কৃষক বাঁচান, মানুষ বাঁচান by প্রফেসর মো. শাদাত উল্লা
বাংলাদেশ
কৃষিনির্ভর দেশ। কৃষি বাঁচলে দেশ বাঁচে। আর এ দেশের কৃষক কিনা এক কেজি আলু
বিক্রি করেও এক কাপ চায়ের দাম পাবে না? এ কৃষকদের কল্যাণে আমরা এখন আর
খাদ্য ঘাটতির দেশের বাসিন্দা তো নই-ই, বরং তাদের শ্রম ও ঘামেই বাংলাদেশ
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশের সুনাম অর্জন করতে পেরেছে। দেশের এ অর্জন আমরা
বিষাদের অন্ধকারে নিক্ষেপ করছি। টানা হরতাল-অবরোধে কৃষকদের স্বপ্ন আজ
দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। নাশকতার আশঙ্কায় পরিবহন সঙ্কটে কৃষক তার পণ্য
গ্রাম থেকে রাজধানী বা জেলা শহরে পাঠাতে পারছে না। ফলে কৃষক আজ পথে বসেছে।
অনেকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। সরবরাহ সমস্যায় অনেক চালকল
বন্ধ হওয়ায় কমে গেছে ধানের দামও। শীত মওসুমকে সামনে রেখে যে স্বপ্ন তারা
বুনেছিল, তা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। মহাসড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেয়ার
পর সবজিবাহী ট্রাক চলাচল বেড়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা কম দামে সবজি কিনলেও
ট্রাক ভাড়া অনেক বেশি। বর্তমানে রাজনৈতিক এই অস্থিরতায়, পরিবহন সঙ্কটের
কারণে দেশের বিভিন্ন মোকামে ও হাট-বাজারে প্রতিকেজি ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে
এক টাকায়। অথচ কৃষি বিভাগের হিসাবে প্রতিকেজি ফুলকপি উৎপাদনে কৃষকের নিট
খরচ হয় চার টাকা। অবরোধের আগে আলুর মণ ছিল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। এখন তা
বিক্রি হচ্ছে আড়াইশ’ থেকে ২৮০ টাকা মণ। একই চিত্র অন্যান্য সবজির
ক্ষেত্রেও। এভাবে যদি চলে তাহলে কৃষক ধুঁকে ধুঁকে মরে যাবে। শুধু কৃষক মরবে
না, আমাদেরও মরতে হবে। আর দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে
অর্থনীতিতে। এককথায় কৃষিপণ্যের অগণিত উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়েই এখন চরম
দুর্ভোগের শিকার। এক দলের শ্রমে-ঘামে উৎপাদিত পণ্য পচে যাচ্ছে এবং এভাবে
তারা লোকসান দিচ্ছে। আরেক পক্ষ অর্থাৎ শহর এলাকার ক্রেতারা বাজারে সরবরাহ
কম থাকায় বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এটাও জানা কথা যে,
হরতাল-অবরোধে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা বঞ্চিত হয়
বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য আয়-উপার্জন থেকে। আমার প্রশ্ন হলো- এ ধরনের
কর্মসূচি থেকে কৃষিপণ্যকে ছাড় প্রদান করা যায় না? এমনটি ঘটলে কৃষক বাঁচে,
ভোক্তাদেরও খানিকটা স্বস্তি মেলে। ২০১৩ সালে হরতালে কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি
হয়েছিল। সেই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই আবারো আঘাত এলো। এ অবস্থায় কৃষক ঘুরে
দাঁড়াতে পারবে কি? চাষিরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সবজি, ফুল আর ফল চাষ করে। এখন
সবজির ভরা মওসুম। অথচ এই ভরা মওসুমেই কৃষককে লোকসানের বড় অঙ্ক গুনতে
হচ্ছে। বড় ধরনের লোকসানের বোঝা চাপবে অনেকের কাঁধে। এই ক্ষতি পূরণ না হলে
তার পক্ষে আগামী মওসুমে সবজির উৎপাদন কষ্টকর হয়ে পড়বে। ধার-দেনায় জর্জরিত
হয়ে কৃষককে অসহায় হয়ে পড়তে হবে। দৈনিক পত্রিকার সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়,
প্রতি বছর শীত মওসুমে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে টমেটো চাষিরা উৎসবে মেতে
থাকতেন এ সময়। আর এখন সেখানে বিরাজ করছে চরম হতাশা। শুধু রাজশাহীর টমেটো
চাষিরা কেন, বগুড়ার আলুচাষি, ঝিনাইদহের ফুলচাষি-তাদেরও একই অবস্থা। সরবরাহ
সমস্যায় অনেক চালকল বন্ধ হওয়ায় কমে গেছে ধানের দামও। বেকার হয়ে গেছেন অনেক
শ্রমিক। এই যে, পহেলা ফাল্গুন আর বিশ্ব ভালবাসা দিবস চলে গেল। যশোরের
ফুলচাষিরা তারা তাদের ফুলের কাঙ্ক্ষিত দাম পেলেন না। বর্তমান অবস্থা শুরুর
আগেই আমন ধান ঘরে তুলতে পেরেছিল কৃষক। আর বোরো ধানের চাষও শুরু হয়েছে।
বোরো ধানের চাষের সময়ে যদি কৃষক উৎপাদনে বাধা পায়, তাহলে তার নেতিবাচক ফল
সারা বছর ভোগ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা
সঙ্কটে পড়বে। দেশে চালের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বোরো থেকে। তাই এ
সময়ে বোরো উৎপাদনে প্রয়োজন মতো সার ও সেচের জ্বালানি না পাওয়া গেলে মওসুমে
লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় চালের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিতে পারে।
আমন ধানচাষিরা ধান ঘরে তুলতে পারলেও পরিবহন সঙ্কটের কারণে বাজারে ধান
বিক্রিও প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। দেশের চালকলগুলোর কেন্দ্রীয় সংগঠন
বাংলাদেশ অটো-হাসকিং-মেজর মিল মালিক সমিতি সংগঠনটির হিসাবে দেশে প্রায় ১৭
হাজার চালকল রয়েছে। অবরোধের কারণে ৭০ শতাংশ চালকল বন্ধ রাখা হয়েছে। আর
দেশের বিভিন্ন বাজারে চালকলগুলো থেকে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টন চাল
সরবরাহ হতো। কিন্তু এখন প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার টন চালও সরবরাহ হচ্ছে
না। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) তথ্য অনুযায়ী
চলমান হরতাল, অবরোধে কৃষিখাতে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ২৮৮ কোটি টাকা। যে
কোন মূল্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করতে না পারলে
ক্রমাগতভাবে কৃষিখাতে যে ধস নেমে আসবে যা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক
প্রভাব পড়বে। বর্তমানে কৃষকের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করা কোনভাবেই সম্ভব
নয়। তবে আর যাতে ক্ষতি না হয় সেদিকে সবাইকে সমান দৃষ্টি দিতে হবে। বন্যা বা
অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর সরকার কৃষকদের পুনর্বাসন কর্মসূচিসহ সহায়তার
হাত বাড়িয়ে দেয়; এক্ষেত্রেও তেমন করতে হবে। তাহলে কৃষক বাঁচবে, দেশ বাঁচবে।
প্রফেসর মো. শাদাত উল্লা |
No comments