আই অ্যাম নট অ্যা সায়েনটিস্ট by আবু এন এম ওয়াহিদ
বিজ্ঞান
নয়, আজকের নিবন্ধের বিষয়বস্তু রাজনীতি, খাঁটি রাজনীতি। তবে কেন এমন
শিরোনাম, একটু ধৈর্য ধরলেই বিষয়টি খোলাসা হয়ে যাবে আপনাদের কাছে। আমি অনেক
দিন ধরে আমেরিকায় থাকি এবং এ দেশেরই একজন ন্যাচারালাইজড সিটিজেন, অথচ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৈনন্দিন রাজনীতি সম্পর্কে খুব একটা খোঁজখবর রাখি
না। তবে এর মানে এই নয় যে তাৎপর্যপূর্ণ বড় বড় রাজনৈতিক ঘটনা আমি জানি না বা
আমার কানে আসে না। কীভাবে আসে, সে কাহিনী লিখতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে,
তাই সেদিকে যাচ্ছি না। আসলে এ দেশের চলমান রাজনীতিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানা
ও বোঝার ব্যাপারে কোনোকালেই আমার তেমন কোনো উৎসাহ জন্মায়নি। তবে মজার
ব্যাপার হল, আমেরিকার রাজনীতিতে আমি যতটা গাফেল, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে
আবার ততটাই ওয়াকিবহাল থাকার চেষ্টা করি। আপাত দৃষ্টিতে এটি একটি বৈপরীত্য
বৈকি। তবে এরও একটি কারণ আছে। সে কথায় পরে আসছি।
বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিদিনকার খবর জানতে আমার প্রতিদিন কমসেকম ২ ঘণ্টা সময় লাগে। সকালে ঘুম থেকে ওঠে চা-নাস্তা খাওয়ার আগেই আরটিএনএন, শীর্ষ নিউজ, আমাদের সময় ডটকমসহ ঢাকার প্রধান প্রধান জাতীয় দৈনিকের পাতায় একবার চোখ বোলাতেই হয়। দুপুরের পর থেকে পরদিনের ঢাকার কাগজের আপডেট আসতে শুরু করে। আমিও সুযোগ করে দেখতে থাকি। আবার রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আরেকবার সর্বশেষ খবর দেখে নেই। বিছানায় গিয়ে মনে মনে বলি, হে আল্লাহ্, সকালে উঠে যেন দেশের কোনো খারাপ খবর দেখতে না হয়।
আমি কিংবা আমার কোনো ঘনিষ্ঠজন সরাসরি বাংলাদেশী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। অদূর ভবিষ্যতে তেমন আশাও দেখি না। দেশীয় রাজনীতি থেকে কোনো ধরনের ফায়দা হাসিল করার ইচ্ছাও নেই, সেই সুযোগ-সম্ভাবনাও নেই। তথাপি দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে এত গভীর আগ্রহ কেন, অনেক চিন্তা করেও এর কোনো হদিস পাইনি। তবে আমেরিকার রাজনীতিতে কেন আমার উৎসাহ নেই তার একটি সম্ভাব্য কারণ হয়তো বা বের করতে পেরেছি। উইক এন্ডের দাওয়াত পার্টিতে এ দেশের চেয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয় ঢের বেশি। তাছাড়া অফিস-আদালতে, দোকানপাটে বা অন্য কোথাও আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে আলাপের বলতে গেলে কোনো সুযোগই নেই। এ দেশের লোকজন মনে করে ধর্মের মতো রাজনীতি এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটি পরিচিত কিংবা অপরিচিত কারও সঙ্গে শেয়ার করার বিষয় নয়। জানা ও বোঝার জন্য তারা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলোচনার চেয়ে টিভি ও নিউজ মিডিয়াকেই বেশি পছন্দ করে। আর কথায় কথায় রাজনৈতিক বিতর্ক তাদের রক্তের মধ্যেই নেই। অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে কোথাও একত্রে বসে অলস সময় কাটাতে হলে তারা রাজনীতি বা ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় সচেতনভাবে এড়িয়ে চলে। বরফ গলানোর জন্য কথা বলে দিনের আবহাওয়া, খেলাধুলা, সিনেমা, সঙ্গীত ইত্যাদি নিয়ে। এগুলোকে বলে সফ্ট টক। এ জ্ঞান আমি কোনো বই-পুস্তকে পাইনি। শিখেছি আমার মেয়ের কাছে, যখন সে ইউনিভার্সিটিতে পড়ত।
অবশ্য এ দেশের ছেলেমেয়েদের এসব জানতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয় না। স্কুলের চৌহদ্দি পেরোবার আগেই তারা আমেরিকার জীবন-সংস্কৃতি বুঝে ফেলে।
শুরুতে ভাবতে পারিনি আজকের ভূমিকা এতটা লম্বা হয়ে যাবে। কোনো কিছু অপ্রাসঙ্গিক লিখে থাকলে পাঠকরা নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। ফিরে আসি শিরোনামের বিষয়ে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর জাতির উদ্দেশে কংগ্রেসের জয়েন্ট সেশনে প্রাইম টাইমে (রাত ৮টা থেকে ৯টা) একটি দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়ে থাকেন। প্রধান প্রধান টিভি চ্যানেল বক্তৃতাটি লাইভ ব্রডকাস্ট করে থাকে। এটাকে বলে স্টেইট অব দি ইউনিয়ন অ্যাড্রেস। এটি আমেরিকার রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমার যেহেতু ইন্টারেস্ট নেই, তাই বছর বছর জানুয়ারি আসে জানুয়ারি যায়, আমি এর কোনো খোঁজখবর রাখি না। প্রেসিডেন্টের স্টেইট অব দি ইউনিয়ন অ্যাড্রেসও শুনি না। এবার কী মনে করে জানুয়ারির ২০ তারিখ সন্ধ্যায় টিভির সামনে অবসর বসেছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ল, ওহ! আজ তো প্রেসিডেন্টের স্টেইট অব দি ইউনিয়ন অ্যাড্রেস, শুনি তো তিনি কী বলেন।
এই ভেবে টিভির রিমোট টিপে শুনতে লাগলাম। বিসমিল্লাহতেই বুঝতে বাকি রইল না, বক্তৃতার প্রথম কয়েক মিনিট আমি এরই মধ্যে মিস করে ফেলেছি। শুনতে গিয়ে বুঝলাম বেশ ভালোই লাগছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অনেক সুন্দর সুন্দর কথা মন্ত্রের মতো বলে যাচ্ছেন। আমেরিকার বিদেশনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, স্বাস্থ্যনীতি, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি একজন নোবেল বিজয়ী প্রফেসর কিংবা বিশ্বনন্দিত দার্শনিকের মতো জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিচ্ছেন। মাঝে মধ্যে তিনি যে ধমক-ধামক দেননি তা নয়। তবে এগুলো যে কথার কথা, পলিটিক্যাল রেটোরিক সেটা যেমন তিনি জানেন তেমনি তার শ্রোতারাও বোঝে। এখানেই রাজনীতিকদের সঙ্গে একজন প্রফেসর বা দার্শনিকের পার্থক্য। তবে আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে, তার মূল বক্তব্যের বাণীগুলো একজন দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কের কথার মতো কানে এসে লাগছে, হৃদয় স্পর্শ করে যাচ্ছে। তিনি প্রফেসর না হলেও নোবেল বিজয়ী তো বটে। আর দার্শনিক না হলে চলবে কী করে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে না, অল কিংস মাস্ট বি ফিলোসফারস, অ্যান্ড অল ফিলোসফারস মাস্ট বি কিংস। বারাক ওবামা কিং নন বটে, কিন্তু কমই বা কী!
এবারকার বক্তৃতায় তিনি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ, গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব কথা আউড়েছেন, যা কি-না নোট করে রাখার মতো। কিন্তু যে বক্তব্যটি আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তাই আজকের শিরোনাম। আই অ্যাম নট অ্যা সায়েনটিস্ট...। অবশ্য তিনি শুধু একথা বলেই তার বাক্যটি শেষ করেননি। একটু পোজ দিয়ে যুক্ত করেছেন আরেকটি অংশ। ...বাট আই নো সায়েনটিস্টস। দুই অংশ যোগ করলে পুরো বাক্যটি দাঁড়ায় এরকম- আই অ্যাম নট অ্যা সায়েনটিস্ট, বাট আই নো সায়েনটিস্টস। আমার বিদ্যা-বুদ্ধি যাই থাক, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কণ্ঠে উচ্চারিত এ বাক্যটি যতই হালকা শোনাক না কেন, এর ব্যাপ্তি ও গভীরতা যে অনেক বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী, তা বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হয়নি। মনে মনে ভাবলাম, কোথায় তারা আর কোথায় আমরা! অর্থাৎ বারাক ওবামা কী বলেন, আর বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীরা কী বলেন! আরও মনে হল, বাংলাদেশ ইদানীং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে অনেক দূর এগিয়েছে; কিন্তু যে রাজনীতি সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে সংস্কৃত ও পরিশীলিত করতে আমার প্রিয় মাতৃভূমিকে আরও অনেক দূর হাঁটতে হবে, অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য, সে পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, বরং নিদারুণ কণ্টকাকীর্ণ।
এবার দেখা যাক বারাক ওবামার কথাটার মানে কী। তিনি বলেছেন, আই অ্যাম নট অ্যা সায়েনটিস্ট, বাট আই নো সায়েনটিস্টস। বারাক ওবামা একজন আইন বিশারদ, তিনি রাজনীতিক, তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট, তিনি রাষ্ট্রনায়ক। জাতির কাছে তিনি অকপটে স্বীকার করছেন তিনি বিজ্ঞান জানেন না, তিনি বিজ্ঞানী নন। এখানেই শেষ নয়, তিনি আরও বলছেন, তিনি বিজ্ঞানীদের জানেন, বিজ্ঞানীদের চেনেন। এর মানে কী? এর অর্থ, তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের কাছ থেকে জানেন, তাদের কথা ধৈর্য ধরে শোনেন, তাদের থেকে শেখেন, তাদের বুদ্ধি পরামর্শ নেন। তার চেয়ে বড় কথা, তাদের পরামর্শ মতো তিনি দেশের বিজ্ঞানবিষয়ক নীতিনির্ধারণ করে থাকেন। এটা শুধু মুখের কথা নয়, বাস্তবে এর প্রতিফলন আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে শুধু বিজ্ঞান বিষয়েই নয়, বরং সব বিষয়েই তিনি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে থাকেন এবং সেই মতো কাজও করেন।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশে কী হয়, নেত্রী কমিটি করে দেন। কমিটি অলোচনা করে বিতর্ক করে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, কোনো কোনো সময় মাসের পর মাস। কমিটি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদেরও পরামর্শ নেয়। সবশেষে রিপোর্ট তৈরি হয়। অনেক সময় সে রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না। যাও বা দু-একটা রিপোর্ট বের হয়, চূড়ান্ত সরকারি সিদ্ধান্ত রিপোর্ট অনুযায়ী হয় না, হয় মহাশক্তিধর এক ব্যক্তির গায়েবি হুকুমে। যতদিন গায়েবি হুকুমে দেশ চলবে, ততদিন ভূতের আগুনে দেশ জ্বলবে, পুড়বে মানুষ, ধ্বংস হবে অর্থনীতি, ভেঙে পড়বে যাতায়াত ব্যবস্থা, ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষা কার্যক্রম, দুর্বল হবে সামাজিক বন্ধন, আরও কতকিছু। প্রতিকারের জন্য দেশবাসী লড়বে ভূতের সঙ্গে, যেন বাংলাদেশের সব অঘটনের জন্য ভূতই দায়ী! আজ দেশে যে আগুন জ্বলছে তার দায় কেউ নিচ্ছে না। যারা প্রতিদিন খুন-গুম হচ্ছে তাদেরও দায় নেয়ার কেউ নেই। যেমন নেই মীমাংসিত নির্বাচন ব্যবস্থাকে অমীমাংসিত করার দায় নেয়ার কেউ। আবু এন এম ওয়াহিদ : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
wahid2569@gmail.com
বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিদিনকার খবর জানতে আমার প্রতিদিন কমসেকম ২ ঘণ্টা সময় লাগে। সকালে ঘুম থেকে ওঠে চা-নাস্তা খাওয়ার আগেই আরটিএনএন, শীর্ষ নিউজ, আমাদের সময় ডটকমসহ ঢাকার প্রধান প্রধান জাতীয় দৈনিকের পাতায় একবার চোখ বোলাতেই হয়। দুপুরের পর থেকে পরদিনের ঢাকার কাগজের আপডেট আসতে শুরু করে। আমিও সুযোগ করে দেখতে থাকি। আবার রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আরেকবার সর্বশেষ খবর দেখে নেই। বিছানায় গিয়ে মনে মনে বলি, হে আল্লাহ্, সকালে উঠে যেন দেশের কোনো খারাপ খবর দেখতে না হয়।
আমি কিংবা আমার কোনো ঘনিষ্ঠজন সরাসরি বাংলাদেশী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। অদূর ভবিষ্যতে তেমন আশাও দেখি না। দেশীয় রাজনীতি থেকে কোনো ধরনের ফায়দা হাসিল করার ইচ্ছাও নেই, সেই সুযোগ-সম্ভাবনাও নেই। তথাপি দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে এত গভীর আগ্রহ কেন, অনেক চিন্তা করেও এর কোনো হদিস পাইনি। তবে আমেরিকার রাজনীতিতে কেন আমার উৎসাহ নেই তার একটি সম্ভাব্য কারণ হয়তো বা বের করতে পেরেছি। উইক এন্ডের দাওয়াত পার্টিতে এ দেশের চেয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয় ঢের বেশি। তাছাড়া অফিস-আদালতে, দোকানপাটে বা অন্য কোথাও আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে আলাপের বলতে গেলে কোনো সুযোগই নেই। এ দেশের লোকজন মনে করে ধর্মের মতো রাজনীতি এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটি পরিচিত কিংবা অপরিচিত কারও সঙ্গে শেয়ার করার বিষয় নয়। জানা ও বোঝার জন্য তারা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলোচনার চেয়ে টিভি ও নিউজ মিডিয়াকেই বেশি পছন্দ করে। আর কথায় কথায় রাজনৈতিক বিতর্ক তাদের রক্তের মধ্যেই নেই। অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে কোথাও একত্রে বসে অলস সময় কাটাতে হলে তারা রাজনীতি বা ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় সচেতনভাবে এড়িয়ে চলে। বরফ গলানোর জন্য কথা বলে দিনের আবহাওয়া, খেলাধুলা, সিনেমা, সঙ্গীত ইত্যাদি নিয়ে। এগুলোকে বলে সফ্ট টক। এ জ্ঞান আমি কোনো বই-পুস্তকে পাইনি। শিখেছি আমার মেয়ের কাছে, যখন সে ইউনিভার্সিটিতে পড়ত।
অবশ্য এ দেশের ছেলেমেয়েদের এসব জানতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয় না। স্কুলের চৌহদ্দি পেরোবার আগেই তারা আমেরিকার জীবন-সংস্কৃতি বুঝে ফেলে।
শুরুতে ভাবতে পারিনি আজকের ভূমিকা এতটা লম্বা হয়ে যাবে। কোনো কিছু অপ্রাসঙ্গিক লিখে থাকলে পাঠকরা নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। ফিরে আসি শিরোনামের বিষয়ে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর জাতির উদ্দেশে কংগ্রেসের জয়েন্ট সেশনে প্রাইম টাইমে (রাত ৮টা থেকে ৯টা) একটি দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়ে থাকেন। প্রধান প্রধান টিভি চ্যানেল বক্তৃতাটি লাইভ ব্রডকাস্ট করে থাকে। এটাকে বলে স্টেইট অব দি ইউনিয়ন অ্যাড্রেস। এটি আমেরিকার রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমার যেহেতু ইন্টারেস্ট নেই, তাই বছর বছর জানুয়ারি আসে জানুয়ারি যায়, আমি এর কোনো খোঁজখবর রাখি না। প্রেসিডেন্টের স্টেইট অব দি ইউনিয়ন অ্যাড্রেসও শুনি না। এবার কী মনে করে জানুয়ারির ২০ তারিখ সন্ধ্যায় টিভির সামনে অবসর বসেছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ল, ওহ! আজ তো প্রেসিডেন্টের স্টেইট অব দি ইউনিয়ন অ্যাড্রেস, শুনি তো তিনি কী বলেন।
এই ভেবে টিভির রিমোট টিপে শুনতে লাগলাম। বিসমিল্লাহতেই বুঝতে বাকি রইল না, বক্তৃতার প্রথম কয়েক মিনিট আমি এরই মধ্যে মিস করে ফেলেছি। শুনতে গিয়ে বুঝলাম বেশ ভালোই লাগছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অনেক সুন্দর সুন্দর কথা মন্ত্রের মতো বলে যাচ্ছেন। আমেরিকার বিদেশনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, স্বাস্থ্যনীতি, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি একজন নোবেল বিজয়ী প্রফেসর কিংবা বিশ্বনন্দিত দার্শনিকের মতো জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিচ্ছেন। মাঝে মধ্যে তিনি যে ধমক-ধামক দেননি তা নয়। তবে এগুলো যে কথার কথা, পলিটিক্যাল রেটোরিক সেটা যেমন তিনি জানেন তেমনি তার শ্রোতারাও বোঝে। এখানেই রাজনীতিকদের সঙ্গে একজন প্রফেসর বা দার্শনিকের পার্থক্য। তবে আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে, তার মূল বক্তব্যের বাণীগুলো একজন দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কের কথার মতো কানে এসে লাগছে, হৃদয় স্পর্শ করে যাচ্ছে। তিনি প্রফেসর না হলেও নোবেল বিজয়ী তো বটে। আর দার্শনিক না হলে চলবে কী করে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে না, অল কিংস মাস্ট বি ফিলোসফারস, অ্যান্ড অল ফিলোসফারস মাস্ট বি কিংস। বারাক ওবামা কিং নন বটে, কিন্তু কমই বা কী!
এবারকার বক্তৃতায় তিনি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ, গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব কথা আউড়েছেন, যা কি-না নোট করে রাখার মতো। কিন্তু যে বক্তব্যটি আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তাই আজকের শিরোনাম। আই অ্যাম নট অ্যা সায়েনটিস্ট...। অবশ্য তিনি শুধু একথা বলেই তার বাক্যটি শেষ করেননি। একটু পোজ দিয়ে যুক্ত করেছেন আরেকটি অংশ। ...বাট আই নো সায়েনটিস্টস। দুই অংশ যোগ করলে পুরো বাক্যটি দাঁড়ায় এরকম- আই অ্যাম নট অ্যা সায়েনটিস্ট, বাট আই নো সায়েনটিস্টস। আমার বিদ্যা-বুদ্ধি যাই থাক, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কণ্ঠে উচ্চারিত এ বাক্যটি যতই হালকা শোনাক না কেন, এর ব্যাপ্তি ও গভীরতা যে অনেক বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী, তা বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হয়নি। মনে মনে ভাবলাম, কোথায় তারা আর কোথায় আমরা! অর্থাৎ বারাক ওবামা কী বলেন, আর বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীরা কী বলেন! আরও মনে হল, বাংলাদেশ ইদানীং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে অনেক দূর এগিয়েছে; কিন্তু যে রাজনীতি সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে সংস্কৃত ও পরিশীলিত করতে আমার প্রিয় মাতৃভূমিকে আরও অনেক দূর হাঁটতে হবে, অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য, সে পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, বরং নিদারুণ কণ্টকাকীর্ণ।
এবার দেখা যাক বারাক ওবামার কথাটার মানে কী। তিনি বলেছেন, আই অ্যাম নট অ্যা সায়েনটিস্ট, বাট আই নো সায়েনটিস্টস। বারাক ওবামা একজন আইন বিশারদ, তিনি রাজনীতিক, তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট, তিনি রাষ্ট্রনায়ক। জাতির কাছে তিনি অকপটে স্বীকার করছেন তিনি বিজ্ঞান জানেন না, তিনি বিজ্ঞানী নন। এখানেই শেষ নয়, তিনি আরও বলছেন, তিনি বিজ্ঞানীদের জানেন, বিজ্ঞানীদের চেনেন। এর মানে কী? এর অর্থ, তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের কাছ থেকে জানেন, তাদের কথা ধৈর্য ধরে শোনেন, তাদের থেকে শেখেন, তাদের বুদ্ধি পরামর্শ নেন। তার চেয়ে বড় কথা, তাদের পরামর্শ মতো তিনি দেশের বিজ্ঞানবিষয়ক নীতিনির্ধারণ করে থাকেন। এটা শুধু মুখের কথা নয়, বাস্তবে এর প্রতিফলন আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে শুধু বিজ্ঞান বিষয়েই নয়, বরং সব বিষয়েই তিনি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে থাকেন এবং সেই মতো কাজও করেন।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশে কী হয়, নেত্রী কমিটি করে দেন। কমিটি অলোচনা করে বিতর্ক করে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, কোনো কোনো সময় মাসের পর মাস। কমিটি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদেরও পরামর্শ নেয়। সবশেষে রিপোর্ট তৈরি হয়। অনেক সময় সে রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না। যাও বা দু-একটা রিপোর্ট বের হয়, চূড়ান্ত সরকারি সিদ্ধান্ত রিপোর্ট অনুযায়ী হয় না, হয় মহাশক্তিধর এক ব্যক্তির গায়েবি হুকুমে। যতদিন গায়েবি হুকুমে দেশ চলবে, ততদিন ভূতের আগুনে দেশ জ্বলবে, পুড়বে মানুষ, ধ্বংস হবে অর্থনীতি, ভেঙে পড়বে যাতায়াত ব্যবস্থা, ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষা কার্যক্রম, দুর্বল হবে সামাজিক বন্ধন, আরও কতকিছু। প্রতিকারের জন্য দেশবাসী লড়বে ভূতের সঙ্গে, যেন বাংলাদেশের সব অঘটনের জন্য ভূতই দায়ী! আজ দেশে যে আগুন জ্বলছে তার দায় কেউ নিচ্ছে না। যারা প্রতিদিন খুন-গুম হচ্ছে তাদেরও দায় নেয়ার কেউ নেই। যেমন নেই মীমাংসিত নির্বাচন ব্যবস্থাকে অমীমাংসিত করার দায় নেয়ার কেউ। আবু এন এম ওয়াহিদ : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
wahid2569@gmail.com
No comments