নিছক গরম ভাতের গল্প by কাজল ঘোষ
ইংরেজিতে
প্যারাডক্স বলে একটি শব্দ আছে। আভিধানিক অর্থ- যা বলাবলি আছে তার উল্টোটা
ঘটছে। আমাদের রাজনীতিতে এই শব্দটি এখন যুৎসই। একরাতের ঘটনার বর্ণনা দিলেই
স্পষ্ট হওয়া যাবে। ধরুন, রোববার রাতের কথা। পেশাগত দায়িত্ব পালনে রাতে
খোঁজখবর নিচ্ছি। সার্চ ইঞ্জিনে নতুন কিছু এলেই চোখ বুলাই। সহকর্মীদের
খোঁজ নিতে বলি ঘটনা কি? অনলাইন বিডি নিউজে দেখলাম, মাহমুদুর রহমান মান্নার
ছবি দিয়ে শিরোনাম করেছে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ চাই’। যতদূর বোঝা গেল অডিও
টেপের গোয়েন্দা তথ্য দিয়েই এই প্রতিবেদন। যেখানে ২৩শে ফেব্রুয়ারি গণমিছিল
এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি, চলমান রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হচ্ছে। যাদের
একজন দেশে আর অন্যজন বাইরে। রাতের প্রথম প্রহরে যখন তরতাজা পত্রিকা হাতে এল
দেখলাম একটি শীর্ষ দৈনিকে এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রধান শিরোনাম। তবে
দু’ রিপোর্টে তথ্য-উপাত্ত দু’রকম। বোঝা গেলনা একই টেপ না অনেকগুলো টেপ। একই
সময়ে একটি টেলিভিশনেও ভয়েস প্রচার হচ্ছে। ক’দিন আগে একইভাবে বিএনপি
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায়কেও একইভাবে একটি অডিও টেপের প্রচারিত
কথোপকথনের ওপর ভিত্তি করে গ্রেপ্তার করা হয়। ইতিমধ্যেই মাহমুদুর রহমান
মান্নার বিরুদ্ধে ৩০টি জিডি হয়েছে। তদন্তে ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হলে আইন
অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সরকার। কিন্তু আমাদের এখানে অডিও টেপ বা
জবানবন্দি প্রকাশ নতুন ঘটনা নয়। এ নিয়ে একেক সরকারের সময় একেক রকম
পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে মিডিয়া। এ ধরনের ঘটনা মিডিয়া সবচেয়ে বেশি
মুখোমুখি হয়েছিল ওয়ান ইলেভেনে সেনা সমর্থিত সরকারের জমানায়। তখন প্রায়
প্রতিদিনই কোন না কোন অডিও টেপ বা পুস্তিকায় টাইপকৃত জবানবন্দি
মিডিয়াগুলোতে চলে আসতো। যার সূত্র বেশির ভাগ সময়ই অদৃশ্য থাকতো। সেই অজানা
স্থানের সরবরাহকৃত দলিল পাঠক গোগ্রাসে গিলেছে। আলোচনা হয়েছে টেবিলে টেবিলে।
এ নিয়ে নানা রসেবশে আলোচনা এখনও রহস্য রোমাঞ্চের জন্ম দেয়। কথা থাকে, সে
সময় যাদের দলিল প্রকাশিত হয়েছে তারাই এখন ক্ষমতায়। দেশের বহু ঘটনার মতো এসব
জবানবন্দির না হয়েছে তদন্ত। না হয়েছে অনুসন্ধান। না হয়েছে বিচার। যাদের
নিয়ে এসব তথ্য বেরিয়েছে তারাও ক্ষমতায় গিয়ে তা ভুলে গেছেন। সাদাকথায় বলতে
চাই, এসব ঘটনা যদি মিথ্যে আজগুবি গল্প বা আষাঢ়ে গল্পও হয়ে থাকে তবে যারা এই
গল্পের লেখক ছিলেন তাদের পরিচয় প্রকাশ জরুরি ছিল সঠিক ইতিহাস বা
সত্যানুসন্ধানের স্বার্থেই। জনমনে প্রশ্ন, তাহলে সে সময়ের যে সব গল্প আমরা
পড়েছি তা কি নিছকই গরম ভাতের গল্প নাকি অন্যকিছু। পুরনো সেই পত্রিকার ফাইল
ঘাঁটলে এখনও অবাক লাগে। হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সরল স্বীকারোক্তি
আর মানুষকে পুড়িয়ে মারার নানা আদ্যোপান্ত। কই কোনটিইতো সত্য হয়নি। সত্য
হোক এটি আসলে কাম্যও নয়। কিন্তু সবকিছুর একটি যুক্তি থাকে। আমরা কি আবারও
সেই পুরনো যুক্তিহীনতার কালে ফিরে যাচ্ছি? সে সময়ের রাজনীতিহীনতার বা
রাজনীতি শূন্যতার বিরুদ্ধে গণমাধ্যম রুখে দাঁড়িয়েছিল বন্দুকের নলের মুখেও।
উর্দিপরা শাসকদের চোখ শাসানি আর পেশিশক্তির কাছেও অকূতভয়ে মিডিয়াকর্মীরা
টকশো আর পত্রিকার কলামে গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে রাজপথে থাকার সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলেন। একসময় তখনকার ক্ষমতাসীনরা সেই পথ পরিহারে বাধ্য হয়েছিলেন। যারা
রাজনীতি, গণতন্ত্র আর জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলার চেষ্টা করেছিলেন।
গণতন্ত্রের নবযাত্রার কৃতিত্ব দিতে হবে রাজনীতিকদেরও। বিশেষত বড় দু’দলের
নেত্রী এর বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছিলেন। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে একটি আত্মিক
সমঝোতায় উপনীত হয়েছিলেন। কিন্তু কথায় আছে যেই লাউ সেই কদু। অথবা লঙ্কায় যেই
যান সেই হন রাবণ। ২০০৬ সালের আগে বিএনপি-জামায়াত জোট গণতন্ত্রকে বেকায়দায়
ফেলেছে। ওয়ান-ইলেভেন এসেছে। একইভাবে বর্তমান জমানায়ও গণতন্ত্র এক নতুন
সঙ্কট অতিক্রম করছে। আমাদের রাজনীতি ঘুরে-ফিরে একই আবর্তে চলছে। নব্বইয়ে
যেই এরশাদ স্বৈরাচার বলে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। গত দু’যুগে সেই স্বৈরাচার
আমাদের রাজনীতিতে নেপথ্যের কারিগরের ভূমিকায়। নির্বাচন এলেই ভোটবাক্সের
হিসাব নিয়ে এদল ওদল করতে থাকেন। সেই স্বৈরাচার নূর হোসেন আর ডা. মিলনের
হত্যাকারী শাসক হয়েও ভুলে যান। রাতের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে যান। যেই
বিশ্ববিদ্যালয় একদিন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের সংগ্রামের দৃপ্ত পদচারণায় মুখর
থাকতো। আজ কোথায় সব? এরশাদের শহীদ মিনারে যাওয়া নিয়ে কাউকে তো প্রতিবাদমুখর
হতে দেখি না। অথচ মতের বিরুদ্ধে গেলেই বিশিষ্টজনদের শহীদ মিনারে নিষিদ্ধ
করার প্ল্যাকার্ড নিয়ে অর্বাচীনের মতো অনেককেই দাঁড়াতে দেখা যায়। খোলনলছে
সব বদলে যাচ্ছে। যে ছাত্রলীগকে একদিন ঐতিহ্যবাহী সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে
লড়াকু ভূমিকা রেখেছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। সময়ের প্রেক্ষিতে তিনিই এখন
ফেলে আসা সংগঠনের তোপের মুখে। সবরকম সৌজন্যতা আমাদের এখানে বিলুপ্তির পথে
আজ। কেউ পূর্বাপর না ভেবেই তাৎক্ষণিক ক্ষমতার দাপটে সব উগরে ফেলে দিতে চান।
না হলে অবাক লাগে যারা সংলাপের কথা বললেন বা বলছেন তাদের দলভুক্তি ও
সুবিধা-অসুবিধা অথবা ক্ষমতায় যাওয়ার হিসাব করা হচ্ছে। একটাবার ভাবুনতো,
দেশটাতে ফায়ার আর ক্রসফায়ার না থাকলে স্বস্তিটা কি শুধুই সাধারণের। যারা
রাজনীতিতে আছেন, যারা দেশ পরিচালনা করছেন এই স্বস্তির আর স্বচ্ছন্দ
ক্ষমতাভোগের অধিকারতো তাদেরই থাকছে। আমজনতা এতটুকু শান্তি চায়। আর তার জন্য
চাই আলোচনা। অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনও বলেছেন, গণতন্ত্রে আলোচনা
না করলে কোন কিছু বদলানো সম্ভব নয়। কিন্তু দিন দিন আলোচনার জায়গাটা সংকীর্ণ
হয়ে গেছে। হাতাশার এই জায়গাটায় আমজনতাও নিশ্চয় এক হবেন। সৈয়দ আবুল মকসুদের
সহজিয়া কড়চায় পড়লাম সৌজন্যবোধের কিছু দৃষ্টান্ত। তারই একটি এখানে উল্লেখ
করছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরুর আমন্ত্রণে পাকিস্তানের
রিপাবলিক আওয়ামী লীগ সরকারের কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ
খান নূন ভারত সফরে গিয়েছিলেন। সেই নূনের সঙ্গী হয়েছিলেন তার পতœী
ভিকারুননিসা নূন। পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে মালিক ও ভিকারুননিসা নূন সিঁড়ি
দিয়ে পাশাপাশি নামছিলেন। বিমানবন্দরের গ্যাংওয়েতে অপেক্ষায় নেহেরু। সিঁড়ির
কয়েক ধাপ নামতেই বেগম ভিকারুননিসার এক পাটি জুতা নিচে পড়ে যায়। নিñিদ্র
নিরাপত্তায় বহু নিরাপত্তা কর্মকর্তা তখন বিমানটি ঘিরে ছিলেন। তাদের কেউ নন
স্বয়ং জুতাটি সিঁড়ির নিচ থেকে তুলে আনেন জওহর লাল নেহেরু। নিরাপত্তা
কর্মকর্তা ও অন্যরা হতবাক। হতবাক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও। কিন্তু তাদের
হতবাক হওয়ার মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায় যখন তারা দেখেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী
বেগম নূনের পায়ে পরিয়ে দিতে এগিয়ে গিয়ে নিচু হচ্ছেন। সে এক অকল্পনীয় দৃশ্য।
আর আমাদের এখানে ন্যূনতম সৌজন্যতা দেখাতে গিয়েও কাঁদা ছোঁড়াছুড়ির
রাজনীতিটা ঠিকমতো হলো কিনা সেঠাকেই বিবেচনায় রাখেন। যাক এত পেছনের কথা বাদ
দিই। এই সেদিনও ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রথা ভেঙে বিমানবন্দরে জড়িয়ে ধরেছেন
ওবামাকে। নিজ হাতে চা বানিয়ে খাইয়েছেন। তাতে মোদির জাত যায়নি। ওবামাও
নিশ্চয়ই অপমানিত বোধ করেন নি। আর কেজরিওয়ালের জয়ে কারচুপির আওয়াজ না তুলে
অভিনন্দনের যে আওয়াজ তাতেও কেউ খাটো হয়ে যায়নি। কাজেই আপনারা যারা দেশ
চালাচ্ছেন, যারা দেশ চালাবেন তারা এভাবে জনগণকে চিড়ে চ্যাপ্টা করে দেশটাকে
আরও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবেন না।
কাজল ঘোষ |
No comments