল, তার কোনোটিই বাস্তবে নেই। এভাবে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে নির্বাহী কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই- এ কথা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের ওই টাকা আদায়ের আর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, কম্পানিও নেই, জামানতও নগণ্য।
আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধ না করা সত্ত্বেও পুরনো ঋণ বারবার নবায়ন করে নতুন নতুন ঋণ পেয়েছে মেসার্স এনএন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের পাওনা এখন প্রায় আট কোটি টাকা। এখন ওই গ্রাহকের কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যাচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর। এ ঋণ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তির কাছ থেকে কাঁচপুরে বিসিক শিল্পনগরীর একটি প্লট কিনে আল্ট্রা মেরিন ব্লু উৎপাদন প্রকল্প স্থাপন করার জন্য এইচএসসি পাস অনভিজ্ঞ এই উদ্যোক্তা ২০০৫ সালে দুই কোটি ৬২ লাখ টাকা ঋণ নেন। কিন্তু ঋণ পরিশোধ করেননি তিনি। ওই ঋণ বারবার নবায়ন করে ২০১০ সালে ওই প্রকল্প বিএমআরই করার জন্য নতুন করে ১২ কোটি ঋণ দেওয়া হয়। সেটা নেওয়ার পরই গ্রাহক সোনালী ব্যাংকের ওই শাখার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। বর্তমানে গ্রাহকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের ঋণ অনাদায়ী থাকা সত্ত্বেও রহস্যজনক কারণে বারবার তা পুনঃ তফসিল করে গ্রাহককে বিএমআরই ঋণ সুবিধা দিয়ে যে দায় সৃষ্টি করা হয়েছে, তা আদায়ই কেবল অনিশ্চিত নয়, এর দায়ভার ঋণ-সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা এড়াতে পারেন না।
একটি এয়ারলাইনসে সোনালী ব্যাংকের ১৩৪ কোটি টাকা ঋণ আদায় অনিশ্চিত উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এয়ারলাইনসটির ৮০ কোটি টাকা এসওডি, ১২ কোটি টাকা মেয়াদি ঋণ ও প্রায় ৫৩ লাখ ডলার স্ট্যান্ডবাই ঋণপত্র সীমার জন্য পর্যাপ্ত জামানত ছিল। পরে মালিকানা পরিবর্তন করে ওএসডি ঋণসীমা ১০ কোটিতে বাড়ানো ও স্ট্যান্ডবাই ঋণপত্র করার ক্ষেত্রে সরকারের ১২১ কোটি টাকা মূল্যের ৯৯ বছরের লিজ সম্পত্তিসহ অন্য একটি গ্রুপের করপোরেট গ্যারান্টি নেওয়া হয়। জামানত হিসেবে এটি পর্যাপ্ত না হলেও আগের গ্রাহকের ৫০ হাজার শেয়ার ফেরত দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্ট্যান্ডবাই ঋণপত্রের লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি কম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে ২৬৪ আসনবিশিষ্ট দুটি উড়োজাহাজ লিজ নিয়ে পরিচালনা করা। কিন্তু ব্যাংক থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের পরই ২০১২ সালে এয়ারলাইনসটি বন্ধ হয়ে যায়। এ প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ঋণ আদায় অনিশ্চিত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
একটি জাল চেক দিয়ে সোনালী ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় থেকে এক কোটি টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'এ শাখায় বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের চলতি হিসাব (নং-৩৩১৩৩১১৩) রয়েছে। ওই হিসাবের অনুকূলে কামাল এন্টারপ্রাইজের বিপরীতে একটি চেকের মাধ্যমে (চেক নং-৩৬৮৯৭৪২, তারিখ ২২ জুন ২০১১) এক কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। ওই চেকটি কামাল এন্টারপ্রাইজের প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের মতিঝিল শাখার মাধ্যমে ক্লিয়ারিংয়ের জন্য পাঠানো হলে ক্লিয়ারিং হাউসের সুপারিশে ২০১১ সালের ২৬ জুন স্থানান্তর দেখানো হয়। কিন্তু বেলহাসা একমের ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারির এক পত্রে দেখা যায়, ওই চেক এবং টাকার অঙ্ক কামাল এন্টারপ্রাইজের নামে ইস্যু করা হয়নি এবং ওই নম্বরের চেক হিসাবধারীর কাছেই আছে। পরে বিস্তারিত অনুসন্ধানে দেখা যায়, যে চেকটির বিপরীতে এক কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, সেই চেক জাল ছিল, তা সোনালী ব্যাংকের ইস্যু করা চেক নয়।'
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে গ্রাহককে তা অবহিত করার নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। এখানে বেলহাসার হিসাব থেকে এক কোটি টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। অন্যদিকে হিসাবধারীর নাম 'বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড' হলেও যে জাল চেকে অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে, সেখানে কম্পানিটির নাম উল্লেখ করা হয়েছে 'বেলহাসা একম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড লিমিটেড'। জাল চেকের বিপরীতে সোনালী ব্যাংকের এক কোটি টাকা ক্ষতি হলেও দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
জালিয়াতি-অনিয়মের ব্যাপারে অলটেক্স-এর পরিচালক জালাল উদ্দিন, এপেক্স উইভিং অ্যান্ড ফিনিশিংয়ের এমডি হারুনুর রশীদসহ আরো কয়েকটি অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও কেউ সাড়া দেননি।
No comments