হাসিনা-খালেদা নিজেই নিজের সঙ্গে সংলাপ করুন! by সোহরাব হাসান
বিএনপির
নেতৃত্বাধীন জোটের সহিংস অবরোধ সদর্পে দুই মাস পার হলেও চলমান রাজনৈতিক
সংকট অবসানের আলামত দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু উদ্বেগজনক হলো, সরকার এখন
পর্যন্ত একে সংকট বলে স্বীকারই করছে না। সরকারদলীয় নেতা-মন্ত্রীদের হাবভাব
দেখে মনে হচ্ছে, ১৬ কোটি মানুষের দেশে ১১৫ জনের প্রাণহানি, ১ হাজার ৩১৭টি
যানবাহনে আগুন-ভাঙচুর, ১৫ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা
কিংবা লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষের রুটি-রুজি বন্ধ হওয়া আর এমন কি! জাতির
বৃহত্তর স্বার্থে এই সামান্য ক্ষতি মেনে নিতেই হবে। আর হরতাল-অবরোধ
আহ্বানকারীরা মনে করছেন, প্রতিদিন দু-চারটি বাসে পেট্রলবোমা-ককটেল ছুড়ে
একটি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াই বড় কথা। কত মানুষ মরল, কত বাস-ট্রাক জ্বলল, তা
নিয়ে ভাবার সময় এখন নয়। ইতিমধ্যে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদ
জানিয়ে দিয়েছেন, এ আন্দোলনে যাঁরা মরবেন, তাঁরা শহীদ ও জাতীয় বীর হিসেবে
গণ্য হবেন। সম্ভবত সে কারণেই তাঁরা শহীদ ও গাজীর সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছেন। আর
সরকারই বা কম যাবে কেন? তারা বাড়িয়ে চলেছে কারাবন্দীর সংখ্যা। আমাদের
নেতা-নেত্রীরা মানুষ নিয়ে ভাবেন না, ভাবেন সংখ্যা নিয়ে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগে একটি কথা বেশ জোর দিয়েই বলতেন, একমাত্র আওয়ামী লীগই মেয়াদ শেষে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। তিনি ২০০১ সালে সেটি করে দেখিয়েছেন। কিন্তু তার পরই সব ওলট-পালট হয়ে গেল। খালেদা জিয়ার ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় যেমন দুর্যোগ নেমে এসেছিল, তেমনি দুর্যোগ দেখেছি ২০১৪ সালেও। এই দুর্যোগের জন্য কে বেশি, কে কম দায়ী, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, আমরা যোগ্য গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বেছে নিতে ব্যর্থ হয়েছি। ২০১৪ সালের ঘটনাবলি যদি দুর্যোগ হয়ে থাকে, দেশে এখন মহাদুর্যোগ চলছে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে ধীরস্থির ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তা সম্ভবত আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের জানা নেই। কেননা, অতীতে তাঁরা শক্ত হাতে বিরোধী দলকে মোকাবিলা করলেও তেমন শক্ত বিরোধী দলের মুখোমুখি হননি।
এখানে বলা প্রয়োজন যে ৫ জানুয়ারির পর বিএনপি-জামায়াত জোট আন্দোলনের নামে যে সহিংস তাণ্ডব চালাচ্ছে, আমরা তার বিরোধিতা করি, নিন্দা জানাই। দাবি ন্যায়সংগত হলেও আন্দোলনের নামে সহিংসতা তথা মানুষ পুড়িয়ে মারা চলতে পারে না। কিন্তু ৫ জানুয়ারির আগে কেন সরকার বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ করতে দেয়নি, কেন খালেদা জিয়ার অফিস অবরোধ করে রেখেছিল, সেই প্রশ্নের জবাব মেলে না। আওয়ামী লীগের দাবি, বিএনপি-জামায়াত জোট আন্দোলনের নামে দেশ ধ্বংসের তৎপরতায় লিপ্ত। নির্বাচন তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের পুনরুত্থান ঘটিয়ে তারা বাংলাদেশকে একটি তালেবানি রাষ্ট্র বানাতে চায়।
যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নিই যে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের পেছনে এ ধরনের কোনো বদ মতলব আছে, তাহলেও বলব, তা মোকাবিলায় এটি সঠিক রাস্তা নয়। বিরোধী দলের কণ্ঠরোধ করে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা গেলেও গণতন্ত্রের যুদ্ধে জেতা যায় না। এতে করে সরকার যে জঙ্গিবাদের ভয় দেখাচ্ছে বা দেখছে, তার হাতই শক্তিশালী হচ্ছে। কোনো পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক দর্শনকে পরাস্ত করতে হয় উন্নত রাজনৈতিক দর্শন বা আদর্শ দিয়ে, গায়ের জোরে পরাস্ত করতে চাইলে তার ফল কারও জন্য ভালো হয় না। বর্তমান ইরাক ও আফগানিস্তানই তার প্রমাণ।
বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধের সীমা যত বাড়ছে, সাধারণ মানুষের কষ্ট-দুর্দশা ততই প্রকট হচ্ছে। নিরীহ ও খেটে খাওয়া মানুষ পেট্রলবোমার আগুনে পুড়ে মরছে, হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। আবার সন্ত্রাস দমনের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অনেক নিরপরাধ লোক মারা যাচ্ছে। দুই মাসের অবরোধে ও দফায় দফায় হরতালে সারা দেশে জনজীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। পরিবহনব্যবস্থা বিপর্যস্ত। বিনিয়োগ বন্ধ। শিল্প-কারখানার উৎপাদন কমে গেছে। বছরের দুটি মাস চলে গেলেও শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারছে না। এত কিছুর পরও যদি সরকার ‘সবকিছু ঠিক হ্যায়’ বলে উড়িয়ে দেয়, তাহলে বুঝতে হবে, এই দুঃখী বাংলাদেশের কপালে আরও দুঃখ আছে। সরকারের মন্ত্রীরা, সরকারি দলের নেতারা জোরগলায় বলে বেড়াচ্ছেন, সমস্যাটি বিরোধী দল তথা বিএনপি-জামায়াতের সৃষ্টি। বিএনপির নেতারা বলছেন, সরকারই সবকিছুর জন্য দায়ী। কিন্তু দেশের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কী দোষ? তারা কেন পুড়ে মরছে? তারা কেন বন্দুকযুদ্ধের শিকার হচ্ছে?
আন্দোলনের যেমন দুটি ধরন (সহিংস ও অহিংস) আছে, তেমনি সেই আন্দোলন নিবৃত্ত করারও দুটি উপায় আছে বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। একটি আলোচনা, দ্বিতীয়টি বলপ্রয়োগ। বাংলাদেশের পূর্বাপার সরকারগুলো দ্বিতীয়টিকেই একমাত্র সমাধান ভাবে। তাই বাস্তবে সরকারের দমনতন্ত্র কিংবা বিরোধী দলের আগুনতন্ত্র কোনো সুফল দেয় না। প্রতিদিন এত বক্তৃতা, এত গ্রেপ্তার, এত মামলা, এত বালুর ট্রাক, এত শান্তি মিছিল, এত মানববন্ধন, এত হুঁশিয়ারি—কোনো কিছুই যখন কাজে লাগছে না, তখন সরকারকে বিকল্প পথই খুঁজে বের করা উচিত।
কী সেই বিকল্প? আলাপ-আলোচনা। জাতিসংঘের মহাসচিব সংলাপের কথা বলছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানেরা সংলাপের কথা বলছেন। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রধান সংলাপের কথা বলছেন। বিদেশি রাষ্ট্রদূতেরা সংলাপের কথা বলছেন। দেশের সাধারণ মানুষও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চাইছে। এমনকি সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টিও জাতীয় কনভেনশন ডাকার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সরকার গোঁ ধরে বসেছে, তারা বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসবে না। আলোচনায় বসলেই নাকি আগুন-বোমাবাজদের কাছে আত্মসমর্পণ করা হবে! অন্যদিকে বিরোধী দলও হরতাল-অবরোধের নামে সন্ত্রাসী ও সহিংস কর্মকাণ্ড দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে দাবি পূরণের আগে তারা ঘরে ফিরে যাবে না। অতএব, আমরা অচিরেই এর কোনো সমাধান দেখছি না।
দুই দলই যখন একে অপরকে আস্থায় আনছে না, সরকার প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হচ্ছে না, তখন নেতানেত্রীদের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, অন্যের সঙ্গে না হলেও অন্তত নিজের সঙ্গে একটি সংলাপ করুন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজের সঙ্গে সংলাপ করতে পারেন। নিজের সঙ্গে সংলাপ করা মানে কী করেছি, কী করছি, কী করার কথা ছিল, সেটি বুঝে নেওয়া। নিজের সঙ্গে সংলাপ করা মানে জনগণের কাছে যে ওয়াদা, তার কতটুকু পূরণ করেছেন সে কথাটি জানা। নিজের সঙ্গে সংলাপ করা মানে বিবেক বা অন্তরাত্মার কাছে প্রশ্ন করা।
বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মানে না। তাই আমরা তাদের ২০০৮ সালের নির্বাচন উপলক্ষে ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারটি পড়ে নিতে বলছি। তাদের মূল স্লোগান ছিল ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও’। তারা বলেছিল, দরিদ্র মানুষের জীবনমান বাড়াবে। এখন সেই দরিদ্র মানুষই পেট্রলবোমায় মারা যাচ্ছে। তারা বলেছিল, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেবে। এখন অবরোধ-হরতালই তাদের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বলেছিল, উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি করে। এখন তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিতে দুটিই বন্ধ। তারা বলেছিল, শিক্ষাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করবে। এখন চার কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনই অনিশ্চিত। বিএনপির নেত্রী নিজেকে প্রশ্ন করলেই জানতে পারবেন, দুই মাস ধরে চলা তাঁদের কর্মসূচিগুলো মানুষকে না বাঁচিয়ে তাদের সর্বনাশ ঘটাচ্ছে। দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগও ২০০৮ সালে দিন বদলের সনদের নামে জনগণের ভোট নিয়েছিল। বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে তারা সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু জনগণের দিন তেমন বদল না হলেও আওয়ামী লীগের নেতাদের দিন ঠিকই বদলেছে। তারা বলেছিল, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। হ্যাঁ, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তবে সরকারি দলের নেতাদের বাদ দিয়ে। তারা বলেছিল, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবে। কিন্তু ছয় বছর পরও আমাদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে। তারা বলেছিল, জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। এখন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে সরকারি দলের সাংসদেরাই বেশি গরহাজির থাকেন। তারা বলেছিল, মন্ত্রিসভার সদস্যদের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস জনসম্মুখে জানাবে। কিন্তু কারও সম্পদের হিসাবই জানানো হয়নি। তারা বলেছিল, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে। এখন সেই শিষ্টাচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একে অপরকে গালাগাল না দিয়ে কথা বলে না। তারা বলেছিল, দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন গড়ে তোলা হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করা হবে। এখন দুটিই পুরোপুরি দলনির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ছয় বছর পর শেখ হাসিনা নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, তিনি দিন বদল করতে পেরেছেন কি না।
আমি হলফ করে বলতে পারি, দিন বদলের সনদ সত্যি সত্যি বাস্তবায়িত হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও ২০১৪ সালে সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন করা যেত এবং দেশবাসী এই মহাদুর্যোগ থেকে রেহাই পেত। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশের রাজনীতি অ্যানালগের দিকেই চলতে পছন্দ করে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগে একটি কথা বেশ জোর দিয়েই বলতেন, একমাত্র আওয়ামী লীগই মেয়াদ শেষে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। তিনি ২০০১ সালে সেটি করে দেখিয়েছেন। কিন্তু তার পরই সব ওলট-পালট হয়ে গেল। খালেদা জিয়ার ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় যেমন দুর্যোগ নেমে এসেছিল, তেমনি দুর্যোগ দেখেছি ২০১৪ সালেও। এই দুর্যোগের জন্য কে বেশি, কে কম দায়ী, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, আমরা যোগ্য গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বেছে নিতে ব্যর্থ হয়েছি। ২০১৪ সালের ঘটনাবলি যদি দুর্যোগ হয়ে থাকে, দেশে এখন মহাদুর্যোগ চলছে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে ধীরস্থির ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তা সম্ভবত আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের জানা নেই। কেননা, অতীতে তাঁরা শক্ত হাতে বিরোধী দলকে মোকাবিলা করলেও তেমন শক্ত বিরোধী দলের মুখোমুখি হননি।
এখানে বলা প্রয়োজন যে ৫ জানুয়ারির পর বিএনপি-জামায়াত জোট আন্দোলনের নামে যে সহিংস তাণ্ডব চালাচ্ছে, আমরা তার বিরোধিতা করি, নিন্দা জানাই। দাবি ন্যায়সংগত হলেও আন্দোলনের নামে সহিংসতা তথা মানুষ পুড়িয়ে মারা চলতে পারে না। কিন্তু ৫ জানুয়ারির আগে কেন সরকার বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ করতে দেয়নি, কেন খালেদা জিয়ার অফিস অবরোধ করে রেখেছিল, সেই প্রশ্নের জবাব মেলে না। আওয়ামী লীগের দাবি, বিএনপি-জামায়াত জোট আন্দোলনের নামে দেশ ধ্বংসের তৎপরতায় লিপ্ত। নির্বাচন তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের পুনরুত্থান ঘটিয়ে তারা বাংলাদেশকে একটি তালেবানি রাষ্ট্র বানাতে চায়।
যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নিই যে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের পেছনে এ ধরনের কোনো বদ মতলব আছে, তাহলেও বলব, তা মোকাবিলায় এটি সঠিক রাস্তা নয়। বিরোধী দলের কণ্ঠরোধ করে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা গেলেও গণতন্ত্রের যুদ্ধে জেতা যায় না। এতে করে সরকার যে জঙ্গিবাদের ভয় দেখাচ্ছে বা দেখছে, তার হাতই শক্তিশালী হচ্ছে। কোনো পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক দর্শনকে পরাস্ত করতে হয় উন্নত রাজনৈতিক দর্শন বা আদর্শ দিয়ে, গায়ের জোরে পরাস্ত করতে চাইলে তার ফল কারও জন্য ভালো হয় না। বর্তমান ইরাক ও আফগানিস্তানই তার প্রমাণ।
বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধের সীমা যত বাড়ছে, সাধারণ মানুষের কষ্ট-দুর্দশা ততই প্রকট হচ্ছে। নিরীহ ও খেটে খাওয়া মানুষ পেট্রলবোমার আগুনে পুড়ে মরছে, হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। আবার সন্ত্রাস দমনের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অনেক নিরপরাধ লোক মারা যাচ্ছে। দুই মাসের অবরোধে ও দফায় দফায় হরতালে সারা দেশে জনজীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। পরিবহনব্যবস্থা বিপর্যস্ত। বিনিয়োগ বন্ধ। শিল্প-কারখানার উৎপাদন কমে গেছে। বছরের দুটি মাস চলে গেলেও শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারছে না। এত কিছুর পরও যদি সরকার ‘সবকিছু ঠিক হ্যায়’ বলে উড়িয়ে দেয়, তাহলে বুঝতে হবে, এই দুঃখী বাংলাদেশের কপালে আরও দুঃখ আছে। সরকারের মন্ত্রীরা, সরকারি দলের নেতারা জোরগলায় বলে বেড়াচ্ছেন, সমস্যাটি বিরোধী দল তথা বিএনপি-জামায়াতের সৃষ্টি। বিএনপির নেতারা বলছেন, সরকারই সবকিছুর জন্য দায়ী। কিন্তু দেশের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কী দোষ? তারা কেন পুড়ে মরছে? তারা কেন বন্দুকযুদ্ধের শিকার হচ্ছে?
আন্দোলনের যেমন দুটি ধরন (সহিংস ও অহিংস) আছে, তেমনি সেই আন্দোলন নিবৃত্ত করারও দুটি উপায় আছে বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। একটি আলোচনা, দ্বিতীয়টি বলপ্রয়োগ। বাংলাদেশের পূর্বাপার সরকারগুলো দ্বিতীয়টিকেই একমাত্র সমাধান ভাবে। তাই বাস্তবে সরকারের দমনতন্ত্র কিংবা বিরোধী দলের আগুনতন্ত্র কোনো সুফল দেয় না। প্রতিদিন এত বক্তৃতা, এত গ্রেপ্তার, এত মামলা, এত বালুর ট্রাক, এত শান্তি মিছিল, এত মানববন্ধন, এত হুঁশিয়ারি—কোনো কিছুই যখন কাজে লাগছে না, তখন সরকারকে বিকল্প পথই খুঁজে বের করা উচিত।
কী সেই বিকল্প? আলাপ-আলোচনা। জাতিসংঘের মহাসচিব সংলাপের কথা বলছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানেরা সংলাপের কথা বলছেন। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রধান সংলাপের কথা বলছেন। বিদেশি রাষ্ট্রদূতেরা সংলাপের কথা বলছেন। দেশের সাধারণ মানুষও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চাইছে। এমনকি সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টিও জাতীয় কনভেনশন ডাকার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সরকার গোঁ ধরে বসেছে, তারা বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসবে না। আলোচনায় বসলেই নাকি আগুন-বোমাবাজদের কাছে আত্মসমর্পণ করা হবে! অন্যদিকে বিরোধী দলও হরতাল-অবরোধের নামে সন্ত্রাসী ও সহিংস কর্মকাণ্ড দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে দাবি পূরণের আগে তারা ঘরে ফিরে যাবে না। অতএব, আমরা অচিরেই এর কোনো সমাধান দেখছি না।
দুই দলই যখন একে অপরকে আস্থায় আনছে না, সরকার প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হচ্ছে না, তখন নেতানেত্রীদের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, অন্যের সঙ্গে না হলেও অন্তত নিজের সঙ্গে একটি সংলাপ করুন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজের সঙ্গে সংলাপ করতে পারেন। নিজের সঙ্গে সংলাপ করা মানে কী করেছি, কী করছি, কী করার কথা ছিল, সেটি বুঝে নেওয়া। নিজের সঙ্গে সংলাপ করা মানে জনগণের কাছে যে ওয়াদা, তার কতটুকু পূরণ করেছেন সে কথাটি জানা। নিজের সঙ্গে সংলাপ করা মানে বিবেক বা অন্তরাত্মার কাছে প্রশ্ন করা।
বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মানে না। তাই আমরা তাদের ২০০৮ সালের নির্বাচন উপলক্ষে ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারটি পড়ে নিতে বলছি। তাদের মূল স্লোগান ছিল ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও’। তারা বলেছিল, দরিদ্র মানুষের জীবনমান বাড়াবে। এখন সেই দরিদ্র মানুষই পেট্রলবোমায় মারা যাচ্ছে। তারা বলেছিল, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেবে। এখন অবরোধ-হরতালই তাদের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বলেছিল, উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি করে। এখন তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিতে দুটিই বন্ধ। তারা বলেছিল, শিক্ষাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করবে। এখন চার কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনই অনিশ্চিত। বিএনপির নেত্রী নিজেকে প্রশ্ন করলেই জানতে পারবেন, দুই মাস ধরে চলা তাঁদের কর্মসূচিগুলো মানুষকে না বাঁচিয়ে তাদের সর্বনাশ ঘটাচ্ছে। দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগও ২০০৮ সালে দিন বদলের সনদের নামে জনগণের ভোট নিয়েছিল। বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে তারা সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু জনগণের দিন তেমন বদল না হলেও আওয়ামী লীগের নেতাদের দিন ঠিকই বদলেছে। তারা বলেছিল, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। হ্যাঁ, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তবে সরকারি দলের নেতাদের বাদ দিয়ে। তারা বলেছিল, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবে। কিন্তু ছয় বছর পরও আমাদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলছে। তারা বলেছিল, জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। এখন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে সরকারি দলের সাংসদেরাই বেশি গরহাজির থাকেন। তারা বলেছিল, মন্ত্রিসভার সদস্যদের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস জনসম্মুখে জানাবে। কিন্তু কারও সম্পদের হিসাবই জানানো হয়নি। তারা বলেছিল, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে। এখন সেই শিষ্টাচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একে অপরকে গালাগাল না দিয়ে কথা বলে না। তারা বলেছিল, দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন গড়ে তোলা হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করা হবে। এখন দুটিই পুরোপুরি দলনির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ছয় বছর পর শেখ হাসিনা নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, তিনি দিন বদল করতে পেরেছেন কি না।
আমি হলফ করে বলতে পারি, দিন বদলের সনদ সত্যি সত্যি বাস্তবায়িত হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও ২০১৪ সালে সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন করা যেত এবং দেশবাসী এই মহাদুর্যোগ থেকে রেহাই পেত। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশের রাজনীতি অ্যানালগের দিকেই চলতে পছন্দ করে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
No comments